অশ্বমেধের ঘোড়া
জীবন পাইক
হন্তদন্ত হয়ে বছর দশের একটি ছেলে সন্ধ্যার প্রার্থনা সেরে হ্যারিকেনের কাঁচ সাবধান-তার সঙ্গে ছেঁড়া কাপড়ের একটি অংশ দিয়ে পরিষ্কার করছিল ৷একটু ভয়ে ভয়ে ও বটে৷
---কি রে এতক্ষন কি করছিলিস?
--আ-আমি-
--আমি-আমি কি-
কথাগুলো বেশ কড়া৷ভারি শাসনের বলতে হবে ৷বছর পনেরোর একটি ছেলের এ ধরনের একটি রাশ ভারি কথা ৷
--শোন ,তোকে না কতবার বলেছি ইস্কুলের ছুটি হলে খেলা ধূলা করিস ঠিক আছে ,প্রার্থনার আগে রুমে ঢুকতে হবে ৷হ্যারিকেন পরিষ্কার করে তেল ভরে তবে প্রার্থনায় যাস ৷প্রয়োজনে হ্যারিকেন জ্বেলে একে বারে নিভু নিভু করে রেখে যাস ৷তা নি হলে ফিরে এসে কত সময় নষ্ট হয় বলতো ৷তোকে কত বার বলেছি একটা মিনিট ও নষ্ট করা যায় না ৷প্রার্থনার পর প্রতি দিন একটানা পড়া অভ্যাস কর ৷পড়লে তবে তো ভালো রেজাল্ট হবে৷
ছোট ছেলেটা দাদার মুখের ওপর একটা ও জবাব দেয় নি ৷ না ছেলেটা ওর নিজের দাদা নয় ৷ খুড় তুতো,জাঠতুতো মামাতুতো এমন কোন দাদাই নয় ৷ওরা একই স্কুলের দুই ভিন্ন ক্লাসের একই হোস্টেলের একই রুমের দুই ছাত্র ৷প্রদীপ নাইনে পড়ে আর সুদীপ ক্লাস সিক্স ৷
একেবারে অজ পাড়া গাঁয়ের এক অনামি স্কুল ৷আজকের দিনের প্রাথমিক স্কুল গুলোর ও যে জৗলুষ আছে ৷তেমন পারিপাট্য রং চং কিছুই ছিল ন সে স্কুলে ৷একটা বিরাট লম্বা ইটের হল ঘর মাথা বোঝাই টালি নিয়ে যেন ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷দশ থেকে বারো জন মাস্টার মশাই নিয়ে চলত হেড মাস্টার মশাইয়ের লড়াই ৷
স্কুলের দক্ষিণ দিকে ঠিক একই ধাঁচের আর একটি লম্বা হল ঘর ৷এটিই ছিল ছাত্রদের হোস্টেল ৷এখানকার কড়া শাসন সকাল সন্ধ্যায় সবাইকে প্রার্থনায় উপস্থিত থাকা অত্যন্ত বাধ্যতা -মূলক৷ আর এখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়াটা বেশ কঠিন ৷প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হয় ৷
সুদীপের বাবা ভীষণ গরীব ৷বিঘে দু-তিন জায়গা৷ দিন মজুরি করে কোন ভাবে চলে তাদের সংসার ৷প্রদীপের বাড়ি পাশের গ্রামে ৷বাড়ির আর্থিক অবস্থা তাদের ও শোচনীয় ৷
নীরবে সুদীপ হ্যারিকেন জ্বেলে পড়ায় মনোনিবেশ করে ৷প্রদীপ বলে ,ভাই অংক ইংরাজি কে অবহেলা করিস না ৷সব বিষয়ের পাশাপাশি এই দুই বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিস ৷দেখবি এরা ঠিক তোর জীবন গড়ে দেবে ৷
এমন ভারি ভারি কথা বলতে বলতে প্রদীপ বেরিয়ে যায় ৷
বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয় ৷অফিস রুমে অঙ্কের মাস্টার মশাই শ্যামলবাবু ইংরেজির মাস্টার মশাই নিরঞ্জন বাবুকে বললেন এ বছর একটা তাজ্জব ঘটনা ঘটেছে সিক্সের ক্লাসে ৷এক অশ্বমেধের ঘোড়া দুরন্ত গতিতে ছুটছে ৷নিরঞ্জন বাবু নাইন টেনে ইংরাজি পড়ান ৷প্রভিশনাল পিরিয়ডে কখনো সখনো সিক্সের রুমে আসেন ৷তাই ক্লাস সিক্সে কি ঘটনা থাকতে পারে তা তাঁর জানা সম্ভব নয় ৷
শ্যামল বাবু বলেন--স্কুলে এ যাবৎ এমন ঘটনা ঘটে নি ৷সিক্সে সুদীপ হালদার ,যার রোল ছিল তেইশ ৷সেভেনে তার নতুন রোল হতে যাচ্ছে--
---কত?
---তিন৷
---মানে?
---সুদীপ থার্ড পজিশন পেল ৷
---বলেন কি?
----সেটাই তো বলছি ৷যার মনের মধ্যে ভালো পজিশনের এক বার খিদে তৈরি হয়ে যায় ,সে ছেলেকে কেউ কোন দিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ৷
অঙ্কের মাস্টার মশাইয়ের কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল ৷ সপ্তম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান,অষ্টম শ্রেণিতে দ্বিতীয় ৷মারাত্মক জেদ আর পড়াশোনার জন্য পরবর্তী সময়ে প্রথম স্থান দখল করে ৷আজ ও সর্ব ভারতীয় নীটে পাশ করে মেডিকেল অফিসার ৷
ভাবতে গেলে বড়ো বিস্ময় লাগে৷ প্রাইমারি স্কুলে ছেলেটা কিই না দূর্বল ছিল ৷তৃতীয় শ্রেণিতে বই পর্যন্ত ও পড়তে পারতো না ৷চতুর্থ শ্রেণিতে দু দু বছর ফেল ৷বিরক্ত হয়ে হেড মাস্টার মশাই বললেন,এ ভাবে বছরের পর বছর আমি রাখতে পারব না ৷ ও হাই স্কুলে গিয়ে পড়ে পড়বে৷ পড়া ছাড়ে ছাড়বে৷ যা খুশি করুক ৷
ভাঙা মন নিয়ে হাই স্কুলের আঙিনায় পা দিতেই প্রদীপ বলেছিল ৷
কোন কিছুতেই ভয় পাবি না ভাই৷ সাহস আর সদিচ্ছার জোরে অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো ছুটতে হবে ৷ জীবনটা থেমে থাকার নয় ৷ মুখ বন্ধ কাঁচের বোতল ঘরের কোনে ফেলে রাখলে কখনো তার ছিপি খুলবে না ৷ ছিপি খুলতে গেলে বোতলের মুখে বার বার আঘাত করতে হয় ৷তোমাকে বার বার ব্রেইনের দরজায় কড়া নাড়তে হলে দিন রাত বইকে বন্ধু করে নিতে হবে ৷ প্রদীপের আলোয় সে দিন জ্বলে উঠেছিল সুদীপের ভিতরের আগুন ৷আর তাকে পিছনে ফিরতে হয় নি ৷ সে এখন অশ্বমেধের ঘোড়া ৷
===========================
জীবন পাইক, সুভাষগ্রাম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন