সুজান মিঠির দুটি কবিতা
স্বাধীনতার মানে
"ই বাবু আইজ ইস্কুলমাইঠ্যে তুরা ভিড় করছিস ক্যান?
আইজ কি পূজা রে?"
ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা টাক মাথা পঞ্চাশ,
চোয়াল ফাঁক করে হাসে- "পুজো নয়রে বোকা,
আজ যে স্বাধীনতা দিবস!"
"সাদিনতা-উটা কি ঠাকুর?
মানত কইরলে কতা শুনবেক?"
খেঁকিয়ে ওঠেন কেউকেটা ভদ্রলোক
"ওরে গাধা, স্বাধীনতা কোনো ঠাকুর নয় রে,
স্বাধীনতা হলো অন্যের অধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়া
আর মুক্তির স্বাদ চেখে চেখে খাওয়া।
--আরে তুই বসে পড়লি কেন?"
"ওই যে,তু বইল্লি খাওয়ার কতা,
দে দিগিনি তিনদিন প্যাট ভইরে খাই নাই রে,
দে না খাইতে।
সাদিনতার খুব ভালো হইবেক। মঙ্গল হইবেক।"
"না রে, স্বাধীনতা আসলে তা নয়, তুই জানিস
সুভাষ বোস, গান্ধীজির কথা?
ওরা দেশের জন্য কত কিছু করেছেন।
ওরে গাধা, স্বাধীনতা হলো মুক্তি,
শৃঙ্খলমোচন।"
"অ--ইটা সাদিনতা!
ই যে তুরা ধুপ দিয়ে, ফুল দিয়ে
সাদিনতা করছিস-
ইর জয়ন্যই কি তুরা রোইজ খেইতে পাস?
মুদের পেইটে লাত মাইরলেও লিখাপরা বেরোবেক লাই।
মুর মা'টা ফুট কইরে মইরে গেল;
ডাক্তারে ছুঁলো না।
বিয়া হইলো না বইলে বুনটা--
গলায় দড়ি নিল।
ই বাবু, ইবার বল সাদিনতা কুনটা?"
চেঁচিয়ে ওঠেন পঞ্চাশ-- "ব্যাটা মূর্খ!
ওই যে রান্না হচ্ছে খিচুড়ি,
ওটাই স্বাধীনতা।
"অ উটা সাদিনতা? তা হইলে মুকে একটু বেশিই দে।
ভাই খাবেক, বাপটা খাবেক। আর তুরা
রোইজ সাদিনতা কর।
আমরা তাইলে রোইজ খেইতে পাবো।
স্বাধীনতা হাতে লাফিয়ে বাড়ি আসে মূর্খটা।
বাপকে বলে, "লে বাপ সাদিনতা খা,
খাইয়ে দ্যাক কি ভালো,
খা, খেয়ে লে।"
______________
বাসি পতাকাটা
জেলেপাড়ার শুকোতে দেওয়া জাল থেকে উড়ে আসে
রক্তের গন্ধ। মাছ, সাপ, নাকি, মানুষের; কি জানি!
পরনে দামি পোশাকের বাচ্চাটা ছুট্টে চলে গেল পাশ দিয়ে,
হাতে একমুঠো গোলাপ, দুমড়ে মুচড়ে ছড়াতে ছড়াতে।
সর্দি চাটা আধা ল্যাংটা পাপড়ি গুলো সরিয়ে সরিয়ে
খুঁজছে। একটাকা ..দুটাকা ..পাঁচটাকা ।
যদি শৌখিনতায় ছড়িয়ে যায় দামি ছেলেটা।
স্কুলে অনুপস্থিত মেয়েটা হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া
ম্যাডামকে দেখে ছুট্টে পালায়। মাতাল বাপ, আর
মায়ের গতর ভাঙা মাঠের কাজ সামলানোয় তাকে
সামলাতে হয় উনুনের কাঠ... হাঁড়ি... খুন্তি…
স্কুলে ভাতের লোভ সত্বেও।।
খাঁ খাঁ দুপুরে কাকের ঠোঁটে আটকানো শান্তি
কা কা চিৎকারে পালিয়ে যায় যোজন দূরত্বে।
শহরের অনবরত ছোটা গাড়ির নিচে লুটায় ফুল বিক্রি
করা ছোট্ট ছেলেটার বিক্রি না হওয়া রজনীগন্ধার মালা।
চুপিচুপি ফলের ঝুড়ি থেকে পচা ফল বিক্রি করে হাসে ফলওলা।
কি দারুন ঠকিয়েছে সে।
ছুটছে গাড়ি, ছুটছে বাড়ি , ছুটছে যন্ত্র ,যন্ত্রী মানুষ
ছুটে চলেছে সময়, দিন, বছরগুলো।
ছোটার লাইনের শেষে অবুঝ উলঙ্গটা হাঁটছে টলোমলো
পায়ে। সে কুড়িয়ে পেয়েছে স্বাধীনতা উদযাপনের বাসি পতাকাটা।
হঠাৎ কাকের ঠোঁট থেকে দূরে যাওয়া শান্তিটা
নেমে আসতে চায় জোরে। বলে "থামো থামো
আমার দেশ বেঁচে আছে। আমার দেশ বেঁচে আছে।"
জেলেপাড়ার গন্ধরাজ তখন সারা শরীর দিয়ে ছড়িয়ে
চলছে সৌরভ। রজনীর মালাটায় নতুন কনে হাসছে
রামধনু।
আমার দেশ বেঁচে আছে।
আমার দেশ বেঁচে আছে।
________________
সুজান মিঠি
গ্রাম - ধাপধাড়া পোষ্ট - সোনারগড়িয়া থানা - জামালপুর জেলা - পূর্ব বর্ধমান
পিন - ৭১৩৪০৪
ভারত