তপন মাইতি
পৃথিবীর আবর্তকারের সাথে সাথে সব যেন আবর্তকারে ঘুরছে। স্রষ্টা-সৃষ্টি পরিপূরক সম্পূরক ও বিপ্রতীপ। নারী হচ্ছে পৃথিবী আর পুরুষ যেন বীজ স্বরূপ। পৃথিবীর আদি পুরুষ লাঙলে কর্ষণে এই সমাজ উৎপত্তি। সমাজে নারী পুরুষ দিনরাতের মতো। মুদ্রার দুপিঠের মতো। জোয়ার ভাটার মতো। একে অপর ছাড়া চলে না। তাই সমাজে নর নারী সমান ভাবে প্রযোজ্য ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর কথা উঠলেই বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। মোচড় দেয়।খাঁ খাঁ করে।ধূ ধূ করে মন। বলার ভাষা কোন থাকে না। এক অস্বাভাবিক গুমোট বাতাস বয়ে যায় চৈত্রের রোদে। বুকের ভেতর বহু দুঃখ কষ্টের মেঘ বৃষ্টি ঝরে পড়তে চায় একসাথে। সেই আদিকাল থেকে দেখে আসছি ইতিহাসে একই ধারাবাহিকতা। পিতৃশোষিত সমাজে নারী কখনও নগ্ন।সংকীর্ণা, প্রচ্ছন্না নমনীয়া, কদর্যা, ঘরকুনো গৃহিনী, বশ্যতার শিকার, পরাধীনতায় অবদমন,ধর্ষণ, রাহাজানি, বীভৎস, জঘন্য রক্তপাত, নিপীড়ন, শোষণ, অন্যায়,অবিচার, ব্যাভিচার, শ্লীলতাহানি, উৎপীড়ন, অধিকার হরণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, শ্রম হেনস্থা, যৌন হেনস্থা, উৎখাত, সহমরণ, অমানবিক প্রথা, পতিতালয়, সতীদাহ, ভাগ্যপন্য, অবহেলা, উপেক্ষা, দাসী, ভার্যা, কণ্যাভ্রুণ হত্যা, দুঃখ, কষ্ট, নিন্দা, অপবাদ, দোষ, জোর জুলুম, টিপ্পনি, কটাক্ষ, নির্মম নিষ্ঠুরতার স্বীকার হয়ে আছে জর্জরিত নারী সমাজ। এরচেয়ে বেশি বললে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে 'তুই সত্যিকারের পুরুষ তো? একজন পুরুষ হয়ে নারীর হয়ে বলছিস কেন?দেখুন নারীদের জন্য নারীরা এগিয়ে এসেছে সামান্য তারচেয়ে অনেক গুণ পুরুষেরা ছুটে এসেছে সাহায্য করেছে।'যা বলেছিস এখানেই থেমে যা নয়তো জিভ টেনে ছিঁড়ে নেওয়া হবে, চেপে যা, মহাভারতে বৃহদারণ্যক উপনিষদে গার্গী ও যাজ্ঞবান্ধ্যের উপাখ্যানে বলা আছে 'সাবধান গার্গী! আর বেশি বললে তোমার মাথা খসে পড়বে...।' তখনকার দিনে নারী ও শুদ্র একই আসনে অধিষ্ঠিতা। সেই সময়ে অন্ধবিশ্বাস ছিল যে নারী, শূদ্র, সারমেয় ও কৃষ্ণবর্ণ পক্ষী দেখলে সমস্ত কাজ নাকি পণ্ড হয়ে যেত এবং পুরুষশাষিত সমাজের মানসিকতা ছিল 'সোনার আংটি (পুরুষ) যতই বাঁকা হোক না কেন, তবুও সে সোনা। নারী তো পতির অর্ধাঙ্গ।
ভারতের ধ্রুপদী সাহিত্যে সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় ধর্মীয় সামাজিক মূল্যবোধ। সাবিত্রী-সত্যবাণ, নলদমবন্ত, রাম-সীতা, দ্রৌপদী গান্ধারী কুন্তী, অরুণন্ধতী, অহল্যা, বিবাহে স্বয়ম্বর সভায় বীরত্ব স্বামী পাওয়ার সৌভাগ্য ছিল। রামায়ণ মহাভারতে তখনকার সমাজে নারীর অবস্থা বা নারী মর্যাদা ঠিক কতটা ছিল তা আন্দাজ করা যেতে পারে।ইসলামে নারী হল স্বর্গভ্রষ্টা। ইসলাম নারীকে কোনোদিন ক্ষমা করেনি। ধর্ম নারীকে পৌঁছে দিয়েছে পৃথিবীর আদিমতম সমাজের বদ্ধ জলাশয়ে। পুরুষের বহুভোগ্য ভয়ংকর তালাক পর্দা প্রথা। এখানে নারীর অবনমন চূড়ান্ত।
আদম ঈভার গল্প সবাই কম বেশি জানো সকলে। সেই প্ররোচণা। সেই বৃক্ষফল খাওয়া। আর সেই থেকে শয়তান প্রবৃত্তি মানুষের শুরু।
আজকাল খবরের কাগজে, সোস্যাল মিডিয়ায়, সমাজের বুকে, ঘরে বাইরে চোখ পড়লেই ভেসে ওঠে নির্মম নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার তাগিদ, নারীর আর্তনাদ, পাশবিক অত্যাচারের স্বীকার, রক্ত ঝরানো নৃশংস খেলা। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে আমরা বর্বর নই আমরা অত্যাধুনিক যুগে বসবাস করি। এখানে নারী পুরুষের সমান স্বাধীনতার অধিকার আছে। শিশুকণ্যার বাঁচার অধিকার আছে। বিধবার বিবাহ করার পূর্ণ অধিকার আছে। কুমারীর স্বামী পছন্দের সমান অধিকার আছে। বিবাহ বিচ্ছেদের সমান অধিকার আছে। পৃথিবীর সব সম্পদের সমান অধিকার আছে। পরিবারের সম্পত্তির সমান অধিকার আছে। ন্যায় বিচারের সমান অধিকার আছে। শিক্ষাতে সমান অধিকার আছে। এত কিছু অধিকারের পর কেন বুঝি বাপু এতকিছু ঘটে যায় চোখের সামনে, রাস্তাঘাটে, বাস ট্রেন ট্রামে, অফিস কাছারিতে, গৃহকোণে, দেশে বিদেশে, খবরের পাতায়, আর যা অগোচরে সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকাংশটা মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো অনেক ইতিহাস। এই ই-কমার্সিয়াল অত্যাধুনিক জনবিস্ফোরণ যুগে নারীরা সংসারের জেলখানা কিংবা পুরুষদের কারাগারে পড়ে নেই। নারীরা রূপে গুনে অনন্যা। কোথায় নেই তারা। শিক্ষিকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, সৈনিক, পাইলট, ডিফেন্স লাইনে, পুলিশ, মহাকাশে, এমনকি পুরো গরীর সংসারের দায় দায়িত্ব নিয়ে সন্মানের সহিত জীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছে তার নজির সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে। আজকাল নারীর প্রগতির জন্য সকলে কম বেশি বোধবুদ্ধি সহানুভূতিশীল হয়েছে। বুঝেছে নারী জাতি এগোলে তাদের স্বনির্ভর করে তুললে সমাজে সার্বিক বিকাশ ও উন্নয়নশীল সমাজ গড়ে উঠবে। তারজন্য সরকারী বেসরকারি সুযোগ সুবিধার বহুমুখী প্রকল্প শুরু হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ কণ্যাশ্রী, রূপশ্রী, শিক্ষাশ্রী, ঐক্যশ্রী, অঙ্গনাড়ী, বিধবা ভাতা, মহিলা সমিতি ইত্যাদি ইত্যাদি।
এটা জানা দরকার পুরুষেরা দৈনিক বলবান হলেও নারীরা কিন্তু মানসিকভাবে ভীষণ শক্তিশালী। পুরুষশাষিত সমাজে আজও পুরোটাই নারী স্বাধীনতা পায়নি। এখনও কণ্যাভ্রুণ হত্যা, নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, পণপ্রথা, বধু নির্যাতনের মতো নির্মম নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। সমাজের ভেতরে দুর্বোধ্য দুরারোগ্য ব্যাধি পুষে রেখে চকচকে ঝকঝকে সৌখিন মাঞ্জা বের করে ঘুরলে কিছু হয় না।
যাইহোক বিতর্কমূলক কথা বললে অনেক কথা বলতে হয়।সমাজ নারী স্বাধীনতা মর্যাদা রক্ষার জন্য নারীদের সাথে সাথে পুরুষদের ও সমান ভাবে সামিল হতে হবে।পুরুষশাষিত সমাজের পরিবর্তে মাতৃশাষিত হলে তেমন ক্ষতি হবে না যদিনা এখনকার নারীদের মতো পুরুষদের সেই ফাঁদে পড়ে পস্তাতে হয়। একই জিনিস একই কোয়ালিটি একই সবকিছু শুধু শুধু অন্য নামের স্টিকার লেবেল মারলে সেই পরিবর্তনের কোন মানেই হয় না।
আমাদের সকলের একটা নারী পুরুষের সাম্যবাদের স্বনির্ভর স্বাবলম্বী সার্বিক বিকাশ সম্পন্ন মানব তন্ত্র সমাজ।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নারী চরিত্র বড়ই বিচিত্র। প্রতিটি চরিত্র স্বতন্ত্রমন্ডিত ও অনন্য।রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যেএক অমূল্য ভান্ডার। যা পরে বাঙালী জীবনে প্রাসঙ্গিক ছিল ও থাকবে। রবীন্দ্রসাহিত্যের উপন্যাস ও বড় গল্পে পেয়েছি, 'ল্যাবরেটরি'র সোহিনী, 'দুইবোনে'র শর্মিলা ও ঊর্মিলা, 'চার অধ্যায়'এর এলা, 'যোগাযোগে'র কুমুদিনী, 'শেষের কবিতা'র লাবণ্য, 'দৃষ্টিদানে'র কুমু, 'গোরা'র সুচরিতা, 'নষ্টনীড়ে'র চারুলতা, 'ঘরে-বাইরে'র বিমলা, 'চোখের বালি'র বিনোদিনী। ছোট গল্পে পাই 'স্ত্রীর পত্রে'র মৃণাল, 'দেনাপাওনা'র নিরুপমা, 'হৈমন্তী'র হৈমন্তী, 'সমাপ্তি'র মৃন্ময়ী, 'শাস্তি'র চন্দরা, রবিবারের 'বিভা', 'সুভা'র সুভাষিণী সহ আরো বেশ কিছু চরিত্র। রবীন্দ্রনাটকে পাই 'রক্তকরবী'র নন্দিনীকে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প 'দেনাপাওনা', 'হৈমন্তী', 'স্ত্রীর পত্র', 'অপরিচিতা' ও 'পয়লা নম্বর'। গল্পগুলোর নায়িকারা নিরুপমা, হৈমন্তী, মৃণাল, কল্যাণী, অনিলা।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জনপ্রিয় কথাশিল্পী। নিখুঁত তাঁর সেই দেখা। অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, ব্যথা, বেদনার কথা।তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্ররা কেউ সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের, আবার কেউ উচ্চবিত্ত। বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, পতিতা, অরক্ষণীয়া প্রত্যেকেই সসম্মানে ঠাঁই পেয়েছেন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে।'পল্লীসমাজ'-এ রমা।'গোরা'য় আনন্দময়ীর।'বড়দিদি'তে লক্ষ্মীর।'অরক্ষণীয়া'য় জ্ঞানদা।'পথের দাবী'। বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। সব্যসাচীর পাশে দেখা গেছে কয়েকজন নারীকে। যাঁরা দেশের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন।'পরিণীতা'য় ললিতা।'শেষ প্রশ্ন' কমল।'নিষ্কৃতি'র সিদ্ধেশ্বরী, নয়নতারা, শৈল।'দত্তা'র বিজয়া।
হুমায়ুন আহমেদের বিখ্যাত নারী চরিত্র শুভ্র, বদিউল আলম, মিসির আলী,বাকের ভাই ও মুনা, হিমু,আনিস ও মতি পড়লে বুজতে পারি সমাজের নারীদের স্থান কোথায়? তাঁদের পছন্দের নারী চরিত্রের কথা, যে চরিত্রগুলোকে তাঁরা এ সময়েও সমান প্রাসঙ্গিক ভাবছেন।
---------------------------
তপন মাইতি
গ্রামঃ পশ্চিম দেবীপুর; পোঃ দেবীপুর;থানাঃ মৈপীঠ কোস্টাল; জেলাঃ দঃ২৪ পরগণা;পিন-৭৪৩৩৮৩
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন