আমার বর্ষামঙ্গল
অতদূর পেছনে কী চোখ যাবে ? চোখ না গেলেও মন নিশ্চয় যাবে । সে অনেক কাল আগের
কথা । প্রায় ছ-ছটা দশক পেরিয়ে গেল । এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে ঋতুর কী অপরূপ
ভারসাম্য ছিল তখন । স্কুলে ঢুকবার আগেই জেনেছিলাম বাংলা মাসগুলোর নাম । স্কুলে
ঢুকে জানতে পারলাম একজোড়া করে মাস নিয়ে আবার ছ'টা ঋতু আছে আমাদের । সেই আনন্দে
ন'বছর বয়সে লিখে ফেললাম ছয় ঋতু নিয়ে একটা কবিতা । আমার জীবনের দ্বিতীয় কবিতা
। 'পথের পাঁচালী' পড়তে গিয়ে পেলাম একটা কথা----কালে বর্ষতু পর্জন্যাঃ । তা
আমাদের সেই শৈশবে মেঘেরা কালেই বর্ষাত । তীব্র দাবদাহের পর কালো মেঘের সম্ভার
নিয়ে এসে যেত আষাঢ়--বর্ষাঋতুর প্রথম মাস । আষাঢ় -এর ঢল বলে তখন একটা কথা শোনা
যেত । এখন শুনি না । কেন না এখন তো সেই ঢল আর নামে না আষাঢ়ে । শ্রাবণে ছিল
ধারা ।
উতল-ধারা বাদল ঝরে সকল বেলা একা ঘরে ------রবীন্দ্রনাথের সুরে মন উদাস
হয়ে হারিয়ে যেত সুদূর তেপান্তরে যেখানে মাঠের বুকে অনবরত আছড়ে পড়ত বাদলধারা ।
উঁচু উঁচু তালগাছগুলোর মাথা দুলত হাওয়ায় । কখনো সে বাতাস হত পাগলপারা ।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দূরাগত বকের সারি মাঠ পেরিয়ে এসে আশ্রয় নিত বিশাল বিশাল
তেঁতুল গাছে । হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে সব থেকে বিপদে পড়ত ছাগলের পাল । আশ্রয়ের খোঁজে
তারা তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে বাড়ির কোনো দাওয়া বা খোড়ো ঘরের চালের
নিচেটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ত । স্কুল থেকে ফিরতে গিয়ে ছুঁচ ফোটানো বৃষ্টির
কত না অত্যাচার
সহ্য করতে হয়েছে । ছুটির সময়কার কিছু মজার গল্প মনে পড়ছে । ছুটির ঘণ্টা বাজছে
। শেষ ক্লাসের স্যার আমাদের মুখ দেখেই বুঝে গেলেন । বললেন-- ক 'জনের কাছে ছাতা
নেই ? দু' চার জন ছাড়া কারো কাছেই নেই । তিনি বললেন --বর্ষাকালে ছাতা আনতে মনে
থাকে না তোদের ? বললাম --কাল থেকে স্যার আর ভুল হবে না । তিনি বললেন ---সেই
শেয়ালের গল্প জানিস তো । তোদের অবস্থা সেই শেয়ালের মতো । কোন শেয়াল , কোন
শেয়াল ---আমরা উদ্গ্রীব । মাষ্টারমশাই গল্প শুরু করলেন--- এক মাঠে এক শেয়াল
ছিল । সে সকালবেলা গর্ত থেকে বেরিয়ে যেত । রাতে নানা কিছু খেয়ে গর্তে এসে
ঢুকবার চেষ্টা করত । কিন্তু খেয়েদেয়ে পেট ফুলে থাকায় গর্তে ঢুকতে তার খুব কষ্ট
হত । সে শপথ নিত কাল সকালে বেরুবার সময় গর্তের মুখটা বড়ো করে তবে যাবে ।
কিন্তু সকালে খুব সহজেই বেরিয়ে যেত বলে সে কথা আর তার মনে পড়ত না । রাতে এসে
আবার সেই একই অসুবিধার সম্মুখীন হত । তোদের অবস্থা সে রকমই । এখন ভাবছিস কাল
ছাতা আনবি । আবার কাল সকালে বৃষ্টি না থাকলে ছাতার কথা আর তোদের মনে পড়বে না ।
২
জুতো ভিজে গেলে খুব অসুবিধা হত । তখন এক জোড়াই তো জুতো । মা সেই ভেজা জুতো
উনুনের গায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুকিয়ে দিতেন । ছুটির দিনে সকালবেলা বৃষ্টি নামলে
খুব মজা হত । পড়াশুনো নেই । জানলা দিয়ে ঝমঝম বৃষ্টি পড়া দেখা । প্রবল হাওয়ায়
কখনো কখনো বৃষ্টির জল মাটিতে পড়ার আগেই উড়ে যেত । তারাকেওট আসত বিশাল একটা
ঝুড়িতে টাটকা মাছ নিয়ে । মাথা বাদ দিয়ে প্রায় পুরো শরীরটাই ভেজা তার । মাথায়
একটা তালপাতায় বোনা ছাতি যাকে আমাদের ওদিকে বলে --'মাথালি' । মা বানাতেন
খিচুড়ি সঙ্গে
অন্যান্য ভাজাভুজি আর মাছভাজা ।
স্কুলের একটু উঁচু ক্লাসে ছিল সংস্কৃত । মেঘদূত , বিশেষ করে বর্ষায় পড়া মেঘদূত
পড়ে মন উদাস হয়ে কোন্ কল্পরাজ্যে যেন হারিয়ে যেত । যক্ষের দুঃখের সঙ্গে নিজেকে
একাত্ম করে ফেলতাম ।
নীপং দৃষ্ট্বা হরিতকপিশং কেশরৈরর্ধরূঢ়ৈ-
রাবির্ভূতপ্রথমুকুলাঃ কন্দলীশ্চানুকচ্ছম্ ।
জগধ্বারণ্যেষ্বধিকসুরভিং গন্ধমাঘ্রায় চোর্ব্যাঃ
সারঙ্গাস্তে জললবমুচঃ সূচয়িষ্যন্তি মার্গম্।।
আধফোটা কদম্ব, কটারঙ সবজে , ভুঁইচাঁপা নদীটির দু পাশে,
শুকনো মাটিতে ফোঁটা , মাতাল করা ঘ্রাণে হরিণ-হরিণী ছোটে কী আশে ?
বর্ষা, বর্ষা এলো , এসেছে সে খবর , প্রতি বিন্দুতে দিক নির্ণয়
অরণ্যে হৈ হৈ , হরিণীর খবরে নেচে ওঠে বৃক্ষ-কেকা-জলাশয় ।
তখন বিনোদন বলতে একমাত্র রেডিও । বেতারে বর্ষামঙ্গলের লংপ্লে রেকর্ড বাজত । কখনও
প্রাণভরে শুনতাম---এ কী গভীর বাণী এল ঘন মেঘের আড়াল ধ'রে / সকল আকাশ আকুল ক'রে
...
বর্ষায় বানভাসি হত ফি বছর । কত লোক ভিটে ছেড়ে স্কুলবাড়িতে । শুকনো ডাঙায় ।
মাঠঘাট জলে থৈ থৈ । শাকসব্জির দো-ফসলি খেত সন্তান হারানো মায়ের মতো কাঁদে ।
নামগোত্রহীন যে ছোট নদী যার পরিচিতি কাঁদর নামে সে-ও ফুঁসতে থাকে । আমার জীবনে
ছোটবেলার নদী বলতে হিংলো আর ময়ূরাক্ষী । এবং বড়বেলায় অজয় ও দামোদর ।
মেদিনীপুরের বন্যাত্রাণে সাহায্যের জন্য গান গেয়ে গেয়ে একদল মানুষ আসতেন
দেখেছি ।
শালনদীর নিচু ব্রিজ জলে ডুবে গেলে জল না নামা পর্যন্ত বাস বন্ধ থাকত মনে আছে ।
বর্ষায় খেতের সব্জি গলে গেলে খাওয়াদাওয়ার কষ্ট হত মানুষের । তারই মধ্যে
বর্ষার খাবার
বলতে আমার পছন্দ ছিল পুঁইশাক ও গাঁঠিকচু । ফলের মধ্যে আম ও জাম । কাঁঠালের
ভক্ত আমি
৩
কোনোদিনই নই । ধোবাপুকুরের পাড়ে একটা জাম গাছ ছিল । অপর্যাপ্ত জাম । খেয়ে শেষ
করা যেত না । আর অগতির গতি খিচুড়ি তো ছিলই ।
বর্ষায় আমার একটা বিলাসিতা ছিল--কবিতার । কবিতা যেমন লিখতাম তেমনই প্রচুর
কবিতা পড়তাম
। এখন বর্ষা অনেক বদলে গেছে । আগেকার বর্ষার কথা ভাবলে আমি চলে যাওয়া প্রেমিকার
দুঃখ অনুভব করি । এ লেখা শেষ হোক আমারই এক কবিতায় ---
*বর্ষা যে যায় যায়*
খুব নীরবে যে জল এসে জমেছে
কাপড়মেলা তারে
সে কোনোদিন পূর্বমেঘের দেখা পায় নি ।
জল থেকে উঠে আসা মাত্র
যারা কচ্ছপ ধরে বেঁধে এনে
কাঠের সন্ধানে যেত
তারাই আজ বালির ওপর ছাতা ধরে
চিল তাড়াচ্ছে ।
খুব ইচ্ছে করে এমন একটা মেঘ যদি ফেরে
যে উড়িয়ে নিয়ে যাবে চিল
আর নিজে ছোট্টো পাখির মতো
এসে বসবে আমাদের কাপড়মেলা তারে ।
আমাদের বর্ষা যে যায় যায় ।
=============================
সুবীর ঘোষ
দুর্গাপুর
খুব ভালো লাগলো সুবীরদা।
উত্তরমুছুন