শাওন বাসর
ইছামতি নদীর তীর ঘেঁষে অনেক ছোট ছোট গ্রাম। তার মধ্যে কমলপুর একটি
গ্রাম। গ্রাম টি যেন ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। মরমী রায় একজন
শিক্ষক। এখানেই তাঁর বাড়ি। তাঁর বাড়ির নাম কথাকলি। এই কথাকলিতে বসে
দেখা যায় কল্লোলিনী ইছামতির নানান রূপ।
এখন শ্রাবণ মাস।ভরা শাওনে ইছামতির কূল ছাপানো দাপাদাপি,
মনোরম তার উদ্দামতা যে কেউ দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। যে দেখবে সে
তার কুল হারাবেই।আজ কথাকলিতে মনোরম বাসর শয্যা
রচিত হয়েছে।বরের নাম মরমী রায় আর কনের নাম গোপা।
একে তো শ্রাবণ মাস। ইছামতির সাথে ওরা-ও কূলহারানো প্রেমের
জোয়ারে ভাসছে। শাওন ঝরছে বাইরে ঝমঝমিয়ে,দাদুরী ডাকছে প্রিয়সঙ্গ আশে।
ঝিল্লি মুখরিত শাওন রাতে বরবধু ভিজছে ভালবাসার বৃষ্টি ধারায়। মরমী গোপার
ঘোমটা সরিয়ে যখন দেখে, যেন রূপসী শাওন চন্দ্রমা। প্রথমে তাকে সোহাগ
চুম্বনে রাঙিয়ে দিল মরমী।গোপা ও মরমী নিজেদের কে আরও কাছে টেনে নিল।
শাওন প্রেমের ধারা স্রোতে ভেসে গেল তাদের দুটি মন। এভাবে কতক্ষন কেটে
গেছে তাদের হুঁস নেই। বাহিরে ঘনঘন অশনি সংকেত, ভেতরে এরা দুজন মুখোমুখি
বসে কিছু সময় উষ্ণতার পরশ অনুভব করলো-আবেশে অনুরাগে স্মৃতিচারণ
করলো।গোপা-ই বললো-জানো মরমী,আজ দিদি র কথা খুব মনে পড়ছে। তখন খুব ছোট্ট
বেলা দিদির পুতুলের মধ্যে থেকে আমি ওর ছেলে পুতুলকে লুকিয়ে এনে আমার
কাছে রেখেছিলাম।দিদি জানতে পেরে আমাকে বলেছিল-তুই চোর। তুই আমার পুতুল
চুরি করেছিস! আর আজ!দিদি তার জীবন্ত পুতুলটি কে আমার হাতে তুলে দিয়ে চলে
গেল। নিয়তির এ কী নির্মম পরিহাস! মরমী গোপাকে খুব কাছে টেনে নিয়ে
বলল-কেন গোপা, তোমার মুখে আজ এসব কথা শুনতে চাইছি না। জীবন তো নদীর মতো
ভেসে চলে, আমরাও আজ স্রোতের টানে এক সাথে মিলিত হয়েছি।বলছি কি,আজ কোন
দুঃখের কথা বোলো না। এখানে আমাদের মাঝে কাউকে টেনে এনো না।দেখো , বাইরে
জল ঝরে অনিবার আমাদের মাঝে কেহ নাহি আর। তুমি আমায় আদর করে কাছে টেনে
নাও।সে রাতে দুজনে দুজনের মুখোমুখি বসে গভীর দুঃখে দুঃখী হয়ে উতল শাওন
ধারাকে সাথে রেখে হারিয়ে গেল প্রেম যমুনায়। সে মধুর শাওন যামিনী ভোর
হলো। তবুও শ্রাবণের মুখ ভার করা আকাশটা পরিস্কার হয় না। যেন চাপ চাপ
জমাট আঁধার নিশা সবখানে। এখনও যেন প্রেম-যমুনার ভারি উথাল হয়ে দোল
খাচ্ছে মরমী ও গোপার মনে আর হয়তো বা কথাকলিকে ঘিরে। তাদের বিবশ হৃদয় আর
বিহ্বল দৃষ্টি অবনত হয়ে আধো আধো চাওয়া আধো আধো বোলে ঢিমে লয়ে চেনা
সুরে চেনা ছন ছন্দে প্রাত্যহিক কর্ম সংগীত পরিবেশনের ধীর তৎপরতা এগিয়ে
চলে দিনের শুরুতে। গোপা চায়ের কাপ টা এগিয়ে দেয় মরমীর দিকে ঠিক যেমন
লোপা করতো একসময় মনে পড়ে যায় মরমীর। লোপা চা টা অবশ্য ভালোই করতো।
মরমী রায় স্কুলে যাওয়ার সময় কত কী যে মনে করিয়ে দিতো তার ভুলো স্বামী
কে! সেই কাজ গুলো এখন গোপা করছে। মরমী স্কুল শিক্ষক বলে লোপা মনে মনে খুব
গর্ব করতো।
একটু বেলা বাড়তে ই মরমী বাজারে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে
প্রতি দিনের মতো। গোপা মরমীর হাতে বাজারের থলেটা ধরিয়ে দিয়ে বলল
তাড়াতাড়ি এসো। স্কুলে বর্ষার ছুটি তো শেষ হয়ে গেছে এবার স্কুলে
যাওয়ার তাড়া। কিছু সময় পরে বাজারের ব্যাগ হাতে মরমী হাজির ভিজে একশা
হয়ে।গোপা বাজার ব্যাগটা মরমীর হাত থেকে নিয়ে চটপট গামছাটা দিয়ে মরমীর
মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে বলল খুব কষ্ট হয়েছে না গো? ঠান্ডা টা না লাগলেই
হয়। এখন ভেজা কাপড়ে না থেকে জামা কাপড় গুলো বদলে ফেল। বলতে বলতে গোপা
রান্না ঘরের দিকে
হনহন করে চলে যায়। তার পর একসময় রান্না শেষ করে ফিরে আসে। গোপা বলল
আচ্ছা, স্কুলে আজ রেনিডে হতে পারে তো? তখন মরমী হাসতে হাসতে বলল -না
ম্যাডাম, ওটা ছাত্র ছাত্রীদের জন্য হতে পারে আমাদের জন্য নয়। খাওয়া
দাওয়া সেরে মরমী স্কুলে চলে গেলে গোপা খুব একা হয়ে যায়। বৃষ্টি টা
একটু থমথমে হয়েছে। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গোপা সাত পাঁচ, আকাশ
পাতাল , অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে একরাশ ভাবনার সমুদ্রে ডুবে গেল।
লোপা আর গোপা পিঠোপিঠি দুই বোন। লোপা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই বিয়ের
পিঁড়িতে বসলো।গোপা ফিলজফিতে এম এ , তারপর বি এড পাশ করে চাকুরীর সন্ধানে
নানান পরীক্ষায় বসে। হঠাৎ করেই লোপা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার বলেছে
লিভার ক্যান্সার হয়েছে। এমন মারণ ব্যাধির খবর পেয়ে মা বাবা মুষড়ে
পড়ে।মা বাবা গোপা কে বলে -লোপাকে একটু দেখনা মা। একটু সেবা যত্ন করতে
বলে। তাছাড়া মরমী কে কেউ দেখার নেই। গোপা সেই থেকে লোপার বাড়িতে গিয়ে
থাকে। এভাবে থাকতে থাকতে গোপা ওদের বাড়ির একজন স্থায়ী সদস্যা হয়ে
যায়।দিদির সেবা যত্ন গোপা নিজের হাতে করে। একদিন লোপা মরমী কে ডেকে
বলল-গোপার খুব একঘেয়েমি লাগে, ওকে নিয়ে একদিন সিনেমায় যাও না কেন?
মরমী কাজের অছিলা দেখিয়ে সরে পড়ে। যদিও মনে মনে এমন ইচ্ছেটা ও হয়
মরমীর।এক রবিবার গোপাকে নিয়ে গেল মরমী সিনেমা দেখতে। লোপার কথা মনে করে
ওরা তাড়াতাড়ি সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
বাড়ি ফিরে লোপার কাছে প্রথমে গেল মরমী। মরমী দেখলো
লোপার মনটা বেশ গরম গরম।কারণ জানতে চাইলে ও বললো-কিছুই হয়নি। মরমী
অনেকক্ষণ লোপার পাশে বসে ওকে হলের রস খাওয়ালো,ঔষধ খাওয়ালো।তাতে লোপার
মনটা একটু ভালো হয়েছে দেখে মরমী একটু স্বস্তি পেল। এমনি বেশ চলছিল
কিন্তু রোগ
পোকারা আবার খুব বেশি কিড়মিড়িয়ে উঠতেই বাধ্য হয়েই লোপাকে নার্সিং
হোমে রেখে আসতে হয়। প্রায় ই মরমী আর গোপা নার্সিং হোমে গিয়ে দেখা করে
আসে লোপার সাথে। একসময় লোপা বুঝতে পারে-তার আয়ু বুঝি ফুরিয়ে আসছে।
লোপা মরমী কে খুব ভালোবাসে। ওকে কষ্ট পেতে দেবে না।রোগ যন্ত্রণার
পাশাপাশি এসব ভাবনা ও হয় তার। সেদিন মরমী আর গোপা কাছে আসতেই সে ওদের
দুজনকেই কাছে ডাকে। এখন আর লোপাকে যেন চেনা ই যায়না।ওর সারা শরীর টা
কালো হয়ে গেছে। ওকে দেখলে ভয় করে ওর বীভৎস চেহারা দেখে।অথচ একসময় কত
সুন্দরী ছিল! লোপা আর গোপা দুইবোন প্রায় এক ই রকম দেখতে। আলাদা থাকলে
সবাই চিনতে ভুল করতো ওদের। তবে ওদের চেনার জন্য একটি সহজ উপায় আছে।সেটা
হলো গোপার বাম চিবুকে একটা কালো তিল আছে। যাইহোক, ওরা কাছে যেতে মরমীর
হাতে গোপাল হাতটা রেখে লোপা বলে-আমি তোমাদের দু'জনকে এক করে দিলাম। আমি
তোমাদের বিয়ে ই দিলাম। দুজনে দুজনকে দেখো। কাঁপা কাঁপা গলায় লোপা
বললো-আমার আর সময় নেই। ওপারের ডাক এসেছে। কথাগুলো বলতে বলতে লোপা
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মরমী লোপা কে বলেছে কি হলো কেঁদো না।
ডাক্তার বাবু বলেছেন তুমি তো ভালো হয়ে যাবে। লোপা নাকী সুরে বলে-মিথ্যে
আশা কোরোনা। তোমরা ভালো থেকো। শুনতে শুনতে গোপা ও কেঁদে ফেলে।
আজ প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হল লোপা মারা গেছে।
ওদিকে বাবা মা দুই জনেই মেয়ের শোকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। এখন
শুধু বর্তমান দাঁড়িয়ে আছে সামনে।সে বলছে---ইছামতির চলমান উজান স্রোতে
ভেসে যাও তোমরা দু'জন। ওদের জীবন এভাবেই এগিয়ে চললো সবার যেমন চলে।অবসর
সময়ে ইছামতির তীরে বসে ঢেউ গোনা আর পুরানো স্মৃতি রোমন্থন---। এভাবেই
তাদের জীবন গতানুগতিক ধারায় হাঁটতে থাকে ভবিষ্যতের পানে।
----------সমাপ্ত-----------
শেফালি সর, জনাদাঁড়ি , পশ্চিম মেদিনীপুর
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন