ট্রেকিং
সিদ্ধার্থ সিংহ
নামলে নামুক। কী আর করা যাবে! ও আর পারছে না। এ বার একটু বসতেই হবে। কিন্তু কোথায় বসবে? বসার জন্য যেই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, ঠিক তখনই ও দেখল, একটা ষোলো-সতেরো বছরের তন্বী মেয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তরতর করে নেমে আসছে।
সমতল থেকে ছ'হাজার ফুট উঁচুতে এসে, চোপতা থেকে পাহাড়ের এই খাড়া পথ বেয়ে সেই যে হাঁটা শুরু হয়েছে, রোহিতাশ্ব শুধু হেঁটেই যাচ্ছে। এত হেঁটেছে যে, পা আর চলছে না। পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতেই যেন জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে। গায়েও আর এতটুকু জোর নেই। এই দিনের বেলাতেও চোখের সামনে হঠাৎ হঠাৎ নেমে আসছে অন্ধকার। মাথাটাও টিপ টিপ করছে। মনে হচ্ছে, ও আর এক পা-ও হাঁটতে পারবে না। যে কোনও সময় মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে।
না, এ বার একটু না বসলেই নয়। তার গাইড এবং সঙ্গীরা কে কোথায় আছে ও জানে না। জানতেও চায় না। পরবর্তী ক্যাম্পে পৌঁছতে আরও কতক্ষণ লাগবে, তার কোনও ধারণাও নেই ওর। ও নিশ্চয়ই অন্যদের থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে, তার পরেও ও যদি এখানে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামে, তা হলে পরবর্তী ক্যাম্পে পৌঁছনোর অনেক আগেই হয়তো অন্ধকার নেমে আসবে।
পথের মাঝে ভিনরাজ্যের অচেনা-অজানা একটা লোককে ও রকম ক্লান্ত-অবসন্ন দেখেই বুঝি মেয়েটি তার কাছে এগিয়ে এল। কোঁচড় থেকে চেরিফলের মতো দেখতে এক মুঠো রা' ফল তার দিকে বাড়িয়ে দিল। ও জানে, এগুলোকে কেউ পার্বতী ফলও বলে। কিন্তু ও জানে না, ওগুলো খায়, না গায়ে মাখে। তাই মেয়েটির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কারণ ও জানে, মেয়েটিকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও মেয়েটি তার ভাষা বুঝতে পারবে না। যদি বোঝেও, তার জবাবে সে যা বলবে, ও সেটা বুঝতে পারবে না।
কিন্তু কয়েক মুহূর্ত মাত্র। মেয়েটি বোধহয় তার ও রকম চাহনি দেখেই বুঝতে পেরেছে রোহিতাশ্বর মনের কথা। তাই সে আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, এটা চুষে চুষে খাও। বলেই, মেয়েটি পাহাড়ের কোন বাঁকে যেন হঠাৎ করে মিলিয়ে গেল। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওই ফলগুলো মুখে দিয়ে একটু চুষতেই ওর শরীরটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। মনে হল, রওনা হওয়ার সময় ওর শরীরে এবং মনে যতটা জোর ছিল, এখন যেন তার থেকেও দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
শুধু চন্দ্রশিলা কেন, ও এখন ইচ্ছে করলে অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্টের চূড়াতেও উঠে যেতে পারে।
আসলে এর আগে ও কখনও পাহাড়ে ওঠেনি। আজ থেকে বহু বছর আগে, ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে একবার পুরুলিয়ায় গিয়েছিল। খড়িদুয়ারায়। মুকুটমণিপুর থেকে একটুখানি। সেটাও ছিল পাঁচ মাথাওয়ালা পাহাড়। একেবারে দুধের মতো সাদা ধবধবে। পরে জেনেছিল, ওটা ছিল খড়ি, মানে চকের পাহাড়। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে রাস পূর্ণিমায় তিন দিন ধরে সেখানে উৎসব হয়--- সৃজন উৎসব।
সেখানেই সে প্রথম দেখেছিল কত দেরি করে ওখানে রাত নামে। অথচ রাত নামলেও অন্ধকার নামে না। জ্যোৎস্নার ফটফটে আলোয় চারিদিক ভেসে যেতে থাকে। মনে হয়, লক্ষ লক্ষ টিউব লাইট জ্বলছে। সেই আলোয় পাহাড়ের গায়ে খড় আর মাথার উপরে ত্রিপল টাঙিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল আয়োজকেরা। সারা রাত ধরে অনুষ্ঠান। পাহাড়ের এ চূড়া, ও চূড়া, সে চূড়ায় ম্যাড়াপ বাঁধা হয়েছিল। ছৌ-নৃত্য আর আদিবাসী চটুল গানে সবাই যখন মেতে উঠেছে, তখন তার মা তাকে নিয়ে ইচ্ছে করেই দল ছুট হয়ে একটু আলাদা হয়ে গিয়েছিল। মাইকের আওয়াজ যেখানে একদম ক্ষীণ, সে রকম একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে ওর মা-ই ওকে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল, সেই বিশাল রুপোর মতো চাঁদটা কেমন হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড়ের একটা চূড়া থেকে আরেকটা চূড়ায় যাচ্ছে।
ও মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল। বেলার দিকে দেখেছিল, পাহাড়ের গায়ে এখানে সেখানে এক-একটা মুরগির লড়াই ঘিরে কেমন ছোট ছোট জটলা তৈরি হয়েছে।
মেলা হচ্ছে শুনে পাহাড়ের ঢালে গিয়ে ও একটু হতাশই হয়েছিল। না, সেখানে কোনও নাগোরদোলা ছিল না। ছিল না রঙিন মাছ। খাঁচায় ভরা বদ্রি বা টিয়াপাখির ঝাঁক। ছিল না ফিশ-ফ্রাই, চিকেন রোল কিংবা দই ফুচকার দোকান। তার বদলে ছিল পাতি লোহার হাতা-খুন্তি, দা-কোদাল। বেতের ঝুড়ি, অ্যালুমনিয়ামের থালা-বাটি। রঙিন রংতায় মোড়া তির-ধনুক। ছৌ-মুখোশ। প্লেট-টেলেট তো নয়ই, শালপাতাও নয়, লুচি, ঘুঘনি আর ঘরে বানানো মারবেলের মতো ছোট ছোট রসগোল্লা বিক্রি হচ্ছিল বটপাতা বা ডুমুরপাতায় করে।
আশপাশের গ্রাম দেখার জন্য পর দিন সকালে ওখান থেকে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে নেমে এসেছিল ওরা। কিন্তু গ্রাম নয়, সামনেই সরু গাড়িরাস্তার গা ঘেঁষে ওঠা পাহাড় দেখে ওরা আর লোভ সামলাতে পারেনি। উঠে পড়েছিল। হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড়ের গায়ে গজিয়ে থাকা ছোট ছোট আগাছা ধরে। বলতে গেলে খানিকটা খাবি খেতে খেতে। সমতলের গাছ হলে হয়তো তাদের টানে উপড়ে যেত। কিন্তু ওগুলো তো পাহাড়ের গাছ। লড়াই করে পাথুরে মাটি ফুঁড়ে শিকড় চালাতে হয় নীচে। তাই বুঝি প্রাণপণে ভূমি আঁকড়ে ছিল।
সাত-আট তলা বাড়ির সমান উঠে শৃঙ্গজয়ের আনন্দে ও যখন গায়ের জামা খুলে ওড়াচ্ছে, নিজেকে মনে করছে লর্ডসের মাঠে সৌরভ গাঙ্গুলি, ঠিক তখনই কতগুলি বাচ্চার হাসি শুনে ও পিছন ফিরে দেখে, চোখের সামনে কী বিশাল একটা আকাশ-ছোঁয়া পাহাড়।
যে-কোনও সময় পড়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে দুরুদুরু বুকে তারা এতক্ষণ ধরে যেখানে উঠে এসেছে, ওর তুলনায় এটা কিচ্ছু না। নিছকই একটা চড়াই পথমাত্র। আর ওই খাড়া পাহাড় বেয়ে তারও চেয়ে ছোট ছোট কতগুলি বাচ্চা কিনা মাথায় লকড়ির বোঝা নিয়ে নাচতে নাচতে নেমে আসছে!
ফিরে এসে সবাইকে এই গল্পটা ও বলেছিল। এখনও মাঝে মাঝে বলে। কয়েক বছর আগে যখন কথায় কথায় সেই গল্পটাই ও বলেছিল, তখন ওরই এক বন্ধু, স্বপন বলেছিল, খড়িদুয়ারা? ওটা কোনও পাহাড়ই নয়। ওটা তো একটা টিলা। মাটির একটা বড় ঢেলাও বলতে পারিস। পাহাড় হচ্ছে অন্য জিনিস। যে একবার ভালবেসে পাহাড়ের কাছে যায়, পাহাড় তাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে।
স্বপনই ওকে বলেছিল, তুই যদি সত্যিই পাহাড়ে যেতে চাস, তা হলে আমাদের সঙ্গে যেতে পারিস। তবে তার জন্য তোকে কিন্তু ট্রেনিং নিতে হবে।
ও বলেছিল, কোথায়?
স্বপন বলেছিল, এন আই এমে।
--- সেটা আবার কী?
--- এন আই এম মানে নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং।
রোহিতাশ্ব জানতে চেয়েছিল, সেটা কোথায়?
ও বলেছিল, উত্তরকাশীতে।
--- বাব্বাঃ, অত দূরে!
--- দার্জিলিংয়েও আছে। এইচ এম আই। মানে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট।
--- কাছাকাছি কিছু নেই?
স্বপন বলেছিল, থাকবে না কেন? সর্বত্রই আছে। আমাদের এই কৃষ্ণনগরেও আছে।
--- তাই নাকি? কোথায়?
— গভর্মেন্ট আর্ট কলেজে ঢোকার মুখেই। দেখবি, গেটের সামনে বড় বড় করে লেখা আছে— মাউন্টেনিয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব কৃষ্ণনগর।
আগ্রহের সঙ্গে রোহিতাশ্ব জানতে চেয়েছিল, ওখানে কত দিনের কোর্স?
স্বপন বলেছিল, বিভিন্ন রকমের কোর্স আছে। কোনওটা পনেরো দিনের, কোনওটা এক মাসের, তো কোনওটা আবার পাঁচ দিনের। যেমন আমি একবার রক ক্লাইম্বিংয়ের কোর্স করেছিলাম শুশুনিয়া পাহাড়ে। এটা ছিল পাঁচ দিনের কোর্স।
--- তাই নাকি? আচ্ছা, ওখানে ভর্তি হতে গেলে কী করতে হয়?
--- দ্যাখ, ওই সব ইনস্টিটিউটগুলিতে গেলেই যে তোকে সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেবে, তা কিন্তু নয়। ওরা কিছু পরীক্ষা নেয়। তবে ক্লাব-ভিত্তিক লোকাল ইনস্টিটিউটগুলিতে অত কড়াকড়ি নেই।
অধীর আগ্রহে রোহিতাশ্ব জিজ্ঞেস করেছিল, ওখানে কী কী শেখায়?
--- অনেকগুলো ধাপ আছে। যেমন প্রথমেই শেখানো হয় ফ্রি হ্যান্ড ক্লাইম্বিং। আর তার সঙ্গে চেনানো হয় পাহাড়ের চরিত্র। সে সব হয়ে গেলে র্যাপলিং। মানে দড়ি ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা। তার পর ন্যাচারাল ক্যাবিটি, সেখানে খালি হাতে খাড়া পাহাড়ে ওঠা শেখানো হয়।
--- খালি হাতে খাড়া পাহাড়ে!
স্বপন বলেছিল, হ্যাঁ, খালি হাতে। অনেক সময় দেখবি, একদম দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড় বেয়ে অনেকে তরতর করে উঠে যাচ্ছে। নীচ থেকে দেখলে কিছুই বুঝতে পারবি না। আসলে পাহাড়ের গায়ে প্রচুর প্রাকৃতিক খাঁজ-খোঁজ থাকে। সেগুলি ধরে ধরে ওঠে। সেই ওঠাটাই শেখানো হয়।
রোহিতাশ্ব জানতে চেয়েছিল, কত করে নেয়?
--- সেটা খুব একটা খরচসাপেক্ষ নয়। তবে ক্লাইম্বিং শেখার সময় একটু খরচ হয় বইকী... অবশ্য একটু করিৎকর্মা হলে বা হাঁটাহাঁটি করতে পারলে, অভিযানে যাওয়ার সময় সরকারি সাহায্য মিললেও মিলতে পারে। আবার ঠিকঠাক লোককে ধরতে পারলে অনেক সময় স্পনসরশিপও জোগাড় করা যায়।
--- তাই নাকি? ও। এমনি ট্রেকিং করতে গেলে কী রকম খরচ-খরচা পড়ে?
--- সেটা নির্ভর করে কোথায় যাচ্ছিস, কত দিনের জন্য যাচ্ছিস এবং কত জন মিলে যাচ্ছিস তার উপরে।
--- কত জন মানে!
স্বপন বলেছিল, সচরাচর কেউ তো একা-একা পাহাড়ে যায় না। তবে দল বেঁধে যাওয়াও ঠিক নয়। সব থেকে ভাল হয়, যদি চার-পাঁচ জন মিলে যাওয়া যায়। আর সব সময় এমন লোকের সঙ্গেই যাওয়া উচিত, যারা পাহাড়কে ভালবাসে। যারা মনে করে পাহাড়ে গিয়েও
বাড়ির যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পাব কিংবা বাড়ির মতোই খাওয়া-দাওয়া পাব, তাদের সঙ্গে না যাওয়াই ভাল।
--- কেন?
--- সেটা না গেলে বুঝবি না। আমরা যেমন কয়েকজন মিলে একবার এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে ট্রেকিংয়ের জন্য কাঠমাণ্ডু থেকে প্লেনে লুকলা গিয়েছিলাম। লুকলা থেকে পায়ে হেঁটেই রওনা হয়েছিলাম একশো কিলোমিটার দূরের কালা পাথরের উদ্দেশে। পথটা ছিল ছ'-সাত দিনের। দু'দিন হাঁটার পরেই আমাদের মধ্যে থেকেই একজন ফস করে বলে ফেলেছিল, এত খরচ করে শুধু শুধু এখানে এলাম! এর থেকে অনেক ভাল হত, যদি গোয়ায় যেতাম। সমুদ্রের পাড়ে শুয়ে থাকতাম। মদ খেতাম আর সারাক্ষণ সাগর-সুন্দরীদের দেখতাম।
সে হয়তো কথাটা এমনিই বলেছিল, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, তার ওই কথাটা আমাদের পুরো জার্নিটাকেই তেতো করে দিয়েছিল।
--- তাই! কিন্তু এটা তো খারাপ অভিজ্ঞতা। ভাল কোনও অভিজ্ঞতা নেই?
--- থাকবে না কেন? প্রচুর আছে। তবে আমার ট্রেকিং জীবনের সেরা মুহূর্তটা আমি কখনওই ভুলতে পারব না। সে বার আমরা দশ-বারো জন মিলে নীলকণ্ঠ পাহাড়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা ওঠার পরেই তাঁবু ফেলা হয়েছিল। ভারী সুন্দর জায়গা। যে দিকেই তাকাই, দেখি, বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে সার সার চুড়ো। তাদের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। চারিদিকে কনকনে ঠান্ডা। হাওয়ার সঙ্গে ঝাঁক ঝাঁক আলপিন যেন ছুটে এসে মুখে বিঁধছে, গলায় বিঁধছে। টিম লিডার বলেছিলেন, কেউ যেন রাত্রে তাঁবু থেকে একা-একা না বেরোই।
কিন্তু আমার তো সুগার আছে। ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হয়। বারবার কাকে ডাকব! তাই শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না-পেরে মাঝরাতে যখন তাঁবুর ভিতর থেকে চুপিচুপি বাইরে বেরিয়ে এলাম, আমি তো একেবারে হতবাক। সে দিনটা ছিল অমাবস্যা। ভেবেছিলাম বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার হবে। তাই বেরোবার সময় টর্চটা সঙ্গে নিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু এ কী! কোথায় অন্ধকার! চারিদিকে ফটফটে আলো। গোটা আকাশটা যেন হিরের কুচি দিয়ে মোড়া। আকাশে এত তারা সেই প্রথম দেখেছিলাম। ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। এক ফোঁটা জায়গা নেই, যেখানে পিন ফোঁটানো যায়।
হঠাৎ মনে হল, অনেক দিন কোনও লোক দেখেনি ওরা, তাই এত তারা একসঙ্গে দল বেঁধে এসেছে আমাদের দেখতে। ওরা তারা! না, তারা মা! জয় তারা। জয় দুর্গা। জয় বাবা ভোলেনাথ!
তখন আমার মনে হয়েছিল, আমরা বুঝি স্বর্গে পৌঁছে গেছি! তখনই ঠিক করেছিলাম, লাগুক ঠান্ডা, তেত্রিশ কোটি দেবতাকে আমি এখন দু'চোখ ভরে দেখব।সত্যিই সে রাতে আমি আর তাঁবুর ভিতরে ঢুকিনি। সারা রাত শুধু ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যারা এ রকম দৃশ্য দেখেনি, তাদের জীবনটাই বৃথা।
স্বপনের কথা শুনতে শুনতে বিহ্বল হয়ে রোহিতাশ্ব বলেছিল, এত সুন্দর!
স্বপন বলেছিল, শুধু প্রকৃতি নয়, ওই রকম প্রকৃতির মধ্যে থাকে বলে ওখানকার মানুষের মনগুলিও খুব সুন্দর। আমি তো বহু জায়গায় গিয়েছি। হিমালয় বা কুমায়ুনেও দেখেছি, যেহেতু ওখানে বিদেশিরাই বেশির ভাগ ট্রেকিং করে, ফলে সাহেব-সুবোদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ওখানকার গাইডরাও একটু সাহেবি গোছের হয়ে গেছে। তারা মাল বয়ে নিয়ে যায়। ঠিকঠাক পথ চিনিয়ে নিয়ে যায়। সারাক্ষণ পাশে পাশেই থাকে। বিপদে-আপদে পড়লে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পারতপক্ষে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। ভীষণ মেপেজুপে কথা বলে। সাধারণত, যত দুর্গম এবং বিপদসঙ্কুল পথ হয়, গাইডদের দৈনিক মুজুরিও তত বেশি হয়। কিন্তু যা নেবার, তা ওরা আগেই দর কষাকষি করে চুক্তি করে নেয়। পরে তা নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য করে না। এক কথায় বলতে গেলে, এরা খুব প্রফেশনাল হয়। কিন্তু ওদের মধ্যে কী যেন একটা নেই। কেমন যেন একটা ফাঁকা ফাঁকা। ফলে কাজে পটু হলেও, যত দিনই থাকুক না কেন, পর্বতারোহীদের সঙ্গে ওদের কোনও আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না।
কিন্তু গাড়োয়াল অঞ্চলটা একটু অন্য রকমের। এখানকার গাইড ও মালবাহকদের সঙ্গে অনেক সময়ই পর্বতাভিযাত্রীদের কথা কাটাকাটি হয়। মন কষাকষি হয়। মুখ ফসকে খারাপ কথাও বলে ফেলে কেউ কেউ। কিন্তু অভিযান শেষ করে ফিরে আসার সময় দেখেছি, ওদের মনটা কত নরম। কত শিশুর মতো। কিছুতেই ভোলা যায় না তাদের সেই থমথমে মুখ। চোখের কোণে চিকচিক করা জলের কণা।
একবার রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে একেবারে হতদরিদ্র একটা চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। খানিক পরেই এক দম্পতি গাড়ি থামিয়ে ডিমটোস্ট আর চায়ের অর্ডার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কোলের বাচ্চার জন্য এক গ্লাস দুধও চেয়েছিলেন।
দোকানি ভদ্রমহিলা তাদের চা-ডিমডোন্ট দেওয়ার আগেই অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে দুধ গরম করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দাম নেওয়ার সময় বাকি সব কিছুর দাম নিলেও, ওই দুধের দাম তিনি কিছুতেই নেননি। বলেছিলেন, দুধের দাম? বাচ্চার জন্য দুধ দিয়েছি, তার জন্য পয়সা নেই? ছিঃ।
শুধু ওই দোকানিই নয়, পরে দেখেছি, ওখানকার মানুষগুলোই ওই রকম।
--- এখনও এ রকম লোকজন আছে! রোহিতাশ্ব বলেছিল, আমি ওখানে যাব। ক্লাইম্বিং করব।
স্বপন বলেছিল, আগে ট্রেকিং কর। তার পর তো ক্লাইম্বিং।
বুঝতে না-পেরে ও বলেছিল, দুটো আলাদা নাকি?
স্বপন বলেছিল, মোটামুটি আঠারো হাজার ফুট অবধি হেঁটে ওঠাটাকে বলা যেতে পারে ট্রেকিং। কিন্তু উনিশ হাজার ছাড়ালেই সেটা সাধারণত ক্লাইম্বিং বা মাউন্টেনিয়ারিংয়ের মধ্যে পড়ে যায়। তখন শুধু গাইড বা মালবাহকে কাজ চলে না। শেরপা নিতে হয়। তবে আমি বলি, পুণ্য অর্জনের জন্য তীর্থযাত্রীরা যত দূর পর্যন্ত উঠতে পারে, ততটুকুই ট্রেকিং।
কিন্তু না। তখন ওর আর পাহাড়ে চড়া হয়নি। পরে, অনেক পরে, পাশটাস করে ও যখন পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে চাকরি পেল, তখন প্রথম পোস্টিং হল মধ্য কলকাতার টি-বোর্ডের পাশেই সার্কেল অফিসের মার্কেটিং বিভাগে।
সেখানেই চাকরি করেন মাউন্টেনিয়ার বসন্ত সিংহ রায়। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হতেই ওর ভিতরে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠল পর্বত-প্রেম। ফলে কারণে-অকারণে, নানান খুঁটিনাটি জিনিস জানার জন্য ও যখনই সুযোগ পেত, অমনি চলে যেত বসন্তদার পাশের চেয়ারে। তাঁর কমপিউটারের সামনে বসে পাহাড় এবং পাহাড়ে ওঠার নানান ছবি দেখত। আলোচনা করত। পাহাড়ের নানা গল্প শুনত তন্ময় হয়ে।
তাঁর মুখেই ও শুনেছিল, সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ায় একবার তাঁর কী দশা হয়েছিল। নেপালের সমতল থেকে পঁচিশ হাজার ফুট উপরে, ধওলাগিরিতে কী ভাবে সারা রাত বরফের মধ্যে অচৈতন্য হয়ে আটকে পড়েছিলেন তিনি। পর দিন যখন তাঁকে হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করা হয়, তাঁর শরীর তখন প্রায় জমে গেছে। পা দুটো এতটাই অসাড় হয়ে গিয়েছিল যে, অপারেশন করে বাদ দিতে হয় তিনটে আঙুল।
হোক। তারও যদি সে রকম হয়, তো হোক। তবু সে পাহাড়ে যাবে। যাবেই। তাই বসন্তদার কাছ থেকে খবর নিয়ে সে যোগাযোগ করেছিল কুড়ি নম্বর পদ্মপুকুর রোডের সাউথ ক্যালকাটা ট্রেকার অ্যাসোসিয়েশনের দীপেন সামস্তর সঙ্গে। তাদের ওখানে কয়েক দিন যাতায়াত করতেই আলাপ হয়ে গিয়েছিল আরও অনেক পর্বতারোহীর সঙ্গে। বয়সে তার থেকে অনেকটা বড় হলেও খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল অরণিদার সঙ্গে। পাহাড় নিয়ে তাঁরও অভিজ্ঞতা কম নয়। তাই তাঁর কাছ থেকেও নানান টিপস নিয়ে, রাহুল, শ্রাবণ আর কারুকৃতের সঙ্গে ও একদিন পাড়ি দিয়ে দিল পঞ্চকেদারের উদ্দেশে।
সে আগেই জেনে গিয়েছিল পাহাড়ে কখনও তাড়াহুড়ো করে উঠতে নেই। দ্রুত উঠতে গেলেই পালমুনারি ইডিমায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। মানে ফুসফুসের মধ্যে জল জমে যায়। আর সেরিব্রাল ইডিমা হলে তো কথাই নেই। অসহ্য যন্ত্রণায় মনে হয় গোটা মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। তখন নীচে নেমে আসা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। তাই ঋষিকেশ, রুদ্রপ্রয়াগে ওঠার সময় দ্রুত পা চালালেও, পঞ্চকেদারের প্রধান দ্রষ্টব্য--- গৌরীকুণ্ড থেকে প্রায় চোদ্দো কিলোমিটার দূরের 'কেদার'-এ যাওয়ার পুরো পথটাই সে ধীরে ধীরেই উঠেছিল।
তার পরে আবার এই চন্দ্রশিলা অভিযান। তবে না, তার ভয়ের কোনও কারণ নেই। যা যা দরকার সবই সে গুছিয়ে এনেছে। পায়ে একটা পরা থাকলেও, রবার সোলের খুব ভাল আরও এক জোড়া জুতো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এই আবহাওয়ায় চাল-ডাল সেদ্ধ হতে প্রচুর সময় লাগে বলে খাবার জন্য এনেছে ছাতু, চিঁড়ে, নুডলস। বড় ফ্রেমের কালো চশমা। রাতে শোয়ার সময় পরার জন্য গরম মোজা। এনেছে জ্যাকেট, স্লিপার ব্যাগ, টর্চ। দড়ি, মোমবাতি, যাবতীয় ওযুধপত্র ছাড়াও অরণিদার পরামর্শ মতো কোকা থার্টি। এটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ। একটু বেশি উপরে উঠে গেলে, যেখানে গাছপালা নেই, অক্সিজেনের মাত্রা কম, বাতাসও ভারী, সেখানে তো নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তখন নাকি এটা খুব ভাল কাজ করে। আর সব থেকে যেটা জরুরি, সেই জলও নিয়ে এসেছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। কিন্তু সেটাও তো এখন শেষের দিকে।
অরণিদা বারবার করে বলে দিয়েছেন, যাচ্ছিস যা। তবে খেয়াল রাখবি, ডি-হাইড্রেশন যেন না হয়। সব সময় লিক্যুইড খাবি। বেশি করে জল খাবি। আর মনে রাখবি, যেটা সঙ্গে করে অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে, সেটা হল, কষ্ট করার মানসিকতা।
কষ্ট তো সে করছেই। চেষ্টা করছে বাকি তিন সঙ্গীর থেকে অন্তত কিছুটা হলেও, একটু এগিয়ে থাকতে। কারণ, ও শুনেছে, যতই বন্ধু হোক, আগে যত লোকই সেই শিখরে পা রেখে থাকুক না কেন, প্রতিবারই, প্রতি দলের প্রত্যেকটা সদস্যই চায় এক মিনিট আগে হলেও, সবার চেয়ে আগে চূড়ায় পৌঁছতে। এবং মজার কথা হল, চূড়ায় উঠে, চূড়া ছোঁয়ার আনন্দে অনেকেই বেমালুম ভুলে যায়, আগে থেকে ঠিক করে রাখা--- উঠেই, পটাপট ছবি তোলার কথা। কারণ, ক্যামেরায় ধরা সময়টাই বলে দেয় সে ঠিক কখন, ক'টায়, কত মিনিট, কত সেকেন্ডে, পারলে সেকেন্ডটাকে যাট দিয়ে ভাগ করে, ঠিক কোন মুহূর্তে সে পৌঁছেছে।
পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ওই তন্বী মেয়েটি তাকে যে রা' ফল দিয়েছিল, সেটা খেয়ে সে বেশ ঝরঝরে তরতাজা হয়ে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু বাকি সঙ্গীদের পিছনে ফেলে হুটোপাটি করে এগোতে গিয়ে তাঁর শরীর আবার বিগড়োতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝেই গা গুলিয়ে উঠছে। গলার কাছে উঠে আসছে টকটক বিচ্ছিরি একটা জল। মুখ ভরে যাচ্ছে তাতে। ইতিমধ্যেই বার কতক বমিও করেছে সে।
মুখ ধুতে ধুতে আর অরণিদার কথা মতো বারবার খেতে খেতে সঙ্গে আনা জলের স্টক এর মধ্যেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। যেটুকু আছে তাতে আর কতক্ষণ চলবে কে জানে! সামনে ঝর্না-টর্না না-পেলে মহামুশকিল! তবে হ্যাঁ, তার এখন আর বমি-টমি হচ্ছে না। বমি-বমি ভাবটাও নেই। ভাগ্যিস খানিক আগে সাধু গোছের ওই লোকটা মাঝপথে হঠাৎ উদয় হয়ে তাকে একটা পোড়া জাম্বুরা লেবু দিয়ে বলেছিল, এটা খেয়ে নে বেটা। আর বুমি-টুমি হুবে না।
সত্যিই তাই। ওটা খাওয়ার পর তার আর বমি তো হয়ইনি, বমি-বমি ভাবটাও চলে গেছে। তবে শরীরটা একটু কাহিল হয়ে পড়েছে। আরও কতটা হাঁটতে হবে কে জানে! সামনে যত দূর চোখ যাচ্ছে, গাইডকে দেখা যাচ্ছে না। প্রথম প্রথম তাদের সঙ্গ ছেড়ে গাইড যখন এগিয়ে যেত, ওদের রাগ হত। কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পরেই ও দেখত, গাইড তাদের চার জনের জন্য কাঠকুটো জ্বেলে গরম গরম নেম্বু-পানি রেডি করে রেখেছে। বিশ্রাম করার জন্য টাঙিয়ে ফেলেছে তাঁবু। তাই গাইডকে দেখতে না-পেয়ে ওর মনে হল, নিশ্চয়ই সামনে কোথাও তাঁবু ফেলেছে সে। এবং সেটা খুব একটা দূরেও নয়। তাই সে ফের আগের চেয়ে একটু দ্রুতই পা চালাতে লাগল।
তুঙ্গনাথ হয়ে সে যখন চন্দ্রশিলায় উঠছে, তখন তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্টটা দশ-এগারো হাজার ফুট ওঠার পরেই সাধারণত হয়। কারও কারও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ছ'-সাত হাজার ফুট উঠলেও হয়। আর সে তো বারো ছাড়িয়ে তেরো হাজার ফুটের দিকে এগোচ্ছে। তার তো এ সব হওয়ারই কথা। এতক্ষণ যে হয়নি, সেটাই অনেক। তার মনের জোর আছে বলতে হবে। তবে না। মনের জোরে সব কিছু হয় না। শরীরটাও একটা বড় ফ্যাক্টর। তার শরীর আর চলছে না। টলে টলে পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, শরীরটাকে ব্যালেন্স করার জন্য শুধু হাত আর পা-ই যথেষ্ট নয়, একটা লেজ থাকলে ভাল হত।
অরণিদা তাকে পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, মনে রাখবি, পাহাড়ে উঠতে হলে শুধু শরীর ফিট রাখলেই হবে না। মনে রাখতে হবে, নিজেকে নিজেরই খেয়াল রাখতে হবে। অসুস্থ হয়ে পড়া মানেই অন্য সঙ্গীদের বিব্রত করা।
তাই কাবু হয়ে পড়লেও সে কাউকেই কিছু জানাবে না। আর জানাবেই বা কাকে! তার তিন সঙ্গীর কেউ তরতর করে এগিয়ে গেছে, তো কেউ আবার তার চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটা পথ।
এই মে মাসেও চার দিকে বরফে বরফ। শুধু পাহাড়ি পথ হলে হত, কিন্তু এই পথটা পুরু বরফে মোড়া বলে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। গোড়ালির কল-কবজা যেন লক হয়ে যাচ্ছে। তবে এখানে যে খুব একটা ঠান্ডা আছে, তা নয়। সামনে দিয়ে বাতাস এসে যখন বুকের উপরে আছড়ে পড়ছে, তখন শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পিঠে রোদ পড়লেই এত জ্বালা করছে যে, মনে হচ্ছে কে যেন বিছুটি পাতা ঘষে দিচ্ছে।
সত্যিই কি রোদের জন্য এটা হচ্ছে, নাকি পাহাড়েরই কারসাজি ওটা! হতে পারে! হতেই পারে! এত লোক এখানে আসে, ব্যবহারের পরে এখানেই ফেলে দিয়ে যায় জলের বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট, বড় বড় পলিপ্যাক। পাহাড় বাগ করবে না?
খাওয়ার পরে কেউ যদি কলার খোসা আমাদের গায়ে ছুড়ে ফেলে, যেতে যেতে জুতো দিয়ে পা মাড়িয়ে দেয়, কাঁধের উপরে উঠে বসতে চায়, আমরা রাগ করব না!তবে?
তাই তো একটু আগেই, সে নিজেই আরও অনেক পর্বতারোহীর মতো এইটুকু পথ আসতে গিয়েই পথের মধ্যে দু'-দুটো খালি বোতল ছুড়ে ফেলেছে। তা হলে কি এই জন্যই পাহাড়টা তার উপরে রেগে গেছে! তাকে এতটাই কাহিল করে দিচ্ছে, যাতে সে আর এক পা-ও এগোতে না পারে। হতে পারে! হতেই পারে! এগুলি তো সহজে নষ্ট হওয়ার নয়। সবাই যদি এই ভাবে দুটো করেও বোতল ফেলে যায়, তা হলে আগামী পঞ্চাশ বা একশো বছরের মধ্যে এখানে যে কী পরিমাণ দূষণ হবে, সেটা কল্পনা করতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল রোহিতাশ্ব। মুখ দিয়ে শুধু একটাই শব্দ বেরিয়ে এল— ছিঃ।
এই জন্যই পাহাড় এত বিরক্ত হয়। থাকতে না-পেরে উসখুস করে। হয়তো চেষ্টা করে এই পর্বতারোহীদের নাগাল থেকে আর একটু দূরে সরে যেতে। আর তার ফলেই নেমে আসে ধস। শুরু হয় প্লাবন। আমরা তো নিজেরাই দেখলাম, এই তো কয়েক বছর আগে, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করেই উত্তরাখণ্ডের উপরে কী ভাবে আছড়ে পড়ল ভয়ঙ্কর দুর্যোগ।
হবে না? পাহাড় ফুঁড়ে পাঁচ তলা ছ'তলা বাড়ি বানাবে। তারস্বরে মাইক বাজিয়ে তার শান্ত পরিবেশ বিঘ্নিত করবে। হাজার হাজার গাড়ির কালো ধোঁয়ায় চারিদিক ঢেকে দেবে, আর সে চুপচাপ সব সহ্য করবে!
আমার তো মনে হয়, সেই দিন আর বেশি দূর নেই, যে দিন দা-কুড়ুল নিয়ে গাছপালা কাটতে গেলে গাছেরাও রুখে দাঁড়াবে। প্রতিবাদ করবে। কিংবা প্রাণপণে ছুটে পালাবে। আর গাছ যদি সত্যি সত্যিই শিকড়বাকড় নিয়ে ছুটে পালায়, তা হলে তার পরিণাম যে কী হবে, তা একবারও কেউ কি ভেবে দেখেছে!
নাঃ, আর নয়। পর্বতারোহীরা বলে--- আমরা এই শৃঙ্গ জয় করেছি, ওই শৃঙ্গ জয় করেছি, সেই শৃঙ্গ জয় করেছি। আরে বাবা, কারও উপরে পা রাখা মানেই কি তাকে জয় করা? পাহাড়কে কি কখনও জয় করা যায়? না, কখনও সম্ভব? পাহাড়ের তুলনায় আমরা এত তুচ্ছ, এত নগন্য যে, ওটা ভাবাটাও অপরাধ। হ্যাঁ, তার কাছে আমরা যেতে পারি। তার পায়ের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে মাথা তুলে তাকে দেখতে পারি, সে কত বড়। তার কোলে দু'দণ্ড জিরিয়ে শীতল-শান্ত হতে পারি। তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে পারি। তাকে ভালবাসতে পারি। কিন্তু জয়? কখনওই নয়।
জয় যদি করতেই হয়, পাহাড়ের শরীর নয়, সবার আগে পাহাড়ের মনটাকে জয় করতে হবে। আর সে যদি খুশি হয়? তা হলে কুলি বা গাইড তো দূরের কথা, যত উঁচু বা দুর্গম চূড়াই হোক না কেন, কোনও শেরপাও লাগবে না। সে নিজেই আমাদের মাথায় করে রাখবে। আর তাকে খুশি করার প্রথম শর্তই হল, তাকে তার মতো থাকতে দেওয়া।
ওর যেই এটা মনে হল, অমনি পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল রোহিতাশ্ব। নাঃ, যত কাছেই এসে থাকুক, সে আর চন্দ্রশিলায় উঠবে না। যে ভাবে সে এসেছে, সে ভাবেই ফিরে যাবে সমতলে। মানুষের কাছে গিয়ে মানুষ হয়েই থাকবে। একজন ছাপোষা মানুষ হয়ে। তবে যাবার সময় এই পাহাড়ের বুকে সে যা যা ফেলে এসেছে, শুধু সেগুলিই না, অন্যরাও যা ফেলে গেছে, সেগুলিও সে খুঁজে খুঁজে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। সে যতই ভারী হোক না কেন।
এটা ভাবামাত্র শেষ বারের মতো পিছন দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে টা টা করল সে। কিন্তু কাকে? সঙ্গীদের, নাকি তাদের গাইডকে, নাকি পাহাড়ের ওই শিখরটাকে, সে নিজেও বুঝতে পারল না।
-----------------------------------
SIDDHARTHA SINGHA
27/P, ALIPORE ROAD,
KOLKATA 700027
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন