বর্ষা যখন জীবনজুড়ে
বর্ষার জল ঝরে, সারা জীবনজুড়ে, দুনয়ন থেকে। বিয়ে হল। কলকাতার, ধনী
ব্যবসায়ী বাবার, সুন্দরী কন্যা। পাত্র বি কম পাস। বেসরকারী চাকুরীরত।
হুগলীর কিন্তু ভাড়া থাকে দুজনে হাওড়ায়। ছয় বছরে, প্রথমে একটি মেয়ে, বিয়ের
এক বছর পরে, ও তার তিন বছর পর আর একটি ছেলে হল। এদের মাঝে হুগলীর গ্রাম
থেকে পড়তে এল ভাই। দাদাবৌদির মাঝে ভাঙ্গন এল। ভাই রয়ে গেল। বউ ও সন্তানরা
গেল সেই গ্রামে। এর আগে বউটি কখন গ্রাম দেখে নি। পরে আর এক ভাই গেল দাদার
কাছে থেকে পড়তে, হাওড়ায়। এখানে শ্বাশুড়ি, শ্বশুর, তিন ননদের নির্যাতনে
কাটে বউটির জীবন। হারিকেনের আলো। ইলেক্ট্রিক ফ্যান নেই। ওঃ কি কষ্ট! হাত
পাখায় হাওয়া করে করে, গরমে মেয়ে ও ছেলেকে রাতে ঘুম পাড়ায়। সারারাত চলে,
মায়ের ডানহাত। কয়েক বছর পর তাই সে হাত যন্ত্রনায় চটপট করতে লাগলো। তবুও
টিউ অয়েলে পাম্প করে করে দশ মিনিট হেঁটে রোজ সকালে ও বিকালে, বড় বড়,
লোহার দশ বালতি জল তোলে, এইই ডান হাত। স্বামী প্রতি শনিবার রাতে আসে আর
রবিবার বিকালে চলে যায়, হাওড়ায়। পায়খানা নেই, তাই, পত্নী রাতে খায় না।
একা রাতে দূরে মাঠে মল ত্যাগ করতে যাবে কি করে? কেউ তো তাকে সাথে করে
নিয়ে যাবে না। সে যেখানে শোয়, সেঘরটি, বেশ অনেকটা দূরে। ও বাড়িতে বাড়ির
অন্য সবাই শোয়। দিনে বউটি সেখানে রান্না করে। সবাইকে খেতে দেয়। আর রাতে
দূরে শুতে দেয়, বাচ্চাদের নিয়ে। বর্ষায় ছাতা মাথায়। জল বয়। বাচ্ছাদেরও
কাদায় নামায় না। কোলে করে নিয়ে যায়। বিছানায় ছাদ থেকে বর্ষার জল পরে।
বিছানার ওপরে কলসী বসিয়ে রাখে, তাই। এতে জল জমে। তিনটে কলসী রাখতে হয়।
তিন জায়গায় জল পরে যে! ....... দুচোখ মায়ের জলে ভরে। বাবার বাড়ীতে কখনও
ভাবে নি, জানেও নি, এ সব, বিয়ের আগে। ছেলেটা খুব ভালো পড়ালেখায়! কোলকাতা
উনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ পেয়ে এম কম পাস করল। আই সি ডব্লিউ এ তেও
ফার্স্ট হল, হাওড়ার মধ্যে। গ্রাম থেকেই যাওয়া আসা করে, পড়ে। দু কাকার
জ্বলন হল। মানসিক অত্যাচার করে করেও যখন পারল না, তখন দাদাকে, অর্থাৎ
বাবাকে ছেলের বিরুধ্যে লাগল। তাও ছেলেটি এগিয়ে চলেছে..... হঠাৎ সাইনাস
হল। অপারেশন হল। নার্ভের রোগ হল, তাই। কিছু বছর পর, নিজের গ্রামের শোবার
ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেল। মাটি অর্ধ পাগলিনী। চির বর্ষা তার দু
আঁখিতে...
গ্রামের নামটি, চৈতন্যবাটী, জেলা, হুগলী। ছেলেটির নাম, আশিস নন্দী। মায়ের
নাম, সবিতা নন্দী। যদি পার, সেখানে গিয়ে দেখে এসো, সেই সে ছেলে ও মায়ের
শোবার ঘর। মাও এখন আর নেই। ছেলের কাছেই চলে গেছে, স্বর্গে। ঘরটি কিন্তু
ঠিক আগের মতোই আছে। ছেলেটি যে মৃত্যুর আগে মায়ের কষ্ট দূর করার জন্য
সারিয়েছিল। এক বছর তাই আর ছাদ থেকে বর্ষার জল, বিছানায় পড়ত না। আর
সারানোর এক বছর পরই সেই সে ঘর হল তার, শেষ শোবার ঘর। তার স্কলারশিপের
পাওয়া টাকা মায়ের নামে নোমিনি করে, পুত্র রেখে গেছে। মায়ের চক্ষে এক
বিন্দুও আর জল নেই।
==========ooo=========
© অঞ্জলি দেনন্দী, মম
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন