Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

নিবন্ধ ।। বিস্মৃত এক কবি অশোক বিজয় রাহা ।। শংকর ব্রহ্ম

 



"...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূন্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,

স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,

তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, 

নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ

তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত শাসন!

সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; 

হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!" 

'কবি অশোক বিজয় রাহা' - স্মরণে কবি ঊর্দ্ধেন্দু দাস এই কথাগুলিই লিখেছিলেন তাঁর ''ঈশানের পুঞ্জমেঘ'' কবিতায়।

 


              আধুনিক কবিতার সূচনালগ্নে যে ক'জন বঙ্গীয় কবি কবিতার ভূবন দাপিয়ে বেরিয়েছেন স্বমহিমায় তাদের মধ্যে অশোক বিজয় রাহা অন্যতম। ব্যক্তি জীবনে তিনি পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিলেও কাব্যচর্চা ছিল তাঁর হৃদযের মর্মমূলে। কবি অশোক বিজয় রাহাকে নানাভাবেই চিত্রিত করা যায়। কারণ তাঁর মধ্যে একাধারে নানান গুণের সমন্বয় ঘটেছিল। 'অধ্যাপকরূপে তিনি ছিলেন অসাধারণ আকর্ষণীয়। তাঁর বাগ্মীতা, পাণ্ডিত্য, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিলো অপূর্ব। তাঁর আবৃত্তি ছিল অনুকরণীয়।' 

         অথচ কী এক অজ্ঞাত কারণে আজ তিনি আমাদের অনেকের কাছেই তেমন সমাদৃত নয়। আক্ষেপের বিষয় আরও হলো বর্তমান প্রজন্মের অনেকে তাঁর নাম পর্যন্ত জানেন না কবি হিসাবে।

 


 


              অশোক বিজয় রাহা ১৯৮০ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকাদক্ষিণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বঙ্কু বিহারী রাহা চা বাগানে কাজ করতেন। বঙ্কু বিহারীর চার ছেলের মধ্যে অশোক বিজয় ছিলেন সবার ছোট। অশোক বিজয় অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুল জীবনে তিনি ছিলেন অন্যদের চাইতে অনেক আলাদা। মেধাবি ও বিনয়ী হওয়ার কারণে শিক্ষকরা তাঁকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। সিলেট গভর্ণমেন্ট হাইস্কুল থেকে অশোক বিজয় প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। আইএ পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। দর্শনশাস্ত্রে অনার্স এবং বাংলায় এমএ পাশ করে 'রসময় মেমোরিয়াল স্কুলে' শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। তারপর করিমগঞ্জ কলেজেও বেশ কিছুদিন অধ্যাপনা করেন।   

           কবি অশোকবিজয় রাহা ছাত্রাবস্থা থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন। সাহিত্যের প্রতি টানের ফলে কলেজে দর্শনের অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৪৭ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক হন।     

           নবগঠিত ভারতীয় গণনাট্য সংঘে তিনি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সহকর্মী হয়েও কাজ করেছিলেন কিছুদিন। 

 


দুই


                     শিক্ষকতার পাশাপাশি অশোক বিজয় রাহা কাব্যচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। কবিতার সাথে শৈশবে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। কবিতার সাথে মিতালী করেই পথচলা অব্যাহত ছিল তাঁর। সময়ের সাথে সাথে সমৃদ্ধ হতে থাকে তাঁর কাব্যচর্চায় ভাণ্ডার। তাঁর ফলস্বরূপ যৌবনে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই কবি প্রতিভার স্বীকৃতি পান তিনি। 'তাঁর ১৯ বছর বয়সের একগুচ্ছ কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশংসা বাণী লিখে দিয়েছিলেন তাঁকে। শুরুটা শৈশবে হলেও তাঁর কবিতা গ্রন্থভুক্ত হয় ১৯৪১ সালে। সেই সলেই তাঁর 'ডিহাং নদীর বাকে' ও 'রুদ্র বসন্ত' নামে দু'টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সিলেট থেকে কবিতার বইগুলো প্রকাশিত হলেও কাব্যরসিক বাঙালীদের মনের মধ্যে তাঁর কবিতা স্থান করে নেয়। কলকাতার সাহিত্যাঙ্গন মহলে বিপুল জনপ্রিয় হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো। এর একবছর পর ১৯৪২ সালে বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'কবিতা ভবন' থেকে 'ভানুমতির মাঠ' প্রকাশ করে তাঁকে প্রথম শ্রেণীর কবি হিসেবে অভিনন্দিত করে স্বীকৃতি দান করেন।

        কবিগুরুর প্রশংসা বাণী, আর বুদ্ধদেব বসুর স্বীকৃতি কাব্যাঙ্গনে প্রবেশের পথ তাঁর সুগম করেছিল। তারপর কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে অশোক বিজয় রাহাকে তাই আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর শ্যামল, সতেজ কথামালা বিদগ্ধজনের হৃদয়ে তাঁর জন্য-আসন তৈরী করে তোলে। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, আর মানুষের জীবনাচার তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হওয়ায় কাব্যাঙ্গনে তার অবস্থান সুদৃঢ় হতে থাকে। সিলেট ও কাছাড়ের শ্যামলবেষ্টিত চা বাগানে কৈশর উত্তীর্ণ হয়েছে তার। পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে তিনি চা-বাগানের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য ছেলে বেলাতেই অবগাহন করেন। সেই প্রভাব পরিস্ফুটিত হয়েছে তাঁর কবিতায় ক্যানভাসে। সিলেট ও কাছাড়ের জীবনযাত্রার চিত্র তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন সন্তর্পণে  -


"একদিকে পাহাড়-চূড়ায়

প্রকাণ্ড সেগুন-বন ঢেকে আছে অর্ধেক আকাশ

জমাট রাত্রির মতো,

বুকে তা'র

ঝিঁঝিঁ- ডাকা গায় অন্ধকার,

শতাব্দীর ঘুম।


অন্যদিকে পাহাড়ের কোলে

ঘুমায় পড়ন্ত- রোদে শালবন,

ছায়া পড়ে ঢালুর কিনারে,

পাশ দিয়ে একখানি আঁকাবাঁকা পথ

নেমেছে সাপের মতো।


মাঝখানে ধূ-ধূ ফাঁকা মাঠ,

একফালি আকাশের ফাঁক,

একটি পাখির শিষ রেখা টেনে যায়

সূর্যাস্তের দিকে।"


 (দিনান্ত, 'জল-ডম্বরু পাহাড়')


সাবলীল ও নিখুঁতভাবে তিনি বনাঞ্চলবেষ্টিত সিলেটের বর্ণনা দিয়েছেন এই কবিতায়। পাহাড়ঘেরা সিলেট অঞ্চলের প্রতিচিত্র যেন 'দিনান্ত' কবিতায় ভাস্বর। নিসর্গের প্রতিচ্ছবি তিনি নিখুঁতভাবে চিত্রন করেছেন শব্দ দক্ষতায়।


কবি অশোক বিজয় ছিলেন বৈষ্ণব ভাবনার অনুগত। তাঁর পিতা-মাতা দুজনেই ছিলেন শ্রী চৈতন্যের ভাবশিষ্য ও বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। তবে পারিবারিক, আবহের কারণে নয়, বৈষ্ণব ভাবধারার প্রতি নিজেই অনুরক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর ব্যক্তি জীবনের সেই ভাবধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।


" আমি শুধু জানি এ জ্যোৎস্না রাতে

কত কচি ডালে ফুলের প্রসব-ব্যথা,

কুমারীর বুকে কত যন্ত্রণা নিয়ে

জন্ম নিতেছে প্রথম প্রেমের কুঁড়ি। "

 (চিঠি, ডিহাং নদীর বাঁকে) 


     কোমলে কঠোরে, তার কবিতা বিচিত্র-রূপীনী। অরণ্য হোক প্রকৃতিই হোক, কিংবা মানুষের প্রতিদিনের আনন্দ বেদনাই হোক, তাঁর লেখনীর যাদুস্পর্শে আমাদের পরিচিত জীব ও জগৎ এক অপরূপ সত্তায় রূপায়িত হয়েছে। অভিনব রূপকল্প নির্মাণে তাঁর সমকক্ষ কবি দুর্লভ।


অশোক বিজয় রাহার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০। 

সেগুলো হলো -

১). ডিহাং নদীর বাকে (১৯৪১), 

২).রুদ্র বসন্ত (১৯৪১), 

১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয় তিনটি কাব্যগ্রন্থ।

৩).জলডম্বরু পাহাড় (১৯৪৫), 

৪). রক্ত সন্ধ্যা (১৯৪৫), 

৫).শেষ চূড়া (১৯৪৫), 


৬).'উড়ো চিঠির মাঠ'(১৯৫১)., 

১৯৬১ সালে 

৭).'সেথা এই চৈত্রের শালবন'(১৯৬১).

 ১৯৮১ সালে দু'টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়

৮).'ঘণ্টা বাজে (১৯৮১)., 

৯).পর্দা সরে যায় (১৯৮১).

এবং ১৯৮৪ সালে 

১০).'অশোক বিজয় রাহার শ্রেষ্ঠ কবিতা' প্রকাশিত হয়।


             গদ্যও লিখেছেন তিনি। তাঁর লেখা প্রথম গদ্যগ্রন্থ 'বাণী শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ' ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। 'পত্রাষ্টক' প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি 'হিরণ কুমার বসু স্মারক বক্তৃতা' করেন। ভাষণটি একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্য সমালোচনা হিসেবে গ্রন্থভূক্ত হয়েছে। 'কবিতার শিল্পরূপ' নিবন্ধে কবি অশোক বিজয়ের কাব্যদর্শন ও কবি ভাবনা বিধৃত হয়ে আছে। কবিতার আঙ্গিক ও বৈচিত্রতা অশোক বিজয় রাহাকে রূপদক্ষ কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অনুভূতির সূক্ষè রূপায়ন তাঁর কবিতায় স্বার্থভাবে বিধৃত হয়েছে। জীবনের প্রয়োজনে তিনি বিভিন্নস্থানে অবস্থান করলেও তাঁর কবিতার শিল্পরূপ ছিল বর্তমান।


" একদিন বহু আগে পৃথিবীর আদিম জঙ্গলে

উঠেছে প্রকান্ড সূর্য। দীর্ঘ এক অজগর-রাত

হঠাৎ উঠেছে ন'ড়ে পাকে-পাকে ছাড়ায়ে কুণ্ডলী

আঁকা-বাঁকা ছায়াপথে টেনে তা'র বিসর্পিল দেহ

লুকায়েছে পশ্চিম-সাগরে।


এদিকে সকাল বেলা

সবুজ বনের শাখা পাখিদের কোলাহলে ভরা,

নানা আলোছায়া থেকে বেরিয়েছে হরিণের দল-

বিচিত্র রঙের রামধনু, মাটির ঘাসের বুকে

উড়েছে অসংখ্য প্রজাপতি; ফুটন্ত ফুলের ডালে

ভ্রমরেরা জুড়েছে গুঞ্জন।


তবু এ-সবের ফাকে

ক্ষণে ক্ষণে আতঙ্কিত ত্রাস, -ওদিকে পাহাড় ভেঙ্গে ছুটেছে

উন্মুক্ত হ'য়ে খড়গনামা প্রকাণ্ড গণ্ডার,

খাগের বনের ধারে চকচকে বাঘ-চাটা জল

হঠাৎ উঠেছে জ্ব'লে ঝকঝক আয়নার মতো।

একধারে নেমে আসে হুড়মুড় মহিষের পাল

লাল-চোখ অদ্ভুত মাতাল, -সহসা বিছুটি বনে

এস্তপায়ে লুকায় গোসাপ, -দূরের জঙ্গল থেকে

বার দুই শোনা যায় চিতার করাত-চেরা ডাক। "

(চিরজীবী, শোষ-চূড়া) 


                তাঁর শৈশব কাটে সিলেট কাছাড়ের বিভিন্ন জায়গায়। ফলে তাঁর কবিতা চিত্রবহুল।

             নদী, পাহাড়, অরণ্যের প্রকৃতি শুধু তাঁর কবিতার পরিবেশমাত্র নয়, তাঁর কেন্দ্রভূমি । স্বল্পবাক, বর্ণাঢ্য চিত্র তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট ।

          প্রকৃতি ও জীবজন্তুকে এক সুতোয় গেয়েছেন তিনি কবিতায়। দীর্ঘ পংক্তিমালায় কল্পনা এবং বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন ভিন্নধারার।

             অশোক বিজয় রাহার কবিতা পর্যালোচনা করলে অপূর্ব শিল্প দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। মানব মনের বিচিত্র অনুভূতি তাঁর কাব্যে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতা হিন্দি, ইংরেজি, ফরাসি ও স্পেনিশ ভাষায় অনুদিত হয়েছে। অন্নদাশঙ্করের জীবনসঙ্গিনী লীলা রায় অনুদিত তাঁর কবিতার অনুবাদ Enchanted tree বহুল প্রশংসিত।

                সজনীকান্ত দাসের শনিবারের চিঠিতে তাঁর 'ভানুমতীর মাঠ' কাব্যগ্রন্থের ভূয়সী প্রসংশা করা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁকে তরুণ চাঁদ বলে অভিহিত করে লিখেছিলেনঃ-


"আকাশের চেয়ে আলোক বড়,/

মাগিল যবে তরুণ চাঁদ/

রবির কর শীতল হয়ে/

করিল তারে আশির্বাদ ।" 

(সৌজন্যে - মিলন সাগর)। 


                 কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল। বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকা বের করলে এর প্রতি সংখ্যায় তিনি লিখেছেন। An Acre of green grass গ্রন্থে বুদ্ধদেব বসু অশোক বিজয় রাহার কবিতাকে Cooldewy Lyrics বলে অভিহিত করেছেন। কবি বিশ্বভারতীকে যোগদান করলে বুদ্ধদেব বসু লিখেন 'ভগবান তাঁকে নির্মল রাখতে চান বলেই শান্তি নিকেতনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।' অশোক বিজয় রাহার বন্ধুভাগ্য খুবই ভালো ছিল। অকালপ্রয়াত কবি প্রজেশ কুমার রায়- কবি অশোক বিজয় রাহাকে তাঁর 'যাত্রারম্ভ' কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেন। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কবি বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেন। 

বিশ্বভারতীকে জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করার কারণে অবসর গ্রহণের পরও শান্তি নিকেতনের সকল কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন তিনি। অশোক বিজয় রাহা শান্তি নিকেতনে ১৯৯০ সালের ১৯ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

           তাঁর প্রথম দু'টি কাব্যগ্রন্থ "ডিহাং নদীর বাঁকে" এবং "রুদ্রবসন্ত" সিলেট থেকেই প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে । 

     তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে।,  "ভানুমতীর মাঠ" (১৯৪২), "জলডম্বরু পাহাড়" (১৯৪৫), "রক্তসন্ধ্যা" (১৯৪৫) ।   

             বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত হবার  পর প্রকাশিত হয়  "উড়োচিঠির ঝাঁক" (১৯৫১), "যেথা এই চৈত্রের শালবন",  "ঘন্টা বাজে! পর্দা সরে যায়" এবং "পৌষ ফসল"। 


              ইংরেজি, ফরাসি ও স্পেনীয় ভাষাতে তাঁর বহু কবিতা অনুদিত হয়েছে। লীলা রায় তাঁর ' মায়াতরু'  কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন Enchanted Tree নামে । 


মায়াতরু

------------

" এক যে ছিল গাছ

সন্ধে হলেই দুহাত তুলে

জুড়ত ভূতের নাচ।


আবার হঠাৎ কখন

বনের মাথায় চাঁদ উঠত যখন

ভালুক হয়ে ঘাড় ফুলিয়ে করত সে গরগর


বৃষ্টি হলেই আসত আবার কম্প দিয়ে জ্বর

এক পশলার শেষে 

আবার যখন চাঁদ উঠত হেসে

কোথায় বা সেই ভালুক গেল

কোথায় বা সেই গাছ?

মুকুট হয়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ হীরার মাছ

ভোর বেলাকার আবছায়াতে কান্ড হতো কী যে

ভেবে পাইনে নিজে।


সকাল হলো যেই

একটিও মাছ নেই

কেবল দেখি পড়ে আছে ঝিকির মিকির আলোর

রূপালী এক ঝালর। "


Enchanted Tree

---------------------------


The one that was the tree

Raise both hands in the evening

Joining ghost dance.


When again suddenly

When the moon rose at the head of the forest

He used to swell his neck like a bear


When it rained, the fever would come again with tremors

At the end of one posh

Laugh again when the moon rises

Where did that bear go?

Where is that tree?

Millions of diamond fish have become crowns

That is what happens in the morning mist

Think of it yourself.


It's morning

Not a single fish

I just saw glistening light falling

A silver fringe.


রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর অন্তরঙ্গ আলোচনা গ্রন্থ 'রবীন্দ্র জিজ্ঞাসা' দুটি খন্ডে পাওয়া যায়।


     এখানে তাঁর সিলেট যুগের বই "রুদ্রবসন্ত" কাব্যগ্রন্থের এই কবিতা দুটি এখানে তুলে দিলাম পাঠকদের জন্য।


একটি সন্ধ্যা

-------------------

    

" বেতারে কার সেতার বাজে, বাংলা খবর শেষ,

শুনে শুনে পথ দিয়ে যাই, মনে সুরের রেশ,

মফস্বলের শহরতলি খানিকটা বন –ঘেঁষা,

ঝোপে ঝাড়ে সন্ধ্যা নামে বুনো গন্ধে মেশা,

বাঁকের মোড়েই হঠাৎ আসে রাঙা মাটির টিলা

ওর পিছনে উঁকি মারে পাহাড়টা একশিলা,

শেয়াল-ডাকা রাত্রি আসে যেই আসি ওর কাছে,

বাদুরগুলো ঝাপটা মারে কাক-ডুমুরের গাছে,

মাথার উপর ডাকল পেঁচা, চমকে উঠি—আরে!

আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে! "


শীত-রাত

-----------------


" গ্রাম-বুড়ী কাঁথামুড়ি খড়ের ধোঁয়ায়

নাক ডেকে ঘাড় গুঁজে বেজায় ঘুমায়,

পথঘাট ঘুমে কাঠ, কোথা নেই সাড়া,


এক পায়ে ঘুম যায় গাছপালা খাড়া,

ঝোপে ঝোপে শেয়ালেরা সব চুপচাপ,

শিশিরের ফোঁটাগুলি ঝরে টুপটাপ,

ইঁদুরের বাদুড়ের নেই খুট্খাট,

একধারে শুয়ে আছে ধান-কাটা মাঠ।


বটগাছে কেঁদে ওঠে শকুনের ছা

জেগে উঠে পাখসাট মারে তার মা,

একা একা কুয়াশায় এই শীত-রাতে

কানা চাঁদ ভাঙা এক লণ্ঠন হাতে

আদম পুরের দিকে চালিয়েছে পা। "


আর এই 'চিত্রলেখা' কবিতাটি তাঁর পরবর্তী কালে শান্তিনিকেতনে থাকার সময়ে লেখা।


চিত্রলেখা

-------------------


" জানে ঐ ছোটো ঠোঁট দুটি

পৃথিবী প্রকান্ড এক সূর্য-সেঁকা রুটি

সারাদিন চলে তাই খুঁটে খুঁটে খাওয়া,

ফাঁকে-ফাঁকে ঘাড় তুলে চাওয়া

গায়ে মাখা হাওয়া

এর কাছে ওর কাছে যাওয়া

কিছুক্ষণ তারস্বরে গাওয়া।


এই শুধু চলে দিনভর

তারপর

সন্ধ্যা হলে চুপি-চুপি ফিরে যাওয়া ঘর

ডালের উপর

খড়ের বাসায় ঢুকে শুয়ে নিঝ্ঝুম

ঘাড় গুঁজে ঘুম।


গাছের সারির পিছে চুপি-চুপি কখন এখানে

এসেছে শবরী উষা,দাঁড়ায়েছে বনের আড়ালে,

পরেছে বিশাল খোঁপা, সদ্যফোটা রক্তজবা কানে

বুকের কাচুলিখানি বিঁধে আছে মহুয়ার ডালে।


ছিন্নমস্তা পৃথিবীকে দেখি

এখানে মাঠের একধারে

রক্তাক্ত চিৎকারে

পৃথিবীর আত্মহত্যা এ কি?


চারিদিকে ধসা মাঠ,কাঁকরের স্তুপ

কালের বিদ্রূপ

তারি এক পাশে

শেষ-সূর্য একবার জ্বলে ওঠে পশ্চিম আকাশে


তীর-বেঁধা রক্তসন্ধ্যা স্রস্ত এলোচুলে

খ'সে পড়ে দিগন্তের মূলে।


দিনশেষে এইখানে

পৃথিবীর মৃত্যুর শ্মশানে

খোয়াই আমাকে রোজ টানে।

মনে হয় সারাদিন দাঁড় বেয়ে চলেছি উজানে

সেই ভোর থেকে

দুই তীরে দেখে-দেখে

কত ঘাসে-ঢাকা জমি,কত ঝাউঝাড়

উঁচু-নিচু পাড়

কত পথঘাট

ধান-ভরা মাঠ

সারি-সারি ঘরবাড়ি

কত যে বিচিত্র নরনারী।


তারপর

দিনশেষে কমে আসে জোয়ারের জোর

পড়ে যায় হাওয়া

থেমে যায় বাওয়া

আবার ভাটার টানে

ফিরে আসি রোজ এইখানে।


এই সকালের বুকে একটি সোনার তার বাঁধা

রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে সাধা।

দিনের আলোর সাথে বীণার মতন

বেজে ওঠে শান্তিনিকেতন

চারিদিকে তার

জেহে ওঠে গাছপালা,পাখির ঝংকার

পথে পথে কাঁপে সেই সুর

বিচিত্র মধুর।


চমকায় সোনালি রোদ্দুর

ডাল-ডালে কচিপাতা হাসে

প্রজাপতি খেলা করে ঘাসে

মুখে-চুলে আলো মেখে ছুটে আসে ছেলেমেয়েদল

পুলক-চঞ্চল। "


------------------------------------------------------

ঋণস্বীকার - অপূর্ব শর্মা, মুকুল গুহ।




             



মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩