জীবিকার সন্ধানে বা পড়াশুনোর সূত্রে কিছু মানুষ যেতেন একসাথে। একই
ট্রেনের একই কামরায়। সেখান থেকেই সখ্যতা। বাঙালী এক যায়গায় হলে নাকি
কালীপুজো হয় আর হয় সাহিত্যচর্চা। এহেন বাঙালীরা রেলের কামরায় কালীপুজোটি
করলেন না কিন্তু ডেইলি প্যাসেঞ্জারের ভিড়ে দিব্যি চলল সাহিত্য আলোচনা।
সেই সাহিত্য আড্ডা পাকতে পাকতে রূপ নিল একটি লিটল ম্যাগাজিনের—পথের আলাপ।
পথে আলাপ হওয়া মানুষগুলো জড়িয়ে পড়ল পথের পত্রিকায়। ২০১২ সালে ১১ই আগষ্ট
চুঁচুড়ার এক প্রেক্ষাগৃহে 'শুধু সুন্দরবন চর্চার'র সম্পাদক
জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ির হাত ধরে প্রকাশ পেল 'পথের আলাপ' এর
আত্মপ্রকাশ সংখ্যা। তারপর ছয় বছর ত্রৈমাসিক ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে
'পথের আলাপ'। 'লোকাল ট্রেনের কামরা', 'কলকাতার ব্যান্ডপার্টি', 'ডোম',
'ছাতা' প্রভৃতি সংখ্যাগুলো সমাদৃত হয়েছে পাঠক মহলে।
পত্রিকার ষষ্ঠ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা রূপে প্রকাশ পেতে চলেছে—বিশেষ
সংখ্যা—গণিতজ্ঞ কেশবচন্দ্র নাগ সংখ্যাঃ
অঙ্ক শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়। তার উপরে কে সি নাগ!!! সকলেরই শিক্ষার্থী জীবনের
নস্ট্যালজিয়ায় জড়িয়ে কেশবচন্দ্র নাগের নাম। ফুটো চৌবাচ্চা, তেল মাখানো বাঁশে
বাঁদরের ওঠানামা, পরস্পরমুখী ট্রেনের গতিবেগ—এমন কত না হিসেব নিকেশ সাদা পাতায়
করিয়ে নিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তার অঙ্কের মতোই রাশভারী ছিলেন নাকি মিত্র
ইন্সটিটিউশনের (ভবানীপুর) এই প্রধান শিক্ষক। কিন্তু চেনা নামের পিছনে রয়ে যায়
বহু অচেনা কাহিনি।
হুগলীর গুড়াপে জন্মগ্রহণের পর পিতৃহারা হয়ে তার শিক্ষালাভই থেমে যেতে বসেছিল
একসময়। তারপর গ্রামের স্কুল, ভাস্তারা হাইস্কুল, বিহারের কিষানগঞ্জ হাইস্কুলে
পড়াশুনোর পাঠ চললেও পৃষ্ঠপোষক মেজদাদা সুধীরচন্দ্রের মৃত্যুতে আবার থমকে যায়
পড়াশুনো। জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে অবশেষে ISC পাশ। সীমাহীন দারিদ্রতা
সংসারে, সামলাতে কেশবচন্দ্র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন ভাস্তারা যজ্ঞেশ্বর
হাইস্কুলে। এরই মধ্যে সংস্কৃত ও অঙ্ক নিয়ে পাশ করলেন IA পরীক্ষা। তারপর
কিষানগঞ্জ হাইস্কুল, বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলিজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করিয়ে থিতু
হলেন মিত্র ইন্সটিটিউশনে(ভবানীপুর)।
গ্রাম সম্পর্কিত দাদা জিতুদাদা, যিনি পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ
স্বামী বিশুদ্ধানন্দ মহারাজ, তার বিপুল প্রভাব ছিল কেশবচন্দ্রের জীবনে। তার
প্রভাবেই শ্রী শ্রী সারদা মায়ের কাছে দীক্ষাপ্রাপ্ত হন কেশবচন্দ্র। পরবর্তীতে
তার পরিবারের সকলেই এই আধ্যাত্মিক জগতের শরণাপন্ন হন।
কেশবচন্দ্রকে আমরা চিনি অঙ্কের শিক্ষক তথা বইপ্রণেতা হিসেবেই। কিন্তু চেনা
নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে অনেক গল্প। ৪২'এর স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি যোগদান
করে কারাবরণ করেন উনি। যুক্ত ছিলেন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে। নিজের গ্রাম গুড়াপকে
গড়ে তুলেছিলেন নিজের মনের মতো করে। স্কুল, পাঠাগার, শ্মশান—সকল কাজেই বৃদ্ধ
বয়স পর্যন্ত মাঠে নেমে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কলকাতায় থিতু হলেও
সপ্তাহান্তে গুড়াপে তার পদার্পণ ছিল বাঁধাধরা। ছিলেন ক্রিকেট অন্তপ্রাণ।
মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য। সমাজসেবায় আদ্যন্ত জড়িত মানুষটি তার বই
বিক্রির সমস্ত রয়্যালটি খরচ করেছেন গুড়াপের জন্য। বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন
কবিশেখর কালিদাস রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। তার দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে তৈরী
করেছেন চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, সোমনাথ
চট্টোপাধ্যায়ের মতো বহু ছাত্রকে যারা পরবর্তিতে সমাজে প্রতিষ্ঠিত।
এই চেনা নামের পিছনের অচেনা গল্পগুলোকে নিয়েই পথের আলাপের বিশেষ
সংখ্যা—কেশবচন্দ্র নাগ। প্রকাশ আগষ্টেই।
সম্পাদকঃ
চমক মজুমদার
যোগাযোগঃ
৭৯৮০০৮৩৩৬৯
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন