কেমন এ ভারত
আদিবাসী অধ্যুষিত ভারতের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য, জনবন্টন ও মানব উন্নয়নসূচক :
আমরা জনবন্টন, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও মানব উন্নয়নের সূচক ধরে আদিবাসী
অধ্যূষিত এই অঞ্চলগুলির একটা ছবি পেতে পারি। জেলাকে উপজেলায় ভাগ করে
বিশ্লেষণ করলে প্রাচুর্যের অভিশাপ বিষয়টি উদ্ঘাটিত হয় আরো নগ্নভাবে।
আমরা একনজরে দেখলাম যে আদিবাসী অধ্যুষ্যিত দন্ডকারণ্য অঞ্চল জঙ্গলে ঘেরা।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কোন দেশের মোট ভূখণ্ডের ৩০%-এর বেশি যেখানে বনজ
অঞ্চল থাকা উচিত সেখানে ভারতে তা ২২% -এ নেমে এসেছে। তৎসত্বেও আদিবাসী
অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে তা ৪০%-এর ওপর। আর এসব অঞ্চলগুলো প্রধানত খনি
অঞ্চল। এইসব অঞ্চল খনি সম্পদে ভরপুর। বিশ্ব স্তরে ভারত খনিজসম্পদে বিশেষ
স্থান দখল করে আছে। কয়লা ও লিগনাইডে ভারতের স্থান তৃতীয়, কাঁচা লোহায়
চতুর্থ , বক্সাইডে ভারতের স্থান পঞ্চম ও ম্যাঙ্গালিজে সপ্তম।
২০১০-১১ সালের একটা সরকারি হিসেব থেকেই দেখা যায় যে কেন্দ্র শাসিত
অঞ্চলগুলো সহ ভারতের ৩২টা রাজ্যে যে খনিজ সম্পদ উৎপাদিত হয় তার সিংহ
ভাগ কেন্দ্রীভূত ১১টি রাজ্যে (সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা সহ) । এই ১১টি
রাজ্যে দেশের মোট খনিজ উৎপাদনের ৯০.০৩% উৎপাদিত হয়। উপকূলবর্তী এলাকাগুলো
এ ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী। তারা উৎপাদন করে মোট উৎপাদনের ২৫.৬৪%। এর
পরেই উড়িষ্যার স্থান। সেখানে উৎপাদন হয় ১০.৬২%। রাজস্থান তৃতীয় স্থানে,
৮.৫৮% উৎপাদনের ভাগিদার। অন্ধ্রপ্রদেশে ৭.৮১% ঝাড়খণ্ডে ৭.৭২, ছত্তিশগড়ে
৬.৬২%, গুজরাটে ৬.৬৩ মধ্যপ্রদেশে ৫.২৮,আসামে ৪.৬৪ গোয়ায় ৩.৪৯ ও কর্নাটকে
৩.২৭% উৎপাদিত হয়। বাকি একুশটা রাজ্যের একযোগে ভাগ মাত্র ৯.৯৭%, তবে
এককভাবে এদের কারো ৩%-এর বেশি নয়। ( Ministry of Mine,Government of
India, modified on 10/05/2012 )
কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, দক্ষিণপূর্ব
মহারাষ্ট্র ধরে দন্ডকারণ্য অঞ্চলের ভৌগলিক, জনবন্টন আর মানব উন্নয়নের
বৈশিষ্ট্য ধরে জানা যায় যে জঙ্গল ঘন আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলগুলোর
প্রামাঞ্চল সব থেকে দারিদ্রপীড়িত, অপুষ্টিতে আক্রান্ত, স্বাস্থশিক্ষার
অভাবে পিছিয়ে থাকা। এই অঞ্চলগুলোর জেলাগুলোকে উপজেলায় ভাগ করে বিশ্লেষণ
করলে দেখা যাবে এই অঞ্চলগুলো ধনী ও গরিব অঞ্চলে বিভক্ত। গ্রামের গরিব
অঞ্চলগুলোতে প্রধানত আদিবাসীদের বাস। এই অঞ্চলগুলি জঙ্গল ঘেরা খনিজ
সম্পদে ভরপুর। এই সব অঞ্চলগুলোতে যে শহরায়ন হচ্ছে তার সুবিধা পেয়ে চলেছে
দেশের বিত্তশালী উচ্চবর্গের মানুষ। সাম্প্রতিক একটা গবেষণা পত্র ধরে আমরা
এই আলোচনায় প্রবেশ করব। প্রাচুর্যের অভিশাপ বলতে আমরা কি বুঝি সেটা তা
দেখিয়ে দেবে। আর আজ এসব অঞ্চলগুলোতে জ্বলে উঠেছে নকশালবাড়ির দাবানল।
জেলা বিভাজন ও প্রাচুর্যের স্ববিরোধিতা :
সারা পৃথিবী ধরেই দেখা যায় প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর অঞ্চলগুলোর ওপর
নিরবিচ্ছিন্নভাবে সাম্রাজ্যবাদের আক্রমন নেমে এসেছে। কর্পোরেট সাম্রাজ্য
লুঠ করে এই সব দেশের সম্পদ। আফ্রিকা এশিয়া লাতিন আমেরিকা ধরে চলেছে এই
ধারাবাহিক লুঠের রাজত্ব। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদে
পৌঁছবার কাল থেকেই এই আগ্রাসন পুঁজিবাদী সভ্যতার নগ্নরূপটাকে উদ্ঘাটিত
করে চলেছে। ভারত এর ব্যতিক্রম নয়। সম্পদের প্রাচুর্যের এই অভিশাপ জঙ্গল
ঘেরা বনাঞ্চলগুলিতে কি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে চলেছে তার বিস্তারিত একটা
চিত্র তুলে ধরেন সঞ্চিতা বক্সী, পূর্বতন পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্যা,
অরুণীশ চাওলা, অর্থমন্ত্রণালয়ের যৌথ সম্পাদক, সমাজ প্রগতি সহগের সম্পাদক
ও পূর্বতন পরিকল্পনা কমিশনের সভ্য মিহির শাহ তাদের একটি সাম্প্রতিক
অনুসন্ধ্যানে। এর জন্য জেলাগুলোকে উপজেলায় ভাগ করে বিশ্লেষণ করেছেন
তাঁরা। এই গবেষণামূলক কাজে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের আলোচিত
অঞ্চলগুলোর জেলাগুলোকে উপজেলায় ভাগ করলে ধরা পরে বিত্তহীন আর
বিত্তবানদের মধ্যে ভয়ঙ্কর মাত্রায় বিভাজনটি বর্তমান। দেশের অভ্যন্তরিন
উৎপাদনে উচ্চমাত্রায় অবদান রাখলেও আদিবাসী অধ্যুষিত বনজ অঞ্চলগুলো
দারিদ্র নিপীড়িত, অপুষ্ট ও নিরক্ষর। এখানকার প্রান্তিক মানুষেরা চিকিৎসার
সুযোগ থেকে বঞ্চিত, আশ্রয়হীন। প্রকৃতিই এদের আশ্রয়। জীবন জীবিকা
সম্পূর্ণ ভাবে প্রকৃতি নির্ভর। সভ্য সমাজ এতদিন এদের খবর রাখত না। আজ
সম্পদের খোঁজ পেয়ে এরা রাষ্ট্রের সমর্থনে এখানে বন্দুক হাতে উপস্থিত।
উদ্দেশ্য অঞ্চল `সাফ` করে সেখান থেকে বসবাসকারী মানুষকে `উচ্ছেদ` করে
`উন্নয়ন` ঘটানো। উন্নয়ন মানে সেখানকার জল জমি খনিজ সম্পদের ওপর দখল
নেওয়া। বিদেশী বহুজাতিক সংস্থা ও তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা দেশীয়
বহুজাতিক সংস্থার হাতে তা তুলে দেওয়া। লুঠের রাজত্ব কায়েম করা। তথাকথিত
এই উন্নয়নের অভিযানকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কলম্বাসের পর
সবচেয়ে সবচেয়ে বড় মাত্রায় জমি দখলের, উচ্ছেদের অভিযান বলে চিহ্নিত করে।
একইসঙ্গে অঞ্চলগুলোর শহরগুলিতে বিত্তশালী একটা সস্প্রদায় গড়ে ওঠে
যারা উচ্চবর্গের মানুষ, দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে যারা আসে। আমাদের
আলোচিত অঞ্চলগুলো খনিজ সম্পদে ভরপুর হওয়ায় এই অবস্থার উদ্ভব ঘটে। সম্পদ
প্রাচুর্য গরিব মানুষের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যেই নিহিত আছে
লুঠের রাজনীতির বীজ। গরিব মানুষকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। আক্রমণকারী আর
প্রতিরোধকারীদের মধ্যে এক যুদ্ধ ঘোষিত হয়।
১৯৯১ সালে নতুন আর্থিক নীতি চালু হওয়ার পর থেকে অঞ্চলগুলির মধ্যে বিভাজন
প্রকট থেকে প্রকটর হতে থাকে। খনিজ সম্পদের স্বর্ণ লঙ্কায় যে প্রবণতা দেখা
যায় তা সরকারি পরিসংখ্যান সমর্থন করে। ৫০-টি প্রধান খনিজ উৎপাদনকারী
জেলাগুলির মধ্যে ৬০% জেলা দেশের সব থেকে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলির
অন্তর্ভুক্ত। দেশের ২৫টি সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্থ জেলাগুলোর ২টি ওড়িশায়,
ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড়ে ১টি করে অবস্থিত। উড়িষ্যার কেওনঝর জেলায় শিশু
মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। দান্তেওয়ারা লোহা সম্পদে ভরপুর হওয়ায় আজ এই
অন্যতম সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে বিনিয়োগের আকর্ষণ সবচেয়ে তীব্র। এই
জেলা ১৫০টি সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জেলার মধ্যে তলা থেকে সপ্তম। এই সম্পদধনী
অঞ্চলে মাত্র ৫৩% শতাংশ মানুষের পানের উপযুক্ত পানীয় জলের ওপর অধিকার
আছে। কর্ণাটকের বেলারি আর গুলবার্গের মত অঞ্চল এর অন্যতম যেখানে
রাজ্যের ৮৪% লোহা পাওয়া যায়। চুনা পাথর উৎপাদনে গুলবার্গ সবচেয়ে অগ্রণী।
কিন্তু গুলবার্গ মানব উন্নয়নসূচকের মাপকাঠিতে সব থেকে পিছিয়ে পড়া কুড়িটি
জেলার মধ্যে উনিশতম আর বেলারি সতেরোতম। বেলারিতে ৪৫% মানুষ দারিদ্র
সীমার নিচে অবস্থান করে। দেশের সমস্ত খনিজ অঞ্চলের অবস্থা একই।
ছত্তিশগড়ের লাগোয়া মহারাষ্ট্রের ইয়াবতমল ও চন্দ্রপুর হল দুটি প্রান্তিক
জেলা যেখানে মহারাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কয়লা আর চুনাপাথর উৎপাদিত
হয়। অথচ এই অঞ্চলগুলো সবচেয়ে দারিদ্র পীড়িত। মহারাষ্ট্রের অন্যত্র বিশেষ
করে উন্নত জেলাগুলোতে তেমন খনিজ সম্পদ পাওয়া যায় না। এই রাজ্যের ৩৫টি
জেলার মধ্যে এই পিছিয়ে পড়া দুটি জেলার অবস্থান যথাক্রমে চৌত্রিশতম ও
ছাব্বিশতম। চন্দ্রপুরে ৪৭% মানুষ দারিদ্র রেখার নিচে অবস্থান করে।
ইয়াবন্তমলে ৪৪% মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে।
এবার দেখা যাক পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোকে উপজেলায় ভাগ করে আলোচনা করলে
সঞ্চিতা বক্সীদের গবেষণা আমাদের কি জানান দেয়। সাম্প্ৰতিক কালে মোট
অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে খনিজ উৎপাদনের অবদান বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক ভাবে
পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলা যায়। কিন্তু একটি
পশ্চাদপদ জেলাকে উপজেলায় ভাগ করলে দেখা যায় জেলার উন্নত অঞ্চলগুলোতে
দ্রুতহারে শহরীকরন ঘটেছে। উন্নত উপজেলায় আদিবাসীদের অংশ কমেছে। সেখানে
অন্য রাজ্য থেকে আসা উচ্চবর্গের বিত্তশালীদের একধরণের কেন্দ্রীভবন
বেড়েছে। পুষ্টি শিক্ষা স্বাস্থ্য সবরকম সুবিধা বেড়েছে। অপরদিকে পিছিয়ে
পড়া জঙ্গলে ঘেরা গ্রামাঞ্চলে আদিবাসীদের কেন্দ্রীভবন কমে নি। তাদের জীবন
জীবিকায় উন্নতি হয়নি। উপরোক্ত গবেষণা অনুযায়ী :
Typically tribal areas are mineral and forest rich and the extraction
of these resources tends to be a one way street with little benefit
flowing to the tribal people.
(Ref: Enclaves of Backwardness, Political and Economic Weekly, 1st Jan 2015)
আলোচনাধীন বিভিন্ন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত জেলাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই
উন্নয়ন শিল্পায়ন ও শহরীকরণের ফলশ্রুতিতে উচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্নতায় ছেদ
পড়েনি, অনাদিবাসী উচ্চবর্গের মানুষের ভিড় বেড়েছে শহরগুলিতে। পশ্চাদপদ
উপজেলাগুলি রয়ে গেছে আদিবাসী অধ্যুষিত। উন্নয়নের ও সম্প্রসারণের
কেন্দ্রগুলি ঘেরাও রয়ে গেছে গরিবি অপুষ্টি ও শিক্ষার অভাবে ভরপুল
গ্রামাঞ্চলের দ্বারা। অভাবের সমুদ্রে গড়ে উঠেছে শহরকেন্দ্রিক
প্রাচুর্যের দ্বীপ। এই গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে :
the most advanced sub-districts are flanked by the most underdeveloped
tribal sub-districts in Korba and Raigarh of Chhattisgarh, Valsad of
Gujrat, PaschimSingbhum, PurbiSingbhum of Jharkhand and Keonjhar,
Koraput and Mayurbhanj districts of Odisha
দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভূমি সংক্রান্ত আলোচনায় স্বীকার করা
হয়েছে যে গত ষাট বছরে ছয় কোটি মানুষ উচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে।
পৃথিবীতে সাম্প্রতিক কালের সর্ববৃহৎ উচ্ছেদ হলো এটা যাকে সরকার নিযুক্ত
একটা কমিটি কলম্বাসের পর সর্ববৃহৎ উচ্ছেদ বলে উল্লেখ করেছে। এদের মধ্যে
এক তৃতীযাংশের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। বাকিদের সম্পর্কে তেমন কিছু
জানা যায় না। উচ্ছেদ হওয়া মানুষের ৪০% আদিবাসী আর ২০% দলিত। উল্লেখযোগ্য
যে ৯০% কয়লা আর ৫০% অন্যান্য খনিজ পদার্থ পাওয়া যায় এই আদিবাসী অধ্যুষিত
জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলগুলিতে যেখানে দারিদ্র আর অপুষ্টি মানুষের নিত্যসঙ্গী
(দ্রষ্টব্য : Planning Commission,2013 Vol-1)
উপরোক্ত গবেষণা চালানো হয় ৬৪০টি জেলা ও ৫,৯৫৫টি উপ-জেলাকে কেন্দ্র করে।
সঠিকভাবেই বলা হয় যে গভীর এবং নির্ভুল বিশ্লেষণের স্বার্থে আলোচনাকে
জেলার গন্ডি পেরিয়ে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যেতে হয় কারন একটি
জেলা একাধিক বিভাজিত উপজেলায় আজ বিভক্ত। তথাকথিত উন্নয়নকে কেন্দ্র করে এই
বিভাজন গড়ে উঠেছে। এই বিভাজন হলো শহর গ্রামের মধ্যে বিভাজন ধনী দরিদ্রের
মধ্যে বিভাজন উচ্চ বর্গের সঙ্গে নিম্ন বর্গের বিভাজন। অর্থিনীতি রাজনীতি
সাংস্কৃতিক বিভাজন। এ এক সর্বাত্মক বিভাজন। উপবিভাজনের ভিত্তিতে এই
বিশ্লেষণ দেখিয়ে দেয় যে আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গল ঘেরা খনিজ অঞ্চলগুলো
আভ্যন্তরীন জাতীয় আয়ে অধিকতর অবদান রেখে চলেছে কিন্তু এইসব অঞ্চলগুলিতেই
আদিবাসীদের কেন্দ্রীভবন বেশি বেশি করে দেখা দিচ্ছে। এখানেই দারিদ্র ও
অপুষ্টি বাসা বাঁধে। শিক্ষার আলো এখানে পৌঁছায় না। চিকিৎসার সুযোগ নেই
বললেই চলে।
পরিসংখ্যানের সাহায্যে এই গবেষণায় কি বলা হয়েছে তা দেখে নেওয়া যাক। এই
গবেষণায় দেখা যায় যে ২৭টি জেলা আছে যার উপজেলার ১০% সর্বোচ্চ ও ১০%
সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করে। ৯২টি জেলার অন্তর্ভুক্ত উপজেলাগুলোর ২০%
সর্বোচ্চ স্তরে এবং ২০% এর স্থান সর্বনিম্নে। ১০৬টি জেলার ৩০% সর্বোচ্চ ও
৩০% সর্বনিম্ন স্তরের উপজেলা বলে বিবেচিত। এই জেলাগুলি এমনভাবে উপজেলায়
বিভাজিত যে কয়েকটি শহরকেন্দ্রিক উন্নত উপজেলা প্রধানত উচ্চবিত্তদের
বাসস্থান। উন্নয়নের সুবিধা এরা ভোগ করে। কিন্তু এইগুলোকে ঘিরে থাকে
দারিদ্র নিপীড়িত আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গলঘেরা খনিসম্পদে ভরপুর
গ্রামাঞ্চল। এই বিভাজিত পিছিয়ে পড়া উপজেলাগুলি হলো খনিজ সম্পদ স্বর্গ।
আদিবাসী মানুষের কেন্দ্রীভবন ঘটে এইসব পিছিয়ে পড়া উপজেলায়। জাতীয় উৎপাদনে
খনিজ সম্পদে এই অঞ্চলগুলির অবদান বেশি হলেও দারিদ্র অপুষ্টি অশিক্ষার
অন্ধকার এই অঞ্চলগুলোকেই তমসাচ্ছন্ন করে রাখে। মানব উন্নয়নের যে কোন
মাপকাঠিতেই এই অঞ্চলগুলো সবথেকে পিছিয়ে পড়া। একই সঙ্গে উন্নয়ন ও
শহরায়ণের দৌলতে বিভাজিত শহুরে উপজেলাগুলো দেশের উন্নত অঞ্চলগুলোর সমতুল
যেখানে আদিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। দখলদারি পেয়েছে উচ্চবিত্তরা। এই
কেন্দ্রগুলি কর্পোরেট সংস্থাগুলির ব্যবসা কেন্দ্র। শিক্ষা চিকিৎসা সব
কিছুতেই এগিয়ে থাকা। অন্যভাবে বলা চলে এইসব জেলাগুলো অভাবে ঘিরে থাকা
প্রাচুর্যের দ্বীপ। আর এখানেই নিহিত আছে প্রাচুর্যের অভিশাপের চাবিকাঠি।
উপরের আলোচনা ধরে বলা যায় যে বিশ্বায়নের নমুনায় শিল্পায়নের আশীর্বাদ
বর্ষিত হয় অনাদিবাসী উচ্চবিত্ত জনগনের মাথায়। আমাদের আলোচিত অঞ্চলগুলোতে
উন্নয়নের হার সর্বভারতীয় মানে যথেষ্ট বেশি। শেষ হিসেবে জানা যায় যে
ছত্তিশগড় ঝাড়খন্ড উড়িষ্যায় উন্নয়নের হার যথাক্রমে ৮.৪৪,৭.২৭ ও ৮.২৩ শতাংশ
যা ভারতের উন্নয়নের গড় হার থেকে বেশি। লক্ষণীয় যে গড় উন্নয়নের হার বেশি
হলেও এই অঞ্চলগুলো মানবউন্নয়নের সূচকে সবথেকে পিছিয়ে থাকা যা আমরা আগে
দেখেছি। আরও লক্ষণীয় যে এই জেলাগুলোতে মানব উন্নয়নহার কিছুটা বেড়েছে
শহরগুলোর উন্নয়নের ফলে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলগুলো যেই তিমিরে সেই তিমিরেই
আছে। আর আজ গ্রামাঞ্চলগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আদিবাসীদের
অভ্যুথ্যান। কারন তারাই আজ সবথেকে তীব্রভাবে শোষিত। আর সাম্রাজ্যবাদের
আক্রমনের ফল-ই এই শোষণ। সুতরাং শোষিত মানুষের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে
অস্ত্রধারণ-ই বলে দেয় আজ ভারতীয় সমাজে লড়াইয়ের অভিমুখ কোনদিকে কিভাবে
এগিয়েছে। প্রধান দ্বন্দ্ব কোনটা। নকশালবাড়ির আন্দোলন আমাদের প্রধান
দ্বন্দ্বকে চিনতে শিখিয়েছিলো। আর সাহায্য করেছিল এই দ্বন্দ্বের চরিত্র
বুঝতে। লড়াইয়ের নীতি ও কৌশল নির্ধারণে এই বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
জনযুদ্ধের গতিশীলতার এটাই চরিত্র। বাস্তব অবস্থার বদলের সঙ্গে সঙ্গে নীতি
ও কৌশলে বদল আসে। কিন্তু শত্রুতামূলক দ্বন্দ্বের সমাধান করতে গেলে
সশস্ত্র লড়াইটা অনিবার্য। সংসদীয় পথে এর সমাধান সম্ভব নয় কারন শোষণ বজায়
রাখতে রাষ্ট্র সবসময়-ই অস্ত্রহাতে উপস্থিত। ঘোষিত বা অঘোষিত যুদ্ধ
জনগনের ওপর চেপে বসে থাকে। এমনকি ভোটের রাজনীতিতেও অস্ত্র কথা বলে, পয়সা
ভোটযুদ্ধকে পরিচালিত করে। শান্তির ললিত বাণী শোনায় ব্যর্থ পরিহাস। এটাই
আজ সাম্রাজ্যবাদী আক্রমনের মুখে নকশালবাড়ি রাজনীতির শিক্ষা।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা আমাদের আলোচনার কেন্দ্রগুলির ভৌগোলিক ও
জনবন্টনের বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরতে পারি আরেকটু বিস্তৃত ভাবে। একই সঙ্গে
মানব উন্নয়নের সূচক ধরে এখানকার মানুষজনের আর্থ সামাজিক অবস্থা বুঝে
নিতে পারি। আর এটা আজ দেশের সম্পদ লুঠের সঙ্গে কিভাবে যুক্ত সেটা দেখব
আজকের ভারতে সাম্রাজ্যবাদী দখলনীতির প্রেক্ষাপটে। সরকার স্বীকৃত
পরিসংখানের সাহায্যেই আমরা আমাদের মূল প্রত্যয় ব্যাখ্যা করব,
সাম্রাজ্যবাদী লুঠের বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করব।
ভারতের খনিজ স্বর্গ :
জঙ্গল পরিষ্কার করে জীবন জীবিকা থেকে বসবাসকারী মানুষকে উচ্ছেদ করে খনিজ
সম্পদ লুঠ করে উন্নয়নের নামে যে সাফাই কর্মসূচী চলেছে তাকে একটি সামরিক
অভিযান বলা চলে যার পোশাকি নাম "Strategic Hamletting" । ছত্তিশগড়ে এসার
ও টাটা বহুজাতিক সংস্থা ভারতের সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীর ও সালভা
জুডুমের সাহায্যে এই সাফাই কর্মসূচি চালিয়ে দান্তেওয়ারায় এক ধাক্কায়
৬৪৪টি গ্রাম ধ্বংস করে দেয়। একটি রিপোর্টে বলা হয় যে সাড়ে তিন লক্ষ
আদিবাসী ও দলিত মানুষকে আশ্রয় হারা করে, জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করে। এদের
মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই আদিবাসী . সরকার এদের রাস্তায় বার করে দেয়.
সরকারি শিবিরে এরা অশ্রয় নিতে বাধ্য হয় ! কয়েক লক্ষ মানুষ অন্ধ্র প্রদেশ
বা অন্য রাজ্যে পালিয়ে যায়, কয়েক লক্ষ জঙ্গলে মাওবাদীদের সঙ্গে যোগ দেয় !
হাতে অস্ত্র তুলে নেয় . সরকারি খবরে এর স্বীকৃতি মেলে যখন দেখি সরকার
নিযুক্ত কমিটি On State AgrarianRelation and Unfinished Task of land
Reform নামক রিপোর্টে লেখে :
"শান্তির সন্ধানের কাজে সালওয়া জুডুমকে অর্থ যোগান দিতে প্রথমেই এগিয়ে
এসেছিল টাটা গোষ্ঠী ও এসার গোষ্ঠী ------------------- সরকারি তথ্য
অনুসারে ৬৪০টি গ্রাম রাষ্ট্রের আশীর্বাদ নিয়ে বন্দুকের সাহায্যে আক্রমণ
করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয় . ৩5৫,০০০ জন আদিবাসীকে ( যা দান্তেওয়ারা
জেলার অর্ধেক) তাদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তাদের কন্যাদের হত্যা
করা হয় এবং তাদের যুবকদের বিকলাঙ্গ কর দেওয়া হয়. যারা জঙ্গলে পালতে পারলো
না তাদের গরু বাছুরের মত ধরে নিয়ে গিয়ে সালওয়া জুডুম পরিচালিত উদ্বাস্তু
শিবিরগুলোতে আটকে রাখা হলো . বাকিরা আজও জঙ্গলে লুকিয়ে অথবা পার্শবর্তী
মহারাষ্ট্র অন্ধ্র প্রদেশ ও ওড়িশার আদিবাসী অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে. ৬৪০টি
গ্রাম আজ জনশূন্য . কোটি কোটি টন লৌহ আকরিকের স্তুপের ওপরে বসে থাকা
গ্রামগুলি মনুষ্যবসতিহীন হয়ে নিলামে সর্বোচ্চ দাম হাঁকা মালিকের জন্য
অপেক্ষা করছে".( অনুবাদ স্বাতী ঘোষ , অপারেশন গ্রিনহান্ট. আসানসোল সিভিল
রাইট এসোসিয়েশন )
মাহেন্দ কর্মা নামে এক কংগ্রেসি নেতা সালভা জুডুম নামে নাগরিক
বাহিনীটির অভিযানে নেতৃত্ব দেয় শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে। এরই
প্রতিক্রিয়ায় আদিবাসী জনগণ মাওবাদীদের নেতৃত্বে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। গত
ত্রিশ বছর ধরে এ লড়াই বহমান। মাহেন্দ্র কর্মা সহ বহু নাগরিক ও সামরিক
বাহিনীর জোয়ান যেমন মারা যায় তেমনি মাওবাদীসহ অসংখ্য মানুষ মরে বা জেলে
পচতে থাকে। এ লড়াই ছড়িয়ে পরে বিস্তীর্ণ বস্তার অঞ্চলে, মহারাষ্ট্রের
দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলে, ঝাড়খণ্ডে, বিহারে, উড়িষ্যায়, পশ্চিমবঙ্গের লাল গড়
সহ ভারতের প্রায় একতৃতীয়ংশ অঞ্চলে। প্রধানত জঙ্গল ঘেরা খনিজ অঞ্চলগুলোয়
এই সাফাই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। আমরা এই অঞ্চলগুলো যে দেশের খনিজ স্বর্গ
সেটা দেখবো।
এই Strategic Hamletting বা সাফাই কর্মসূচি আজ আদিবাসী অধ্যুষিত
অঞ্চলরগুলোকে বিত্তবান আর বিত্তহীনে, আদিবাসী অনাদিবাসী, শহরবাসী আর
গ্রামবাসীতে ভাগ করে দিয়েছে যে সম্পর্কে আগে আলোচনা করা হয়েছে। এই
অভিযান মানুষকে আশ্রয়হীন করে জীবিকাহীন করে পথের ধারে শিবিরে এক পশুর
জীবন যাপনে বাধ্য করেছে। এদের মধ্যে অনেকে অজানা আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়েছে,
অনেকে জঙ্গলে মাওবাদিদের সঙ্গে একত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল
হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে জনাতনা সরকার যাকে উচ্ছেদ করতে রাষ্ট্র আকাশপথ
জলপথ ও সড়কপথে সামরিক বাহিনী নামিয়েছে। এই অঞ্চল কেমন খনিজ সম্পদে ভরপুর
তা দেখে নেওয়া যেতে পারে কারণ এই খনি লুঠ-ই হলো অভিযানের মূল উদ্দেশ্য।
আমাদের আলোচিত তিনটে রাজ্য তথা ছত্তিশগড় ঝাড়খন্ড আর উড়িষ্যা ধরে আমরা
খনিজসম্পদের এই স্বর্গপুরীকে চিনে নেবো।
গুনগত মান ও পরিমানের দিক দিয়ে এই অঞ্চলগুলো খনিজ সমৃদ্ধ বনজ অঞ্চল
যেখানে প্রধানত আদিবাসীদের বাস সেটা আমরা আগেই বলেছি। আমাদের আলোচিত
তিনটে রাজ্য কর্ণাটকের বিরাট অঞ্চল মহারাষ্ট্রের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের
দন্ডকারণ্য ধরে এই খনিজ সুড়ঙ্গ অঞ্চল গড়ে উঠেছে যাকে আজ শাসক সম্প্রদায়
লাল সুড়ঙ্গ নাম দিয়ে যুদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল বলে চিহ্নিত করেছে। ওড়িষ্যা
ঝাড়খন্ড ছত্তিশগড়ে একত্রে ভারতের মোট কয়লা সম্পদের ৭০% আকরিক লোহার ৮০%
বক্সাইডের ৬০% ম্যাঙ্গানিজের ৪০% টিনের ৯০% আর ক্রোমিয়ামের ১০০% পাওয়া
যায়। কেবলমাত্র উড়িষ্যায় বক্সাইডের ৫১% ম্যাঙ্গানিজের ৩৫% কয়লার ২৪% আর
লোহার ১৭% পাওয়া যায়। টিনের ৮৮%, লোহার ১০% কয়লার ১৬% আর বক্সাইডের ৫%
সঞ্চিত আছে ছত্তিশগড়ে। এখানে ২৮ ধরণের খনিজ পদার্থ মেলে। রক্তাক্ত
দান্তেওয়ারায় রাজ্যের লোহার ৬৯% পাওয়া যায়। ঝাড়খন্ড একটি খনিজ সমৃদ্ধ
রাজ্য যেখানে দেশের মোট খনিজ মূল্যের ৮% সঞ্চিত। এই রাজ্যে অর্থ মূল্যে
মোট কয়লার ৯০% পাওয়া যায়। এখানে দেশের মোট লোহা র ১৪% ও বক্সাইডের ৩%
সঞ্চিত আছে ( দ্রষ্টব্য Rich and Poor People, Center for Science and
Environment, 2008; Operation Greenhunt ebang Bharat)।
এই খনির স্বর্গপুরীতে জাতীয় উৎপাদনে খনিজ সম্পদের অবদান বেশি হলেও
মাথাপিছু জাতীয় আয় কম। বরং খনিজ সম্পদ তেমন পাওয়া যায় না সেই সব অঞ্চলে,
যেমন তামিলনাড়ু বা মহারাষ্ট্রের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে, গুজরাটে মাথাপিছু আয়
বেশি। এটা সম্পদ প্রাচুর্যের স্ববিরোধিতাটাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে
দেয়। আমরা মানব উন্নয়নের সূচকের সাহায্যে এই স্ববিরোধের দিকটা উন্মোচিত
করতে পারি। উপজেলা ভিত্তিক আলোচনায় দেখা যায় খনিজ সমৃদ্ধ জেলার
খনিজপ্রধান উপজেলায় খনিজ সম্পদের অবদান অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বেশি হলেও
মানব উন্নয়নসূচকের বিচারে এই অঞ্চলগুলোর অবস্থা অবর্ণনীয়। কিন্তু এই সব
জেলায় যেখানে খনিজ সম্পদ পাওয়া যায় না ব্যবসা বাণিজ্যের দৌলতে নগরায়ন
ঘটছে সেখানে মানব উন্নয়ন সূচক উঁচু। আর উন্নত এই সব অঞ্চলে আদিবাসীদের
বাসের শতাংশ কমছে। উচ্চবিত্তদের ভিড় বাড়ছে। অর্থাৎ খনিজ সম্পদের দৌলতে
কিছুটা উন্নতি হলেও তার ফসল খাচ্ছে করপোরেট জগৎ আর উচ্চবিত্ত উচ্চবর্গের
মানুষরা।
জনবন্টন ও মানব উন্নয়ন সূচক :
যদি আমরা জনবন্টন ও তার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করি তবে আমাদের আলোচিত
রাজ্যগুলিতে একই ধরনের প্রবণতা খুঁজে পাব। আমাদের আলোচিত তিনটি আদিবাসী
অধ্যুষিত রাজ্যই খনিজ সম্পদে ভরপুর, বনজ অঞ্চল সীমা অতিক্রম করে নেমে
যায়নি যদিও শহরগুলিতে জঙ্গল সাফাই-এর কাজ শুরু হয়ে গেছে ভয়াভয় ভাবে।
ভৌগলিক দিক দিয়ে শহরগুলিও সংকটাপন্ন উচ্চহারে জঙ্গল উচ্ছেদের কাজ চলছে
বলে। গড় হিসেবে তাও এই অঞ্চলের জেলাগুলো কিছুটা হলেও সন্তোষজনক। উড়িষ্যায়
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের মোট ৪১৯৭৪২১৮ মানুষের মধ্যে
আদিবাসীদের সংখ্যা ৯৫৯০৭৫৬ তথা ২২.৮ শতাংশ। ঝাড়খণ্ডে ৩২৯৮৮১৩৪ জন
বসবাসকারীর মধ্যে আদিবাসীর সংখ্যা ৮৬৪৫০৪২, রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৬.২
শতাংশ। ছত্তিশগড়ে মোট জনসংখ্যা ২৫৫৪৫১৯৮। এর মধ্যে আদিবাসীর সংখ্যা
৭৮২২৯০২ যা মোট জনসংখ্যার ৩০.৬ শতাংশ। তিনটি রাজ্যে গ্রামীণ আদিবাসী
জনসংখ্যা যথাক্রমে ২৫.৭, ৩১.৪ ও ৩৬.৯ শতাংশ। লক্ষ্যণীয় যে এই তিনটি
রাজ্যে শতাংশ হিসেবে শহরে আদিবাসী জনসংখ্যা ঝাড়খণ্ডে ৯.৮%, উড়িষ্যায়
৮.৫% আর ছত্তিশগড়ে মাত্র ১০% । যদি শহরীকরণের আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা
করা যায় তবে দেখা যাবে শহরে আদিবাসী উচ্ছেদ শুরু হয়ে গেছে যা কার্যত
আজকের বহুজাতিকসংস্থার স্বার্থে দখল, সাফাই ও উন্নয়ন কর্ম্মসূচির অঙ্গ।
আদিবাসী অধ্যুষিত খনিজ সম্পদে ভরপুর রাজ্যগুলির খনিজঞ্চলগুলো প্রধানত
জঙ্গল ঘন। অথচ এই অঞ্চলগুলোই সবথেকে পিছিয়ে থাকা। আমরা আমাদের আলোচিত
উড়িষ্যা ঝাড়খন্ড আর ছত্তিশগড়ের পশ্চাদ্পদতার চেহারাটা দেখে নিতে পারি।
সাম্প্ৰতিককালে উন্নয়নের নামে সম্পদের ওপর আক্রমন তথা সম্পদ লুঠের কারবার
অবস্থাকে সেখানকার আদি বসবাসকারী মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক করে তুলেছে। এই
প্রান্তিক মানুষগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে চলেছে। তাদের পৃথক সত্তা মুছে
যেতে চলেছে। আদিবাসী গোষ্ঠীগুলি অবলুপ্তির মুখে আজ রুখে দাঁড়িয়েছে। এটা
নেহাত মাওবাদী সমস্যা নয়, একটা জাতিসত্তার জীবন মরণ সমস্যা। মাওবাদীরা
তেমন না থাকলেও অঞ্চলগুলোতে একভাবে বা অন্যভাবে অভ্যুথ্যান ঘটে চলেছে।
এমনকি কোথাও কোথাও সংসদীয় দলগুলোও জড়িয়ে পড়ছে। যেমন উড়িষ্যায় সিপিআইয়ের
নেতাদের কোথাও কোথাও নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে। তাদের ওপর রাষ্ট্রের
সন্ত্রাস নেমে এসেছে।
মানব উন্নয়ন সূচকের সাহায্যে এইসব অঞ্চলগুলোর ভয়াভয় দারিদ্র ও দুরবস্থার
কথা আমরা জানতে পারি। আমরা জানি যে আন্তর্জাতিক স্তরে মানবউন্নয়নসূচক
বিচারে ভারত দরিদ্রতম দেশগুলোর অন্যতম। যদিও বিশ্বের ধনীতম মুষ্টিমেয়ের
মধ্যে ভারতের ধনীতমরা আরো উচ্চমাত্রায় জায়গা করে নিচ্ছে। আয় বন্টনের বা
ভাগ বন্টনের সূচক গরিব মানুষকে আরও গরিব করে তুলছে। এই প্রসঙ্গে অমিত
ভাদুড়ির বক্তব্য :
একটা ভারতে আকাশচুম্বী বিলাসবহুল আবাসন, বিরাটাকারের বাণিজ্য সংস্থার
প্রাসাদ, চোখধাঁধানো বিপনন মহল এবং উচ্চ প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা উড়ালপথ যার
ওপর দিয়ে নতুন নতুন নকশার গাড়ির মিছিল। আজ যে ভারত প্রথম বিশ্বে জায়গা
পেতে চলেছে এগুলো হল সেই ভারতের ছবি। এর সঙ্গে সহাবস্থান করে আরেক ভারত।
এই ভারতে অসহায় কৃষক একের পর এক আত্মহনননের পথ ধরতে বাধ্য হচ্ছে, অদূরে
গ্রামগুলোতে দলিতদের নিয়মিত খুন হতে হচ্ছে, আদিবাসীরা তাদের জীবন ও
জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে চলেছে আর খুদে শিশুরা যারা ঠিকমত হাটতে অক্ষম
তারা চকচকে শহরগুলোর রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে দ্রষ্টব্য: Economic
and political Weekly, 17th Feb 2007, Development or Development
Terrorism)।
ভারত মানব উন্নয়ন সূচকের বিচারে পৃথিবীর ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৩৫ স্থানে
অবস্থান করে। অর্থাৎ শেষের দিক থেকে কিছুটা উঁচুতে। বহুজাতিক সংস্থাগুলির
মৃগয়াক্ষেত্র ভারতের সম্পদ সাম্রাজ্যে বনজ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী
জনসাধারণের অবস্থান রাজ্যগুলির মানবউন্নয়ন সূচকে একেবারে সিঁড়ির শেষ
ধাপে বা প্রায় শেষ ধাপে। পুষ্টি শিক্ষা চিকিৎসা পরিচ্ছন্নতা মহিলা বঞ্চনা
প্রভৃতি সূচক নিয়ে গঠিত মানব উন্নয়ন সূচকে ভারত যেমন আন্তর্জাতিক স্তরে
পিছিয়ে তেমনি ভারতে বসবাসকারী আদিবাসী গরিব সম্প্রদায় ভারতীয়দের মধ্যে
সবচেয়ে পিছিয়ে। তাদের মধ্যে আবার জঙ্গলে ঘেরা গ্রামাঞ্চলের মানুষের
অবস্থা আরও খারাপ। সরকারি বেসরকারি সব হিসেবেই এই সত্য ধরা পরে। সরকার
গঠিত কমিটি বা প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন। ২০০৬
সালে মে মাসে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত একটি কমিটির রিপোর্টে বলা হয় :
" গ্রামীণ দরিদ্ররা চিরায়তভাবে চারণভূমি বনাঞ্চল ও জলসম্পদের ওপর
নির্ভরশীল থাকতো। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার সহযোগিতায় ওই সাধারণ সম্পত্তি
ক্রমাগত মুনাফা অর্জনকারীদের হস্তগত হচ্ছে। একদিকে জাতীয় উন্নয়নের হার
বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশ্বের ধনীদের তালিকায় নাম উঠছে ভারতীয় ধনীদের, বহু
ধনপতির বিত্তের হিসেবে পর্বত প্রমান হয়ে উঠেছে ব্যাংকের খাতায়,
কম্পিউটারে অন্যদিকে নি:সীম দারিদ্রের সংবিধানের ৩৯ ধারায় কতিপয়ের সম্পদ
পুঞ্জীভূত হতে না দেওয়ার কথা হাসির উদ্রেক করে। অস্পৃর্শ্যতা পারিবারিক
হিংস্রতা দুর্বলদের প্রতি নিপীড়ন ইত্যাদির ব্যাপকতা লক্ষণীয়। শিক্ষা
স্বাস্থ্য পরিবহন আবাসন প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে বিত্তবান ও প্রান্তিক
মানুষের মধ্যে আকাশজমিন ফারাক দৃশ্যমান। তাই জনগনের একটা বড় অংশ
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবস্থাপনা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করায় অসহিষ্ণু হয়ে
উঠছে। '' ( দ্রষ্টব্য: অপারেশন গ্রিনহান্ট, আসানসোল সিভিল রাইট
এসোসিয়েসন, পৃ ৭৬ )
দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থিত জনসংখ্যার কথা ধরলে দেখা যায় যে তপশীলি
উপজাতির ৪৭.৩ শতাংশ, তপশীলি জাতির ৩৬.৮ শতাংশ আর অন্যান্য পিছিয়ে পড়া
বর্গের ২৬.৭ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করে। এর ওপরের সাধারণ
বর্গের ১৬.১ শতাংশ এই বিবেচনায় দরিদ্র। সমস্ত জনসংখ্যাকে একসঙ্গে ধরলে
দেখা যায় যে ভারতে গ্রামাঞ্চলে অক্ষর পরিচয়ের পেক্ষাপটে শিক্ষিতের সংখ্যা
৬৮.২% যেখানে শহরে ৮৪.৮৪% শিক্ষিত। তপশীলি উপজাতিদের মধ্যে গ্রামে
৬১.৫% ও শহরে ৮০.৪% শিক্ষিত অর্থাৎ অক্ষর জ্ঞান আছে। মহিলাদের মধ্যে
অক্ষর জ্ঞান পুরুষদের তুলনায় কম। দেশে সামগ্রিক বিচারে শিশুমৃত্যু গড়
যেখানে ১৮.৪ শতাংশ সেখানে তপশিলী উপজাতিদের মধ্যে এই হার ৩৫.৮% । এদের
মধ্যে স্বাস্থ্য বীমার সুযোগ পায় মাত্র ২.৬% । সারা দেশের গড় হার হল
৩১.৯% । পানীয় জল থেকে পায়খানা জীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ছবিটা
একই কথা বলে। এসব অঞ্চলে জেলা গুলোকে উপজেলায় ভাগ করলে ছবিটা তপশিলি
উপজাতিদের পক্ষে আরো ভয়ঙ্কর।
দারিদ্র পীড়িত আর দুর্দশাগ্রস্ত উড়িষ্যার মানুষের অবর্ণনীয় দুরবস্থার
কথা জানা যায় মানব উন্নয়ন সূচক ধরে। খনিজ সমৃদ্ধ এই রাজ্যের মানব উন্নয়ন
সূচক 0.৪০৪ যা তলার দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় বিভিন্ন রাজ্যের সারনী
বিচারে একেবারে তলার দিকে। জাতীয় গড়ের দুইতৃতীয়াংশ ছিল মাথাপিছু আয় যা এই
উন্নয়নের দৌলতে নয়ের দশকের শেষে অর্ধেকে নেমে এসেছে। জাতীয় স্তরে
দারিদ্র অনুপাতের সূচক কমলেও এই অনুপাত উত্তর ও দক্ষিণের খনিজ সমৃদ্ধ
অঞ্চলগুলোতে বেড়ে গেছে। কোরাপুট সুন্দরগর আঙ্গুল ময়ূরভঞ্জ যে সব অঞ্চলে
রাজ্যের প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ শতাংশ আদিবাসী মানুষ বাস করে সেগুলো এইসব
অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। সবচেয়ে খনিজসমৃদ্ধ জেলা কঞঝড়রে ৬২% মানুষ দারিদ্র
সীমার নিচে অবস্থান করে। বক্সাইড রাজধানী বলে পরিচিত কোরাপুটে ৭৯% মানুষ
দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। পুষ্টি শিক্ষা পরিচ্ছন্নতা সব বিচারেই
অবস্থা করুন ( দ্রষ্টব্য Riches Out from Under India`s Odisha Tribals,
by Ranjit Devraj, o9.08.2008)।
ঝাড়খণ্ডে মোট জনসংখ্যা ৩.৩ কোটি যা মোট ভারতের জনসংখ্যার ২.৭২%, ২৮% হলো
তপশিলি উপজাতি। ২০০৮-০৯ সালের হিসেবে এ রাজ্যে গড় বনজ অঞ্চল ২৮.৮২%।
খনিজ প্রধান গ্রামগুলি ঘন জঙ্গলে ঘেরা। রাজ্যের ৭৫.৯৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে
বাস করে। এর মধ্যে ৯৫% আদিবাসী। মোট তপশিলি জনসংখ্যার ৯১% গ্রামে বাস
করে। গ্রামে উচ্চবর্গ মানুষের বাস নেই বললেই চলে। মানব উন্নয়ন সূচকে এই
রাজ্যের স্থান দেশের শেষ পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে। রাজ্যের মানব উন্নয়ন সূচক
মাত্র ০.৩৬। অক্ষর জ্ঞানে এই রাজ্যে শিক্ষিত ৬৭,৬% মানুষ। ক্ষুধার সূচকে
এই রাজ্যে পরিস্থিতি ভয়াভয়। দারিদ্র অনুপাত সূচক ৪৫.৩ যা দেশের গড় মানের
অনেক উর্ধে। এছাড়া অন্যান্য বিষয়কে ধরলে যাকে বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক
বলা হয় তবে এর মান লাফিয়ে ৭৪.৮-এ উঠে যায়। পানিয় জল ও পায়খানার সুযোগ
এখানে চারজনে একজনও পায় না।
ছত্তিশগড়ে অবস্থা মোটেও এর থেকে খুব ভালো কিছু না। দেশের মোট জনসংখ্যার
২% এই সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির একটিতে বাস করে। এই রাজ্যে ২৩%
মানুষ শহরে আর ৭৭% মানুষ আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলে বাস করে। এই
রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ২.৫৫ কোটি। ৩১.৭৬% তপশিলি উপজাতি যাদের আমরা
আদিবাসী বলি। ১১.৬১% তপশিলি জাতি। দেশের মোট আদিবাসীদের ১০শতাংশ এই
রাজ্যে বাস করে যা আদিবাসী অধ্যুষিত ঘনতম অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটা। রাজ্যে
অক্ষরজ্ঞানে শিক্ষিতের সংখ্যা ৬৪.৬৬% যা জাতীয় গড়ের অনেক নিচে। গ্রামে
এই শিক্ষার হার শোচনীয়। স্বাস্থ্যের নিরিখে মানব উন্নয়ন সূচক মাত্র ০.৪৯।
পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার ৯০.৩%। মানব উন্নয়নের মান ০.৩৫৮, দেশের
মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। অথচ উন্নয়নের হার ৮%-এর মত যা জাতীয় গড় থেকে
বেশি। রাজ্যের খনিজ সম্পদের অবদানের জন্যই এই হার বেশি। অর্থাৎ রাজ্যটি
বন্টন এবং বঞ্চনার ফাঁকের শিকার ((Ref : about Chattisgarh_UNDP in
India)।
মাথাপিছু আয়, শিক্ষা স্বাস্থ্য, পানীয় জল, পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি সূচক ধরে
এই সব অঞ্চলের গরিব মানুষের গরিবি দুর্দশা আর অসহায় অবস্থাটা জানা যায়।
এসব-ই যেন এক নীরব ক্রন্দনের প্রতিধ্বনি যা আকাশে বাতাসে গুমরে মরে। এই
অসহতাই জ্বলে ওঠে জনরোষে যা স্ফুলিঙ্গ হয়ে দাবানলের সৃষ্টি করে। প্রতিটি
ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। আজ করপোরেট লোভ তাদের দস্যুতা, রাষ্ট্র
যন্ত্র ব্যবহার করে যে উচ্ছেদের ক্রিয়াকান্ড চলছে উন্নয়নের নামে তার
বিরুদ্ধেই বিক্ষুব্ধ এই ভারতের জনজাতি। হিংসা হিংসাকেই ডেকে আনে। আর
রাষ্ট্রীয় হিংসার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় জনতার রোষ, তার প্রতিহিংসা।
এরই ফলশ্রুতি শ্রেণী যুদ্ধ। এক শ্রেণী কর্তৃক আরেকশ্রেণীকে উচ্ছেদের
নিরলস সংগ্রাম। আর সাম্রাজ্যবাদ যেহেতু কপোরেট শোষকদের হয়ে একটা হিংসা
চাপিয়ে দিয়েছে তাই তার প্রতিক্রিয়ায় জনতার হিংসাকে একটা অনিবার্যতাই
বলতে হয়। সংসদীয় রাজনীতিতে এর সমাধান নেই কারন রাষ্ট্রযন্ত্র শোষকশ্রেণীর
হাতের ক্রীড়নক। শোষনের হাতিয়ার। আজ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নিপীড়িত মানুষের
দ্বন্দ্ব ভারত সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব। এ এক শত্রুতামূলক দ্বন্দ যার
সমাধান সম্ভব গরিব মানুষের স্বার্থে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মাধ্যমে।
নকশালবাড়ির রাজনীতির এটাই শিক্ষা। ব্যাপক মানুষকে সমাবেশিত করে এই
যুদ্ধকে জয়ের পথে নিয়ে যাওয়াকেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে। এক ধাক্কায়
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সেরে সমাজতন্ত্রের দরজা খুলে দেওয়া যায় না যুদ্ধের
এই স্তরে। এই লড়াইয়ে শ্রমিক শ্রেণী যেমন গরিব কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে
কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়ে তেমনি এর সঙ্গে যুক্ত হয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়,
দেশপ্রেমিক শক্তি আর আজকের পরিবেশ কর্ম্মিরা। শ্রেণী স্বার্থ পরিবেশ
স্বার্থ আর আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বার্থ এক বিন্দুতে মেলে। এই জনযুদ্ধে
একদিকে যেমন যুদ্ধের হিংসা অনিবার্য তেমনি আরেকদিকে বিকল্প উন্নয়নের একটা
নমুনা সামনে রেখে নতুন সমাজ গঠনের দিকটা তুলে ধরতে হয়। এর জন্য দরকার
ঘাঁটি এলাকা, একটা বিকল্প সমান্তরাল সরকার যার পাহারাদার গণমুক্তি ফৌজ।
আজ ভ্রুনাকারে হলেও এটা ছত্তিশগড়ে দেখা দিয়েছে। নকশালবাড়ির আন্দোলন যে
ডাক দিয়েছিল সে ডাকে সাড়া দিয়েই এই জনযুদ্ধ এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রে
প্রবেশের দরজায় পৌঁছতে গেলে তার আগে যে দরজাটা বন্ধ সেটা খুলতে হয়। আর আজ
প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধান পেতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করতে হয়। এর
জন্য শ্রমজীবী মানুষ দেশপ্রেমিক শক্তি আর পরিবেশ বন্ধুদের নিয়ে এক
যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলতে হয়।
সিদ্ধান্ত :
আমরা আমাদের আলোচনায় দেখলাম যে খনিজ সম্পদে ভরপুর জঙ্গলে ঘেরা
গ্রামাঞ্চলগুলোতে প্রধানত আদিবাসীদের বাস। দেখা যায় যে বার বার সমতল
অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে পিছু হঠতে হঠতে এরা এই জঙ্গল অঞ্চলে আশ্রয়
নিয়েছে। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই আর্যদের আগ্রাসনের সময়কাল থেকেই এটা ঘটে
চলেছে। এই প্রসঙ্গে হিমাংশু কুমার নামে একজন গান্ধীবাদী যিনি আদিবাসীদের
সেবা করবেন বলে দান্তেওয়ারা অঞ্চলে আশ্রম করায় রাষ্ট্র কর্তৃক উচ্ছেদ
হয়েছিলেন তিনি বলেন :
এটা আসলে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক কালক্রমের মধ্যে দিয়ে ঘটে এসেছে। আজ দেশের
যেখানে যেখানে আদিবাসীর বাস, সেখানে সেখানেই খনিজ পদার্থ আছে। আমরা,
আর্যরা, মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে এসে সমতলভূমিতে আধিপত্য কায়েম করি। যে
ভূমিপুত্ররা ছিলেন তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করি, যেটাকে আমরা `দেবদানবের`
সংঘর্ষ বলে লিপিবব্ধ করেছি ------ অর্থাৎ `আমরা`, দেবতারা দানবদের সঙ্গে
যুদ্ধ করি। দানবদের যে বর্ননা পাওয়া যায় ------ কৃষ্ণবর্ণ, কুঞ্চিত কেশ,
মাথায় শিং ------- এটা অবিকল আদিবাসীদের বর্ণনা। আমরা অতীতে তাদের
খেদিয়ে দিই। আমরা সমভূমিতে আধিপত্য কায়েম করি। আজও আদিবাসীরা এবড়ো খেবড়ো
জমি, পাহাড়, জঙ্গল এইসব অঞ্চলেই বাস করেন। কৃষিযুগ শেষ হতে চলেছে। ধীরে
ধীরে শিল্পোদ্যোগের যুগ আসছে। এবার চাই খনিজ পদার্থ, যেখানে খনিজ পদার্থ
সেখানেই আদিবাসীদের বাস। ( দ্রষ্টব্য: হিমাংশু কুমার এখন বিসংবাদ
এপ্রিল ২০১০) ।
এই দুর্গম বনাঞ্চলে ব্রিটিশরাও পৌঁছতে পারেনি। ভারতের স্বাধীন সরকার এদের
কোন খবর রাখত না। আজ বহুজাতিক সংস্থাগুলি এখানে লুকনো খনিজ সম্পদের খবর
পেয়ে রাষ্ট্রের সহায়তায় অস্ত্র হাতে হাজির। শুরু হয়েছে 'দখল', 'সাফাই'
আর 'উন্নয়নের' নামে লুঠের কারবার। আজকের সভ্যতা খনি নির্ভর আর এই খনিজ
সম্পদই হলো কর্পোরেট দুনিয়ার লাভের উৎস যা নিয়ে মার্কিন সাহেব ডিউই
এন্ডারসন বলেন :
আধুনিক যুদ্ধে, যুদ্ধশিল্পের শাঁস হিসেবে আলূমনিয়াম এককভাবে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রচুর পরিমাণে আলূমনিয়াম ছাড়া বর্তমানে কোন
যুদ্ধ সম্ভব নয়, এবং কোন যুদ্ধে বিজয়লাভও সম্ভব নয়। আলূমনিয়াম দিয়ে যুদ্ধ
ও মাল পরিবহনের এরোপ্লেন তৈরী হয়। পারমানিক অস্ত্র তৈরী ও অস্ত্র
নিক্ষেপ দুটোতেই আলমনিয়াম প্রয়োজন। -------- আলুমনিয়াম, হ্যাঁ প্রচুর
পরিমাণে আলুমনিয়াম যুদ্ধে জয় পরাজয়ের মধ্যে পার্থক্য টেনে দেয়। (
উদ্ধৃতি : অপারেশন গ্রিন হান্ট ও ভারত , আপডেট প্রকাশনা পৃ ১২) ।
আলুমনিয়ামি শুধু নয়, ২৫০ বছর শিল্পবিপ্লবের কাল থেকেই আধুনিক শিল্পে
লোহার গুরুত্ব অপরিসীম। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস লেখক থমাস কালহিল এই
প্রসঙ্গে বলেন : "the nation which gains control of iron, soon acquires
control of gold"
সুতরাং বলা চলে যে আজকের ভারতে খনিজ সম্পদ খননের প্রশ্নটি খনি থেকে
উন্নয়নের প্রয়োজনে মাটি খুঁড়ে খনিজ সম্পদ তোলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
আদিবাসী যৌথ সমাজকে ভেঙে তাদের উচ্ছেদ করে কর্পোরেট রাজত্ব স্থাপন করার
এক কর্ম্মযোগ্য হল এটা। এ সম্পর্কে খনি অর্থনীতির গবেষক চন্দ্রভূষণ
বলেন:
Mining in India, therefore, is not a simple `dig and sell` proposition
as it is made out to be by industry. It is, in fact, a highly a
complex socio-economic and environmental challenge: at stake are
natural resources as well as people ----- forests, wildfield, water
,environmental quality and livelihoods----
( Chandra Bhusan )
কর্পোরেট দুনিয়ার কার্যকলাপ ও রাষ্ট্রের দখলদার সন্ত্রাস প্রসঙ্গে অভিজিৎ
প্রভুদেশাই বলেন :
The only terrorist is the capital worshipping industrial-financial
nexus, with its brainwashed / greedy supporters and its mindless
slaves who destroy, displace and enslave man, in order to unleash
their killing machines against the Earth--- I salute all indigenous
people and others who live as a part of nature, for they are the only
protector of our beloved and only planet.
Source:
http://www.countercurrents.org/walia030510
# 'প্রাচুর্যের অভিশাপ' নামক পূর্বপ্রকাশের পরের অংশ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন