প্রসঙ্গ স্বাধীনতা
ভুবনেশ্বর মন্ডল
প্রথমেই জানতে হবে স্বাধীনতার শব্দটির অর্থ। শব্দটিকে সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় - স্ব+অধীনতা। অর্থাৎ নিজের অধীনে থাকা। কারো ইচ্ছা, অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত না হওয়া। কোন ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব অধিকারগুলি নিজের ইচ্ছে মতো উপভোগ করবেন। সেখানে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। স্বাধীনতাকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি-(১) ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা (২) বাইরের জীবন ও জগৎকেন্দ্রিক স্বাধীনতা। ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতাটি হলো যে, কোন ব্যক্তি নিজস্ব মত, পথ ,রুচি, সংস্কৃতি ও দর্শন অনুযায়ী জীবন যাপন করবেন। তবে মানুষের অন্তর্গত রক্তের ভিতর যে আদিম প্রবৃত্তি গুলি খেলা করছে সেগুলিও সর্বদা স্বাধীন ভাবে থাকতে চায়। লোভ, লালসা, হিংসা, কামজ তাড়না ইত্যাদি ব্যক্তিকে তার নিজস্ব পথে পরিচালিত করতে চায়। প্রবৃত্তি গুলি অনেক ক্ষেত্রেই মনের অবচেতন স্তরে থেকে যায়। কিংবা অনেক সময় এগুলোকে সভ্যতার প্রলেপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। আবার কখনো কখনো তার বহিঃপ্রকাশও ঘটে। যেহেতু আমরা বৃহত্তর সমাজ জীবনে বাস করি তাই সমাজ বা সমষ্টির কল্যাণের কথা ভেবে উপরোক্ত প্রবৃত্তিগুলি থেকে আমাদের দূরত্ব রাখতে হয় কিংবা সেগুলিকে চাপা দিয়ে রাখতে হয়। আর চাপা দিতে না পারলেই নেমে আসে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য এবং অবক্ষয়। তাই প্রবৃত্তিগত স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভোগ করতে গেলেই বিপদ। ইচ্ছে থাকলেও উপায় থাকে না। এখানে আমাদের চেতনা বা বিবেক আমাদেরকে আদিম স্বাধীনতা উপভোগে বাধা দেয়। কখনো কখনো প্রবৃত্তি ও বিবেকের মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। তাতে ক্ষতবিক্ষত হয় একজন ব্যক্তি মানুষ। এই আদিম প্রবৃত্তি উপভোগের স্বাধীনতা যারা পেতে চান তারা সমাজ জীবনে ডেকে আনেন নৈরাজ্য ও অবক্ষয়। শুধু মানব প্রকৃতি নয়, বিশ্ব প্রকৃতির কাছেও মানুষ পরাধীন। বহু ক্ষেত্রেই আমাদেরকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে অনেক কিছুই অর্জন করতে হয়। প্রকৃতি যেন বলেন " বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচগ্র মেদিনী।"তাই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদেরকে প্রকৃতির বিরুদ্ধেও লড়াই চালাতে হয়। আমাদের হাঁটাচলা, মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে মুক্তিবেগ নিয়ে মহাকাশে যাওয়া ইত্যাদির পিছনে প্রকৃতির কাছে পরাধীনতা আছে। তবুও আমরা লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, প্রকৃতির কার্যকারণ সম্পর্ক গুলি জেনে। প্রকৃতিতে যে শক্তির খেলা, মহাকর্ষ লীলা চলছে তা অতিক্রম করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের এই নীলগ্রহের প্রকৃতির যে সিস্টেম তা জীবনের উপযোগী। তাই প্রকৃতি আমাদের পরিপূরক। আবার সে স্বয়ংসম্পূর্ণও বটে। কিন্তু আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। মহাবিশ্বের রহস্য জানতে আমাদের অনন্তকাল লেগে যেতে পারে। সে জানা হয়তো ফুরোবেও না। তাই সার্বিক স্বাধীনতা আমাদের কাছে মরীচিকা। তাছাড়াও আমাদের বৃহত্তর সমাজ জীবনের নীতি-আদর্শ নিয়ম প্রথা ইত্যাদিগুলিও আমাদের মনের ভেতর ক্রিয়াশীল। তাই ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা চাহিদার সঙ্গে সামাজিক আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার একটা বিরোধ বা সংঘর্ষ অনেক সময়ই দেখা যায়। বহু ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত চাহিদা জনিত স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে সমাজ-সত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। আমাদের সাহিত্যে সেই সব মনস্তাত্ত্বিক ঘাত প্রতিঘাতের চিত্র নানা ভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। যদিও বিজ্ঞানমনস্ক যুগে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রকাশ ঘটেছে। সামাজিক গোঁড়ামি কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ব্যক্তি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তবুও সর্বকল্যাণকামী চেতনার কাছে ব্যক্তি আমির স্বার্থকে মাথা নেওয়াতে হয়। "ছোট আমি" থেকে আমাদেরকে "বড় আমি"তে যেতে হয়। আসলে ব্যক্তির মধ্যেও সংকীর্ণতার অন্ধকার আছে,আছে প্রবৃত্তির খেলা। সে খেলা থেকে বেরিয়ে এসে বলতে হয় -"বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।"
তাই আমি আমার ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা চাহিদা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে সবকিছু করতে পারি না। সামাজিক রীতিনীতি মেনে অনেক সময়ই আমাকে চলতে হয়। তাই স্বেচ্ছাচার নয় আত্মনিয়ন্ত্রণের একটা ব্যাপার এসে যায়। এই আত্মনিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি স্বাধীনতা কিছুটা খন্ডিত হয় বৈকি।এখানেই যে আলোচনাটুকু সংক্ষেপে করা হলো তা ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা বিষয়ে।
বাইরের জগত ও জীবন কেন্দ্রিক যে স্বাধীনতা তার আধার আমাদের বস্তুগত জীবন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজ ,অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদি। সমাজ ব্যবস্থায় রয়েছে নানা বৈষম্য- অর্থনৈতিক বৈষম্য বা ধন ও সম্পদের অসম বন্টন,, আগ্রাসন, শোষণ ,বঞ্চনা, ক্ষমতার দম্ভ, অত্যাচার, ধর্মীয় ভেদাভেদ ইত্যাদি নানা বিষয়। এসব বিষয়গুলি মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে। সবল দুর্বলের উপর অত্যাচার চালায়, অর্থনৈতিক শোষণ চালায়, সম্পদ লালসা মেটাতে গিয়ে অমানবিক হয়ে পড়ে। ক্ষমতা ও সম্পদের আকাঙ্ক্ষা যত বাড়ে অত্যাচার ও শোষণের মাত্রা তত বাড়ে। অনেক সময় পরদেশ দখল করে আগ্রাসন চালায় অর্থ সম্পদ লোভীরা। পৃথিবীতে এর বহু নজির আছে। আবার একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার লাভ, বাজার দখল ইত্যাদিকে কেন্দ্র করেও আগ্রাসন চলতে থাকে। এর ফল ভোগ করেন সামাজিক মানুষ, বিশেষ একটি দেশের জনগণ। আগ্রাসন মানতে না চাইলে বা তার বিরোধিতা করলে অর্থনৈতিক ভাবে বলীয়ান, অস্ত্র সম্ভারে বলীয়ান ওইসব শাসকদল নির্মম অত্যাচার শুরু করেন। তখন তারা মানবিকতার ধার ধারেন না। ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতা ও সম্পদ দখলই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। অনেক সময় ধর্ম আলাদা হওয়ার জন্য সংখ্যালঘুদের সহ্য করতে হয় সংখ্যাগুরুদের অত্যাচার।কোন একটি রাষ্ট্র যখন বিশেষ একটি ধর্ম পরিচয়ে চিহ্নিত হয়ে যায়, বা বিশেষ কোন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে তখন সেখানে বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মের মানুষদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর বহু উদাহরণ আছে। সুতরাং পরাধীনতা নানা রূপে নানা ভাবে আমাদের জীবনে আসে। আমরা নানা ভাবে স্বাধীনতা হারাই। আমরা সাধারণত ধরে নিই কোন বিদেশি রাষ্ট্রনায়কের হাত থেকে দেশীয় মানুষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেই আমরা স্বাধীন। বিষয়টি মিথ্যা নয়। অপশাসনের উচ্ছেদ ঘটিয়ে, অত্যাচারীকে উচ্ছেদ করে আমরা যদি স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারি ,মুক্ত অক্সিজেন পাই, দেহ মনে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠি ,তাহলে নিশ্চয়ই আমরা স্বাধীন। ভোটাধিকারের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়ে আমরা যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে বলা যায় আমরা স্বাধীন। পৃথিবীর বহু দেশেই এভাবেই স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু এ স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই বাইরের স্বাধীনতা। আমরা বাইরে যতটা স্বাধীন ভিতরে ততটা নই। মানুষ স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে যে স্বপ্ন দেখে তা যদি পূরণ না হয়, তাহলে তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা বলা যেতে পারে না। সে স্বাধীনতা খন্ডিত হয়ে যায়। সর্বপ্রথম দরকার অন্ন,বস্ত্র ,বাসস্থান এ সবের অভাব মেটানো। স্বাধীন দেশে কেউ যেন অনাহারে না থাকে, কোন মানুষ যেন বস্ত্রহীন না থাকে।সবার মাথার উপরে যেন একটা ছাদ থাকে। তারপর শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এইসব বিষয়গুলো তো আছেই। অবশ্য একটা সদ্য স্বাধীন দেশকে স্বনির্ভর হতে গেলে কিছুটা সময় লাগে। তাকে সাবালক হয়ে ওঠার জন্য সময় দিতে হয়। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাজিকের মত সবকিছু হাতে এসে যায় না। কিন্তু একটা পর্যাপ্ত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নিশ্চয়ই সেগুলি প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু যদি দেখা যায় সে প্রত্যাশা বহুকাল অধরাই থেকে যাচ্ছে তাহলে সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে খন্ডিতই বলতে হয়। স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটা দেশাত্মবোধ বা দেশপ্রেম। বহু দেশপ্রেমিকের আত্মদানের মধ্য দিয়ে একটা দেশে স্বাধীনতা আসে। স্বাধীন দেশের নাগরিকের কর্তব্য হলো দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকা। দেশের মহান উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্যকে অঙ্গীকার করা। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশীয় স্বার্থকে বড় করে তোলা। যারা দেশ পরিচালনার কাজে যুক্ত হবেন তাদেরকেও ভাবতে হবে স্বৈরাচার, স্বেচ্ছাচার, ভ্রষ্টাচার, দুর্নীতি ইত্যাদি তাঁদেরকে যেন গ্রাস না করে। তাছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমরা স্বাধীনতার অপমৃত্যু ঘটতে দেখি। বাক্ স্বাধীনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ইত্যাদি ব্যাপারে শক্তিমানের কাছে দুর্বলকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। অর্থ ও ক্ষমতার বলে বলীয়ান রাষ্ট্রগুলো নয় কে ছয় বা ছয়কে নয় করার ক্ষমতা প্রদর্শন করে। তখন "বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।" এসব ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে, আমাদের কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা শক্তিমানের গোলামী বা দাসত্ব করি।এও তো এক প্রকার পরাধীনতা। এই পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া বড় কঠিন। মানুষের অন্তর্গত চেতনার জাগরণ না হলে সত্যিকারের স্বাধীনতা আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে। তবুও যেটুকু পেয়েছি বা পাচ্ছি এটুকু নিয়েই আমাদের কাজ চালাতে হবে। কারণ নেই মামার চেয়ে একটি কানা মামা থাকা অনেক ভালো। আসলে প্রকৃত স্বাধীনতা পাওয়ার পথে বাধা মানব প্রকৃতি ও মানব মনস্তত্ত্বের রহস্য জটিল অন্তর্বয়ন। এর থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। কবি জীবনানন্দের ভাষায় বলা যেতে পারে সেটা হয়তো "অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।"
______________________________
ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাঁইথিয়া লেবুবাগান
পোস্ট -সাঁইথিয়া
জেলা- বীরভূম
পিন নাম্বার ৭৩১২৩৪
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন