লোকটা
জেলা হাসপাতালের critical care unit এর সামনের একফালি বারান্দার মেঝেতে লোকটা শুয়ে আছে। দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময়ই ওই ভাবে পরে থাকে। মাঝে মধ্যে উঠে বসে ঠিকই কিন্তু তা বেশি সময়ের জন্য নয়। হাসপাতালে আমার এই দু তিন দিনের যাওয়া আসায় লোকটাকে এইভাবেই দেখছি । রোগা পাতলা চেহারা,পরনে আধ ময়লা প্যান্ট শার্ট,মাথায় প্রকান্ড একটা টাক। থেকে থেকেই শব্দ করে এমন হাই তোলে যে তাতে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তবে মজার ব্যাপার হল সে ভাবেই থাকুক না কেন তার কোটরগত চোখ কিন্তু সবসময় ccu এর বন্ধ দরজার দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছে। দেখলেই বোঝা যায় ভর্তি হওয়া রোগীর বাড়ির লোক। হাসপাতালের এই এক নিয়ম, ২৪ ঘন্টা রোগীর বাড়ির কাউকে না কাউকে থাকতে হবে।যার পর নাই বিরক্তকর।কাহাতক একজন বসে থেকে,পায়চারি করে,বা জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকতে পারে।কিন্তু কোনো উপায় নেই। থাকতেই হবে। একঘেয়েমি কাটাতে লোকটার সাথে আলাপ করি।নাম সমীর দে। বেশ মিশুকে। ফোকলা দাঁতের ফাঁকে হাসি নিয়ে বলে প্রায় তেরো বছর হাসপাতালে আসছে পেটের টানে।আসলে উনি সামান্য কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রোগীর বাড়ির লোকের হয়ে পরিষেবা দেন। যাদের সবসময় থাকা সম্ভব নয় বা যাদের অর্থ বল থাকলেও লোক বল তলানিতে তাদের হয়ে ইনি প্রক্সি দেন। সময় মতো দিনে দু তিন বার ডাক্তারে কাছে রোগীর খবর নেওয়া,দরকারি ওষুধ বাইরে থেকে নিয়ে আসা, বাড়ির লোকেদের রোগীর খবরাখবর জানানো এই হলো তার কাজ। পেশেন্ট পার্টিও শুধু মাত্র পারিশ্রমিক ও কিছু অতিরিক্ত টাকা গচ্ছিত রেখে নিশ্চিন্তে,নির্ঝঞ্ঝাট এ থাকতে পারে। বেশ অবাক লাগে। সত্যি সংসারে কতরকমের মানুষ আছেন, যারা অবলীলায় নিজ সুখ,সাচ্ছন্দ, আহার,নিদ্রা ত্যাগ করে গুরুদায়িত্ব একা কাঁধে নিয়ে জীবন সংগ্রামে লড়ে যাচ্ছেন।
ঘটনাটা ঘটলো দিন সাতেক পর। সকাল বেলায় এসে দেখি ভদ্রলোক মেঝেতে বসে একমনে কি যেন ভাবছেন। আজকের হালহকিকত জিজ্ঞেস করায় বলেন তার রুগী বেশ সুস্থ ,আজ বিকেলেই ছুটি হয়ে যাবে । জানতে চাইলাম এইবার কি করবেন? সমীর বাবু কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু একবার কাঁধতা ঝাঁকিয়ে হাতদুটো উপরে নির্দেশ করেন।
বিকেলে ccu এর সামনে এসে বুঝতে পারি কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। ভেসে আসা কথায় বুঝি গণ্ডগোলটা সমীর বাবুকে নিয়ে। তার নাকি দুপুর হতে কোনো হদিস নেই। mobileটা সুইচ অফ,বাড়ির ফোনটাও বেজে যাচ্ছে কেউ তুলছে না। এদিকে পেশেন্ট পার্টির রুগী ছুটি করা হয়ে গেছে,সমীর বাবুর থেকে বকেয়া টা পেলেই তারা রওনা দেয়। বেশ খানিক হাসপাতালের এদিক ওদিক খুঁজে না পেয়ে,রুগীর বিদেশ ফেরৎ ছেলে বলে ওঠে "না,ও আর ফিরবে না,পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে কেটে পড়েছে। তবে আমি ছাড়বো না,সুপারিনটেনডেন্ট এর কাছে চললাম কমপ্লেইন জানাতে।" কথাগুলো শুনে মনটা খিটকেল হয়ে গেল। লোকটার মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিছুক্ষন পর রুগীর ছেলে ফিরে এসেছে ,ঠিক সেই সময় ক্লান্ত বিধস্ত সমীর বাবু ফিরে এলেন। দেখেই মনে হচ্ছে তার উপর দিয়ে যেন কোনো ঝড় বয়ে গেছে। কাছে গিয়ে হাত দুটো ধরে বলি "কি গো আপনি কোথায় ছিলেন?" ধীরগলায় ভদ্রলোক বললেন, "আজ দুপুরে আমার স্ত্রী কে সাপে কামড়েছে, তাই বাড়ি গিয়ে তাকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করলাম। অবস্থা ভালো নয়।"বলেই পেশেন্ট পার্টির কাছে গিয়ে বকেয়া টাকা ও ওষুধের রশিদ দিয়ে বলেন "মোবাইলে চার্জ না থাকায় আপনাদের কিছু জানাতে পারি নি, আমায় ক্ষমা করবেন।"
সেই মুহূর্তে ভদ্রলোকের পাংশুটে মুখটা দেখে আমার কেন জানি না মনে হল "সত্য সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ।"
জানালার দিকে চোখ যেতে দেখলাম, জেলা কোর্টের উপরের জাতীয় পতাকাটা যেন আজ একটু বেশিই নুইয়ে আছে।
============================
সন্তু চ্যাটার্জী
আসানসোল
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন