স্বাধীনতা : ফিরে দেখা
সমীর কুমার দত্ত
বীরের রক্ত , মাতার অশ্রু ও শত সহস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত বহু প্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত স্বাধীনতার ছিয়াত্তর বৎসর অতিবাহিত হলো। এখন ফিরে দেখার স্বাধীনতার সঙ্গে কি কি প্রাপ্ত করছি আমরা। আমরা ব্রিটিশের কাছ থেকে পেয়েছি শোষণ, বঞ্চনা, প্রতারণা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা সর্বোপরি বঙ্গ বিভাজন যার ফলে রাজ্যগুলোর ওপর পড়েছে জনসংখ্যার চাপ, তাতে উন্নয়ন হয়েছে মন্দীভূত। তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। হয়েছি স্বাধীন। কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ বুঝিনি। বুঝিনি বলেই স্বাধীনোত্তর যুগে স্বদেশীদের দ্বারা স্বদেশীরা হচ্ছে লাঞ্ছিত, শোষিত, অত্যাচারিত, প্রহৃত ও বঞ্চিত। এখন এদের মধ্যে কেউ কেউ উন্নয়ন হয়নি বলে বঙ্গ বিভাজনে সোচ্চার হয়ে উঠছে ।যেখানে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়ার কথা এই সুদীর্ঘ সময়ে, সেখানে উন্নয়নের চেহারাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। তবে হ্যাঁ উন্নয়ন যে একেবারেই হয়নি তা নয় । উন্নয়ন যে হয়েছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। স্বাধীনতা ছিল গোষ্ঠীর স্বপ্ন আর উন্নয়ন এখন ব্যক্তির স্বপ্ন অর্থাৎ ব্যক্তিস্বার্থরক্ষা। যেখানে একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সকল মানুষের তথা একটা জাতির উন্নয়ন লক্ষ্য হওয়া উচিত ,সেখানেই স্বাধীনতার সার্থকতা।
বস্তুত স্বাধীনতা পরবর্তী প্রবহমান বছরগুলি থেকে আজ পর্যন্ত আমরা কি পেলাম?
পেয়েছি চরম বেকারি, হতাশা,খাদ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্যে অরাজকতা ও চরম দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের রাজনীতি, দারিদ্র্য আর তার ওপর আছে প্রোমোটাররাজের দৌরাত্ম্য, খুনখারাবি, নারীধর্ষণ, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতাজনিত হত্যাকাণ্ড,আইন শৃঙ্খলার ভগ্নদশা, ভাষার ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে, গোষ্ঠীর ভিত্তিতে পৃথক পৃথক রাজ্যের দাবি সোচ্চার হওয়া।গণতন্ত্রের প্রধান অস্ত্র ভোটাধিকারের দ্বারা জন প্রতিনিধি নির্বাচন। এই পদ্ধতিতে জনগণ ভোটাধিকার হারাচ্ছে বহুলাংশে। শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ভোট লুঠ করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে এবং নির্বাচনকে প্রসহনে পরিণত করছে। যদি অত্যাধুনিক কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা যায় তবে হয়তো নির্বাচনের সঠিক মূল্যায়ন হবে।ভোটের আগে চটকদার স্লোগান প্রতিটি রাজনৈতিক দলের রক্ষাকবচ।ভোট যুদ্ধে জয়ী হরার জন্য বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের, যাদের কোন রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা নেই, ধরে এনে দাঁড় করিয়ে যেন তেন প্রকারে নির্বাচনে জয়ী করে সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভের মাধ্যমে সরকার গড়ার চেষ্টা চলে আসছে।সারা বছরে যাদের একবারও মুখ দেখতে পায়না কেউ ।সুতরাং জনগণের মঙ্গল হবে কোথা থেকে।
স্বাধীনতার পূর্বে দেশের হাসপাতালগুলোর অবস্থা আজকের মতো ছিল না। আজকে তার বেহাল অবস্থা। যদিও লোকসংখ্যা তখন কম ছিল,তার জন্যই আজ রোগি মৃত্যু সংখ্যার হার বেড়েই চলেছে হয় ডাক্তারের অভাবে, নয়তো যন্ত্রপাতির অভাবে। ওষুধপত্র যা রোগীদের জন্য বরাদ্দ, তার বেশিরভাগ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পরিসেবা দিতে পারুক আর না পারুক সরকারি মাহিনা ঠিক সময়ে হাতে এলেই হলো। তারপর উপরি আয়ের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেয়।ঘুষ অথবা বকশিস্ যাই বলা হোক না কেন, আদায় করে নেয় গরীব মানুষের কাছ থেকে।তাতেও পরিসেবা ঠিকমতো পাওয়া যায় না।দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে।
ব্রিটিশ রাজত্বে গড়ে ওঠা শিল্পের দরজা যে কোন কারণেই হোক বন্ধ হয়েছে। আর নতুন কোন শিল্প তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি যাতে বেকার সমস্যার সমাধান ও দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত হয়। প্রতি বছর হাজার হাজার ডিগ্রিধারী ছেলে মেয়েরা ও শ্রমিকরা নিজ নিজ রাজ্যে কর্মসংস্থান করতে না পেরে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। এদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে কর্ম অথবা শিক্ষার তাগিদে।বিদেশে দেহান্ত হচ্ছে অনেকের। এখানে বেসরকারি কর্মচারীদের চোখের সামনে একের পর এক মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা করার কোন প্রয়াস নেই কি কেন্দ্রের কি রাজ্যের। যেখানে ভোটের রাজনীতি সেখানে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের মঙ্গল করার চেষ্টা চলছে। রাজ্যগুলি সীমিত আয়ের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে চলেছে।কিন্তু এগুলি তো কোন স্থায়ী সমাধান নয়।দীর্ঘ মেয়াদী কোন পরিকল্পনার ও সদিচ্ছার দরকার। কেন্দ্র রাজ্যগুলির কাছ থেকে রেভিনিউ আদায় করে, সুতরাং কেন্দ্রের দায়িত্ব অনেক। রাজনৈতিক কারণে রাজ্যগুলি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। গান্ধীজি বলে ছিলেন কুটির শিল্পের ওপর জোর দিতে। কুটির শিল্পের দ্বারা স্বনির্ভর হলে বেকার সমস্যার অনেকটা সুরাহা হবে। তারপর বৃহৎ ও ভারি শিল্পের কথা চিন্তা করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কুটির শিল্পের পরিবর্তে বড় এবং ভারি শিল্পের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দেশের বেশ কিছু সংখ্যক পরিবারের হাতে প্রচুর ধন সম্পদ সঞ্চিত হতে লাগলো এবং গরিবের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগলো। ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে লাগলো। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই গান্ধীজি মৃত্যু বরণ করেন। তিনি বঙ্গ বিভাজন তথা হিন্দু মুসলিম বিভাজন চাননি, হয়তো এইজন্যই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আর তার পূর্বে সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান দেশকে কঠিন সমস্যার মুখে ঠেলে দিলো।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেখা দিল খাদ্য আন্দোলন। এক শ্রেণীর কালোবাজারি খাদ্য মজুত করে কৃত্রিম খাদ্যাভাব সৃষ্টি করে। জওহরলাল নেহেরু একবার কালোবাজারিদের উদ্দেশ্যে খুব সম্ভবতঃ বলেছিলেন— কালোবাজারি,যারা অন্যায় ভাবে চোরাপথে খাদ্যশস্য নিয়ে গিয়ে গুদামজাত করে কৃত্রিমভাবে খাদ্যাভাব সৃষ্টি করে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত।ভারত মূলতঃ কৃষি প্রধান দেশ।শিল্পে যেখানে স্বনির্ভর নয় সেখানে কৃষিতে জোর দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। কৃষিতে না এসেছে আধুনিকীকরণ, না দেওয়া হচ্ছে তেমন জোর। বৈদেশিক মুদ্রা আসে এমন কৃষির ওপর জোর দেওয়া দরকার।উৎপন্ন দ্রব্য সংরক্ষণের
যথেষ্ট হিমঘরের ব্যবস্থা নেই। ফলে লাগাম ছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি,যা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ব্যর্থ।
যে দেশে দুর্নীতি বিরাজ করে সে দেশ কোনদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতীয়দের নৈতিক চরিত্র তলানিতে এসে ঠেকেছে।এর আমূল সংস্কারের দরকার। সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন গণতন্ত্রের পূর্বে মানুষের চরিত্র সুগঠিত করার। কারণ গণতন্ত্রে একটি ভোটের মূল্য অনেক। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে তাঁকে দেশ স্বাধীন হবার অনেক আগেই নিরুদ্দিষ্ট হতে হলো। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই দেশ হারালো মহাত্মাকে । স্বাধীনতার মহান সৈনিক সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান ও কবি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হলো স্বাধীনতার পূর্বেই। যা হোক শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে পরিবর্তন। সর্বাগ্রে চাই শিক্ষা।শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। সেই শিক্ষা যে শিক্ষা নৈতিক শিক্ষা দেয়। ন্যায় নীতির চেতনা জন্মে, স্বার্থপরকে করে তোলে নিঃস্বার্থপরায়ণ ।
বেকারি, দারিদ্র্য নিয়ে বেঁচে থাকা দেশের যুবসম্প্রদায় রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এখন রাজনীতি হলো বিনা মূলধনের ফাটকা ব্যবসা। তাতে করো কপাল খোলে আবার কারো খোলে না। ওপর তলার নেতা মন্ত্রীরা থাকেন বহাল তবিয়তে থাকেন অক্ষত।প্রাণ দেয় নিচু তলার সদস্যরা।ফল ভুগতে হয় তাদের পরিবারকে। দেশের যুবসম্প্রদায়কে সঠিক পথে চালিত করার আর একজন বিবেকানন্দ নেই। তাই দেশের আজ বড়ো দুর্দিন!
আজ স্বাধীনতা দিবসের পুণ্যলগ্নে তাই আমাদের শপথ হোক দারিদ্র্য মোচনের, প্রকৃত শিক্ষা প্রসারের, ভ্রাতৃত্ব বোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার, আমাদের শপথ হোক উন্নয়নের। আমাদের শপথ হোক দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন ও শোষণমুক্ত সমাজ। আর শপথ হোক চরিত্র গঠনের। নতুবা ব্যর্থ হবে বীরের রক্তস্রোত, মাতার অশ্রুধারা আর শত শহীদের আত্মত্যাগ।
============
Samir Kumar Dutta
Bally, Howrah
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন