কবিতার প্রথমযুগের দিনগুলি
বাঙালি শিশুরা কবিতার মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠে । মা মাসি বড় দিদিদের কোলে কোলেই তারা শুনে ফেলে অনেক কবিতা অনেক ছড়া । আমিও হয়তো শুনেছিলাম ---" চাঁদের বুড়ি চরকা চালায় / লঙ্কা দিয়ে ভাত মেখে খায়" বা "চাঁদের কপালে চাঁদ টি দিয়ে যায়" -----জাতীয় কোনো ছড়া । তবে তা আমার স্মৃতিতে থাকার কথা নয় । আমি সজ্ঞানে প্রথম কোন্ কবিতাটি পড়েছিলাম তা আজ আর নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই । হাতেখড়ির আগেই আমি পড়তে লিখতে শিখে গেছিলাম । স্কুলে না গেলেও আমার নিজস্ব বইয়ের বাক্স ছিল । আমার বড়দাদা আমাকে খেপিয়ে আমার সেই টিনের বাক্সকে বলত --প্যাঁটরা । তখন সোভিয়েত দেশ থেকে অনেক সুচিত্রিত বই আসত । আমারও কয়েকটা পাতলা চওড়া বই ছিল । একটা ছিল এক পোষা কুকুরের গল্প । কুকুরটার নাম ছিল –বিসকা । এরকম ভাবেই এটা সেটা পড়তে পড়তে আমি পড়ে ফেলি কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কবিতা ---"মৌমাছি , মৌমাছি , / কোথা যাও নাচি নাচি / দাঁড়াও না একবার ভাই" । প্রথম রবীন্দ্র-কবিতা পড়ি –" অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে" । সেটা অবশ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে । এর মধ্যে আমার হাতেখড়ি হয়ে গেছে এক সরস্বতীপুজোর সকালে । ঠাকুরমশাই আমার হাতে চকখড়ি ধরিয়ে দিয়ে আঙুল ঘুরিয়ে 'অ' লেখাবেন কী , তার আগেই আমি লিখে বসে আছি , আর থালা ভর্তি বাতাসা মণ্ডার দিকে তাকিয়ে আছি । পরে অবশ্য আমার ভাগ্যেও বাতাসা মণ্ডা জুটেছিল ।
আমার জন্ম বর্ধমান জেলার শিল্পশহর কুলটিতে । আমার যখন পাঁচ বছর বয়েস তখন আমার বাবা চাকরি পালটে কুলটি থেকে দুর্গাপুর চলে এলেন । উপযুক্ত বাসস্থানের অভাবে বাবা প্রথম প্রথম সেখানে একাই থাকতে লাগলেন । আমরা আমাদের পৈতৃক ভূমি বীরভূম জেলার খয়রাশোলে চলে গেলাম । পরের বছরই সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম । ভর্তির সময় সেই স্কুলের হেডমাস্টারমশাই আমাকে একটা কবিতা মুখস্থ বলতে বললেন । আমার কোনো কবিতাই মুখস্থ ছিল না । কিন্তু তবু আমি সুকুমার রায়ের 'বাবুরাম সাপুড়ে' কবিতাটা বলে দিয়েছিলাম । আমি সেই বয়সেই রেডিওতে অনুরোধের আসর শুনতাম । রেডিওতে প্রায়ই শিল্পী সনৎ সিংহর গলায় বাবুরাম সাপুড়ে গানটা শোনা যেত । সেটা শুনে শুনেই কবিতাটা আমার মনে থেকে গেছিল ।
তখন টিভি , কম্পিউটার , ইন্টারনেট , স্মার্টফোন , ফেসবুক , হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না । মানুষের বিনোদন বলতে রেডিও বা লাইব্রেরির বই । ছোটবেলায় দেখেছি দাদারা পালাপার্বণে নাটক করত । কখনো মুকুট বা বিসর্জন তো কখনো যুগের দাবি । স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে আনিয়ে আমার মাকে পড়তে দেখেছি 'কড়ি দিয়ে কিনলাম' বা 'মহাস্থবির জাতক'- এর মতো বিশাল মাপের বই । ঐ গ্রন্থাগারটি ছিল মিলন সংঘের সেখানে বই দেওয়ানেওয়া করতে এবং ক্যারম খেলতে রোজ ভিড় হত । মিলন সংঘের উদ্যোগে ষাটের দশকের গোড়ার দিকে একটি পত্রিকা বেরোত , নাম –'অঙ্কুর' । তাতে দেখতাম আমার বড়দা ও তার বন্ধুরা কবিতা গল্প লিখতেন । তখন যাঁদের ঐ অঞ্চলে লিখতে দেখতাম তাঁদের মধ্যে আমার বড়দা সমর ঘোষ , সুকান্ত সরকার , শ্রীদামচন্দ্র ঘোষ , ডাক্তার আব্দুল খালেক , হীরালাল মুখার্জি , প্রকাশ ভাণ্ডারী উল্লেখযোগ্য । আমি বুঝি বা না বুঝি ঐ সব লেখা পড়ে ফেলতাম । তারপর একদিন নিজেই সবার অজান্তে একটা কবিতা লিখে ফেললাম 'যাত্রী' নাম দিয়ে । ইংরেজি ডিকশনারির পাতার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলাম । আমার দিদি সেটা বড়দাকে দেখিয়ে দেয় । আমি খেলতে বেরিয়ে যাই সামনে থাকব না বলে । পরে ফিরে এলে দিদি বলে , বড়দা কবিতাটাকে ঠিকঠাক করে দিয়েছে । পরে বড়দারই উদ্যোগে সে কবিতাটা 'অঙ্কুর'-এর পরের সংখ্যায় বেরোয় । তখন আমার ৯ বছর বয়েস । এর কিছুদিন পর ঐ 'অঙ্কুর' পত্রিকাতেই 'ছয়ঋতু' নামে আমার আর একটা কবিতা বেরোয় । আর এর পর থেকে উৎসাহিত হয়ে আমি ডাকে কবিতা পাঠিয়ে কিছু কিছু সাফল্যও পেতে থাকলাম । এভাবেই রোশনাই , রামধনু , মৌচাক , ঝুমঝুমি , লিপিমিতা , শ্রীচরণেষু , দৈনিক বসুমতীর ছোটদের পাতা ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত আমার লেখা বেরোতে লাগল । আমার স্কুলজীবনে রোশনাই পত্রিকার দুটি বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল ---সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণ সংখ্যা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ উপলক্ষ্যে একটি সংখ্যা । দুটোতেই পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আমার কবিতা রেখেছিলেন । অনেক দশক পর রোশনাই পত্রিকার তরফ থেকে এশিয়া পাবলিশিং কোং 'নির্বাচিত রোশনাই' বের করেন সেখানে আমার 'দোল' কবিতাটি তাঁরা পুনর্মুদ্রণ করেছিলেন ।
এ সময় কোচবিহার থেকে প্রকাশিত 'ত্রিবৃত্ত' ( যা এখনও বেরোয় ) পত্রিকাতেও ২-৩ বার আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল । আমার জীবনের প্রথম কোনো সংকলনে স্থান পাওয়া কবিতার নাম –' ঘরে ফেরার সময়' । সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল সোদপুর থেকে ১৯৬৭ সালে ।
স্কুলের সিলেবাসের বাইরেও আমাকে সারা বছরই নানা কবিতা পড়তে হত । রবীন্দ্রজয়ন্তী বা স্বাধীনতা দিবসের উদযাপনে আবৃত্তির তালিকায় আমার নাম থাকতই । আর সেই সুবাদে আমার পড়া হয়ে যেত রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন , ব্রাহ্মণ , দেবতার গ্রাস , দুই বিঘা জমি , শিবাজী উৎসব ইত্যাদি কবিতা অথবা নজরুলের বিদ্রোহী বা কাণ্ডারী হুঁশিয়ার । কিংবা কবি সুকান্তর লেখা রানার বা ছাড়পত্র । তখনকার মানুষ বেশ খুঁতখুঁতে ছিল । একবার আমি কোনো আসরে আবৃত্তি করেছি --- " শুধায়োনা কবে কোন্ গান" । মঞ্চ থেকে নামতেই আমাকে কেউ কেউ বললেন –"এটা তো 'মহুয়া' কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রের কবিতা , এটা পড়লে কেন ?" এখন তো দেখি এমন চমৎকার কবিতাটা দিব্যি পড়া হয় ।
আমি হাইস্কুলে পড়তাম বীরভূমের নাকড়াকোন্দার জমিদার হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়-প্রতিষ্ঠিত উচ্চ বিদ্যালয়ে । সেখানে আমার শিক্ষকদের মধ্যে জয়হরি মুখোপাধ্যায় কবিতা লিখতেন । যেদিন স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম তিনি আমাকে বলেছিলেন--- "কবিতা লেখা ছেড়ো না" । এছাড়া শান্তিবাবু ,সুজিতবাবু ,শিববাবু এঁরা কবিতার নিয়মিত পাঠক ছিলেন । দিলীপবাবু এলেন দিল্লি থেকে । তিনিই প্রথম আমাদের স্কুলে স্কুল ম্যাগাজিন চালু করলেন । প্রথম সংখ্যাতেই তিনি আমার কবিতা বাদ দিয়ে দিলেন । কারণ হিসেবে বললেন ওটা না কী কবি বিষ্ণু দের লেখা । আমি তখনও বিষ্ণু দের কোনো কবিতাই পড়িনি । আমার বড়দা সব শুনে বলেছিল ---"তোদের টিচার বিষ্ণু দের কবিতা পড়েইনি" । যাই হোক্ পরের বছর থেকে স্কুল ম্যাগাজিনে আমি নিয়মিত লিখেছি । দিলীপবাবু স্কুল থেকে চলে যাবার পর এলেন শিববাবু । সেবার তাঁর উদ্যোগে বেরোল স্কুল ম্যাগাজিন । আর সে বছরই আমি হলাম ছাত্র-সম্পাদক । আমি শিশুসাহিত্যের ওপর একটি গদ্য লিখেছিলাম । পত্রিকাটিকে আমি নিজের মতো করে সাজিয়েছিলাম । সেটা ১৯৭০ সাল । আমার স্কুলজীবনের শেষ বছর । এর দুবছর আগে অন্য স্কুল থেকে আমাদের স্কুলে ভর্তি হল সমরেশ মণ্ডল । তার সঙ্গে আমার সেই যে বন্ধুত্বের সূচনা হল তা আজও বজায় আছে । বর্তমানে সমরেশ একজন সুপরিচিত কবি-গল্পকার ও সম্পাদক । এ ছাড়াও আমাদের আর এক বন্ধু দিলীপ সেনগুপ্ত ভালো কবিতা লিখত । কোলিয়ারিতে কাজে যোগ দিয়ে সে লেখালেখিতেও মন দিয়েছিল । কিন্তু সে অকালে প্রয়াত হয় । স্কুলজীবনে লেখালেখি ও পত্রিকাতে প্রকাশ সংক্রান্ত ব্যাপারে সমরেশের সঙ্গেই আমার আলোচনা ও আদানপ্রদান বেশি হত ।
সত্তর দশকে বিশ্বভারতীতে প্রথমে স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর পড়তে এসে আমি বিশ্বভারতীর পত্রিকাগুলি ও সেখানকার সাহিত্যানুষ্ঠানগুলির সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়ি । আমাদের নিজেদের উদ্যোগে বেরোত রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা 'সাহিত্যিকা' । এ ছাড়া বিশ্বভারতীর পত্রিকা 'সপ্তপর্ণী' । 'সাহিত্যিকা' –তে কবিতা , গদ্য , অণুগল্প লিখেছি , তার মধ্যে 'নিরুদ্দেশ' ও 'বাসাবদল' কবিতা দুটো ওখানকার পাঠকদের ভালো লেগেছিল বলে জানতে পেরেছিলাম । শান্তিনিকেতনের বাইরে যে সব পত্রিকায় সত্তর দশকে লিখেছিলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য -----দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-সম্পাদিত 'পরিচয়' , অমিয় চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত 'পত্রাণু' , শিশির ভট্টাচার্য –সম্পাদিত 'অন্যদিন' , রণজিৎ দেব-সম্পাদিত 'ত্রিবৃত্ত' । এছাড়া প্রতিধ্বনি ( বারাণসী ) , রোশনাই ( কলকাতা ) , মানসলোক ( দুবরাজপুর ) , শীকর ( বার্ণপুর ) , শাশ্বতী ( আসানসোল ) ইত্যাদি । পত্রাণু-র সুবাদে আমার অণুকবিতা ও অণুগল্প লেখার সূত্রপাত । ঐ পত্রিকাটির আমি শান্তিনিকেতনের প্রতিনিধিও ছিলাম । মানসলোক পত্রিকায় আমার যে কবিতাটি বেরিয়েছিল --'পলাশ প্রহরী নবীনেরই চিরদিন' -- সেটি আমার সহপাঠীরা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছিল । সে সময় আমাদের হস্টেলে একজন রাশিয়ান ছাত্র ছিল ----পাসপালোভ । সে ভালো বাংলা শিখেছিল । ঐ কবিতাটিতে একটা লাইন আছে –"আমার প্রাণেতে মুক্তি আঁধারী ধোঁয়া" । পাসপালোভ যার ডাকনাম ছিল জোরা সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল প্রাণে শব্দটার সঙ্গে তো বিভক্তি রয়েছে , তা হলে 'তে' লাগিয়ে আবার কেন বাড়তি বিভক্তি যোগ করলাম । জোরার সেই অনুসন্ধিৎসা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম ।
শান্তিনিকেতনের দিনগুলিতে অনেক কবি-লেখকের কাছাকাছি আসার সুযোগ হয়েছিল । বিখ্যাত কবি অশোকবিজয় রাহা ছিলেন বাংলা বিভাগের প্রধান । স্কুলের বইয়ে তাঁর কবিতা পড়েছিলাম----"হঠাৎ দেখি আরে / আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে" । সেই কবিকে প্রত্যক্ষ দেখলাম । তাঁর বক্তৃতা শুনলাম । নানা দরকারে কাছেও গেলাম কয়েকবার । আমার এক বান্ধবী তাঁর ছাত্রী ছিল । সে একদিন আমাকে বলল –"তুমি পান্ডুলিপি রেডি কর । অশোকদাকে বলেছি । তিনি রাজী বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে" । তারপর আমরা দুজন বসে কবিতার বইয়ের নাম ঠিক করে ফেললাম –'অন্বেষা' । তখন এ নামটা এখনকার মতো এত শোনা যেত না । সে মেয়ে ছবিও আঁকত । বইয়ের প্রচ্ছদও করে ফেলল । কিন্তু ওই পর্যন্তই । পান্ডুলিপি তৈরি আর হল না । তখন অত কবিতাই বা কোথায় আমার ? অশোকদা ছাড়া আর যাঁদের ওখানে পেয়েছিলাম ---কবি বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় , অসিত ভট্টাচার্য , সৌমিত্রশঙ্কর দাশগুপ্ত , লেখক অজেয় রায় প্রমুখ । সাহত্যিক লীলা মজুমদারের সঙ্গেও দীর্ঘ আলাপচারিতার স্মৃতি আছে । কবি কবিরুল ইসলামের সঙ্গে ওখানেই আলাপ । তিনি সিউড়ি থেকে চলে আসতেন । কবি মনুজেশ মিত্র থাকতেন বোলপুরে । ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যাঁরা তখন লিখতেন তাঁদের মধ্যে অনুত্তম বিশ্বাস , সিদ্ধার্থ রায় , সমর চক্রবর্তী , শিবাদিত্য সেন , কুন্তল রুদ্র , জয়িতা বন্দ্যোপাধ্যায় , বৌধায়ন মুখোপাধ্যায় , বিশ্বনাথ রায় প্রমুখের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে । এঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন । নানা কবিতাসভায় কবিতা পড়তে গিয়ে আলাপ হয়েছিল আবৃত্তিশিল্পী ও পত্রাণু-সম্পাদক অমিয় চট্টোপাধ্যায় , দাউদ হায়দার , সুশীল রায় , স্বপনবুড়ো , বরেন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কবি –লেখকের সঙ্গে । এবং আবৃত্তিশিল্পী প্রদীপ ঘোষের সঙ্গেও । অনুত্তমদার বাবা ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী অরবিন্দ বিশ্বাস এবং মাতামহী কথাসাহিত্যিক আশালতা সিংহ যিনি সে সময় সন্ন্যাস নিয়ে বাতিকার আশ্রমে থাকতেন । সিদ্ধার্থর দাদা ছিলেন কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় । এঁরা যখনই শান্তিনিকেতনে আসতেন , দেখা হত এবং আনন্দে কেটে যেত সেদিনটা । দেবেশদার সংবর্ধনা উপলক্ষে একটি সাহিত্যসভায় আমাকে বক্তৃতা দিতে হয়েছিল । আর একটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম বুদ্ধদেব বসুর প্রয়াণের পর তাঁর স্মরণসভায় । নানা সাহিত্যসভায় আসতেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত , শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বড় কবিরা । শক্তির তখন সদ্যপ্রকাশিত বই 'প্রভু নষ্ট হয়ে যাই'-এর কবিতা তখন আমাদের মুখে মুখে । শক্তি আমাদের অনুরোধে গমগমে গলায় শুনিয়েছিলেন---" মেঘলাদিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে" । আমাদের খুব প্রিয় কবিতার বই ছিল বিনয়ের 'ফিরে এসো চাকা' , শঙ্খর 'নিহিত পাতালছায়া' , শক্তির 'হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য' । আমার তখনকার কবিবন্ধুদের মধ্যে সব থেকে ঘনিষ্ঠতা ছিল অনুত্তম বিশ্বাস , সিদ্ধার্থ রায় ও সমর চক্রবর্তীর সঙ্গে । এঁরা তিনজনেই প্রয়াত । প্রথম দুজনের সঙ্গে আমি 'সাহিত্যিকা' পত্রিকা নিয়েও যুক্ত থেকেছি । সমরদা অত্যন্ত প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন । কিন্তু অনেকটাই অপচিত মেধা । কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডা দিতে দিতে তাঁর ক্লাস ফাঁকি পড়ে যেত বহুবার । তাঁকে আমি সেই সত্তর দশকে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলাম । তারপর সময়ের বোঝা চাপা পড়ে সে কথা ভুলেও গেছিলাম । মনে পড়ল একটি ঘটনাতে । তিরিশ বছর পর একটি সাহিত্য সভায় গেছি কোচবিহারে । আয়োজক—কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা । মঞ্চ থেকে আমাকে ডাকা হল কবিতা পড়তে । অবাক হয়ে দেখলাম আমাকে টপকে মঞ্চে উঠতে চাইছেন সমরদা । তাঁকে আটকালেন সঞ্চালক প্রয়াত কবি নাসের হোসেন । সমরদা বললেন তিনি মাত্র দুটো কথা বলে নেমে যাবেন । সমরদা শিলিগুড়ির বিদগ্ধ অধ্যাপক ও কবি । তাই তাঁকে মঞ্চে উঠতে দেওয়া হল । সমরদা খুব ভালো বক্তা ছিলেন । তাঁর সেদিনের বক্তব্য ছিল এই যে তিনি আহুত কবি সুবীর ঘোষকে সেই কলেজবেলা থেকেই চেনেন । আরো একটি কথা তিনি বললেন –"সুবীর আমাকে ৩০ বছর আগে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিল যেটি এখনও আমার মুখস্থ থেকে গেছে" । অসম্ভব ভালো স্মৃতিশক্তি ছিল সমরদার । তিনি তারপর আমার সেই কবিতাটি আবৃত্তি করে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন । এমন মধুর স্মৃতি জড়িয়ে যে কবিতার সঙ্গে তার সম্বন্ধে দু'চার কথা বলা উচিত । মহাকবি গ্যেটের একটি কথা Stay there. You are so beautiful. কে আশ্রয় করে এই কবিতাটা লেখা ।
মুনিয়া ওড়ে , চরে হরিণ
ক্রমশ বাড়ে গোপন ঋণ
আর কিছুটা সময় লিখো
হিসেবহীন ঘরে
অসমসমের পূর্বাপরম্
বিপুল চরাচরে । ( ধূসর ভিড়ে / অংশ )
=======================
সুবীর ঘোষ
৩০১ আশ্রয় এ্যাপার্টমেন্ট
গ্রুপ হাউসিং , বিধাননগর
দুর্গাপুর—৭১৩২১২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন