সাব্বিরের হাসি ও রুপনার মনোদহন
সৌমেন দেবনাথ
দীর্ঘয়ী রুপনার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী। এই প্রথম রুপনাদের বাড়ি এসেছে। রুপনার স্বামীর সাথে লম্বা সময় আলাপ করেছে। রুপনাকে আলাদা করে ডেকে বললো, তোর স্বামী বড্ড মিষ্টি আর মিশুক একটা মানুষ। কিন্তু প্রতি কথার শুরুতে হাসে। দিলে গিয়ে লাগে। ওভাবে আর অত বেশি হাসতে মানা করবি, যার তার স্বপ্নে গিয়ে বাসা বাঁধবে তো!
রুপনা কথাটি সিরিয়াসভাবে না নিয়ে বললো, প্রাণবন্ত একটা মানুষ। ভীষণ ভাগ্যবতী ভাবি নিজেকে।
দীর্ঘয়ী বললো, কি মিষ্টি হাসি! আহা, যদি কেনা যেত! এক মুষ্টি কিনে নিতাম! যতটুকু দুঃখ আছে, তা আর থাকতো না।
রুপনা শুনে বললো, চোখের জল, মুখের হাসি কেনাবেচা করা যায় না।
দীর্ঘয়ী চোখের পাতা নাচিয়ে বললো, অত মোহমুগ্ধ হাসি ভালোও না। যে কেউ তার প্রেমে পড়ে যাবে। অতি আবেগপ্রবণ যারা, তারা হাসির প্রেমে পড়ে, তুই তো বাস্তববাদী বুঝতে পারছিস না।
কথাটি শুনে রুপনার খারাপ লাগলেও খারাপ লাগা প্রকাশ করলো না। ওদিন বিকালেই দীর্ঘয়ী চলে গেলো। রুপনা সাব্বিরের হাসি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে থাকলো। একটা মানুষ হাসবে, তার হাসি কি কাড়া যায়! একটা মানুষকে কি হাসতে মানা করা যায়! যে মানুষটা হৃদস্পন্দনেই বাস করে, আলাদা শব্দ দিয়ে যাকে বর্ণনার প্রয়োজন পড়ে না, তাকে হাসতে সে মানা করে কি করে? একটা মানুষ হাসবে, যার হাসি দেখলে নিজেরও ভালো লাগে, তার হাসির জোয়ারে কেন সে বাঁধ দেবে?
এভাবে চলতে থাকে, দিন আসে দিন যায়। মিল যাদের মনে মনে, কিছুতে কিছু ঘটলে অভিমানও তাদের মধ্যে এসে জটলা করে। আর সে সময়ও সাব্বির হেসে দিয়ে পরিবেশ হালকা করে ফেলে। রেগে গিয়েও হেরে যায় রুপনা। অভিমান করে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, তার একটায় কারণ সাব্বিরের ঠোঁটের মৃদু হাসি। অভিমান করলে কি দারুণ কৌশলে রুপনার অভিমান ভাঙায় সে। অভিমান সব সময় ভালো, যদি অভিমান বোঝার মতো একটা মানুষ থাকে কাছে। একে অপরের জন্য মনের মধ্যে মায়া না থাকলে, ভালোবাসা না থাকলে অভিমান আসে না, একে অপরের জন্য অনন্য অনুভূতি মনের অলিন্দে খেলা করে না। একসাথে থাকতে গেলে বাসাটা রাজকীয় লাগে না, দুটো মানুষের চাওয়া-পাওয়া এক প্রবাহে চললেই চলে। বুঝতে জানা মানুষের সাথে বসবাস করলে অভাব আধিপত্যতা পায় না। একে অপরের জন্য হৃদয়ের টান থাকলে বৈষয়িক আলাপ-যুদ্ধ স্থান পায় না। ভালোবাসার মানুষের সাথে সর্বত্রই ভালো থাকা যায়, হোক সে প্রাসাদের সর্বোচ্চ চূড়া বা জলাভূমির ধারের কুঁড়েঘর।
প্রিয় মানুষটা সাথে থাকলে আর তেমন কিছুর প্রয়োজনই পড়ে না৷ যত্ন করার একটা মানুষ পাশে পাশে থাকলে বাড়তি কোন প্রাপ্তির প্রয়োজন পড়ে না। যত্ন করার মানুষটাকে তাই রুপনা আগলে রেখে দেয়।
প্রায়শই রুপনাকে নিয়ে সাব্বির বাইরে ঘুরতে যায়। পরিচিত মানুষ দেখলেই সাব্বির হেসে কথা বিনিময় করে। এসব সৌজন্যতা দেখলে আগে সাব্বিরের প্রতি বিগলিত হতো সে৷ এখন ভাবে, যার তার জন্য হাসি ও দেবে কেন? হাসিকেও সস্তা করে তোলা দুর্বলদের লক্ষণ! সবার জন্য যেমন হাসে, আমার জন্যও তেমন হাসে৷ আমার জন্য হাসি যে সে দেয়, তাতে তো নেই অনুরাগ! তাতে তো নেই ভালোবাসা। এভারেজ হাসি, তাতে আমি মুগ্ধ হয়ে তবে তো ঠকি!
মুখে উচ্চারণ করে বলে, সবাইকে দেখেই হাসো। শত্রুকে দেখেও হাসো। প্রতিযোগিকে দেখেও হাসো। প্রতিপক্ষকে দেখেও হাসো। এসব তো জীবনে না উন্নতি করার লক্ষণ! গম্ভীর হতে জানো না। গাম্ভীর্যতা নেই। তুমি তো সবার কাছে হালকা হয়ে যাচ্ছো!
সাব্বির শুনে আবার হাসে আর বলে, হাসতে হবে, হাসতে জানতে হবে। হাসলে মানুষের কাছে হালকা হয়ে গেলেও ভালো, কারণ হাসি দিলে হৃদয় ভার কমে। কষ্ট বুকে চেপে গুমড়ে মরার চেয়ে হেসে হেসে হালকা থাকা শ্রেয়।
রুপনা কথা বাড়ায় না। হাস্যোজ্জ্বল মানুষটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হাজার হাজার মানুষের মাঝে ভরসা করার মতো মানুষটি আছে তার। অবিশ্বাসীদের ভীড়ে বিশ্বাস করার মতো একটা মানুষ আছে তার। সুদর্শন মানুষ না, তার পাশে একজন দায়িত্বসম্পন্ন মানুষ আছে। তাকে বোঝার আর তাকে জানার মতো একটা মানুষ আছে তার। তার তাই আর অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। লোকের ভালোবাসা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে, নিজেও যে এমন একটা ভালোবাসার মানুষ পাবে কখনো ভাবতেও পারেনি। লোকের ভালোবাসা দেখে দেখে এখন আর তার চোখ জুড়ানো লাগে না, নিজেই ভালোবাসায় ভাসছে।
যখন যেদিকেই যাক বাড়িতে ফিরলেই রুপনার দিকে তাকিয়ে আগে একটা হাসি দেবে তারপর কথা বলবে সাব্বির। হাসি দিয়ে কথা বলা শুরু করা এটা সাব্বিরের অভ্যাস, যাকে রুপনা ইনাদীং বলছে বদাভ্যাস। মানুষ স্বার্থ হাসিলের জন্য হাসি দিয়ে কথা শুরু করে, অন্য ক্ষেত্রে কিন্তু তা করে না। কিন্তু সাব্বিরের হাসি দেওয়ার পিছনে কোন কারণ থাকে না। পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে সালাম দিয়েই হাসির ফোয়ারা ছিটিয়ে তারপর কথা বলবে। এই হাসতে জানা মানুষটার সাথে কথা বলে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। তাকে নানা কারণে অপছন্দ করা মানুষটাও কথা বন্ধ রাখতে পারে না।
সংসারে সারাদিন কাজ করা ক্লান্ত রুপনা সাব্বিরের এমন হাসি দেখে হেসে দিত প্রথম প্রথম। খুব ভালো লাগত তার স্বামীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখলেই। দিন শেষের ক্লান্তি, মনের অবসাদ হাসি মুখের মিষ্টি কথায় বিলীন হয়ে যেত। একটি হাসি মুখ একটি ওষুধের ভাণ্ডার। মন ভালো রাখার কারখানা। এমন হাস্যোজ্জ্বল একটি মানুষের সঙ্গে থাকতে পারাও সৌভাগ্য। চারিদিকে চিন্তিত মানুষের মুখ বেশি। গোমড়ামুখো মানুষের সংখ্যা বেশি সমাজে। হাসতে জানা মানুষ নেই বললেই চলে। কিন্তু এই কারণ ছাড়া হেসে দেওয়াটা ইদানিং রুপনার ভালো লাগে না। অবসাদে মেঘাচ্ছন্ন মনের সামনে হঠাৎ হাসতে দেখা মানুষকে বিরক্তিকর লাগে। আবার হাসতে তাকে মানাও করতে পারে না। হাসি কি আর মানা করলে বন্ধ হয়?
জোড়া তালির জোড় জীবন চলতে থাকে। জীবনটা সুন্দর যদি অভাব-অনটনের মধ্যেও অনুভূতিটাকে টিকিয়ে রাখা যায়। যেভাবে মানুষ চলতে চায়, বাস্তবতার কষাঘাত তাকে সেভাবে চলতে দেয় না। মন যেটা আশা করে মন সেটা পাবে না, এটা বুঝতে পারা আত্মা সন্তুষ্টির খোঁজ পায়। এই অপ্রাপ্তির বিষয়াদিকে বড় করে দেখে একে অপরকে দোষারোপ করলে শান্তি দূরে চলে যায়। যা আছে তা দিয়ে জীবন উপভোগ করলেই জীবনটা সুন্দর হয়ে যায়। সাব্বির-রুপনার জীবনও চলে যাচ্ছে সুখে-দুখে। সাব্বিরের কোন অভিযোগ বা অনুযোগ নেই রুপনাকে নিয়ে, রুপনারও কোন ক্ষোভ ছিলো না সাব্বিরকে নিয়ে। তবে ইদানীং সাব্বিরের এই হাসি দেওয়াটা তার আর সহ্য হচ্ছে না। হাসির মতো সুন্দর জিনিস নেই, তাও যে কখনো কখনো মানুষের সহ্যের বাইরে চলে যায় রুপনার ক্ষেত্রে তা সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। একদিন রুপনা বলেই ফেললো, তুমি তো আর বাচ্চা শিশু নও। কারণ থাকলে হাসবে। অকারণেও হাসো কেন?
কথাটি শুনতেই সাব্বিরের মুখটা নিষ্প্রভ হয়ে গেলো। এমন কথা শুনবে ভাবতে পারিনি। সদা হাসি মুখ থেকে হাসি চলে গেলে খুব মলিন লাগে। কিছু না বলে কর্মক্ষেত্রে চলে গেলো। কর্মক্ষেত্রেও মন বসছে না। রুপনা তার হাসি নিয়ে প্রশ্ন করেছে, মনের মধ্যে শুধু ঐ কথায় ঘুরে ফিরে বাজছে। কেউ কখনো তার হাসি মুখে থাকায় বিরক্ত হয়নি, রুপনা হবে কেন! সে কখনো সশব্দে হাসে না, ঠোঁটে হাসে। সশব্দের হাসিতে না হয় বিরক্তির কারণ থাকে। এসব প্রশ্ন মনের মধ্যে গোলমাল পাকাচ্ছে। অনেক বেশি আশা-ভরসা যাকে ঘিরে থাকে তার মুখ থেকে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত কথা শুনলে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। জোর করে বাঁধ দিয়ে নদীর চলন থামানো গেলেও হাসি কি থামানো যায়? বাড়ি এসেই হেসে দিলো৷ ওমনি রুপনা বললো, মনের মধ্যে খুব সুখ? হাসি দেখে মনে হচ্ছে প্রমোশন নিয়ে ঘরে ঢুকেছো! ডায়মন্ডের হার এনে লুকিয়ে রেখেছো? এত হাসি কোথা থেকে আসে? অভিনয় করো?
মুখটা বিষণ্নে ভরে গেলো এসব কথা শুনে সাব্বিরের৷ যার মন রাঙানোর জন্য হাসে সে সেই মন রক্তাক্ত করে দিলো। হাসির চেয়ে সুন্দর উপহার আর কি আছে! সাব্বির আরো সতর্ক হয়ে গেলো। হাসিতে যে মুগ্ধতা ছিলো তার শেষ হয়েছে। বাস্তবতা কঠিন, শুধু হাসি দিয়ে কাউকে খুশী করে রাখা যায় না।
বাড়ি এলে নিজেকে সামলে রাখে। হাসি যেন অযথা বের না হয়। মায়ের সাথে কথা বলার সময় না হেসে পারে না। হাসি হাসি কথা বলা দূর থেকে দেখে রুপনা রাগে ফোঁসে। ঘরে এলো। রুপনা কোন কথা বলছে না। কাজ করছে, ঘর-বাইর যাচ্ছে, কিন্তু কথা বলছে না। ভালোবাসার মানুষটা কথা বলছে না, খুব খারাপ লাগছে সাব্বিরের। রুপনাকে থামিয়ে দুই কাঁধে দুই হাত রেখে সাব্বির বললো, আমার হাসিই তো তোমার না খুশীর কারণ! হাসবো না।
বলেই রুপনার চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। রুপনার প্রচণ্ড রাগ হলো, বললো, আমাকে দেখলেই হাসো! আমি কি তোমার হাসির খোরাক?
সাব্বির নিষ্পলকে চেয়ে থাকলো কথাটি শুনে। ভীষণ খারাপ লাগলো আজ তার। অথচ এই রুপনা সাব্বিরের কথা শুনবে বলে অধীর হয়ে থাকতো। হাসি মুখটা দেখবে বলে পথ চেয়ে থাকতো। আর বলতো, তোমার মতো একজন মানুষ জীবনে আসবে বলে আমি কত না স্বপ্ন দেখেছি। তোমার মতো একটা ভালোবাসার মানুষ পেয়েছি, আমার রাজপ্রাসাদের প্রয়োজন নেই। তোমার মতো ভরসা করার একটা মানুষ জীবনে খুব প্রয়োজন ছিলো।
কথা শুনে প্রাপ্তির ঝর্ণাধারায় স্নাত হতো সাব্বির। একটা মানুষ তাকে কত বেশি আপন করে নিয়েছে জানতে পেরে মনের মধ্যে খুশীর জোয়ার বয়ে যায়। নিজেকে পৃথিবীর সেরা ধনী মনে করতো। কারো স্বপ্নের মতো সে এটা জেনে তার ভীষণ ভালো লাগতো। প্রিয় মানুষটার জীবনে যে সে সৌভাগ্য এটা জানতে পারাও অনন্য প্রাপ্তি ছিলো। তাই বলতো, রুপনা তুমি আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছো। আমার বড্ড ভালো লাগে, আমার জীবনে তোমার মতো একটা তুমি আছো। আমার সুখের কারণ তুমি, আমার খুশীর কারণ তুমি। জীবন চলার পথে তোমার মতো একজন সহযাত্রীর প্রয়োজন ছিলো। আমি আমার জীবনের সঠিক মানুষটাকেই পেয়েছি।
সেই সাব্বিরই আজ বাড়ি এলে গোমড়া মুখে থাকতে বাধ্য হয়, হাসতে মানা। জীবন ছন্দে দ্বন্দ্ব এসেছে হাসির মতো পবিত্র জিনিসের কারণে। কিন্তু হাসি যার ঠোঁট থেকে ফুরাবার না তার হাসি কি কোন বাঁধ মানে? চুপচাপ সম্পর্কে আনন্দ থাকে না৷ তাই প্রথমেই প্রতিবার সাব্বির কথা বলে। নিজেরও রাগ আছে, প্রকাশ করে না, সম্পর্কে যেন দ্বন্দ্ব স্থায়িত্ব না পায় তাই। প্রিয় মানুষের অনেক অপ্রিয়ও না দেখার ভান করতে হয় প্রিয় থাকার স্বার্থে। অনেক কিছু বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়, অনেক সময় হেরে জেতে হয়, ভেতর রক্তাক্ত হলেও উপরে প্রকাশ করতে হয় না। ভালোবাসার মানুষই তো ভালোবাসার মানুষের সাথে রাগ দেখাবে, ক্ষোভ প্রকাশ করবে, বকবে। রাগ, ক্ষোভ আর বকাবাজিই কি জেতে? ভালোবাসার মানুষের উপর অভিমানের স্তূপ থাকে, অভিযোগের বারতা থাকে। অভিমান, অভিযোগও তো জেতে না। তাই সাব্বির আগে আগেই কথা বলে রুপনার রাগ ভাঙায়, আজকাল সেটা আর পারছে না সে৷ আজকাল রাগ জিতে যাচ্ছে, হেরে যাচ্ছে ভালোবাসা। বেশি দূরে থাকে না তাই, কাছে কাছে থাকে। অযত্ন, অবহেলায় ভালোবাসার শরীরের মরিচা পড়ে। আজ বললো, আমার উপর রাগ আছে তোমার। আর তাই আমার হাসিকে দোষারোপ করছো। যার উপর অধিকার থাকে তার উপর রাগ করবেই। কয়েকটি দিন কথায় বলছো না। ক্রমাগত রাগ করেই যাচ্ছো, ক্রমাগত রাগ সম্পর্কের মাঝে আধিপত্য করছেই। ভালোবাসায় ডুবিয়ে, ভালোবাসায় রেখে, ভালোবাসায় থাকার লোভ দেখিয়ে এখন দূরে ঠেলছো কেন?
ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে রুপনার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করলো সাব্বির৷ ওমনি রুপনা বললো, তোমার হাসি সুন্দর না। তোমার বন্ধুরা কি কখনো একথা বলেছে? তোমার হাসির ভেতর তাচ্ছিল্য-তাচ্ছিল্য ভাব আছে। বিটলেমি বুদ্ধি যাদের মাথায় থাকে, তারা তোমার মতো করে হাসে৷ হাসিতে বদমাশি-বদমাশি ভাবও আছে। তোমার এই হাসি দেখলে আমার শরীরে জ্বালা দিয়ে উঠে।
এই কথা শুনে সাব্বির একেবারে থ। কল্পনাতেও ভাবেনি এমন কথা রুপনা বলবে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কেটে বাইরে চলে গেলো। নিজেকে ধিক্কৃত মনে করতে থাকলো ও। ওর হাসি দেখতে ভালো না, কেউ কখনো বলেনি৷ ওর গায়ের রং নিয়ে কথা বললে ও মেনে নিতে পারতো। ওর আয়-রোজগার নিয়ে কথা বললে ও মেনে নিতে পারতো। কিন্তু ওর হাসি রুপনার পছন্দ না এটা ও মেনে নিতে পারছে না। জীবন যেমন সুন্দর, তেমন অসুন্দরও। ভালোবাসার মানুষের মিষ্টি কথাতেই জীবন সুন্দর হয়ে যায়, তেমনি ভালোবাসার মানুষের তিক্ত কথাতে জীবন অসুন্দর হয়ে যায় মুহূর্তেই।
কাজে-কর্মে মন বসে না। হাসিটা জোর করেও ঠোঁটে জাগাতে পারে না। পাশের সহকর্মীদের সাথে হেসে কথা না বললে হয় না৷ তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসে সে। কিন্তু মন থেকে আসা হাসি আর জোর করে হাসির মধ্যে পার্থক্য থাকে। পাশে থাকার মানুষটায় যেহেতু তার হাসি পছন্দ করে না, তাই সে সংকল্প করলো বাড়ি ফিরলে আর হাসবে না।
এত সংকটের মধ্যে হাসতে জানা বড় কঠিন কাজ। সেই হাসিই সাব্বিরের ঠোঁটে-মুখে-চোখে সস্তা হয়ে ধরা দিতো। বাড়ি এলে আর হাসে না। রুপনা বললো, কাল অর্ণা আসবে।
সাব্বির বললো, ভালো তো।
রুপনা সাব্বিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, অর্ণা আসবে, আমার বোন। এখন তোমার মুখে হাসি নেই! আমার বোন আসবে, তুমি খুশী না?
সাব্বির পড়লো মসিবতে। চলে গেলো পাশ কেটে। যার কথা শোনার জন্য উতালা থাকতো তার কোন কথায় আর ভালো লাগে না, শুধু তীর্যক কথার কারণে। যার সান্নিধ্যে থাকার জন্য মন ব্যাকুল থাকতো এখন তার পাশ থেকে যেতে পারলেই ভালো লাগে শুধু তার ব্যবহারের কারণে। কথা মিষ্টি প্রথম প্রথম থাকে। পুরাতন হতে থাকলে তিতো হয়ে যায়। আর এটা যখনই প্রকট হয় তখন নিজেদের মাঝ থেকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কমতে থাকে আর অযত্ন, অবহেলার লতা বাড়তে থাকে।
চোখের সামনে দেখতে থাকা মানুষটাকে দেখতে দেখতে আর ভালো লাগে না। আর তখনই আসে মুখে অযাচিত কথা, অনাকাঙ্ক্ষিত কথা। অথচ পরিচিত মানুষটার সাথে প্রতিদিন চলতে চলতে প্রতিদিন নতুন করে চেনাটায় ছিলো আসল কাজ। পরিচিত হাত দুটিই প্রতিদিন নতুন করে ধরতে হয়, প্রতিদিনই নতুন করে শপথ করতে জানতে হয়। হারানোর ভয় থাকে না বলেই প্রিয় মানুষটাকে যাচ্ছেতাই বলা ঠিক না। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে জানতে হয়। মানসিক শান্তি প্রিয় মানুষের কাছ থেকে যদি না পাওয়া যায়, তবে শান্তির দেখা কি আর মেলে! যার কাঁধে মাথা রাখলে সুখ মেলে, তাকে কথার বাণে জর্জর করতে নেই।
সাব্বির যে আর আগের মতো হাসে না ব্যাপারটা রুপনার চোখে বাঁধলো। মুখটা গম্ভীর করে থাকে। প্রয়োজনের বাইরে ও আর কথা বলে না। তার কথাতে তার স্বামী কতটা ক্ষত হয়েছে বেশ পরেই সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এই রুপনায় সাব্বিরকে রাগ করতে দিতো না, রাগ করার সুযোগই দিতো না। কাছের মানুষকে কষ্ট দিলে নিজেরও কষ্ট লাগে। কাছের মানুষটিকে কষ্ট দিয়ে প্রশান্তি মেলে না। বাঁচতে হলে বিশ্বাসযোগ্য মানুষের খুব প্রয়োজন। বিশ্বাস করার মতো মানুষ পেলে অকারণে কষ্ট দেওয়া ঠিক না। রুপনা তাই সাব্বিরের কাছে এলো। এসে মাথা উঁচিয়ে নিষ্পলকে তাকালো। তারপর বললো, অনেক ভাগ্য না নিয়ে জন্মালে ভালো একটা জীবন সঙ্গী জোটে না। ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যেরও ব্যাপার। সেই সৌভাগ্যবতী হওয়া সত্ত্বেও আমি বুঝিনি। আর তাই কত ভাবে তোমায় আঘাত দিয়েছি।
কথাতে কর্ণপাত না করে সাব্বির চলে যাচ্ছিলো। মনে বিষণ্নতা, তাই শুকনো মুখেই সুখবরটা বলতে হলো। রুপনা বললো, তুমি মনে হয় বাবা হতে যাচ্ছো!
সাব্বির এমন একটা সুসংবাদ শুনবে প্রস্তুত ছিলো না। ফিরলো, অবাকদৃষ্টে রুপনাকে দেখলো, তারপর চলে গেলো। কিন্তু তার ঠোঁটে খুশীর কোন চিহ্ন দেখা গেলো না। হাসির নদীটা যেন শুকিয়ে গেছে৷
পরদিন ডাক্তারের কাছে গেলো। ডাক্তার চেকআপ করে ব্যবস্থাপত্র দিলেন। অলিখিত ব্যবস্থাপত্রের মধ্যে যেটি ছিলো সেটি হলো রুপনাকে হাসি-খুশী রাখতে হবে। কাউকে হাসি-খুশী রাখতে হলে নিজেকেও হাসি-খুশী থাকতে হয়। কিন্তু সাব্বির হাসে না৷ আমরা এমনই, পরমানুষ প্রচণ্ড কষ্ট দিলেও মেনে নিই, আপনজন সামান্য কষ্ট দিলেও সহ্য করি না। একটা খুশীর খবর, অথচ কেউ হাসে না। কারো মুখে হাসি নেই। হাসি যেন উবে গেছে কর্পূরের মতো। রুপনা বললো, বুঝি তো, দিন শেষে যার কাছে ফেরো তাকে আর ভালো লাগে না।
সাব্বির বললো, যে ব্যথা সহ্য করতে পারি না, সেই ব্যথায় দাও। যেদিন বুঝবে আমি তোমার ভিন্ন না, সেদিন এমন বাজে কথা উচ্চারণও করবে না।
তারপর রুপনাকে সাহায্য করতে থাকলো। হাত ধরে বেডে নিয়ে গেলো। বেডে উঠতে সাহায্য করলো। বালিশটা ঠিক করে দিয়ে ঘুমাতে বললো। কিন্তু মুখমণ্ডল জুড়ে নিষ্প্রভতা। রুপনা বললো, আমি না হয় তোমার হাসি কেড়েছি, কিন্তু আমি কি তোমার হাসির কিছুই বহন করছি না?
সাব্বির রুপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, কথা বলো না তো। ঘুমাও।
রুপনা আবারও বললো, তুমি বদলে গেছো। তুমি আর আগের মতো হবে না বোঝা শেষ। তুমি ক্ষমা করতে জানো না।
সাব্বির বললো, তোমাকে কখনোই অপরাধী করিনি। ভালোবাসার মানুষকে আমি কখনোই দোষ দেবো না। তুমি আমার জীবনের বড় পাওয়া। তোমাতেই আমার যত সুখের বার্তা। তুমি আক্ষেপ করো না। ঘুমাও।
রুপনা সাব্বিরের হাত ছাড়ে না, কথাও বলে না, ঘুমায়ও না। সাব্বির হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু রুপনা ছাড়ে না। তৎমুহূর্তে সাব্বির হেসে দিলো। রুপনা উঠে সাব্বিরের বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, তুমি হাসবে। আমার সামনে হাসবে। আমাকে দেখে হাসবে। আমাকে দেখলেই হাসবে। তোমার হাসি মুখটা না দেখলে আমি থাকতে পারবো না।
সাব্বির আবার একটু হেসে বললো, আমার হাসিতে যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাব থাকে৷
রুপনা বললো, না, থাকে না, রাগে বলেছিলাম। অন্যের কুমন্ত্রণা শুনেছিলাম। আমি বুঝেছি ভালোবাসার মানুষকে শত উপায়ে ভালোবাসতে হয়, কিন্তু এক বাক্যে বিশ্বাস করতে হয়। তোমার হাসির কারণে তুমি আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে কেন? তুমি যত মন চায় হাসবে, তোমার হাসি না দেখলে আমি প্রফুল্ল হবো কি করে?
এভাবে দুজন কথা বলতে থাকে। দুটি মন থেকে দূরত্ব চলে গেলো। অবিশ্বাসীদের ভীড়ে বিশ্বাসী মানুষকেও অবিশ্বাসী লাগে। আর তাই তৃতীয় পক্ষের কেউ মনের মধ্যে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলে সন্দেহটায় প্রবল রূপ নেয়। তখন সুখ-শান্তি চলে যায় দূরে, আর দুঃখ-কষ্ট আসে কাছে। নিজেদের ভুল নিজেরা ধরতে পারলে সম্পর্কের মধ্যে আবার সুবাতাস ফেরে। এরপর থেকে রুপনা অবাক হয়ে সাব্বিরের মুখের হাসি দেখে আর হাসি আটকে না রাখতে পেরে নিজেও হেসে দেয়।
===============================
সৌমেন দেবনাথ, ঝিকরগাছা, যশোর, বাংলাদেশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন