বিশ্ব কবিতায় বর্ষার সেকাল একাল
কিংবদন্তী ক্ষণার বর্ষার উক্তি হচ্ছে: চৈত্রেতে থর থর বৈশাখেতে ঝয় পাথর
জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে, তবে জানবে বর্ষা বটে। ছোট্ট বেলায় বর্ষা কেটেছে
হাটুজল বিলের শাপলা ফোটা শুভ্র সকাল দেখে দেখে। একদল দস্যু তারুণ্যের
শাপলা তোলার আনন্দে। চারদিক টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ আর টইটম্বুর ভিজা ভিজা
প্রকৃতির সবুজ আঁচল। বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় কলাপাতার নড়ে চড়ে ওঠা আর কচু
পাতার হঠাৎ হঠাৎ চিৎপটাঙ তারই মধ্যে কোলা ব্যাঙের বৃষ্টি হতে নিজেকে
লুকাবার জানবাজি চেষ্টা। মেঘদেবের ডমরু ডাক ধূসর অন্ধকারে দখিণা জানালার
দৃশ্যপট। রাত্রির উন্মাতাল ঝড়ের তান্ডবে চৌচালা ঘরের পশ্চিমে পুকুর পাড়ে
ছিঁড়া কদমের বুক ভরা হাহাকারের সকরুণ দৃশ্য। বাংলার প্রকৃতির বর্ষা ঋতু
বড় অস্থির করে সারাটা সময়। উজানী পোয়াতি পুঁটি লাল বেনারশী পরে জল রেখে
জয় করতে চায় ডাঙ্গার আদর। কলমীর চিকন ডালে লাগে জলজ হাওয়া। দোয়েল পাখিটা
মত্ত হয় নৃত্যে। বর্ষায় হয় তার আরোজ গোসল। দাঁড় কাকটি ভিজে জবুথুবু
দেয়ালের আড়ালে। বাংলা ষড়ঋতুর দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা। বর্ষা বলেই আকাশের বিরহ
ব্যথা প্রবল হয়ে ওঠে। বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজলে শাপ মোচন হয়। বর্ষাকে অনেকেই
নারীর সঙ্গে তুলনা করেন। মেঘকে কবি কালিদাস মেঘদূত বলেছেন। রবীন্দ্রনাথতো
বর্ষাকে জন সাধারণের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। বলা বাহুল্য যে,
রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে বহু মাত্রিকতায় উপস্থাপন করেছেন। বর্ষা কবিদেরকেই
সবচেয়ে আন্দোলিত করে। এজন্য প্রকৃতির বর্ষা কবিদের মনে অন্যরকম দোলা দেয়।
যা থেকে রস আস্বাদন করে কবিরা লিখে চলেন তাদের মনে উৎসারিত কথামালা।
কেননা, কবিরা কেবল প্রকৃতির কাছেই দাসত্ববরণ করেন। আর বর্ষার তপস্যা
সেজন্যই কবিদের আরাধ্য বিষয়। বর্ষাকে কবিরা বিভিন্ন উপমায় ব্যবহার করে
থাকে। কি তবে এই বৃষ্টি ? ঐ দূরের আকাশ থেকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে
ভূপৃষ্ঠের দিকে যে জল পড়ে। এগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত
হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। এই ফোঁটাগুলি যথেষ্ট পরিমাণে ভারি হলে তা পৃথিবীর
বুকে বৃষ্টি নামে ঝরে পড়ে। বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে বৃষ্টি সুপেয় জলের
সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে এই বৃষ্টি। বৃষ্টি ছাড়া বনাঞ্চল কল্পনাই করা যায় না।
বর্ষার খোলাসা বুকে কবিতার প্রেম থাকে, ফুলের যৌবন থাকে, মেঘে মেঘে
প্রেমিকার অভিমান থাকে। প্রমথ চৌধুরী বর্ষার বৃষ্টিধারাকে কখনো নদীর
কুলুধ্বনি কখনো পাতার মর্মর, জলের শব্দ, বাতাসের সুর ও স্বরকে মিলিয়ে এক
সুরে গাঁথতে চেয়েছেন। এজন্যই কালিদাস বর্ষাকে মেঘদূত, জয়গোস্বামী
মেঘবালিকা, নির্মলেন্দুগুণ দ্রৌপদী আর আমি বলি মেঘদেব।
তাই বলতে চাই :
বর্ষার পুজো দিতে চাই কদম ফুলই
কুমুদ কিংশুক কৃষ্ণচূড়ার কোন কাজ নেই
মেঘ দেবতার মধুময় খুশিতে কচি পাতার বিসর্জন
আর কদম ফুলের আরতি সুখে আষাঢ়ী
আমি বলি এ সব নিয়ে
নাতিষ্ণ হাঙ্গামা করে লাভ কী
থাক কালিদাস কদম ফুলে মহাসুখে। (রীনা তালুকদার)
সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাসের মেঘদূত বর্ষাকে নিয়ে একমাত্র সাহিত্য সৃষ্টি
যা অন্য কোনো সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মেঘদূতের কাহিনী অনুযায়ী
কুবেরের কর্মচারী এক যক্ষ স্ত্রৈণতাবশত: রাজকার্যে অবহেলা করায়
শাপদগ্রস্ত হয়ে সব ক্ষমতা হারিয়ে এক বছরের জন্য রাসগিরি পর্বতে নির্বাসিত
হন। নির্বাসিত সময়ের আট মাস পর প্রিয়তমার বিরহব্যথায় উন্মত্তপ্রায় যক্ষ।
বিরহী যক্ষ নিজের অবস্থা বিবেচনা করে- (যক্ষ) যে মরেনি এবং আবার তাদের
মিলন হবে এই সংবাদটা তার স্ত্রীকে পাঠালে হয়তো সে বেঁচে যাবে; এই ভেবে
মেঘের দ্বারা নিজের কুশল সংবাদ স্ত্রীর কাছে পাঠাতে মনস্থ করে। মেঘকে দূত
বানিয়ে তার বিরহ জীবনের মনোকষ্ট ব্যক্ত করে মেঘকে প্রিয়ার কাছে পাঠান।
পেছনে যক্ষের প্রেমিক যদি মেঘকে চিনতে না পারে, যদি মেঘকে ভুল বোঝে! সে
কথা মনে রেখে মেঘকে গোপন কথাটি বলে দেয়। যে কথটি যক্ষ এবং তার প্রেমিকই
জানে। মেঘের মারফত গোপন কথাটি শুনে প্রেমাস্পদ নিশ্চয়ই নিশ্চিত হবে যে,
আসলে যক্ষই মেঘকে পাঠিয়েছে। গোপন সেই কথাটি :
ÔÔহে মেঘ তোমাকে আর একটি গোপন কথা বলে দিচ্ছি, যাতে সে নিঃসন্দেহে বুঝতে
পারবে তুমি আমার আপনজন এবং তোমাকে আমিই পাঠিয়েছি। তাকে বলবে, মনে পড়ে
তোমার একদিনের কথা ? কোনো এক রাতে তুমি যখন আমার কণ্ঠলগ্না হয়ে গভীরভাবে
ঘুমোচ্ছিলে তখন হঠাৎ অকারণে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। তোমার ঘুমন্ত
অবস্থায় কান্না দেখে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তুমি কেঁদে উঠলে? তখন
তুমি মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলে, আমি স্বপ্নে দেখলাম তুমি অন্য এক নারীর
সঙ্গে ছিলে। এই গোপন কথাটি বললে তার মনে আর কোনো সন্দেহ থাকবে না।ÕÕ কী
গভীর অনুভূতির কথা। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য আর গোপন সেই অভিসারের ভাবনায়
আচ্ছন্ন কবি। প্রাচীন যুগে কালিদাস, মধ্য যুগের কবি বড়– চন্ডীদাস,
বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ চন্দ্র দাস তাদের লেখায় বর্ষাকে উপমা
হিসাবে নিয়েছেন। শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন কাব্যে রাধার কণ্ঠেও বেজেছে বর্ষা
নৃত্য মাদল-
ও সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর..
অন্যত্র বলেছেন-
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইলো বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে।
আদিকাল থেকেই বৃষ্টির সাথে মানুষের প্রেম। বৃষ্টি মানুষের প্রথম প্রণয়।
বাঙ্গালীর অনেক রোমান্টিক স্মৃতির আধার এই বর্ষা। এই বর্ষা
নির্মলেন্দুগুণ তো বর্ষাকে ধ্রুপদি দ্রৌপদী বর্ষা বলেই ক্ষ্যান্ত হননি
বরং বলেছেন- ষড়ঋতুর মধ্যে গ্রীস্মদেব ঠাকুর, লেখক শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়, নায়ক বসন্ত চৌধুরী, গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কবি শীতলদাস
জোয়ারর্দার এরা সবাই পুরুষ আর একমাত্র নারী হচ্ছে দ্রৌপদী বর্ষা। তিনি
বর্ষার স্ববিরোধীতায় বলেছেন :
ক) আমি জন্মেছিলাম এক বিষন্ন বর্ষায়
কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত
আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে
কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল।
আবার কবি অন্য জায়গায় বর্ষার আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছেন। সেখানে বর্ষাকে
তিনি হৃদয়ের উষ্ণতায় আলিঙ্গন করে যেনো হৃদয়ের ভিতরেই কদম ফুটিয়ে বলেছেন :
খ) আষাঢ় এল আষাঢ় এল আষাঢ় এল
সজল চোখে কাজল মেখে
বাতাস এলো আকাশ ঢেকে
ছুটল মেঘ আকাশ ভরিয়ে
ফুটল কদম কেশর ছড়িয়ে
সেই সুবাসে হৃদয় আমার জড়িয়ে গেল।
হিসেব নেই বর্ষা নিয়ে কত, কবিতা, গল্প, ছড়া, গান রচিত হয়েছে । সংস্কেৃত
ভাষার কবি কালিদাস বর্ষাকে আবিস্কার করেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ বর্ষার রূপ
বন্দনায় মানুষের জীবনের সাথে সমন্বিত রূপে পূর্ণতা দিয়েছেন। নাগরিকের নগর
জীবনে ছুটে চলা ব্যস্ততায় বর্ষার দিনে আকাশের দিকে চেয়ে দেখে। আজ কি রকম
আকাশের রঙ। তাকিয়ে একবারের জন্যে হলেও তার প্রিয় বর্ষার কবিতা বা গানটি
গুণগুণ করে মনে কোণে বাজিয়ে নেন। বর্ষাকে আমন্ত্রণ জানায় বাঙালীরা
বর্ষার কবিতা ও গান দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন অসাধারণ বর্ষা প্রেমিক
ছিলেন। গীতবিতানে প্রকৃতি পর্যায়ের গানের সংখ্যা ২৮৩। এর মধ্যে বর্ষা
পর্যায়ের গানের সংখ্যাই ১২০টির মতো। এমন কোনো কবি নেই যে কবি তার কবিতায়
বর্ষাকে স্থান দেননি। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য লেখা রয়েছে বর্ষাকে নিয়ে।
বর্ষাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত লেখা গুলোর দুÕএকটি চরণ হচ্ছে :
ক) নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে
খ) মম যুথী বনে শ্রাবণ মেঘের
সজল পরশ লেগেছে
তৃষাতুর মন অঙ্গনে যেন প্রথম বর্ষা নেমেছে।(গান)
গ) এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝর ঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।
ঘ) তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।
ঙ) বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান
চ) হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে
গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে, গরজে গগনে। (গান)
ছ) আজি ঝর ঝর মুখর বাদলদিনে জানিনে
জানি নে কিছুতেই কেন মন লাগে না (গান)
জ) তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার!
শ্রাবণ বরিষনে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার (গান)
এজন্য রবীন্দ্রনাথ সমস্যাপূরণ গল্পে বলেছেন : ÔÔছোটো একটা নদীর ধারে হাট।
বর্ষাকালে নদী পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। কতক নৌকায় এবং কতক ডাঙায় কেনাবেচা
চলিতেছে, কলরবের অন্ত নাই। পণ্যদ্রব্যের মধ্যে এই আষাঢ় মাসে কাঁঠালের
আমদানিই সবচেয়ে বেশি, ইলিশ মাছও যথেষ্ট। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে;
অনেক বিক্রেতা বৃষ্টির আশঙ্কায় বাঁশ পুঁতিয়া তাহার ওপর একটা কাপড় খাটাইয়া
দিয়াছে।Ó এই গল্পে সুন্দর ভাবে খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন কথা তুলে
ধরেছেন। বৃষ্টির সময় দরিদ্র মানুষগুলোর দারিদ্রতা বেড়ে যায়। বেকার বসে
থাকলে পেটে জোটেনা আহার। বৃষ্টিতে ভিজেও তাদের কাজ করতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি থেকে বাদ পড়ে না জনজীবনের ঘরে বাইরের কোনো কিছুই।
বর্ষা প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ কবিতা প্রিয়দের কাছে চিরকাল স্মরণীয়।
বৃষ্টির রূপ চিরকাল সুন্দর ও আবেগময়। বৃষ্টি পৃথিবীতে শুধু জলই দেয় নাা
মানুষের অনুভুতিও ছুঁয়ে যায়। এই অনুভুতি মানুষ নানা ভাবে প্রকাশ করে। কেউ
আবেগ আপ্লুত হয়, কেউ অভিমানী হয় আবার কেউ কেউ বিরক্তিতে নাকাল হয়।
শৈল্পিক অনুভূতি প্রবণ মানুষেরা কবি হয়ে ওঠে বৃষ্টির সুকোমল সুরের শীতেল
স্পর্শে। কবি নজরুল অনেক কবিতা ও গান রচনা করেছেন। কবি নজরুল বর্ষাকে
তুলনা করেছেন প্রিয় বিরহের সাথে তার বর্ষা বিদায় কবিতায় বলেছেন :
ক) সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নুপূর খুলি
চলিতে চলিতে চমকি উঠ না কবরী উঠে না দুলি!
সেথা রবে তুমি ধেয়ান মগ্ন তাপসিনী অচপল
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ফটিক জল!
খ) বাদল রাতের পাখী
উড়ে চল
যেথা আজো ঝরে জল
নাহিক ফুলের ফাঁকি!
গ) ওগো বাদলের পরী
যাবে কোন দূরে ঘাটে বাধা তব কেতকী পাতার তরী
ওগো ও ক্ষণিকা পুব অভিসার ফুরাল কি আজি
তব পহিল্ ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব ?
গ) কাহার কাজল আঁখি চাহি মোর নয়নে
ঝুরেছিলে এক রাতে কবে কোন শাওনে,
আজি এ বাদল ঝরে সেই আঁখি মনে পড়ে
বিজলি খুঁজিছে তারে নভ অঙ্গনে।
ঘ) আজি বাদল ঝরে ঘোর একেলা ঘরে
হায় কী মনে পড়ে ঘন এমন করে
হায় এমন দিনে কে নীড়হারা পাখি
যাও কাঁদিয়া কোথায় কোন সাথীরে ডাকি।
ঙ) সে দেশে যবে বাদল ঝরে কাঁদে না কি প্রাণ একেলা ঘরে,
বিরহ ব্যথা নাহি কি সেথা বাজে না বাঁশি নদীর তীরে।।
চ) খেলে চঞ্চলা বরষা-বালিকা
মেঘের এলোকেশে ওড়ে পুবালি বায়
দোলে গলায় বলাকার মালিকা।।
ছ) চপল বিদ্যুতে হেরি' সে চপলার
ঝিলিক হানে কণ্ঠের মণিহার,
নীল আঁচল হতে তৃষিত ধরার পথে
ছুড়ে ফেলে মুঠি মুঠি বৃষ্টি শেফালিকা।।
ঝ) কেয়া পাতার তরী ভাসায় কমল -ঝিলে
তরু-লতার শাখা সাজায় হরিৎ নীলে।
ছিটিয়ে মেঠো জল খেলে সে অবিরল
কাজলা দীঘির জলে ঢেউ তোলে
আনমনে ভাসায় পদ্ম-পাতার থালিকা।।
বরষার সুর কবিদের দোলা দেয় কত রকম অনুভূতিতে। ভাল লাগা মানুষের মুখ ভেসে
ওঠে বার বার হৃদয়ের দেয়ালে, চোখের মনিটরে। আর তাই কবি বিষ্ণুদে বলেছেন
সবচেয়ে সুন্দর কথাটি তিনি প্রিয় মানুষকেই শ্রাবণের কদম ফুল উপহার দিতে
গিয়ে বলেছেন:
তোমাকে যে দেব জীবনের সন্ধ্যার
শ্রাবণ মাসের প্রথম কদম ফুল।
বিরহী মনে বৃষ্টির দোলা অন্যরকম। যেনো বর্ষার জল আর চোখের জলের একাকার
মাখামাখি। বিরহী বেদনার মধ্যেও প্রিয় মুখের উপস্থিতি কামনা করেন কবি।
আশির দশকের দু:খবাদী কবি ও গীতিকার খোশনূর বর্ষায় প্রিয় মানুষের আগমন
কামনা করে বলেছেন :
তুমি আসবেই বৃষ্টি ভেজা একগোছা দোলন চাঁপা দেবে
আরো বলবে বৃষ্টি কোথায় হলো কতো খানি
বলবে মেঘ কখন করেছে
কখনো সাদা কখনো ধূসর আনমনা
হবে বিধূর বিষাদে
আমি মুকুলিত ইচ্ছে
ছড়িয়ে দেবো মুক্ত হাওয়ায়।
রোদ গেছে ঘুমিয়ে এখনি নামবে বর্ষার ধুমল বর্ষণ। গ্রাম গঞ্জের বৃষ্টিতে
পল্লীর বালিকাদের মনের যে উচ্ছাস তা ধারণ করেছেন পল্লী কবি জসীম উদ্দীন
তার পল্লী বর্ষায় বলেছেন :
আজিকার রোদ ঘুমিয়ে পড়িছে
ঘোলাটে মেঘের আড়ে
কেয়া বন পথে স্বপ্ন বুনিছে
ছল ছল জলধারে
তাহার ঝিয়ারী কদম্ব শাখে
নিঝুম নিরালায় ছোট ছোট রেণু
খুলিয়া দিয়েছে
অস্ফুট বালিকায়।
যার জন্য তুমুল বৃষ্টিতে কবি লিখবেন বলে আশা করেছেন ততোখানি তিনি লিখতেই
পারেননি। লেখার শুরুতেই তিনি বলেছেন তার লেখা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়েছে।
সেই বালিকা এমনই আকর্ষণে কবির দিকে ছুটে এলো বর্ষারূপে কবির লেখাই আর
লিখতে হলো না। কবি জয় গোস্বামী মেঘ বালিকার জন্য রূপকথা কবিতায় বলেছেন-
এক পৃথিবী লিখবো বলে একটা খাতাও শেষ করিনি
সঙ্গে সঙ্গে ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি এল
খাতার উপর
আজীবনের লেখার উপর
বৃষ্টি এল এই অরণ্যে।
প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ অসাধারণ উপমায় প্রকৃতির বিভিন্ন উপকরণকে
কবিতায় ধারণ করেছেন সহজ বাচ্যতায়। তিনি তার বর্ষার কবিতায় সোনালী ডানার
চিলকে কাঁদতে বারণ করেছেন। অসম্ভব সুন্দও উপমা হচ্ছে ভিজে মেঘের দুপুর।
তারপর বলেছেন কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা পেতে চায়। তার হায় চিল কবিতায়
বলেছেন-
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল
এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।
কবি মহাদেব সাহা তার প্রেমিকার অপেক্ষায় চেয়ে থাকতে থাকতেই বর্ষা রূপ
ধারণ করেছেন। তিনি নিজেকেই বর্ষা বানিয়ে ফেলেছেন। বলছেন মেঘে মেঘে মল্লার
হয়ে গেছেন। তাই কবিতায় বলেছেন :
তুমি বুঝলেনা আমি কতকাল এই বর্ষা হয়ে আছি
মেঘে মেঘে মল্লার হয়ে আছি তোমার জন্য
এক বিন্দু অশ্রু হয়ে আছি সমস্ত প্রেমিকের চোখে।
আবার অন্য কবিতায় তিনি বর্ষাকে ভিন্ন মর্যাদায় গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি তার
প্রিয় মানুষকেই বারণ করেছেন বর্ষার দিনে বাইরে না যেতে। যদি তার প্রিয়
মানুষের শরীর খারাপ করে। তাই প্রেমিকার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, সে
যেন বৃষ্টিতে ঘরের বাইরে না যান। কবিতায় এভাবেই বলেছেন :
ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন মাধবী তুমি এখন বাইরে যেও না
এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হবে তোমার শরীর
এই বৃষ্টিতে ঝরে যদি কারো হৃদয়ের আকুল কান্না শোকের তুষার
গলে গলে যাবে এই বৃষ্টির হিমে তোমার কোমল দেহের আদল
মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে যেও না।
কবি রবিউল হুসাইন এই উপমহাদেশের নাম বর্ষা থেকে হলো কি-না এই জন্য বর্ষণ
থেকে ভারতবর্ষের নাম হতে পারে। যেভাবে প্রকৃতি ও নদী বেষ্টিত ভূখন্ড। তার
মধ্যে নিসর্গের আশ্চর্য সৌন্দর্যে দৃশ্যমান হিমালয় পর্বত। তাই কবিতায়
বলেছেন-
দুঃখ কষ্ট প্লাবন শ্রাবণ যোজন আষাঢ় কর্ষ
যেন বর্ষণ থেকেই এই ভূ-ভাগের নাম হয় ভারত বর্ষ
এই বাংলার মানুষ ও মাটি এই হিমালয় দুহিতা
শস্য শ্যামল নদী জল ধারা চিরদিন প্রবাহিতা।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বৃষ্টি প্রিয় মানুষকে না দেখে কিঞ্চিত বিরহ
ব্যথার কথাই জানিয়ে বলেছেন-আজ বেশ ভিজিয়ে নিচ্ছ আকাশ ছেঁচা জলে কিন্তু
তুমি নেই বাহিরে
অন্তরে মেঘ করে
ভাল লাগুক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে।
নগর জীবনের নাগরিক কবি শামসুর রাহমান ঘুম থেকে জেগে বাইরে তাকাতেই চোখে
পড়লো বৃষ্টি নতর্কী। বৃষ্টির এই যে নানান ছন্দে আঁকা বাঁকা ঢেউয়ের আকাশ
থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসা সেটাকেই তিনি নাচের সাথে তুলনা করে বলেছেন-
ঘুম ভাঙাদৃষ্টি দ্রুত জানালায় বাইরে যেতেই
চোখে নাচে অপরূপ বৃষ্টি নর্তকী।
তাহলে কি সত্যি সত্যি বর্ষা তার অসামান্য ঘাগড়া দুলিয়ে এই ইট পাথরের শহরে
উচ্চু অট্টালিকা আর বিনীত মাটির ঘরদোরে বড় বেশি চুমো খায়। কবি আসাদ
চৌধুরীর কণ্ঠে ধ্বনি হয়েছে যাদের জন্য বৃষ্টি অনাবশ্যক সেই মধ্যবিত্ত
পরিবারের কেরানীর দৈন্যদশা। এই বরষায় তার ভিজে ভিজে অফিস থেকে ঘরে ফেরার
সেই দুর্দশাগ্রস্ত সময়কে বর্ণনা করেছেন :
বৃষ্টির সন্ত্রাসে কাঁপা পথচারী, করুণ কেরানি
ফোঁটা ফোঁটা রিমঝিম অবিরল জল পাঠ করে
ময়ূরের নাচ (মনে মনে)।
আমীর খানের কণ্ঠে মল্লারের আর্তনাদে জমে
বৃষ্টির সংসারে আমি নবীন প্রেমিক।
কবি শিহাব সরকার বৃষ্টিকেই ধ্রুব বলেছেন। তার ভাষায় কোনো খরা থাকতে পারে
না। মানুষের ভেতরে বৃষ্টি আছে। মেঘনার ঢল আছে। তাই কবিতায় তিনি সমস্বরে
বলেছেন :
খরা মিথ্যা, বৃষ্টিই ধ্রুব
সবার ভিতরে নিঃশব্দে মেঘ জমে এই যে সব পুড়ে খাক
নির্জলা ভুলে ছবি; কেন হাহাকার? অঝোর বৃষ্টি মেঘনায়।
কবি সমুদ্র গুপ্ত অতৃপ্ত অভিমানী কথা বলেছেন প্রিয় মানুষের উদ্দেশ্যে।
তিনি বলেছেন প্রিয় মানুষের কোনো ভালোবাসার বৃষ্টি নেই তার প্রতি। তবুও
তিনি আশায় আশায় বেঁচে আছে। যতি একদিন ভালোবাসার লাবন্য জমে তার জন্য তার
প্রিয় মানুষের মনে। এই জন্য কবিতায় বলেছেন :
তোমার আকাশ থেকে আমার উপরে কোনোই লাবণ্য ঝরে না
তবু টিকে থাকি
বেঁচে থাকি। বৃষ্টির লবন একদিন লাবণ্য জমবে।
কবি আহসান হাবীব বৃষ্টিকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেন রোদ আর মেঘ যদি
মাখামাখি হয় তাহলে তার দর্শন দাড়ায় বৃষ্টি। এবং সেই সাথে বলেছেন এই
দর্শনে আকাশের রঙ বদলে যায়। তাই কবিতায় বলেছেন
বৃষ্টির দার্শনিক তত্ত্ব রোদে মেঘে মাখা মাখি হলে
আকাশ বিচিত্র হয় এই দর্শণের প্রাচীনতা।
কবি শেখ সামসুল হক প্রিয় মানুষকে কামনা করেন যখন; তখন সে ধরা দেয় না
কিন্ত যখন চান না তখনই সে ধরা দেয়। যখন চারিদিকে চাই চাই বাতাসে উতলা করে
তখন তার দেখা পাওয়া যায় না কিছুতেই। অথচ অপ্রয়োজনে সে এসে দাঁড়ায় কাছে।
তাই বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছেন-
যখন চাইনা তখন চাতক বৃষ্টি
সবকিছু এলোমেলো করে দেয়
কোন কাজ করার ভাব ভাবনা
এমনকি সেই প্রিয় মুখ
নিম তিতা হয়ে ওঠে
একেবারে দেখতে ইচ্ছে করে না
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা এখন।
বর্ষায় ইলিশ এক নতুনত্ব নিয়ে আসে বাঙালী ঐতিহ্যে। কবি সেই ঐতিহ্যকে তুলে
ধরেছেন বর্ষার চিরন্তন রূপের মধ্য দিয়ে। দেশ ভাগের সন্ধিক্ষণের রোমান্টিক
কবি বুদ্ধদেব বসু ১৯৩৮ সালের জুন মাসে তার ইলিশ কবিতার প্রথম অংশে বলেছেন
:
আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহ্বল
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি বৃষ্টিতে ধূমল।
আর শেষাংশে বলেছেন-
রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব
নদীর নিবিড়তম উল্লাসের মৃত্যুর পাহাড়
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।
নতুন প্রাণের উদ্দীপনা নিয়ে বাংলার শ্যামল ভূমি বৃষ্টির অপেক্ষায় যে
রুক্ষ রূপ ধারণ করে সে জন্য কবি অমিয় চক্রবর্তী বলেছেন :
অন্ধকার মধ্য দিনে বৃষ্টি, ঝরে মরে মাটিতে
বৃষ্টি ঝরে রুক্ষ মাঠে, দিগন্ত পিয়াসী মাঠে, স্তব্ধ মাঠে
মরুময় দীর্ঘ তিয়াশার মাঠে ঝরে বনতলে
ঘনশ্যাম রোমাঞ্চিত মাটির গভীর গূঢ় প্রাণে
শিরায় শিরায় স্নানে, বৃষ্টি ঝরে মনে মাটিতে।
অন্যত্র তিনি বলেছেন-
কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধার
ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে
শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।
আরেক জায়গায় বলেছেন-
আদিম বর্ষণ জল হাওয়া, পৃথিবীর
মত্ত দিন, মুগ্ধ ক্ষণ প্রথম ঝংকার।
অমর বাউল অতুল প্রসাদ সেন তার প্রিয় বঁধুকে ডেকেছেন। মানুষের মধ্য দিয়ে
মানুষের প্রকাশ সেই গ্রাম্য বধূ যে তার ব্যথা বলতে পারে না। অথচ ব্যথা
বিদ্ধ পাজরে নিশি যাপন করে। সেই মুখচোরা বধূর বেদনার কথা তিনি উচ্চারণ
করেছেন বঁধুয়া নিদ্ নাহি আঁখি পাতে কবিতায় বলেছেন :
বধুয়া নিদ্ নাহি আঁখি পাতে!
আমিও একাকী তুমিও একাকী
এ বাদল রাতে ডাকিছে
দাদুরী মিলন-পিয়াসে
ঝিল্লী ডাকিছে উল্লাসে
পল্লীর বধূ বিরহী বঁধুরে
মধুর মিলন সম্ভাষে
আমারো
যে সাধ বরষার রাত কাটাই নাথের সাথে;
নিদ্ নাহি আঁখি পাতে।
গগনে বাদল নয়নে বাদল জীবনে বাদল ছাইয়া
এস হে আমার বাদলের বঁধু চাতকিনী আছে চাহিয়া।
এখানে তিনি বাদল রাতে প্রিয় মিলনের বিরহকে তুলে ধরেছেন। ছন্দের যাদুকর
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মন্দাকান্তা ছন্দের অনুকরণে রচিত তার যক্ষের
নিবেদন কবিতায় বলেছেন-
বিহবল ব্যথিত নভতল, কই গো কই মেঘ উদয় হও
সন্ধ্যার তন্দ্রার মূরতি ধরি আজ মন্দ্রমন্থর বচন কও
সূর্যের রক্তিম নয়নে তুমি মেঘ! দাও হে কজ্জল পাড়াও ঘুম
বৃষ্টি চুম্বন বিথরি চলে যাও অঙ্গে হর্ষের পড়–ক ধূম।
এখানে কবি প্রিয় মিলনে আনন্দের উচ্ছাসকে আহবান জানিয়েছেন। অপরূপ প্রকৃতির
সামর্থকে বর্ষায় এঁকেছেন কবি মাইকেল মধুসূদন :
গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর
উথলিল নদ-নদী ধরণী উপর
রমনী রমন লয়ে, সুখে কেলি করে
দানবাদ ... দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।
কবি সমর সেন, বর্ষায় একেবারে রূঢ় বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন আমাদের কলুষিত
রাজনীতির নেতাদের বর্ষাকে নিয়েও যে নোংরা রাজনীতি সমর সেন সে নোংরা দিকটি
উন্মোচিত করেছেন। তার ঘরে বাইরে কবিতায় বলেছেন :
ফ্লাড রিলিপ পান্ডব বর্জিত এ দেশ
সকালে বৃষ্টি বিকেলে মন্ত্রী হাট নষ্ট
চারিধারে ধানক্ষেত ভেসে গেল
বৃষ্টি আর থামে না
দলে দলে তাই চলেছি সভায়
দেখি আগন্তুক মন্ত্রী কী বলেন
কী যেন খেয়ে তাঁর ঘোর তর অম্বল, রক্তবর্ণ মুখ
তাই স্বল্পভাষী বিজয়ী প্রাসাদে গেলেন ফিরে;
যাতায়াতী খরচ কত
পৈটিক রসদ কত কঠিন তরল
শত্রু পক্ষ নানা কথা বলে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য সব সময়ই নিরন্ন মানুষের হাহাকারের চিত্র তুলেছেন
কবিতায়। এই বর্ষাকে তিনি তার সেই চিরাচরিত প্রতিবাদেই তুলে ধরেছেন স্মারক
কবিতায় :
আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়
তবুও পড়িবে মনে
চঞ্চল হাওয়া যদি ফেরে হৃদয়ের আঙ্গিনায়
রজনী গন্ধা বনে
তবুও পড়িবে মনে
বলাকার পাখা আজও যদি উড়ে সুদূর দিগঞ্চলে বন্যার মহাবেগে।
আশির দশকের দু:খবাদী কবি ও গীতিকার খোশনূর তার এই বৃষ্টি কবিতায়
ভালোবাসার মানুষের আগমনের কথা বলেছেন। বলেছেন সেই প্রিয় মানুষ আসবে
দোলনচাঁপা দিবে, জিজ্ঞেস করবে কই কতখানি বৃষ্টি হলো বলবে মেঘ কখন করেছে।
তার কবি নিজেই হারিয়ে যাবে। তাই বৃষ্টির বন্দনায় বলেছেন :
তুমি আসবেই
বৃষ্টি ভেজা একগোছা দোলনচাঁপা দেবে
আরো বলবে বৃষ্টি কোথায় হলো কতোখানি
বলবে মেঘ কখন করেছ
কখনো সাদা কখনো ধূসর আনমনা
হবে বিধূর বিষাদে, আমি মুকুলিত ইচ্ছে
ছড়িয়ে দেবো মুক্ত হাওয়ায়।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিচিত্র এদেশের বর্ষার ভয়ংকর রূপকে তুলে ধরেছেন।
বৃষ্টির এই অলস ভাবে সর্ষে ঝরা ঝরতে থাকে সারাদিনমান সেটাকে কবি মায়ের
কাছে ছোট শিশুর বায়না ধরে কাঁন্নার সাথে তুলনা করেছেন। আবার বলেছেন
মেঘরাণী বোন হাত ধোয়া পানি ফেলে। বর্ষাকে বোন ডেকে তাকে আনার জন্য কাগজের
নৌকাকে যেতে বলেছেন। আবার বলেছেন বৃষ্টি পায়ের নূপুর। আবার তিনি সেই
শৈশবের আম কুড়ানোর দিনে ফিরে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে বলেছেন :
টাপুর টুপুর টাপুর টুপুর
বাজছে কারও পায়ের নূপুর
ও আমার বোন মেঘরানী
হাত-পা ধুয়ে ফেলায় পানি
কলের সিঁড়ি চড়ে
তাকে আন আদর করে
যা কাগজের নৌকো।
আবার অন্যত্র বলেছেন-
ঝড় উঠল অগ্নিকোণে
ঝড় উঠল ঝড়
কচুর পাতায় নুন এনেছি
একটি আম পড়
অম্বুবাচী গেলে বাঁচি
হচ্ছে বৃষ্টি ছাড়ছে না।
ফসল এ সন ভালো হবে
শোধ হবে সব ধায় দেনা।
উনুনে মোটে আঁচ পড়েনি
হবে না আজ রান্না
ভিজে গায়ে মাটি মায়ের
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না
এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে
কবি সামসুন্নাহার ফারুক বৃষ্টি দোলায় শিহরিত হয়ে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে
বৃষ্টির মধ্যেই হারিয়ে গেছেন। নিজে একা নয় সঙ্গে সেই তোমাকে নিয়ে। আর তাই
বৃষ্টি ভাবনা নিয়ে বলেছেন :
তোমার মনেও কি আজ
বৃষ্টি শিহরণ? এসো না তবে এসো এই বেলা
একটু খেলে নিয়ে দুজনে একলা
তুমূল বর্ষণে
বৃষ্টি বৃষ্টি খেলা।
কবিরাও পিছিয়ে নেই বর্ষা থেকে। ছড়াকার বাতেন বাহার বর্ষা দেখলেই মনের
মধ্যে কথার উঁকি ঝুঁকি তার। তাই বলেছেন :
বর্ষা এলে বৃষ্টি যখন চার দেয়ালে থামে
কত্ত কথা হয়রে জমা মনের গোপন খামে।
কবি গিয়াস উদ্দিন চাষা বর্ষাকে দেখেছে প্রকৃতির রূপ বদলের ভেতর দিয়ে
কৃষকের ফসল তোলা এবং ফসল বোনার মধ্য দিয়ে আর গ্রাম বাংলার মাঝির মনের
আনন্দে গান গেয়ে বৈঠা বেয়ে যাওয়ার সে দৃশ্যপট এঁকেছেন-
বাদল ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুলে
ভিজিয়েছে মাঠ-ঘাট-নদী-নালা
থই থই জলে ব্যাঙেরা সাঁতরায়
মনমাঝি ত্রিতাল হাওয়ায় ছুটে চলে দূরে
কৃষক তোলে পাট, বোনা ধানে হাটুজল
মাঝি টান ধরে সাধের বৈঠায়
এখানে কবি বাংলার প্রকৃতির চিরন্তণ রঙ রূপের বর্ণনা দিয়েছেন। যা কবিতায়
চমৎকারভাবে নন্দনতত্ত্ব পরিপূর্ণতা পেয়েছে। বিশ্বের সকল কবিই বর্ষাকে
তাদের নিজস্ব আঙ্গিকে সাজায়। কবিরা কেবল বর্ষা কালেই কবিতা লেখে না। বরং
বর্ষা নিয়ে সারা বছরই বর্ষাকে সব ধরনের কবিতায় উপমা হিসাবে উপস্থাপন করে
থাকে। বৃষ্টি নিয়ে আমেরিকান ইমাজিস্ট উদগাতা কবি এমি লোয়েল তার দুটি
হাইকুতে বলেছেন-
ক). শেষ রাতে বৃষ্টি হায়
জন মানবহীন শুভ্র সকাল
নীলকুঠি নিনাদ শোনা যায় ...
খ). বজ্রের গর্জনে
ফুল ফুটে সুখ পাই
বাকি সব বর্জনে।
সুইডেনের কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার তার ধ্যান কবিতায় বৃষ্টিকে তুলেছেন
অন্যরকম এক অনুষঙ্গে। কত উজ্জীবনের কথা তিনি বলেছেন। প্রিয় মানুষের
সান্নিধ্যে তার কাছে আলো হয়ে ধরা দিয়েছে। তাই কবিতায় স্বগোক্তি :
একটি ঝড় প্রচন্ড ঘূর্ণিতে ভাসিয়ে নিল কারখানাটি
রাতের আঁধারে চূর্ণ হলো না কিছুই
তোমাকে সেভাবেই জাগিয়ে রেখেছে
হাঙরের ধূসর পেট তোমার ক্ষীণ বাতি।
স্পেনের চিত্র শিল্পী ও কবি পাবলো পিকাসো তার শৈশবের ভেতরে ঢুকে পড়ো
কবিতায় বলেছেন সবুজের সাথে কী কী সম্পর্ক বৃষ্টির। বৃষ্টি নিজের খেয়াল
খুশীতে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন করে, সবুজের সাথে সাঁতার কাটে, আবার :
সবুজ যা নিজের খুশিতে লিখে যায় বৃষ্টিতে পরিচ্ছন্ন
সবুজ যা সাঁতার কাটে সবুজ হলুদ ধোঁয়া মোছা বিস্মৃতির ভিতরে তার
সবুজ পায়ের নীচে বালিতে পৃথিবীর দুপুর বেলায় পৃথিবীর গান বালি পৃথিবী।
স্পেনের কবি হুয়ান রামন হিমেনেথ তার সংগীত কবিতায় প্রিয় মানুষকে বৃষ্টির
সুরের সাথে তুলনা করেছেন। আবার বলছেন এই বৃষ্টিই আকাশের ঐ তারাদের
বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই তার উক্তি :
স্থির শান্ত রাতে
বিশুদ্ধ কোমল সুর বৃষ্টি ধারা তুমি
বাঁচিয়ে রেখেছো ঐ তারাদের
যেন পাশাপাশি এক অতল আঁধারে।
স্পেনের কবি ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা বলেছেন তার পলাতকের গান কবিতায় তিনি
নিজেকে সমুদ্রের জলে হারিয়েছেন। আর শ্রাবনে তার ভালোবাসার ফুল ছিঁড়ে
গেছে। সেই খন্ডিতের মধ্যে তিনি ভালোবাসা ও যন্ত্রণা দুটোই পেয়েছেন।
কিন্তু তবুও তিনি ছোট্ট শিশুর মতো নিস্পাপ হয়ে থাকেন। আর তাই বলেছেন :
বহুবার নিজেকে হারিয়েছি আমি সমুদ্রের জলে
শ্রাবণে আমার সদ্যছিন্ন ফুলদল
অধরে ভালোবাসা আর যন্ত্রণার সঞ্চয়
বহুবার নিজেকে হারিয়েছি আমি সমুদ্রের জলে
যেমন আজও হারাই অন্য কোনো শিশুর হৃদয়ে।
আধুনিক আফ্রিকার কবি জঁ জোসেফ রাবে লিভলো বৃষ্টিকে আদি রসে বৃষ্টিতে
ভিজিয়ে সিক্ত করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন –
ছোট ছোট ঢিবি করে রাখে মেয়ে সমুদ্র ধন
কুয়াশা ঢাকা এক উপকূলে
বিবস্ত্র নাবিকেরা তার সম্পদ কিনে নেবে
জিভ কাটা যাদের
যুবতীর বাণিজ্য হবে যতদিন বৃষ্টি না নামে।
ওয়েষ্ট ইন্ডিজের কবি ডেরেক ওয়ালকট বৃষ্টিকে অন্য ভাবে উপস্থাপন করেছেন।
তিনি বলতে চেয়েছেন গোলাপেও কাঁটা আছে। কাঁটার আঘাত সয়ে তবেইতো ভালবাসতে
হয়। বৃষ্টি ঘাসের বুকে যে আকাশ থেকে পড়ে যে আঘাত হানে সেটা প্রকৃতি মেনে
নিয়েছে। এটাকে তিনি সন্ত্রাসের সাথে তুলনা করেছেন। আবার বলেছেন এই
সন্ত্রাস না হলেতো ঘাসের বেঁচে থাকাটা কষ্ট হতো। তাই তিনি বলেছেন :
বৃষ্টির ছিটে হাতুড়ি চালায় প্রতিটি ঘাসের পাতায়
এই সন্ত্রাস আমরা মেনেছি;
ভালোবাসা মানে শৃঙ্খল তবু ভালোবাসাবাসি হয়।
বৃষ্টির নানান রূপ। একেকজন একেক ভাবে বৃষ্টি গ্রহণ করে। অনেকের কাছেই
উটকো ঝামেলার উপাদান। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচলে বিঘœ ঘটেছে।
দীর্ঘ যানজটে আটকে যায় মানুষ। কিন্তু বৃষ্টি তো উৎসবের কিন্তু জনজীবনের
দুর্গতিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৃষ্টি নিয়ে অনেক গান রচিত হয়েছে বাঙালি
সংস্কৃতির ভান্ডারে। সিনেমা, নাটক, অ্যালবাম, ভিডিওতে উঠেছে নানা সময়ের
বৃষ্টি। গানে বৃষ্টি মানেই রোমান্টিকতার আভাস, আবার বিরহের প্রতীক হয়েও
ধরা দিয়েছে।
বর্ষা নিয়ে অসংখ্য কবিতা ও গান রচিত হয়েছে। এসব গানে টাপুর টুপুর বৃষ্টির
সুর আর পাওয়া যায় সোঁদা মাটির গন্ধ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই
বিখ্যাত গান যার আবেদন এখনো সেই রকমই আছে অপরিবর্তনীয়।
এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন
কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।
জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের লেখা যদি মন কাঁদে গানটি। নুহাশ পল্লীতে
বসেই গানটি লিখেছিলেন। গেয়েছেন নাট্যকর্র্মী ও সঙ্গীত শিল্পী মেহের আফরোজ
শাওন। এই গানটি এক বর্ষার রাতেই সেটি গেয়ে শোনায় শাওন। অসম্ভব রকমের
বর্ষা প্রেম ছিল লেখক হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে। বৃষ্টি এসেছে তার অনেক
লেখাতেই। গানটি শুনলে একে তো বৃষ্টি অনুভব করা যায়।
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়।
শিরোনামহীন ব্যান্ডের ইচ্ছেঘুড়ি এ্যালবামের গান - মেঘলা কবেকার স্মৃতিময়
বাতায়ন, বলে যায় তোমায় অনেক ভালবাসি।
আরো অনেক শিল্পীর কণ্ঠে অসাধারণ সব বর্ষার গান সমৃদ্ধ করেছে গানের জগতকে :
রিমঝিম বৃষ্টি (মান্না দে), অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে (রুনা লায়লা), এই
বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না (রুনা লায়লা), বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
(শ্রীকান্ত আচার্য্য), বৃষ্টি পড়ে (বাপ্পা মজুমদার), আমি বৃষ্টি দেখেছি
(অঞ্জন দত্ত), একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে (অঞ্জন দত্ত), বৃষ্টি
(ফাহমিদা-রূপঙ্কর), আমি বৃষ্টিবিহীন (ন্যানসি), এই বৃষ্টি ভেজা রাতে
(আর্টসেল), ঝুম (মিনার), আমার আকাশে বৃষ্টি (অর্ণব), বৃষ্টি ঝরে যায়
(তৌসিফ), বৃষ্টি ভেজা স্বপ্ন (ছবি- আশিকী), বৃষ্টিরে বৃষ্টি আয় না জোরে
(স্বপ্নের পৃথিবী), বৃষ্টি নেমেছে (ওয়ারফেইজ), বরষা (কণা), এই মেঘলা দিনে
একলা (অনুপম রায়)।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। তাই তো কবি জীবনানন্দ তার
কবিতায় বলেছেন :বাংলার মুখে আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না
আর। বিশ্ব স্রষ্টা সমস্ত সৌন্দর্য উজার করে দিচ্ছেন। আর তারই সৃষ্ট মানুষ
সেই সৌন্দর্যের ডালা থেকে নিষ্ঠুর কুঠার দ্বারা ধ্বংস করে বৃক্ষ তরু।
হারিয়ে যাচ্ছে বাদল দিনের কদম ফুল। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা এক অনন্য ঋতু।
বর্ষার আগমনকে স্বাগত জানায় কদম ফুল। কদম ফুল মানুষের মন উদাস করে। কিসের
যেন অভাব, না পাওয়ার বেদনা মানুষকে অভিভূত করে তোলে। মন চায় প্রিয়জনকে
কাছে পেতে। অপ্রাপ্য আনন্দ খোঁজে মানুষ। মনের অজান্তেই গেয়ে উঠে
Ôচেয়ে আমি আকাশ পানে কোন কাজ নাহি হাতে
কোন কাজে নাহি বসে মন।
তন্দ্রা আছে, নিদ্রা নাই,
দেহ আছে, মন নাই,
পৃথিবী যেন অস্ফুট স্বপন।Õ
আষাঢ়ের কালিমাখা মেঘের অন্ধকারে লুকানো কদম ফুল মানব মনের পর্দায় এক
অজানা শিহরণ জাগায়। বিরহী মন তখন কেঁদে উঠে, তুমি কোথায়! তুমি কোথায়!
বেদনা বিধূর তপ্ত হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি কামনা জাগে। বিশ্ব কবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গীত বিজ্ঞানে গেয়েছেন। মেঘের ছায়ায় অন্ধকার রেখেছি
ঢেকে তারে এই যে, আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান আজ এনে দিলে হয়তো
দিবেনা কাল-রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল। গ্রাম বাংলার মেঠো পথে হেঁটে
যেতে যেতে প্রায়ই বাতাসের গাঁ ছুঁয়ে মোহনীয় কদম ফুলের গন্ধ পাওয়া যেতো। এ
মোহনীয় গন্ধে স্বর্গীয় সুবাস ছড়াতো চারিদিক। কদম গাছ নিয়ে অনেক কবি কবিতা
লিখেছেন। দ্বাপর যুগে শ্রী বৃন্দাবন লীলা মাধুর্যের কদম বৃক্ষের কথা
উল্লেখ রয়েছে। অবতার পুরুষ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কদম্ব শাখায় বসে বংশী
বাজিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে কদম বৃক্ষের প্রাচীনত্ব প্রমাণ রয়েছে।
বৃষ্টি নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের নানান রকম ভাবনা। বিখ্যাত
ব্যক্তিদের বর্ষা নিয়ে বিখ্যাত বানীতে পীথাগোরাস বলেছেন: বৃষ্টি পড়লেই
দুটো কথা সবচেয়ে বেশিবার ভাবতে হয়। শেক্সপিয়র বলেছেন: 'ভিজবো নাকি ভিজবো
না' কথা দুটো অনেক পুরনো এবং বহুল প্রচলিত। স্টিভ জবস বলেছেন- ছাতার
সঙ্গে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। মার্ক টোয়েন বলেছেন-বৃষ্টি দেখলেই ভিজতে
চাইবেন না, তারা আপনাকে লোভ দেখিয়ে টেনে হিঁচড়ে ছাদে নিয়ে যাবে এবং তারপর
ঠান্ডা জ্বর বাঁধিয়ে দিবে। বার্নাডশ বলেছেন -প্রেম হলো বৃষ্টির মতো, যার
আরম্ভ ফেসবুকে আর শেষ পরিণতি রাস্তার কোমর সমান পানিতে। মহাবিজ্ঞানী
আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন- বৃষ্টির পানি ড্রেনে চলে যাওয়ার পরও যতটুকু
রাস্তায় অবশিষ্ট থাকে তাই হলো জলাবদ্ধতা। পৃথিবীর দার্শনিক সক্রেটিস
বলেছেন- বৃষ্টির সকালে অফিস করার চেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা
ভালো। নেপোলিয়ান বলেছেন- আমাকে এক পসলা বৃষ্টি দাও আমি তোমাদের একঝাঁক
ফেসবুক স্ট্যাটাস উপহার দেব। বিল গেটস বলেছেন- গতকালের বৃষ্টিতে আমি
ভিজতে পারিনি কিন্তু আমার সব বন্ধুরা ফুটবল খেলতে খেলতে ভিজেছিল। আজ
তাদের জ্বর-সর্দি আর আমি দিব্যি সুস্থ অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। মাইকেল
জর্ডান বলেছেন- আমি বৃষ্টিকে মেনে নিতে পারি কিন্তু জলাবদ্ধতাকে মেনে
নিতে পারি না। টমাস আলভা এডিসন বলেছেন- আমি বলব না আমি এক হাজার বার
বৃষ্টিতে ভিজেছি, আমি বলব যে আমি এক হাজার বার খিচুড়ি আর মাংস ভুনা
খাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পেরেছি। উইলিয়াম ল্যাংলয়েড।বলেছেন- যেখানে বৃষ্টি
নেই, সেখানে ঠান্ডা সর্দি কাশিও নেই। চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন:আমি
বৃষ্টিতে হাঁটি যাতে কেউ আমার অশ্রু দেখতে না পারে।
রাস্তার দুÕধারে এবং গ্রাম্য পুকুর পাড়ে প্রচুর কদম গাছ ছিলো। চারিদিকে
সুবাস ছড়াতো কদম ফুল। অথচ এই কদম গাছ রক্ষণাবেক্ষনে বর্তমান সময়ে তেমন
কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত ভাবে নিজস্ব বাগানে যে কদম
গাছ জন্মাতো তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রতি বছর হাজার হাজার কদম গাছ
ধ্বংস হচ্ছে ম্যাচ ফ্যাক্টরী ও ইট ভাটায়। কদম গাছের যেমন রয়েছে ভেষজ গুণ
তেমনই ফুলে রয়েছে বায়ু দূষণমুক্ত রাখার সুগন্ধি শক্তি। কদম বৃক্ষ অনেকটা
নিজ থেকেই জন্মে তেমন যতœাদি করতে হয় না। অল্প দিনেই কদম গাছ বেশ বড় হয়ে
উঠে। কদম গাছের পাতা বেশ বড়। কদম ফুল গোল। শক্ত গোল গোটার উপর হাজার
হাজার ছোট ছোট পাপড়ি দ্বারা আচ্ছাদিত। তার উপর আরও সুন্দর নরম দীর্ঘ
সাদা-হলুদ পাপড়ি। কদম ফুল আরও মোহনীয় রূপ ধারণ করে। এ মোহনীয় কদম ফুলের
রেণুর আকর্ষণে হয়তো বনচারি অজান্তেই বলে উঠে Ôনসাং জেবারে জাগাং চারি/
ইদু আগং জনমন পুরি/ এ জাগা গান রইয়েছে মা মনান জুরি।Õ এই সুন্দর নিবিড়
বনের মায়াময় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছে, মাতাল উদাস
করে দিয়েছে, এ জায়গা ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা। যে কোনো মানুষ ইচ্ছা করলে
তার চারিপাশ সুন্দর সবুজ বৃক্ষের আচ্ছাদন গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু সেই
সদিচ্ছা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। সে কারণে ঋতু বৈচিত্র্যের এ
বাংলাদেশে কদম গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এটি শ্রাবণের বুকে ভেতর দু:খ জমার মত
আতংকের বিষয়।
আকাশে মেঘ দেখলেই মনের ভেতর অন্যরকম একটা ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে।
বৃষ্টি কারো কাছে মায়ার আবেগ, কারো কাছে স্মৃতিময় সময়ের কথন। একেক জনের
অনুভূতি একেক রকম। একেক বয়সে একেক জনের কাছে বৃষ্টির রূপ একেক রকম হয়ে
থাকে। ছেলে মেয়েদের কাছে বৃষ্টি মানেই আনন্দের ঢেউ, কিশোর বয়সে নেহায়েত
পাগলামী, যৌবনের আবেগে কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা'র হাতছানি,
বার্ধক্যে অতীতে ফেলে আসা স্মৃতির কোলাজ। বৃষ্টির সঙ্গে আবেগের একটা
সুগভীর সম্পর্ক আছে। এই জন্য কষ্ট আর ভালোবাসার প্রতিরূপ ভাবা হয়
বৃষ্টিকে। কিশোর দিনে শৈশবের দিনে বৃষ্টি হলেই গ্রাম মহল্লায় ছোট বাচ্চা
ছেলেরা বল নিয়ে মাঠে, রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে, অলিতে গলিতে ফুটবল খেলায়
ব্যস্ত হয়ে পড়ত। বাড়ির মেয়েরা সবাই মিলে ছাদে ভিজতে যেত। দিনভর একটানা
বৃষ্টিতে সন্ধ্যার পর গ্রামের বাড়িতে গানের আসরে হতো। জমে উঠতো বড়দের
পারিবারিক আড্ডা। ছুটির দিনে বৃষ্টি মানে ছিল বেশী আরাম আর অবসরের সবচেয়ে
বড় উপকরণ। পুরুষরা সব কাজ-কর্ম ভুলে একেবারেই অবকাশ যাপন করতো।আর
গৃহিণীরা বাড়িতে মজাদার খিচুড়ি রান্না করতো। বৃষ্টির সুন্দর আবহ এখনো সেই
দস্যিপনা গ্রামেই বেশি ভাল রাগে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ ভিন্ন এক
সুরের ছন্দের তৈরি করতো। নদীনালায় বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য অতুলনীয়। ঘাটের মাঝি
বিকেল গড়াবার আগেই ফিরত ঘরে। দিন বদলে সময় বদলায়, পরিবর্তন হয় কত কিছুই।
এখন শহরে বৃষ্টি মানে যন্ত্রণা, দুর্ভোগ, দুর্যোগ। রাস্তায় জমা জলে
মানুষের কর্মব্যস্ততার দিনে বয়ে আনে অশান্তি। পথের মাঝে জীবিকা অর্জন করে
বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কাছে বৃষ্টি যেন দারুণ অভিশাপ। বৃষ্টিতে নালার
পানি একাকার হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। সুয়ারেজের সাথে একাকার হয়ে রোগ
জীবাণু ছড়ায়। এই শহরের ফ্ল্যাট বাড়ির ভেতরে বৃষ্টির শব্দ কানে আসে না,
কখন বৃষ্টি আসে কখন যায় দেখা যায় না। কষ্টের মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে। এই
শহরে সবুজ পাতার হলুদবর্ণ নিমিষেই সরে যায় বৃষ্টিতে। গ্রামে বর্ষার দিনে
চাল ভাজা আর নারকেল সে কি মজাদার। শহরের মানুষগুলো এর স্বাদ কেমন কোনো
দিনই বুঝবে না। ঝুম বৃষ্টি যেন রিনিঝিনি নুপুরের ধ্বনি মন পাগল করা অপরূপ
সৃষ্টি । উদাস হয়ে শুধুই তাকিয়ে থাকা সুদূরের আকাশে। যান্ত্রিক শহরে
ব্যস্ততার ভিড়ে বৃষ্টির ছোঁয়া হয়তো সেভাবে কারোর মনেই কোনো রোমন্টিকতা
আনে না।
বর্ষা সাহিত্যের একটি বিরাট অংশই দখল করে ফেলেছে বলা যায়। কেননা কবি
মাত্রই বর্ষার বন্দনা করেন। বর্ষা কবিতায় হাজারো উপমার মধ্যে সবচেয়ে
শক্তিশালী একটি উপমা। বর্ষাকে কবিরা রোমান্টিক, প্রেম, বিরহ ব্যথা,
প্রতিবাদ, মাতৃভূমির অপার সৌন্দর্য, প্রকৃতির সাজ সব অনুষঙ্গ হিসেবেই
ব্যবহার করে থাকেন। কবিরা একটি মাত্রায় কখনও স্থির থাকেননি। একই কবিতায়
বহুমাত্রায় বিবিধ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। একই সাথে মানুষের অস্বাভাবিক
আচরণে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্ষায় কৃষকের ফসলের
ক্ষতি, বীজের পরাগায়ন; অন্যদিকে জন-জীবনে দুর্ভোগ এ সকল কিছু ছাপিয়ে
সুন্দর প্রকৃতির রূপটাই আকাংঙ্খিত হয়ে উঠে কবিতায়। কবির বর্ষা বরণের সাথে
মানবীয় প্রেম-অভিসার কথা, মৎস্য বহুল বাঙালীর ঐতিহ্য, সোনালী আঁশের কথা,
ধান কাউনের কথা, বর্ষায় নদী-নালা-খাল-বিলের চিত্র, কলকারখানার বর্জ্যে
পরিবেশ দূষণ, বীজের পরাগায়ন, বর্ষার কাদায় ফুটবল-হা-ডু-ডু খেলা, কৈশোর
বয়স ও সোনালী আগামীর প্রত্যাশা জীব জগতের তাবৎ বিষয়ের ছোঁয়া রয়েছে। তাই
কবিদের কাছে বর্ষা মানে নতুন এক অনুভূতি সব সময়ই জীবন্ত থাকে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিত : নব্বই দশকের কবি, প্রাবন্ধিক। মহসচিব- অনুপ্রাস
জাতীয় কবি সংগঠন। বিভাগীয় সম্পাদক-অনুপ্রাস সাহিত্য পাতা দৈনিক নব
অভিযান, দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা ও সাপ্তাহিক কালধারা। সভাপতি- বঙ্গবন্ধু
বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ।
সাবেক সভাপতি, বদরুন্নেসা কলেজ ও সাবেক সহ-সভাপতি, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ)
ছাত্রলীগ। বা -মো: আবদুল করিম। মাতা- আনোয়ারা বেগম। পড়াশুনা- এম.এ। জন্ম
-২১ আগস্ট, ১৯৭৩, জেলা- লক্ষ্মীপুর, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ১৩টি, গবেষণা প্রবন্ধ-২টি (বিজ্ঞান কবিতার ভাবনা ও
কাব্য কথায় ইলিশ), সম্পাদনা কাব্যগ্রন্থ-১টি, সহযোগী সম্পাদনা
(বিষয়ভিত্তিক)- ১১টি।জাগ্রত ছোট কাগজের সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য
কাব্যগ্রন্থ- সাত মার্চ শব্দের ডিনামাইট (বঙ্গবন্ধু সিরিজ), বিজ্ঞান
কবিতা, প্রেমের বিজ্ঞান কবিতা, স্বাধীনতা মঙ্গলে, বিজ্ঞান সনেট। বর্তমান
সময়ে তিনি বিজ্ঞান সমন্বয়ে কবিতাকে নতুনত্ব দিয়েছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশ হয় নব্বই দশকে।
লেখালেখির জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এর মহান
বিজয় দিবস-২০১১ সম্মাননা ও সাপ্তাহিক শারদীয়া কাব্যলোক বিশেষ
সম্মাননা-২০১৩ পেয়েছেন। ঠিকানা: এ-২, বাণিজ্যবিতান সুপারমার্কেট,
ইস্টকর্ণার, ২য়তলা, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫, বাংলাদেশ। ইমেইল-
rinakobi@yahoo.com ফোন:-01716676350।
=========================================================
রীনা তালুকদার -এর
বর্ষার একগুচ্ছ কবিতা
পাবার বাসনা
কত যে পাবার বাসনা মনের গভীরে
এত কাছে তবু ঠিকানা খোঁজে মন
চারিদিকে কত সব স্বাভাবিক দেখা
নিজের ভেতরেই অস্বাভাবিকতায়
দুর্মর জিজ্ঞাসা হাতড়ে হাতড়ে হাঁটে
ভ্যাপসা বায়ূর নির্বিচার আনাগোণা
জলীয় বাস্পে বৃষ্টির প্রত্যাশা
মৃত্তিকার অদৃশ্য টানে
ঘেমে নেয়ে ওঠে চলনবিল
নৌকা দৌঁড়ে কাতলার বিচরণ
বলতে বলতে ফুসে ওঠে সমুদ্র কথন
নৃবিজ্ঞানী কত আর এভাবে সেভাবে ?
উন্মত্ত পাহাড় বলছে কেবল
তোমার সাথে ক্লান্ত হতে চায় ভীষণ!
অবাধ্য বৃষ্টিতে
তোমার বৃষ্টিতেই ভিজে যাই তুমুল
এতো এতো বর্ষণ গিরিখাতে
পাহাড় ভেসে ভেসে লোকালয়
ছুঁয়ে যায় যায় কখনো ;
অবাধ্য বৃষ্টির মোহন স্রোতকে
আর কত সতর্ক করা যায় বলো ?
চোঁয়ালের কাঠিন্য রোধ করা দূরূহ এখন
দু'হাতে জড়িয়ে ফোটা ফোটা বৃষ্টিকে
তুলে নেই সযতেœ বুকে
চিবুকের শব্দহীন বাক্যবলয়
ঘুরপাক খায় মিরাকল স্মৃতিতে
লোক কথার কালিদাসী মেঘ
ধুমল বৃষ্টিতে ভাসিয়ে নেয় নিষিদ্ধ চরাচর
তুমি শুধু রাই কৃষ্ণের ছল করে
উচ্ছ্বল মেঘের দেশে যাবার গল্প শোনাও।
থাক না হয় না যাও
আজ বৃষ্টি থাক না হয় না যাও
এমন ঘন সন্ধ্যার আলো আঁধারি
রাখো একটু মায়াবী হাত হাতের কাঁচিতে
কিছুইতো নেই নেয়া দেয়ার
দেখে দেখে আইবল স্থির ষ্ট্যাচু
এতটা চাই বলেই কি দূরে দূরে ঘোরা ফেরা
না না জড়াবো না কোনো দায়ভারে
স্বাধীন পাখি যেখানে খুশী সীমান্ত পেরিয়ে
উড়ে যাও যাবার পথে ক্লান্তির ঘাম মুছো
পান্থ পথিক অলস আসন পেতে আরাম আয়েশে
মেঠো জল ছুঁয়ে হিম শীতল বুকের ঘ্রাণে
অকৃত্রিম শ্বাস নাও নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে
কেউ কেউ জীবনে বিন্নাছোপ বসতি
আসে চলতি পথে যায় মন চায় যে দিকে
পরিবার পরিবার খেলা নেই তাতে
তবুও থাকো কিছু সময় শুভার্থী
পরাধীন হাওয়াহীন যখন যেখানে।
অবগাহনের উল্লাস
এখন সবুজ পাতার ফাঁকে
ছোট্ট ছোট্ট বকুলের রঙ লাল
ফুল নেই মালা গাঁথার
তবু তার অবয়বে লেগে আছে সাজ
মনে হয় হাসছে বকুল গাছ
নাচছে রঙ বাহারি ঘাসফড়িং
দুর্বার উর্ধ্ব মুখী হামাগুড়ি
সাবধান সৈনিক সচেতন চেতনায়
বৃষ্টির আয়োজনে প্রকৃতি সরব
ননস্টপ সার্ভিসে প্রস্তুতি লেগে আছে
ছুটছে পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথে
গন্তব্যের অভিমুখে অভিমানী মেঘ
কালিদাস মেঘের অবাধ আহবানে
মেঘ বালিকা খুলে দিয়েছে ঝর্ণার বন্ধ কপাট
অকৃপণ বৃষ্টি ঝরছে বনলতা শরীরে
চরাচর জুড়ে তার অবগাহনের উল্লাস।
অসম যোগান
কদিন ধরে কিছুই লিখছিনা
লেখার ঝোঁক যে ভেতরে
অস্থিরতা বাড়ায় না তা নয়
খেরুয়া জীবনের পাঁচমিশালী
তটস্থ রাখে সারাবেলা
সময় বৈরী হলে যা হয়
মধুর ভালোবাসাও পানসে লাগে
ধামাল প্রকৃতিতে প্রচন্ড গরম শেষে
চলছে কালিদাস দ্রুপদীর বর্ষার ব্যস্ততা
কালিদাস আকাশ দ্রুপদী মেঘমালা
বর্ষা ঋতুর অবিচ্ছেদ্য সন্ধিতে
কাদা জলে ভিজিয়েছে হাঁটুরে পথ
কেউ চায় বা না চায় বৃষ্টির ওসবে মাথা ব্যথা নেই
সে আপন গতিতে নাচবে, গাইবে, হাসবে, ধেয়ে চলবে
ফুটপাত লাইব্রেরীতে-
বই পোকাদের উপচে পড়া ভিড়
শামিল হলাম অভ্যাসবশত
একটাও হলো না তেমন পছন্দ
দু'একটা অবশ্য আধা আধি
প্রয়োজনে মিলেনি বিক্রেতার চাহিদা
ক্রেতা কি আর বৃথা কাজে
চাহিদার চেয়ে অসম যোগানে
পা বাড়াবে; তাতো হয় না
দিনকে দিন হাড় হাভাতে-
মিল অমিলের দ্বন্দ্ব বাড়ছে
একটা ভাল বই খুঁজে যাচ্ছি নিরন্তর
কেবল একটা ভাল লেখার জন্য
অসম যোগানের গোলক ধাঁধায় ঘুরছে মানুষ।
শ্রাবণের জল ওগো
শ্রাবণ তুমি ঝরছো বুনো হাওয়ায়
কতজল তোমার চোখের তারায়
কার সাথে পেতেছো মনের আড়ি
ঝরছো কি তাই এতোই আগ বাড়ি
এমন সুরে নৃত্য করে কারে তুমি ডাকো
ধানের ক্ষেতে টুপটাপ হাটুজল ভিজিয়ে রাখো
শাল পিয়ালের পাখির বনের ভেতর
কোন পাখির বাসা ভেঙ্গে করেছো কারে পর।
শ্রাবণ তোমার মনের জ্বালা নেভাও বুঝি জলে
আকাশ মেঘের ঘর থেকে তাই দিচ্ছো ভুমে ফেলে
মাধুরী দিয়ে এ ধরাকে দিচ্ছো পরশ স্নানে
কি অনুরাগে মাটি তোমার জল নিচ্ছে টেনে
আমায় তুমি ভাসিয়োনা অথৈ জলের স্রোতে
সামর্থবান রাখো তোমার চলার পথে।
কে উত্তম
কালরাত ভীষণ বৃষ্টিপাত
জানালা খুলতেই দমকা
এক মুঠো ঝাড়ের ছাট্
ভিজিয়ে দিল আমার রুমের অর্ধেকটা
সঙ্গে সঙ্গেই সপাৎ-সপাৎ বন্ধ করেছি প্রিয় জানালা
বৃষ্টি আমার সর্বাঙ্গে লেপ্টে আছে আবেশে-
ভাবছি মানুষ হলে বৃষ্টির আচরণ কেমন হতো ;
হিম হিম বাতাস ঘরটাকে করেছে আবেগী
আমার প্রিয় বন্ধু ঘুমে অচেতন
বৃষ্টির শব্দ ধার ধারে না ওর ঘুম
বেশ ঘুম কাতরে মানুষ
বাইরে ঝড়ের উম্মত্ততা-লীলা করছে মনের সুখে
ভোর হবে কখন কে জানে-
ঝড়ের অন্ধকারে ভোরের আলো কখন পৌঁছাবে
পৃথিবীর ঘরে কে জানে
ঘুমে দুচোখ গভীরে হারিয়ে যায়
সকালে বেশ আলো হলেই রাস্তায় বের হই ;
খানিক যাবার পরেই দেখি
ছিন্নভিন্ন টেলিফোনের তার, বিদ্যুতের তার,
রাস্তায় ইলেকট্রিক খুঁটি ভেঙ্গে পড়ে আছে অর্ধেকটা
টান্সমিটার, ছোট বাচ্চার প্যান্ট, শার্ট ওড়না,
রাবারের স্যান্ডেল, পানির বোতল
ইত্যকার সব বস্তু, কাদা পানিতে
একটি কাক মরে পড়ে আছে
উপরে বটগাছ অসংখ্য কাক
চিৎকার করে পাড়া কাঁপিয়ে তুলছে
সতীর্থের জন্য শোক মিছিল!
কাকের চেঁচামেচি ভাল লাগল না
আরো খানিকটা হাটতে থাকলাম
একটি গলির ভেতর পাঁচ ছয় জন লোক দাঁড়িয়ে আছে
এগিয়ে দেখি একটি লোক মরে পড়ে আছে
ক্ষত-বিক্ষত শরীর
সবাই বলছে বেওয়ারিশ !
একটি জীবনের বিদায়,
কেউ কাউকে প্রশ্ন করেনা ;
কেন এ লাশ ? এ লাশের ঠিকানা কি ?
এ লাশের ঠিকানা কি কেবলই বেওয়ারিশ!
তারও যে ঘরবাড়ি, স্বপ্ন-পরিবার আছে
সেকি কেবলই অজানা থেকে যাবে ?
মানুষ কি তবে শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও
ওই কাকের চেয়েও অধম !
-------------0-------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন