"আদর্শ ও বাস্তবতা "
এক একটা করে বছর পার হয় । বর্ষবরণ উৎসব থেকে শুরু হয়ে ঝুঁকে যাওয়া বছরের মধ্যবর্তী কিছু সময়ের পর থেকেই শুরু হয় স্বাধীনতা দিবস পালনের নানান প্রস্তুতি,কুচকাওয়াজ, নিরাপত্তার বলয় বেষ্টনীর নানান নিরাপত্তা।
মিডিয়া, সংবাদ মাধ্যম ,সংসদের কার্যকলাপ,স্কুল কলেজ অনুষ্ঠানে মনে করিয়ে দেওয়া হয় স্বাধীন ভারতের স্বাধীন নাগরিক আমরা। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সেই সকল বীর সেনানীদের । শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয় , উদ্বুদ্ধ হই,মহাপুরুষদের জীবনী পড়ে। ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা,বাঘাযতীন, মাতঙ্গিনী কি বিবেকানন্দ এই সকল শ্রদ্ধেয় শ্রদ্ধেয়া গনের মহান কীর্তি, চোখের সামনে স্বাধীন ভারতের এক উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরে।
ওনাদের সেই দৃপ্ত চাহুনি ,রোমহর্ষক কাহিনী শুনে,পড়ে কিংবা সিনেমা আকারে টেলিভিশনের পর্দায় দেখে বাস্তব জীবনে,কিছু করার মানসিকতা চাঙ্গা করে আমাদের, কিন্তু বড়ই ক্ষণিকের সে অনুপ্রেরণা।
আবার গতানুগতিকজীবনযাত্রা ,চারপাশের ভূরি ভূরি উদাহরণ, একঘেয়েমি জীবন যাপনে অভ্যস্ত আমাদের জীবন গড়গড়িয়ে না হলেও কোনো রকম ধীর পদক্ষেপে চলতে থাকে। একদিকে আদর্শ অন্যদিকে আমাদের দৈনন্দিনতা,চাওয়া না পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে চলতে থাকে আমাদের জীবন, চোখে হাজার স্বপ্ন এঁকে।কিন্তু চোখের সামনে আশপাশটা কেমন যেন আধুনিকতার জাদু পরশে বেশ পাল্টে যাচ্ছে কিন্তু অবক্ষয়ের পাল্লা ভারী করেই।
বড়ো দুর্দিনের পথ পাড়ি দিচ্ছি আমরা ।দিনে দিনে ছাঁচে ঢালা আধুনিকতা ,আমাদের একটু একটু করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছে ।কখন কোন পরিস্থিতিতে,ঠিক কতটা কেমন আচরণ করতে হয় তা আমরা সাফল্যের সাথে শিখছি ও শেখার চেষ্টা করেই চলেছি ।খুব ভালো করে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেই ছোট ছোট শহর তলি ,মফস্বল শহর গুলিতে সর্বক্ষেত্রে প্রায় পরিবর্তনের ঢেউ ।
চোখে পড়ছে ,পাড়ার মুদির দোকান এখন সেজে উঠছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে । ঘুগনি ,আলুর দম বিক্রেতা রাতারাতি ব্যাঙ্ক লোনে খুলেছে মোমো ,রোল সেন্টার ।দিকে দিকে বিরিয়ানি সেন্টারের রমরমা । পাশের মুড়ি চপ কাকুও হাল না ছেড়ে নতুন আইটেমে ভরসা করছেন ,এ যেন এক টিকে থাকার লড়াই । সব মিলিয়ে আমাদের চারিপাশে এক জমজমাট পরিবেশ ,কত নাম ,কত ব্রান্ডের সমাহার ,বাজার মলে ।
হাতের নাগালে অফুরন্ত ইন্টারনেট ,একটু আঙুল স্পর্শ তো প্রয়োজনীয় হোক আর দেখনদারির জিনিষ ,নিমেষে হাতের নাগালে দোর গোড়ায় হাজির । কিন্তু সবই তো হচ্ছে বেশ ভালোই কিন্তু দ্রুতগামীর যুগে মানসিকতার উর্ধগামীতা না হয়ে অধোগতিই বেশি নজরে পড়ছে ।ভালো মানুষের রুচিবোধ ,বিবেক ,ভালোত্ব এগুলো কেমন যেন আজ কোনঠাসা হয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে ফিকে । পাঁচ ফোড়নের মতো অতি আধুনিকতার অনুঘটক হয়ে আমিত্ব বা বড়াই ,স্বার্থপরতা, ঈর্ষা, অতিযৌনতা, রেষারেষি বহাল তবিয়তে মনের গভীরে শাখাপ্রশাখা বাড়িয়েই চলেছে ।
এই সকল বিষয় সমূহ আদি অনন্ত কাল থেকে চলে আসছে কখনো লুনি,ফল্গু ধারা হয়ে আবার কখনো কেমন প্রকট বহিঃপ্রকাশে চাপ বাড়িয়েছে সমাজে । ইদানিং যেন, বেলেল্লেপনা, খুল্লম খুল্লম যৌনতা ,যা কিছু ভালো লাগলো করায়ত্ত করার বাসনা বৃদ্ধি, অসহিষ্ণুতা আদতে অপরাধ মনস্কতাকে প্রশয় দিচ্ছে ।
এই কয়েক সপ্তাহ আগে, অফিস যাবার একমাত্র বাহন, শেয়ালদহ্ গৌহাটি কাঞ্চনজংঘা এক্সপ্রেসে চড়াটাই কালঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছিলো। কাতারে কাতারে,গরু ছাগলের মতো গাদাগাদি করে দূর রাজ্য থেকে কাজ করতে যাওয়া মানুষদের ঈদে বাড়ি ফেরা দেখছিলাম । কি ভয়ানক কষ্ট ! সামান্য দুটো কোচ যদি বাড়ানোর সুযোগ দিতো রেল,প্যাসেঞ্জার গণ খুশি হতেন ,কিন্তু সে সুযোগ নেই । ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর বড় অভাব উচ্চ মহলে কিন্তু এটা হবে,সেটা হবে সে লম্বা ফিরিস্তি শুনতে অভ্যস্ত আমরা। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও বিপুল জনগণের চাহিদা দেখে লোকাল,এক্সপ্রেস ট্রেন নয়,বুলেট ট্রেন নিয়ে মাতামাতি হয় প্রবল।যাইহোক , টি টি গণ সদলবলে স্লিপার কোচে ওঠার ফাইন কাটছেন হাস্য বদনে! এত্তো মুরগি প্যাসেঞ্জার পাওয়া মানেই তো লক্ষী লাভ, কোনো রকমে যে যেখানে পেরেছে টিকিট নিয়ে উঠে পড়েছে,তার মানে তো ফাইন করে সবক শেখানোর গুরু দায়িত্ব টি.টি দের।আর ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রেন লেট ,তাতে জবাব দিতে তাদের বয়েই গেছে!
আমি তো মিথ্যা করেই ,ভেতরে সিট আছে বলে , সাইড পেয়ে নিজেকে চালান করে দিলাম ট্রেনের ভেতরে । ভিড় এড়াতে , সটান আপার সিটের মগ ডালে বসে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল ।রবি ঠাকুরের দেশে বোলপুর,শান্তিনিকেতনে স্টপেজ আসতেই ভিড় অন্য মাত্রা নিলো, আরো ডেলি প্যাসেঞ্জার, কিশোরী স্কুল ছাত্রী, কলেজ গামী তরুণীদের আগমনে ।
প্যাচ প্যাচে গরমে পাখা থেকেও না হাওয়া হওয়া ভারতীয় রেলের গর্বের পরিবেশে , হটাত এক বিশ্রী অনুভূতি! চোখ আটকে গেলো নিচের ভিড়ে । ধীর্ঘ দিন যাতায়াতের ফলে এক মুখচেনা লম্বা ভদ্রলোক এ কি করছেন ! সামনে দাঁড়ানো এক কিশোরী ছাত্রী, ভয়াল মুখে সরে সরে এপাশ ওপাশ করলেও সামনে আর জায়গা কোথায় সরে আসার !
এই একই দৃশ্য সেদিন ট্রেন ঘোষণা হতে ওভার ব্রিজ দিয়ে নামার ভিড়ে আমি দেখেছি এক বৃদ্ধ পাঞ্জাবির হস্ত সঞ্চালন সামনের নাতনি বয়সীর শরীরে । আজ আবার পুনরাবৃত্তি ,তাও এই মুখচেনা সরকারি আধিকারিক ! উনি তখনো এই ভিড়ের সুযোগে ওনার অবচেতন নোংরা হাতে খুঁজে বেরাচ্ছেন এক অলীক সুখ ।
এক রাশ ঘেন্না বেরিয়ে এলো ভেতরে ।নিজেকে অপরাধী লাগলো এমন বোবা দর্শক হয়ে থাকার জন্য ।আর কি কোনদিন পারবো ওনার পাশের সিটে বসে অফিস আসতে ! মন কে অভয় দিলাম এখন সঠিক সময় নয় ,ঠিক স্রোতের মতো খবর টা মুখে মুখে ছড়াতে হবে ,প্রয়োজনে ওনার অলক্ষ্যে করা ভিডিও রেকর্ডও কাজে লাগবে । প্রতিবাদ যেন ওনার কান পর্যন্ত যায়। যদিও কি এসে যায় এদের ! অবসরের পরও ছুঁক ছুঁক নেশার কবলে পড়বে ,নয় কাজের মেয়ে ,ছেলের বৌ বা পাশের বাড়ির বাচ্ছা নাতনি,তাকে কোলে বসিয়ে ! ছি ছি বড়ো ঘেন্নার এই ব্যস্ত জীবনে নোংরামি দৃশ্য ,কি রেখে যাচ্ছি আমরা নব জাতকদের কাছে ভাবলে কোনো উত্তর আসে না মাথায় ।
ইদানিং রাস্তা ঘাটে, ভিড়ে এই নৈতিক অধঃপতন হামেশাই চোখে পড়ছে ।পেপার ,টিভি খুললেই ধর্ষণ ,অশ্লীলতার আঁচড় ।প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে পথ চলি ,হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইলে বিশ্ব বার্তায় মগ্ন হই আর মোমবাতি মিছিলে সামিল হয়ে নির্ভয়া কাণ্ডে ধিক্কার জানাই ।আর নীরবে এই জনা কতক সামাজিক কীট ,বিষাক্ত পোকা ভদ্র মুখোশে কাজ সারে, অথচ,অফিসে নীতিবোধের পাঠ শেখায় এরাই ।
আজ যখন এই লেখাটা লিখছি ,হোয়াটসঅ্যাপ গ্রূপে এক ব্ন্ধু ম্যাসেজ করলো । আমাদের বর্ধমান শহরের এক প্রোথিতযশা সঙ্গীত শিল্পী ,এক নামী গার্লস স্কুলে যুক্ত । ওনার হাতে পরীক্ষার ত্রিশ নম্বর থাকায় ছাত্রীদের অশ্লীল ম্যাসাজ পাঠিয়ে কু প্রস্তাব দিতেন বেশি নম্বরের লোভ দেখিয়ে । সুতরাং, কতোদূর ই না গেছে অবক্ষয়ের শাখাপ্রশাখা !নোংরামির শেকড় ভাবলে অবাক হতে হয় !
তবুও আমরা আধুনিকতার গ্রাস এড়াই কি করে ! আর এড়িয়ে যাওয়াটাও কাম্য নয় ভবিষ্যতের স্বার্থে । আসুন সকলে একটু সচেতন থাকি, আসে পাশে ফুলের মতো বাচ্ছা গুলোকে সচেতন করি । আছড়ে পড়ুক সভ্যতার ঢেউ , যতটা সম্ভব নীতি , রুচিবোধ , বিবেককে অন্তরে রেখেও যদি আধুনিকতার ভালোত্বকে আত্মস্থ করে পথ হাঁটি তবে সেটা হবে স্বাধীনতার প্রতি আমাদের সেরা নৈবেদ্য।
****************************************
রাণা চ্যাটার্জী
বিবেকানন্দ কলেজ মোড়
বর্ধমান(পূর্ব)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন