চন্দন দাশগুপ্ত
সেটা ২০১৪ সাল। আমি তখন বহরমপুরে পোস্টেড, মুর্শিদাবাদ জেলার শ্রমদপ্তরের প্রধান হিসেবে কাজ করছি। সরকার থেকে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন ধরণের কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কাজ হচ্ছিল। সেই সূত্রে প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে বহু মানুষ আসতেন, কেউ ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, কেউ শিক্ষক, কেউ সাধারণ বিড়ি শ্রমিক বা ছাপোষা গৃহবধূ।
সেদিন বিকেলে এক ভদ্রমহিলা আমার সাথে দেখা করতে এলেন। প্রাথমিক কথাবার্তার পর তিনি বিদায় নিলেন। এরপর তিনি মাঝে মাঝেই আসতেন। পাঁচ দশ মিনিট জরুরী কথাবার্তার পর চলে যেতেন।
ভদ্রমহিলার নাম সুচিত্রা ঘোষ। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ মহকুমার এক প্রত্যন্ত গ্রাম শেখপাড়ায় তাঁর বাড়ি। বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। মাত্র সতেরো বছরের বয়সেই তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীর ছিল ছোটখাট একটি মুদিখানার দোকান। সবকিছু মোটামুটি ঠিকই চলছিল, কিন্তু বিপদ ডেকে আনল গঙ্গা। নদী ভাঙ্গনে বছর দশেকের মধ্যেই সুচিত্রাদেবীর শ্বশুরবাড়ির ভিটেমাটি গঙ্গাগর্ভে চলে গেল। সরকার থেকে যথারীতি ক্ষতিপূরণ দেবার আশ্বাস দেওয়া হলেও লাল ফিতের ফাঁস খুলে কোনদিনই আর সেই ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে এল না।
কয়েক বছর তীব্র টানাটানির মধ্যে সংসার চালানোর পর সুচিত্রাদেবীর স্বামী বিবেকানন্দবাবু স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন। শ্বশুর শাশুড়ি অবশ্য আগেই চলে গিয়েছিলেন। নাবালিকা দুই মেয়েকে নিয়ে সুচিত্রাদেবী তখন অথৈ জলে।
দিন কাটছে।
সুচিত্রাদেবীর লড়াই শুরু হল। সারাদিন চলত বিড়ি বাঁধার কাজ। আর ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা। বিয়ের আগে মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন। এবার প্রাইভেটে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, তারপর গ্র্যাজুয়েশনটাও করে ফেললেন। তারপর শুরু করলেন বাড়িতেই ছাত্র পড়ানো। সাথে সাথে চলল মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো।
বারো বছর কেটে গেছে। এবার সব কাজের সাথেই সুচিত্রাদেবী তৈরি করলেন "লালবাগ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন" নামে একটি এন.জি.ও। অনেক বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে সেটি আজ হয়ে উঠেছে মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম নামকরা সংস্থা। সব রকম জনকল্যাণমূলক কাজে জেলাশাসক প্রথমেই সুচিত্রাদেবীর এনজিও-কে ডাকেন। অথচ প্রথম দিকে এই কাজটা ছিল যথেষ্ট কঠিন। সামাজিক বাধা তো ছিলই। একজন মহিলা নিজের উদ্যোগে একটি এনজিও চালাচ্ছেন, এটা স্থানীয় বহু মানুষই মেনে নিতে পারেননি। নানাভাবে তাঁর কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে, রটানো হয়েছে নানা কুৎসা। এসেছে রাজনৈতিক বাধাও। আর আর্থিক সমস্যা তো ছিল সুচিত্রাদেবীর নিত্যসঙ্গী। কিন্তু কোনও সমস্যাই তাঁকে টলাতে পারেনি। নিজের ওপর অগাধ আস্থা, জেদ এবং সততা---এই তিনটি বিষয়ের ওপর ভর করে সুচিত্রাদেবী নিজের এনজিওকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
সুচিত্রাদেবীর অনুরোধে একদিন আমি লালবাগে গিয়ে ওঁনাদের কর্মকান্ড দেখে এসেছিলাম। অন্তত ছশো পরিবারকে ওঁনারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করছেন। চলছে পোলট্রি, মৌমাছি আর রেশম কীট পালন, ফুলচাষ, সেলাই-উলবোনা সহ বিভিন্ন ধরণের হাতের কাজের নিবিড় প্রশিক্ষণ। শুনলাম, এনজিও মহিলাদের ক্রুশ দিয়ে তৈরি টেবিল ক্লথ আর বেডকভার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষ কিনে নিয়েছেন। সব দেখেশুনে ভীষণ ভাল লাগল। সুচিত্রাদেবী জানালেন,
-------আমরা এবার এখানে দুটো হ্যান্ডলুম বসাবো। ফুলিয়া থেকে একজন অভিজ্ঞ তাঁতী এসে এখানকার মেয়েদের তাঁত বোনার কায়দাকানুন শেখাবেন।
------তাই নাকি ?
------হ্যাঁ। বাংলার লুপ্তপ্রায় তাঁতশিল্পকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে চাই। আপনাদের শুভেচ্ছা থাকলে আমরা অবশ্যই সফল হবো।
------আমি নিশ্চিত, আপনারা অবশ্যই সফল হবেন।
এরপর আরো আধঘন্টা নানা বিষয়ে আলোচনার পর আমি সেদিন ফিরে আসি।
🌑
দশ বছর কেটে গেছে। আমি অবসর নিয়েছি বছর তিনেক আগে। গতকাল বিকেলে একটা চিঠি এল। আজকাল তো চিঠিপত্র একেবারেই আসেনা, তাই বেশ আশ্চর্য হলাম। তাড়াতাড়ি খামটা খুলে পড়লাম........
"স্যার, আশা করছি ভাল আছেন। আজকাল চিঠিপত্র বিশেষ লেখা হয়না, প্রয়োজনও তেমন পড়েনা। সব কাজ ইমেল আর হোয়াটসঅ্যাপেই হয়ে যায়। তবুও মনে হল, আপনাকে চিঠি লিখেই সবটা জানাই।
সেবার আমাদের এখান থেকে ঘুরে যাবার পর আপনি যা পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমরা সেটাই করার চেষ্টা করেছিলাম। প্রথমে পরীক্ষামূলক ভাবে চারটে জায়গায় লম্বা বাঁশ পুঁতে, তার মাথায় তামার ত্রিশূল বসিয়ে, সেখান থেকে ইনসুলেটেড তার একদম মাটি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তাতেই এল অদ্ভুত সাফল্য। আগে প্রতিবছর আমাদের আশেপাশের গ্রামগুলোতে বাজ পড়ে কমপক্ষে পনেরো-কুড়ি জন মারা যেতেন। আপনার প্ল্যানমাফিক বাঁশ লাগানোর পর আর এদিকে কেউ বাজ পড়ে মারা যায়নি। যাবে কি করে ? বাজ তো পড়বার আগেই বাঁশের সাথে লাগানো তামার ত্রিশূল আর তার বেয়ে মাটিতে চলে যাচ্ছে ! ভাল রেজাল্ট পেতেই আমরা গোটা জেলাজুড়ে ব্যাপকভাবে এইভাবে বাঁশ পোঁতার জন্য মানুষকে সচেতন করতে পেরেছি। এর ফলে একদিকে যেমন অহেতুক প্রাণহানি আটকানো গেছে, অন্যদিকে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর জন্য দেওয়া সরকারী অনুদানের খরচও বেঁচে গেছে। এজন্য আগামী মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তর থেকে আমাদের এনজিও-কে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হবে।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসছি। এতদিন মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা আর জলঙ্গীর মতো কিছু নদী থেকেই শুধু মাছধরার কাজ হত। কিন্তু আপনি বলেছিলেন, অগভীর ছোট্ট পুকুর কেটে তার মধ্যেই প্লাস্টিক পেতে মাছ চাষ করা যেতে পারে। সেইভাবে আমরা মোট একশো ষাট টি জায়গায় শিং-মাগুরের মত জিওল মাছ চাষ করে বিরাট সাফল্য পেয়েছি। পুকুরগুলোর ওপর মশারির কাপড় ঢাকা দেবার বুদ্ধিটা আপনি দারুণ দিয়েছিলেন। এর ফলে কাক-চিল-বক একটাও মাছ চুরি করতে পারছে না, অথচ পুকুরে দিব্যি আলো-হাওয়া ঢুকছে।
এবার বলব, ক্রুশের কাজে আর তাঁতের কাপড়ে সুন্দর নক্সা করে আমাদের এনজিও-র দুজন মহিলা রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। শিগগিরই আমরা মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের জন্য সোলার লাইটের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারব আশা করছি। এতে পরিবেশ দূষণ কমবে, আর গরীব মানুষের আর্থিক সাশ্রয়ও হবে। এর মধ্যেই আমরা মুর্শিদাবাদ জেলার প্রায় তিরিশ হাজার বিভিন্ন ধরণের অসংগঠিত শ্রমিক-কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রম দপ্তরের "বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা" প্রকল্পে নথিভুক্ত করতে পেরেছি।
সবশেষে বলব, আপনি তো জানেন শকুন এখন লুপ্তপ্রায় পাখি। বনদপ্তরের সহযোগিতায় আমাদের এনজিও লালবাগে পরীক্ষামূলক ভাবে একটি "শকুন পুনর্বাসন কেন্দ্র" চালু করেছে। সেখানে প্রথমে চারটি শকুন রাখা হয়েছিল। এখন তাদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে বাইশ। আগামী জুন মাসের পাঁচ তারিখে আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবসে পাঁচটি শকুনকে জেলাশাসকের উপস্থিতিতে মুক্ত পরিবেশে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মুর্শিদাবাদে পোস্টেড থাকাকালীন আপনি যেভাবে আমাদের পাশে থেকে উৎসাহ-পরামর্শ দিয়েছিলেন, তার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। মুর্শিদাবাদে এলে অবশ্যই আবার এখানে আসবেন। আর যদি আগামী জুন মাসের পাঁচ তারিখে এখানে আসেন, তাহলে আমাদের ভীষণ ভাল লাগবে......."
সুচিত্রাদেবীর চিঠিটা পড়ে একটা অদ্ভুত ভাললাগায় মনটা ভরে গেল। মা-দুর্গার মতো তিনি হয়ত অসুর বধ করেননি, কিন্তু সাক্ষাৎ মা-দুর্গার মতোই তিনি অসংখ্য গরীব-অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মতো একজন সামান্য মহিলার অসামান্য হয়ে ওঠার কাহিনী নিশ্চয়ই পরবর্তী প্রজন্মকেও উদ্বুদ্ধ করবে।
[ সত্য ঘটনার ছায়ায় লেখা। স্থান-ব্যক্তির নাম পরিবর্তিত ]
================
চন্দন দাশগুপ্ত
সি/৩০/১, রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, রিজেন্ট এস্টেট,
কলকাতা--৭০০ ০৯২
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন