স্বাধীনতাদিবসের এখন তখন
কিছু
বক্তৃতা, দেশাত্মবোধক গান-নাচ-আবৃত্তি-নাটিকা সমণ্বিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,
মার্চ-পাস্ট পতাকা, উত্তোলন এবং বোঁদে বা জিলিপি। প্রতি বছর ১৫ই আগস্টের এই পরিচিত
ছবিটা দেখতে বা তাতে অংশগ্রহণ করতে সাত সকালে স্কুল, বাবাদের স্টাফ রিক্রিয়েশন
ক্লাব ও অফিসের মাঠে হাজির হতাম। এই তিনটের সময়সূচি এমন ছিল যে একটা জিলিপি বা এক
মুঠো বোঁদেও না ফস্কাত না। সেই কচি বয়সে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের
আত্মত্যাগের কাহিনী যতটা উদ্বুদ্ধ করত ততটাই বিমর্ষ। তখন এই ভ্যালেন্টাইন ডে, মা
দিবস, বাবা দিবস, বন্ধু দিবস, পৃথিবী দিবস, পরিবেশ দিবস ইত্যাদির আমদানি হয়নি। তাই
স্বাধীনতা দিবস ছাড়া বুঝি অন্যদিন স্বাধীন নই এমন প্রশ্নও মনে উদয় হোত না। মোটের
ওপর পুজোর মতো ১৫ই আগস্টও ছিল ‘বছরকার দিন’ মানে আনন্দের দিন।
তখন
‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হেয়’ বাক্যটি শুনে থাকলেও বুঝতাম না। তখনও জানতাম না কাশ্মীরের
জঙ্গি কার্যকলাপও আসলে স্বাধীনতা আন্দোলন, তখনও জানতাম না স্বাধীন দেশের
উত্তর-পূর্ব অংশের নাগরিকদের বিনা পরোয়ানায় যখন খুশি গ্রেপ্তার করার স্বাধীনতা
সেনার আছে, কৈফিয়ত চাওয়ার স্বাধীনতা নাগরিকদের নেই; তখনও জানতাম না একই দেশে
নাগরিকদের ধর্মভেদে বিশেষ দেওয়ানি আইনের অস্তিত্ব ও তার ফলে লিঙ্গভেদে স্বাধীনতার
তারতম্যের কথা। শুধু বুঝতাম আগে ইংরেজ শাসকরা অত্যাচার করত, এখন ভারতীয় শাসকরা দেশের উন্নতির
কথা ভাবে; আগে বৃটিশ পুলিস বিপ্লবীদের ধরত, এখন ভারতীয় পুলিস চোর ডাকাতদের ধরে।
খুন শব্দটার সঙ্গে পরিচয় কিছু হিন্দী সিনেমায়। সেসব দেখলে সপ্তাহভর বুক ঢিপ ঢিপ
করত। বাস্তবে ডাকাতের হাতে কেউ খুন হয়েছে শুনলে মাসের পর মাস রাতে মাকে না জড়ালে
ঘুম আসত না।
স্কুলে
ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম শুনলাম পৃথক হওয়ার দাবিতে কাশ্মীরে অশান্তি ও
একই দাবিতে পাঞ্জাবের খালিস্থান আন্দোলন। ভূস্বর্গে বেড়াতে যাওয়া যাবে না এইটুকু
আফসোস ছাড়া এসব আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার অর্থ নিয়ে নতুন করে ভাবায়নি বা ১৫ই
আগস্ট উদ্যাপনের উৎসাহে ভাঁটা ফেলে নি। রাজনীতি মানে যে কিছুটা শঠতা চালাকি সেটা
শুনেছিলাম, কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস বা বিপ্লবী দলগুলির নিজ নিজ পদ্ধতিতে স্বাধীনতা
সংগ্রামও যে আদতে রাজনৈতিক কার্যকলাপ এবং সেখানেও পারস্পরিক ক্ষমতা দখলের
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, তা অজানা ছিল। তাই বাপুজী, চাচাজী ও নেতাজীদের একই আসনে
বসিয়ে ফুল মালা দিয়ে পুজো করার নামই ছিল স্বাধীনতা দিবস পালন।
স্কুল
জীবনেই প্রথম পণের জন্য বৌ পোড়ানোর খবর শুনি। আমাদের দু বোনের কান বাঁচিয়ে বাবা মা
চাপা গলায় আলোচনা করছিলেন। ইংরেজি খবর কাগজ আসত বলে আমার পড়া হোত না। মনে নেই
খবরগুলো শুনে শুনে ঠিক কতদিন ধরে রাগে ভয়ে উদ্ভ্রান্ত থাকতাম। কিছু নিষিদ্ধ
অপরাধমূলক শব্দের ব্যবহারও পড়তে শুনতে শুরু করলাম। যেহেতু সেইসব কীর্তিকলাপের পর বিশ্রীভাবে
খুন করাটা তখনও তেমন জনপ্রিয় ছিল না, তাই ইভটিজিং, পালিয়ে বিয়ে আর ধর্ষণ কাছাকাছি
পর্যায়ের অসভ্যতা ও গোপন আলোচনা ছিল। লছিপুরে জিটি রোডের ধারে কুটিরগুলোর সামনে দাঁড়ানো
মুখে রং মাখা হাতছানি দিয়ে ডাকা বাচ্চা মেয়েগুলোর যে নিজের উপার্জনেও অধিকার নেই,
তারা যে আসলে স্বৈরিণী নয় দাসী, তা বুঝেছি অনেক পরে। অথচ জানতাম স্বাধীন দেশে দাস
ব্যবসা বেআইনি!
তখন
ইতিহাস বইতে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’-র কথা পড়েছি; কিন্তু ১৪ই ও ১৫ই আগস্ট দুটি দেশের
স্বাধীনতা নামক প্রাপ্তিটি যে ভারত উপমহাদেশে সর্বসাধারণের জীবনে স্বাধীন
জীবনযাত্রার বদলে পাকাপাকিভাবে চূড়ান্ত অশান্তির বীজ বুনেছে সে সম্পর্কেও ধারণা
স্পষ্ট ছিল না। ছোটরা তো বরাবরই বড়োদের অধীন। কিন্তু স্বাধীন দেশের প্রাপ্তবয়স্ক
নাগরিকদের স্বাধীনতাও যে অর্থনৈতিক সামর্থ্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অবশ্যই লিঙ্গভেদে
একরকম নয় তা যত স্পষ্ট হয়েছে, ‘সকল দেশের রানী’-কে তত হতদরিদ্র মনে হয়েছে। একটি
ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জন্য যে কত লক্ষ মানুষের বাঁচার
স্বাধীনতাও ভস্মীভূত হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে ভাবলে ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’
মধ্যপ্রাচ্য কি আফ্রিকার মতোই তমসাচ্ছন্ন দুর্ভাগা দেশ মনে হয়।
উদ্বেগ
আতঙ্কের সঙ্গে সহাবস্থান করতে করতে ক্রমশ স্বার্থপর অনুভূতিহীন হওয়ার পাঠ নিচ্ছি।
যখন নিজের ঘরে কি নিজের গায়ে আগুন লাগবে তখন ভাবব। যতক্ষণ না লাগছে স্টে কু-ল,
বিন্দাস থাকো, ক্ষণস্থায়ী জীবন ভোগ করে নাও। আপাতত স্বাধীনতা বলতে বুঝি মানবিক
মূল্যবোধ, অন্যায়ের প্রতিবাদ স্পৃহা, পরার্থে কাতরতা ইত্যাদি ছেঁদো অনুভূতির হাত
থেকে মুক্তি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে স্বার্থপর বলি। কিন্তু এই স্বার্থপরতা
মূলধন করেই তারা কেউ কেউ সুখী ও স্বাধীন। নারী নির্যাতনে নিত্যনতুন রেকর্ড আর
ধর্মীয় মৌলবাদের হুংকারের মাঝেই আমাদের মঙ্গলযান কিংবা ‘ইসরো’-র মহাকাশ যান বিজ্ঞান
প্রযুক্তি উন্নয়নের জয়গান গাইছে স্বগৌরবে। সেগুলোই বোধহয় এ পোড়া মাটি ছাড়তে পেরে হাঁফ
ছেড়ে বেঁচে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন