পিতৃশিক্ষা
বাবা-মায়ের পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান থেকে ফিরতেই রাতুল রাগে ফেটে পড়লো বাবার উপরে,"তুমি কি পাগল নাকি? আমাকে না জিজ্ঞেস করে আমার জীবনের সিদ্ধান্ত তুমি কিভাবে নিতে পারো?"
"দৃষ্টি আমার ছোটবেলার বন্ধুর মেয়ে। মেয়েটা যে খুবই ভালো, তা তুইও জানিস। তাহলে আপত্তি কোথায়?"
"আপত্তি কোথায় মানে? মেয়ে ভালো জন্যই আমাকে বিয়ে করতে হবে?"
"ভালো পরিবার, ভালো মেয়ে আর গুণিও। সমস্যা কি তবে?"
"আর রূপ?"
"রূপ ধুয়ে জল খাবি?"
"শোনো, ওসব বলা সহজ। অ্যাসিড হামলার পরে ওর মুখটা দেখলে একদম গা শিউড়ে ওঠে আমার। সেই মেয়েকে আমি বিয়ে করবো? অসম্ভব!"
"অ্যাসিড হামলার দোষটা তো আর ওর না। তাহলে শুধু শুধু ও কেনো শাস্তি পাবে?"
"আমি কি ওর ঠেকা নিয়ে বসে আছি নাকি? আমি কেনো ওকে উদ্ধার করতে যাবো? দেখো বাবা, আমি পারবো না ওকে বিয়ে করতে ব্যস!"
"একজন মানুষ, যার জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার কোনো দোষ নেই। আমাদের কি উচিৎ না এমন মানুষের পাশে দাঁড়ানো? আর রূপ কি জিনিস? আজ যার রূপ দেখে বিয়ে করবি, কাল তো তার রূপটা নাও থাকতে পারে। কিন্তু মানুষের গুণ আমৃত্যু থেকে যায়।"
"শোনো বাবা, ওসব ডায়লগ দেওয়া অনেক সহজ। আমি মানলাম এরকম একটা মেয়েকে উদ্ধার করা পূণ্যের কাজ। কিন্তু আমার মন অত বড় না। আজ আমার জায়গায় তুমি থাকলেও পারতে না। অন্যকে জ্ঞান দিতে ভালোই লাগে। এতই যখন জ্ঞান তোমার, তবে তুমি কেনো মাকে বিয়ে করেছিলে? একজন অ্যাসিড আক্রান্তকে কেনো করোনি?"
রাতুলের বাবা আর কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। রাতুলের মা নিজের ঘর থেকে একটা সাদা খাম নিয়ে এসে রাতুলের হাতে দিলেন। রাতুল খামটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"এটা কি?"
"খুলেই দেখ।"
রাতুল খামটা খুলে তার ভেতর থেকে একটা ছবি বের করলো। আর ছবিটা দেখামাত্র আঁতকে উঠলো।
"তোর বাবা জ্ঞান দিচ্ছে না তোকে শুধু শুধু। উনি নিজেও সেই পথেই হেঁটেছেন, যে পথে তোকে হাঁটতে বলছেন।" রাতুলের মা বললেন।
"মা, এটা তুমি?"
রাতুলের হাত থেকে ছবিটা নিয়ে রাতুলের বাবা এবার বললেন,"হ্যাঁ এটা তোর মায়ের বিয়ের আগের ছবি। দৃষ্টির মতোই তোর মায়ের জীবনও একটা কুলাঙ্গার এভাবে নষ্ট করতে চেয়েছিল। দৃষ্টিকে আজ যেরকম আড়ষ্ট, বেদনায় ভরা দেখছিস, তোর মাও সেরকমই ছিল। কিন্তু দৃষ্টির মতোই তোর মায়ের মনটাও খুব ভালো আর ওউ গুণি। সেই দেখেই আমি ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমার কাছে রূপের কোনো মাহাত্ম্য নেই। রূপ আজ আছে, কাল নেই। কিন্তু মানুষ মনের দিক দিয়ে ভালো হলে, তা কখনোই পরিবর্তন হয় না।"
"কিন্তু মা তো..."
"তোর মা ছবি তুলতে চাইতো না। ভয় পেত, লজ্জা পেত। তাই বিয়ের পরে আমি টাকা সঞ্চয় করে তোর মায়ের প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলাম। আমার তোর মায়ের এই রূপের প্রতি কোনো আকর্ষন আজও নেই। আমি আজও তোর মায়ের মনটাকেই ভালোবাসি। তুই তোর মায়ের যত ছবি দেখেছিস সব হয় অ্যাসিড অ্যাটাকের আগের বা প্লাস্টিক সার্জারির পরের।"
"বাবা, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমাকে আমি চিনতে পারিনি এতদিন। তুমি এত বড় মনের মানুষ, আমি আজ জানলাম।"
"এত বড় মনের কিছু নেই। একটাই কথা তোকে বলবো যে, মানুষকে রূপ দিয়ে বিচারই করবি না। এমন মানুষকে ভালোবেসে কি লাভ যার কাছ থেকে আমি ভালোবাসার পরিবর্তে কিছু আশা করছি! এমন মানুষকে ভালোবাসতে হয়, যার কাছ থেকে পরিবর্তে আমি কিছুই পাবো না। সেটাই সত্যি ভালোবাসা।"
"আমি দৃষ্টিকে বিয়ে করতে রাজী বাবা। আমিও আজ থেকে আর রূপকে গুরুত্ব দেবো না। কথা দিলাম তোমাকে।"
======================
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন