অদিতি চক্রবর্তী
"আরে নীলা যে!"
বাস থেকে নেমেই থমকে যায় নীলা! রোগা,ক্ষয়াটে চেহারার এক ভদ্রলোক তাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠেছে! কে? মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে নীলা,"আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না" বলে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সে ভদ্রলোকের দিকে, মুখে একরাশ কাঁচা পাকা দাড়ি চেনার চেষ্টা করে সে হাতড়ে চলে স্মৃতি , নাহ্ এমন কাউকে সে খুঁজে বের করতে পারেনা, "আমি প্রবাল" ভয়ঙ্কর একটা ঢেউ আছড়ে পড়ে তটের বুকে নীলা বলে ওঠে প্র_বা_ল মানে ? "ডঃ প্রবাল সমাদ্দার! "" আরে স্যার আপনি এ কী চেহারা হয়েছে আপনার! আমি তো চিনতেই পারিনি!" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবাল সম্মাদার তাকিয়ে থাকেন , নীলার মনে হয় ঠিক যেন ঝড়ে উপড়ে নেওয়া একটা অশ্বত্থ গাছের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে , একদিন যে গাছ কত পাখ পাখালিকে আশ্রয় দিয়েছে ,কত ঘর ছাড়া মানুষের ঠাঁই হয়েছে আজ সেই গাছ নুয়ে পড়েছে ! নীলাই কি আজ এখানে পৌঁছতে পারতো বাবা মারা যাওয়ার পর সাইন্স কোচিংয়ের মাইনে কিছুতেই সে জোগাড় করে উঠতে পারছিল না ,অথচ তার চোখে স্বপ্ন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আ্যপ্লাইড ম্যাথ নিয়ে সে পড়বেই তখন সে হায়ার সেকেন্ডারির স্টুডেন্ট , নব্বই সালের কথা ! নীলার মাথায় সমস্ত নার্ভ গুলো যেন শুকিয়ে যাচ্ছে , চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার কী করবে কোথায় যাবে! চারপাশের লোক জন, আত্মীয় ,পরিজন সবাই আস্তে আস্তে সম্পর্ক হালকা করতে লাগলো কেবল মাত্র এই স্যার তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এক শীতল আশ্রয় নিয়ে! আজ এই মুহূর্তে কত কথা যে মনে পড়ছে নীলার ! বন্ধুরা কত ঠাট্টা করেছে " আরে এত হ্যান্ডু স্যার, তোর প্রতি এত উইকনেস , ঝুলে পড় নীলা" ! নীলা লজ্জায় লাল হয়ে যেত " তোদের মুখে কিছু আটকায় না রে?" "ওনাকে আমি যে সিংহাসনে বসিয়েছি সেখান থেকে এই ভাবনা করাও পাপ!" তবে সত্যিই প্রবাল সমাদ্দার তার থেকে প্রায় বছর দশেকের বড় কিন্তু উনি সামনে এসে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে কোনো কথা বলতে এলেই ওর সারা শরীরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতো মনে হতো অনেক অনেক আদর করুক ওকে কেউ ,অবশ হয়ে যেত হাত পা ! তারপর একঝটকায় সম্বিত ফিরে পেয়ে ধাতস্থ হতো! এই অসম বয়সের ভালো লাগা কবে যেন ভালবাসায় পরিনত হয়ে যায় কিন্তু সবটাই এক পক্ষের অর্থাৎ নীলার দিক থেকেই! মোমের দহনের মত সে ভালবাসা, অপর পক্ষ বুঝলেও সাড়া দেয়নি কোনো দিন তারপর ভাগীরথী জলে বয়ে গেছে সময়! নীলা উত্তর বঙ্গের একটা কলেজের প্রফেসর হয়ে কলকাতা ছাড়ে মাঝে মাঝে ল্যান্ডফোনে খবরাখবর তারপর আস্তে আস্তে তাও বন্ধ, আজ এত বছর পর সে দাঁড়িয়ে আছে তার ক্ষয়ে যাওয়া বিবর্ণ ভালবাসার সামনে আজ আর শরীরের গন্ধে সেই আদর খাওয়ার ইচ্ছে নেই, পরিণত বয়সে সেই ইচ্ছে গুলো হলুদ হয়ে আসা শুকনো পাতার মত হয়ে যায়, একটু হাওয়ায় উড়ে চলে যায়! নীলা কিছু টা ধাতস্থ হয়ে একটা দ্বিধান্বিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় "কেমন আছেন"? একই ভাবে তাকিয়ে থাকেন প্রবাল সমাদ্দার নির্মোহ গলায় বলেন" ভালো এই মহামারী দিনে যেমন থাকা যায়!" "তুমি?"" চলছে স্যার" নীলা ও ছোট্ট উত্তর সারে, "অনেক দিন ধরে তোমাকে খুঁজে চলেছি নীলা! কোনো ফোন নম্বরে তোমাকে পাইনি! তোমার বাড়ি গিয়ে ও দেখেছি তারা ঝুলছে! "কে আর থাকবে স্যার, মা তো আমার সাথে নর্থ বেঙ্গলেই থাকেন, আমি এই লকডাউনে চলে এসেছি মা ও এসছেন সাথে, এখন একটু এক জেঠু জেঠিমা কে দেখতে গিয়েছিলাম এই ফিরছি জাস্ট! "" ও আচ্ছা" বলে এগিয়ে চলে গেলেন নীলার পাশ দিয়ে নীলা অস্ফুট স্বরে ডেকে ওঠে "স্যার" খুব ধীরে পিছনে তাকিয়ে প্রবাল সমাদ্দার বলে ওঠেন "বড় দেরি হয়ে গেছে নীলা"! আর সময় নেই, মনে মনে তোমাকে চেয়েছিলাম কাছের করতে কিন্তু সমাজ, সংস্কার বার বার বাধা দিয়েছে ! আদর নিও অনেক" বলতে বলতে চোখের পলক ফেলতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল লোকটা! নীলার পা দুটো ভারী হয়ে আসছে এগোতে পারছেনা, কোনো রকমে বাড়িতে নিয়ে আসে শরীরটাকে টেনে টুনে, বাড়িতে আসতেই মাধবী দি এসে দাঁড়ায়," দিদি চা দিচ্ছি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও এই আপদ ভাইরাসের জন্য তো আবার পুরো স্নান করতে হবে, যাও স্নানটা সেরে নাও দিকি"নীলা স্নানঘরে ঢোকে, এই একটা জায়গায় নিজেকে বড় নিজের মনে হয় ! সব ক্লান্তি, গ্লানি কোথায় যেন নিমেষে হারিয়ে যায়, শীতল স্পর্শে সব দূরে সরে যায়! প্রধান সেরে সে মায়ের কাছে গিয়ে বসে, মায়ের সামনে গেলে মনে হয় পৃথিবীর কোথাও কিছু ঘটেনি,মা বলেন," নীলা রাত পোহালেই ভোরে মহালয়া রেডিও টা দেখ তো ঠিক ঠাক আছে কিনা?" উফ্ মা যেন এই বিশ সালে ই সব বিষমুক্ত করে দেন! কী যে এক মারণ ভাইরাস এলো ! জানিস ওই যে তোর মাস্টার মশাই ছিলেন না! আরে প্রবাল? প্রবাল তো বিয়ে থা করেনি! একা একাই থাকতো ওই বিশাল ফ্ল্যাটে তা করোনা হয়েছিল কাউকে জানাতে পারেনি না কি কে জানে! তিন দিন ধরে না কি, ফ্ল্যাটে মরে পড়েছিল! কী নিষ্ঠুর সব প্রতিবেশী কেউ একটু খোঁজ খবর নেয়নি ,এরা কী মানুষ! আজ কালো প্যাকেটে মুড়ে ডেডবডি নিয়ে গেল পৌরসভার লোক জন! উফ্ মা গো কী অসহায় পরিস্থিতি মানুষের"" মা" একটা অস্ফুট শব্দ শুধু বেড়িয়ে আসে নীলার মুখ দিয়ে,গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে যন্ত্রণা ! তবে কি সবটাই ইলিউশন! কে !ছিল ওটা! কে! তবে কী যাওয়ার সময় একটা ছাপ রেখে গেলেন প্রবাল স্যার ! কিন্তু নীলা তো এসব বিশ্বাস করেনা, তবে সবটাই তার দৃষ্টি ভ্রম! সে মনের অবচেতন কোনে কোথাও প্রবাল স্যার কে খুঁজছিল? এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা দেয়! মা অনেকবার ডেকেও সারা পাননা,ভোর রাতে দরজা খুলে নীলা এসে দাঁড়ায় মায়ের ঘরের সামনে রেডিওতে তখন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদ্দাত্ত কণ্ঠ " যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেণ সংস্থিতা ..... মনে মনে সে ও বলে ওঠে শক্তি দাও মা ! শক্তি দাও!
--------------------
অদিতি চক্রবর্তী
১৮৮বারুইপাড়া লেন, কলকাতা১০৮
পোষ্ট অফিস বনহুগলী আই এস আই
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন