google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re আশিস চৌধুরীর মুক্তগদ্য - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

বুধবার, ১৮ জুলাই, ২০১৮

আশিস চৌধুরীর মুক্তগদ্য




বাদল বাউল বাজায় রে একতারা



গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহে যখন শরীর মন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে তখন আমরা চাতকের মত আকাশপানে চেয়ে থাকি,দেখি মেঘ করেছে কি-না। এ যেন যক্ষপ্রিয়ার মত মেঘের অপেক্ষায় বসে থাকা।এখন অবশ্য বর্ষা সময়মত আসে না। বড় অভিমানী হয়েছে সে। মৌসুমীবায়ু যে সময়ে এই বাংলায় প্রবেশ করার কথা তা এখন করে না,কিছুটা বিলম্বিত বলা যায়ঋতুচক্রে এখন অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেছে বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে একথা আমরা আজ সকলেই জানি।আর এই বিশ্ব-উষ্ণায়নের মূল কারণ হচ্ছে অতি আধুনিক মানুষের লাগামছাড়া ভোগবিলাস।কাজেই বর্ষার আগমন একটু দেরিতে হলেও আমরা আগের মত অস্থির হই না,অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে।
সুতরাং বর্ষা দেরি করলেও আমরা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে কার্পণ্য করি না।তার আগমনে আমাদের হৃদয় ময়ূরের মত নেচে ওঠে।আমরা যেন এইভাবে অভ্যর্থনা জানাই-‘এসো শ্যামল সুন্দর/আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।ঋতুচক্রের নিয়মানুযায়ী আষাঢ়,শ্রাবণ-এই দুমাস বর্ষাকাল।তা সত্ত্বেও ভাদ্রমাসেও কিন্ত যথেষ্ট বৃষ্টি হয়।তবু আষাঢ়-শ্রাবণ কে নিয়েই আমাদের যত কাব্য,গান আর নস্টালজিয়া।এই মুহূর্তে আমারই মনে পড়ে গেল-আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন..... এই গানটিকিংবা ধরুন রবীন্দ্রনাথের এই গানটির কথা-আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে/এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি।রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু যেমন বর্ষা এবং বসন্ত তেমনি আমাদেরও অনেকের প্রিয় ঋতু বর্ষা এবং বসন্ত।এই দুটি ঋতুই আমাদের অনেক পুরনো স্মৃতি উসকে দেয় অর্থাৎ আমাদের নস্টালজিক করে তোলে।আরও একটি গানের কথা মনে পড়ে গেল- বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা/তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।আষাঢ় আর শ্রাবণকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেক গান রচনা করেছেন। শ্রাবণবরিষন পার হয়ে কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে, কিংবা যায় দিন শ্রাবণদিন যায় , এই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে এইসব গানের কথা এই বর্ষায় মনে পড়ে গেল।আর আছে ভানুসিংহের পদাবলীর এই গানটি-শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটানিশীথ যামিনী রে।কালীদাসের মেঘদূত আর রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান আমাদের বড় স্মৃতিমেদুর করে তোলে ও এক অনন্য অনুভূতি এনে দেয়।বিরহী যক্ষের অন্তরের কথা উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের এই গানে-‘মন মোর মেঘের সঙ্গী উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসংগীতে....।বিরহী যক্ষ মেঘকে যতই তার প্রিয়ার কাছে যাওয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করুক না কেন আমাদের কিন্তু অনেক সময় মনে হয় এই যক্ষ এবং মেঘ যেন এক এবং অভিন্ন সত্ত্বা।নজরুলের গানেও সেই যক্ষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়-পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে বলিও আমার পরদেশীরে....কারণ অদৃষ্টবশে তার প্রিয়া আজ দূরবর্তী তাই পরদেশি।ধনপতী কুবেরের ক্রোধে সে আজ প্রিয়ার
সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে রামিগিরি পর্বতের একটি আশ্রমে নির্বাসনে রয়েছে। আমরাও তো এক বছরের মত সময় বর্ষার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত থাকি।
ছোটোবেলা থেকে এই বড়বেলা পর্যন্ত আমাদের জীবনে বর্ষার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছেজল পড়ে পাতানড়ে থেকে সেই যে শুরু তারপর বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর হয়ে এই এখনও পর্যন্ত নানান স্মৃতি। এসব তো আছেইআর আছে বর্ষা মানে ইচ্ছে করে স্কুল থেকে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফেরা,কখনও বা ভিজতে ভিজতে স্কুলে যাওয়া এবং রেনিডে  ঘোষিত হওয়ার উল্লাসে মেতে ওঠা, বন্ধুরা সকলে মিলে ভিজতে ভিজতে ফুটবল খেলা,খিচুড়ির জন্য বাড়িতে আবদার করা ,ছোটো ছোটো কাগজের নৌকা গড়ে জলে ভাসিয়ে দেওয়া-এইসব নানা মজার স্মৃতি।গ্রামের বাড়ির উঠোন দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তাদের মনে পড়ে বৃষ্টির জমে যাওয়া জলের ওপর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়ে যে বুদবুদ সৃষ্টি হয় এবং নিমেষে মিলিয়ে যায় সেদিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকার গভীর আনন্দের কথা।
       আজি ঝর ঝর মুখর বাদর-দিনে/ জানিনে, জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।বর্ষা আমাদের কেমন যেন উদাস করে দেয়।আমরা স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকি। পুরনো স্মৃতগুলোকে সে যেন জাগিয়ে দিয়ে যায়। মন যেন মেঘের সঙ্গী হয়ে ওঠে আর তারপর  অবস্থাটা অনেকটা এরকম-‘ চিত্ত আমার হারালো আজ মেঘের মাঝখানে।বর্ষার মেঘকে সঙ্গী করে আমাদের এই মানসভ্রমণ এক অনন্য অনুভূতি এনে দেয়।বর্ষার রূপের তো কোনও শেষ নেই।ঝিঁঝি পোকার ডাক,ব্যাঙের ঘ্যাঙ ঘ্যাঙর,টিনের চালে ঝমঝম শব্দ- সব মিলে এক অপুর্ব অর্কেষ্ট্রা শুনতে পাই।আবার কোথাও বা প্রবলবেগে কলকল করে জল বয়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়।‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান’-রবীন্দ্রনাথের গানের এই লাইনটি কত কথা মনে করিয়ে দেয়।মরসুমের প্রথম প্রবল বৃষ্টিপাতে মনের ক্যানভাসে কত ছবিই না ফুটে ওঠে।বর্ষা আসলে বড় স্মৃতিজাগানিয়া।সুখ-দুঃখের অনেক স্মৃতিই তার পদসঞ্চারে জেগে ওঠে।রবীন্দ্রনাথ বড় সুন্দর করে বলেছেন-‘তোমায় গান শোনাবো তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া/বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক ওগো দুখজাগানিয়গানটি প্রেম পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও এ গান বর্ষারাতের এক বিশেষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি রচনা করেছেন ,এটা অনেকেই জানেন।গ্রাম-বাংলায় বর্ষার অপরূপ রূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।‘আমরা চাষ করি আনন্দে /মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধেশহুরে মানুষ এই দৃশ্য ট্রেনের জানলা থেকেও দেখতে পায়।বর্ষার একটি ভয়াবহ রূপের কথা না বললেই নয়,তাহল বন্যা।প্রত্যক বছর এই বর্ষায় প্রবল বন্যায় সাধারণ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এখন বর্ষার রূপ অনেকটাই পাল্টে গেছে। অনেকদিন আগের কথা যদি আমরা মনে করি তাহলে দেখবো তখন দু-তিন দিন ধ’রে টানা এমন বৃষ্টি হ’ত যে মানুষ বাড়ির বাইরে যেতে পারত না। বাড়ির জিনিষপত্রে ছাতা পরে যেত, জামাকাপড় শুকত না।তার অনেকটা আভাস আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের এই গানটিতে-‘বাদল-বাউল বাজায় রে একতারা/সারাবেলা ধরে ঝরোঝরো ঝরো ধারা/জামের বনে ধানের ক্ষেতে আপন তানে নেচে নেচে হ’ল সারা।’মনে পড়ে যায় এই আধুনিক গানটির কথা-থৈ থৈ শাওন এল ওই/পথহারা বৈরাগী রে তোর একতারাটা কই।এখনসেরকমবৃষ্টিপাতখুবএকটানজরেপড়েনামেঘ থেকে বৃষ্টি আবার এই বৃষ্টির জল বাষ্পায়িত হয়েই মেঘের সঞ্চার করে। অর্থাৎ  মেঘ যেন অনেকটা সেতু বন্ধনের কাজ করে। বিরহের পর ক্ষণিক মিলন তারপর আবার বিরহ। প্রকৃতিতে এবং মানবজীবনে এই ক্রম চলতেই থাকে।‘মেঘদূত’ এ মানুষের চিরবিরহ বোধের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। কালিদাস যক্ষের ব্যক্তিগত বিরহব্যাথাকে সর্বজনীন করে তুলতে পেরেছেন বলে অনেক সময় আমাদের মনে হয়।‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে/আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে’-রবীন্দ্রনাথের এই গানে যেন বিরহকাতর যক্ষপ্রিয়ার কণ্ঠস্বর শোনা যায়।কালিদাস এর মেঘদূত আর রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান আমাদের সকল অনুভবকে এমনভাবে প্রকাশ করেছে যে আমরা অভিভূত হয়ে যায়। এই বর্ষায় বৃষ্টিধারার সাথে রবীন্দ্রনাথের গানের ঝর্ণাধারায় অবগাহন করে আমরা শরীর ও মনের দাহ জুড়াই।



আশিস চৌধুরী, বি—৪/৩,রাস্তা নং-৫, রিভারসাইড টাউনশিপ, ডাকঘর-বার্নপুর, জেলা- পশ্চিম বর্ধমান।

৪টি মন্তব্য: