বাংলা আমার মন -প্রাণ, বাংলা আমার নাড়ির টান
বাংলা শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা আপন আপন ভাব ফুটে ওঠে যার সাথে নিজেকে একাত্ম করে তোলাতেই নিজ অস্তিত্বের পরিপূর্নতা খুঁজে পাই ।বাংলা অনেকটা যেন রক্তে মিশে আছে ,মিশে আছে ঘ্রাণে ,মিশে আছে প্রতিটি বাঙালির মনে -প্রাণে ।
কিছু কিছু বঙ্গ সন্তান অন্যদের সম্মুখে নিজেকে ''পরিমার্জিত ''প্রতিপন্ন করার জন্য যতোই খটমটে বিদেশী শব্দ বলুক না কেন ,আচমকা ব্যথা লাগলে সহজাতভাবে তাদেরই মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে -''ও মা গো /ও বাবা গো ''।এখানেই লুকিয়ে মাতৃভাষার টান ।এখনও বিদেশ -বিভুঁইয়ে হঠাৎ কোনো বাঙালির সাথে দেখা হলেই মনে হয় যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই /বোনকে ফিরে পেয়েছি ।
আমাদের এই সাধের বাংলা ভাষা একটি ইন্দো -আর্য ভাষা ।মাতৃভাষীর সংখ্যায় বাংলা ইন্দো -আর্য ভাষা পরিবারে দ্বিতীয় এবং ইন্দো -ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের চতুর্থ ও বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা ।বাংলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ,ত্রিপুরা ও আসামের বরাক উপত্যকার সরকারী ভাষা এবং আমাদের অন্যতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় ও রাষ্ট্র ভাষা ।আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রধান কথ্য ভাষাও বাংলা ।এছাড়া বিশ্বের সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাভাষী বহু মানুষ ।
আজ আমরা বাংলার যে রূপের সাথে সুপরিচিত ,তা ১২০০বছরের অধিক সময় ধরে বিকশিত হয়ে চলেছে ।অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার অধুনা রূপ ধারণ করে ।বাংলার সুকথিত ও বহু চর্চিত পূর্বসূরীরা হোলো -পালি -প্রাকৃত ,অপভ্রংশ ,অবহঠঠ ও পূরণ বাংলা ।সুদীর্ঘ ইতিহাস স্বাক্ষী রেখে ,শত সহস্র চড়াই -উতরাই পাড়ি দিয়ে বাংলা আজ বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় সমাদৃত ।ভাষা আন্দোলন হোলো সেই বিকাশ পথের অন্যতম মাইলফলক এবং ২১শে ফেব্রুয়ারী হোলো সেই ফলকগাত্রে খোদিত দিক্ নির্দেশিকা ।
বঙ্গীয় সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে যে আত্মচেতনার বিকাশ ঘটে তারই অন্যতম ফসল হোলো ভাষা আন্দোলন ।১৯৪৭সালের নভেম্বর -ডিসেম্বর মাসে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে শুরু হয় ভাষা বিক্ষোভ ।১৯৪৮সালে সীমিত পরিসরে ভাষা আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং ১৯৫২সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী এর চরম ব্যাপ্তি ঘটে ।ওইদিন সকালে ১৪৪ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নামলে পুলিশের গুলি চালনায় বেশ কয়েকজন হতাহত হন ।প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে জমায়েত হন ।২২শে ফেব্রুয়ারী পুনরায় ছাত্র -জনতা রাজপথে নামে ।তারা মেডিকেল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করেন ।২৩শে ফেব্রুয়ারী এক রাতের মধ্যে ওখানে গড়ে ওঠে শহীদস্তম্ভ ,যা ২৬শে ফেব্রুয়ারী সরকার গুঁড়িয়ে দেয় ।এই ঘটনার পর বাংলা ভাষা আন্দোলন আরো গতি লাভ করে ।
আজ পর্যন্ত ২১শে ফেব্রুয়ারী দিনটি বাংলাদেশে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে ।২১শে ফেব্রুয়ারী ১২টা এক মিনিটে রাষ্ট্রপতি ,প্রধানমন্ত্রী ,মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ ,রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণ শহীদ মিনারে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ।১৯৯৯সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরের বছর থেকেই দিনটি জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশসমূহে মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে ।
বাংলা শুধু আমাদের মুখের ভাষা নয় ,বাংলা আমাদের আবেগ ,বাংলা আমাদের অহংকার ,বাংলা আমাদের অলংকার ।প্রতিদিন না জানি কতো রত্ন ফলাচ্ছে আমাদের এই বাংলা ভাষার সৃজনী জমি ।প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে নিজে ,যাতে আমরা প্রত্যেকে সদর্পে বলতে পারি -''আমি বাঙালি ''।আমিও বলছি মা গো -
'যতদূর সোজা -বাঁকা
পথ ধরে হেঁটে যাই .....
খুঁজে নিই তোমারই মেঠো পথের
প্রাণভরা সোঁদা গন্ধ ।
আকাশও মাঝে মাঝে
অকারণে খসে পড়ে ।
তোমারই স্নেহ আমার অশ্রু -আনন্দ ॥
==============================================
-অমৃতা বিশ্বাস সরকার
ভাদুল ,বাঁকুড়া