তার আসা-যাওয়া
নিজের দখল সহজে কে আর ছেড়েছে কবে! তবু যখন আসে সে, বড় রকমের একটা সমর্থন
নিয়েই আসে নিশ্চয়ই। তাও কখনও কখনও চলে না কি বোমাবাজি-গোলাগুলি! আবার
কখনও আসে সহজে টেরটি পাওয়া যায় না যেন।
নির্বিরোধী ঋতুরাজের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা বাড়াবার অবসরে কখন সে বাড়িয়ে নেয়
নিজেরই আধিপত্য। তারপর একসময় কানে কানে বলে, তুই তো রইলি বেশ কিছু দিন,
এবার আমাকে আসতে দে! ইতস্তত কণ্ঠে নরম ঋতুরাজ বলে, তা আয় না, কে বারণ
করেছে তোকে! বলে বটে, তবু যেতে কি আর মন চায়! বাবা-বাছা করতে করতেও তার
মধ্যে অগত্যা দু-একদিন একটু জানান দিতেই হয় তাই – কড়া চোখ, চড়া মেজাজ।
স্বভাব যাবে কোথায়! সরাসরি নয় অবশ্য, একটু কায়দার চেষ্টা। আসলে ব্যাপারটা
তো বার্তা পাঠানোর। সমঝদারোঁ কে লিয়ে ...। সব কথা বুঝিয়ে বলতে হবে কেন!
মুখের কথা শুনে ভিতরের কথাটি বুঝতে হবে। কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছ
নিশ্চয়ই। সুতরাং মানসম্মান যদি থাকে তো সময় থাকতে অর্থাৎ মানে মানে কেটে
পড়ো। বাড়াবাড়ি করার দরকার না পড়ে! বার্তাটি পড়তে অসুবিধা হয় না ঋতুরাজের।
আস্তে আস্তে পা টেনে নেয়, ক্রমশ অন্তরালবর্তী।
যাত্রারম্ভ। শুরুতে নরম নরম। সবাই যাতে বরণ করে নেয়। একেবারে ক্ষেপিয়ে
দিলে হবে না। তারপর আস্তে আস্তে দেখাতে থাকো স্বরূপ। দেখিয়ে দাও তাপের
দাপট। বুঝিয়ে দাও নিদাঘ কাকে বলে! অনেক দিন নরমসরম কাটিয়েছে সব। কেমন সব
হয়ে উঠেছে পেলব-পেলব - ভাববিলাসী! প্রেমিক-প্রেমিক, কবি-কবি! কঠিন
বাস্তবটা ভুলতে বসেছে। মধুবাতাই তো কেবল, তাপপ্রবাহ কাকে বলে সেটাও তো
বোঝাতে হবে! দেখাতে হবে প্রখরতা কী! সুতরাং দাপটের পরাকাষ্ঠা! সরসতাকে
শুষ্কতায় পর্যবসিত করো। জ্বালা ধরিয়ে দাও, তৃষ্ণার্ত করে তোলো। বুঝিয়ে
দাও এ জীবন নরম নরম আলোয় পুষ্পসৌরভে মাতোয়ারা মলয়ানিলস্পর্শধন্য মধুর
সংগীত নয় কেবল, তা কঠিন-কঠোরের সঙ্গে সংগ্রামেরও। নবাগতকে জগৎই প্রথমে
দেখতে থাকে, তারপর জগৎকে দেখতে থাকে সেই নবাগতই। দেখতে দেখতে একসময়
দেখাতে থাকে। সেই দেখাতে-থাকা কখনও কখনও সেই দর্শকদের কাছে দেখা দেয়
ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়ে। সুতরাং সমস্তকিছু শুষ্ক মরু হয়ে পড়ার পূর্বে শুরু
হয়ে যায় শোষণমুক্তির মহড়া। পরিণামে অনিবার্য সংঘর্ষ। গগনে কৃষ্ণমেঘের
দোলা দেখে লেলিয়ে দেওয়া হয় তাণ্ডবকারী হাওয়া, শূন্যে শুষে নেওয়ার সবরকম
বন্দোবস্ত করা হয় প্রাণস্পর্শী বৃষ্টিকণার। এ সংঘর্ষ এলাকা দখলের, এ
যুদ্ধ আধিপত্য বিস্তারের। অজস্রশাখ সুদূর-প্রসারিত অগ্নিকৃপাণ ফালা ফালা
করে দিতে চায় আকাশ-পৃথিবী, অশান্ত অগ্নিকণ্ঠ অশনি হানা দেয় মুহুর্মুহু।
কিন্তু সে নিদারুণ নিদাঘ জানে না, কণামাত্র হলেও, তারই অবসরে অতীষ্ঠ
তৃষ্ণার্ত মানুষ পেয়ে যায় প্রাণের সন্ধান! সুতারাং শুরু হয়ে যায় সমবেত
অন্যতর সাধনা।
সে সাধনায় সাড়া দেবে না কে! সুতারাং শুরু হয়ে যায় প্রকৃতির অন্যরূপ লীলা।
আপন সৃষ্টিকে আপনাকেই তো রক্ষা করতে হবে! সবাইকে শেষ করে কী করে বাঁচবে
প্রকৃতি! সবাইকে নিয়েই তো তার অস্তিত্ব। সেই তো সবাই, সবাই-ই তো সে!
সুতরাং সংঘর্ষশেষে বারিময় ঘনাগম। লাজুক-লাজুক বিক্ষিপ্ত থেকে একসময়
একান্ত একনিষ্ঠ লীলাময়ী। নবপ্রাণনা নবপ্রেরণার গীতি আকাশে বাতাসে -
প্রাণমণ্ডলে। বিক্ষিপ্ত তৃষ্ণা নিরারণ থেকে প্রাণময় পরিতৃপ্তি। শুষ্ক,
প্রায়-শুষ্ক আধার টইটম্বুর। ভূপৃষ্ঠ রসসিক্ত, রসময়। তার আগমনই যে শূন্যকে
পূর্ণ করার জন্যে। শোষণে শেষ হয়ে যেতে বসেছে যে, তার কাছে সে যেন
আবির্ভূত অসীম আশীর্বাদরূপে! এই সবেমাত্র প্রাণবায়ু নির্গত হল যার, সেও
যেন কেঁপে ওঠে প্রাণস্পর্শী বারিধারায়! নীরব কণ্ঠ তখনও যেন বলতে চায়, সেই
এলে, একটু আগে আসতে পারলে না! কিন্তু প্রায় সব যুদ্ধই তো কিছু-না-কিছু,
কোনো-না-কোনো রকম বলিদান দাবি করে! তারপর শুরু হয় নবনির্মাণ।
নব-প্রাণোন্মাদনায়। শস্যশ্যামলা পৃথিবীর সেই-ই তো প্রথম প্রণোদনা! ছয় ঋতু
রসসিক্ত করে রাখার দায়িত্ব তো তারই। খারিপ হোক বা রবি, মূলত তারই তো
অবদান – কখনও সরাসরি কখনও সঞ্চয় থেকে। সম্বৎসরের গান বলতে গেলে তারই তো
সরসতায়। গ্লানি ঘুচিয়ে, আবর্জনা সরিয়ে, আদিগন্ত প্রকৃতিকে ধারাস্নান
করিয়ে সেই-ই তো করে নির্মলতা-দান। শস্যে সবুজে সরসতার কল্যাণহস্তে তখন
তার বরাভয়-মুদ্রা। সে যেন সহজ আশীর্বাদ।
আকাশে মেঘভার, বাতাস ভারী। ধরায় জললীলা, কঠিন-কঠোর মৃত্তিকা আদরে যেন গলে
গলে যেতে চায়! আরম্ভ হয় অফুরাণ সৃষ্টির আয়োজন। প্রকৃতি-গর্ভে ঘুমিয়ে-থাকা
বীজে উদ্গম হয় অঙ্কুরের। জমানা কায়েম হয় বর্ষার। কত রূপে লীলা!
পুষ্পবৃষ্টি, ঝিরিঝিরি, মুষলধার, পুবে শর, ইদানীংকার ব্যাপক ব্যবহৃত
নিম্নচাপ। ক্ষণিক থেকে এক-দু-দিন কি সপ্তাহজোড়া। প্রাথমিক খুশি ক্রমশ
বিরক্তিতে পরিণত। সে থামে, বিশ্রাম নেয় ক্ষণিক থেকে হয়তো গুটিকয় দিন।
আবার ধরে। পুরোপুরি ছেড়ে দেয় না। কখনও কূল ছাপিয়ে ওঠে তবু সে ক্ষান্ত হয়
না। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি সম্মিলিত হয়ে কখনও প্লাবিত করে গ্রাম, নগর –
জনপদ। প্রলয়ে গান থামে প্রকৃতির। গান শোনাতে ভয় পায় আকাশনাণী বা
দূরদর্শনও। ধ্বংসকারী তাণ্ডব বা জলযন্ত্রণায় রোল ওঠে কান্নার।
প্রাণস্পর্শী বারি হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী – অজস্র তৃণগুল্ম থেকে বৃক্ষ, মানুষ
থেকে পশুপাখি। নিষ্কৃতির জন্য আবার শুরু হয় প্রার্থনা। ক্বচিৎ থামার
অবসরে, শ্বেত-শুভ্র মেঘ উঁকি দিলে জাগে আশা – শুরু হয় অন্য আবাহন।
কিন্তু কে খোয়াতে চায় রাজত্ব! তাই শুভ্র মেঘ দেখলে লেলিয়ে দেওয়া হয় কৃষ্ণ
মেঘ। আকাশ ঝলমল করে উঠলে পরক্ষণেই কৃষ্ণ কি ধূসর বৃষ্টির মেঘকে পাঠিয়ে
দেওয়া হয় বারিপাতের জন্যে। সে তার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু কোন ফাঁকে
আবার হেসে ওঠে আকাশ! আবার বৃষ্টি নিয়ে ধেয়ে আসে মেঘ। বৃষ্টি ঝরায় মাঝারি
থেকে ঝিরঝির। কেন-না সে তখন ক্ষীয়মান-শক্তি। কিন্তু জমি ছাড়তে চায় না
একচুলও। সুতরাং চলতে থাকে রোদ-বৃষ্টির দ্বন্দ্ব, লুকোচুরি। তারই মধ্যে
ভেড়ির উপর হেসে উঠতে থাকে কাশ, উদ্যান বা লোকালয়ে শিউলি। তারাও সঙ্গত করে
ধূসর বৃষ্টির-মেঘের ফাঁকে হেসে-ওঠা সূর্যকে। ব্যাপারটা অসহ্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু একটানা ঘণ্টা থেকে সপ্তাহ দাবিয়ে রাখার সামর্থ্য তখন তার অস্তমিত।
সেই ফাঁকে মুচকি হেসে শরৎ বলে, অনেক তো হল – আর কেন! এবার যা – আসতে দে
আমাকে। সবাইকে একটু স্বস্তি-শান্তির মুখ দেখতে দে! আস্তে আস্তে শরতের সে
দাবি না মেনে আর উপায় থাকে না বর্ষার।
=================================================
--অরবিন্দ পুরকাইত
মগরাহাট, দঃ ২৪ পরগনা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন