পোড়া মাটির প্রজাপতি
রাতের কোন প্রহর এখন, জানে না হাসোহা। পিঠে এলিয়ে পড়ে রয়েছে তার ঢেউ খেলানো কোমর ছাপানো কালো গভীর লতানে এলোমেলো অযত্নে লালিত সমস্ত চুলটার নির্মম মলিন গোছ। ঠিক যেন বুড়ো বটগাছের হাজার বছর ধরে জমতে থাকা তালগোল পাকানো শেকড়।তীব্র অসহনীয় যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে কাটাতে হবে আরও বহুকাল - রয়েছে তারাও সেই একাকী নিঃসঙ্গ অপেক্ষায়। তবে তাতেও হাতে পায়ের দগ্ধে ওঠা সব জ্বালাদের উপশম কোনোদিন হয়না আমাজনের জঙ্গলের গভীরতম আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা শামান উপজাতির এইসব মানুষদের - পরতে পরতে শুধু জমতে থাকে গরম কয়লা চেপে চেপে ফুটিয়ে তোলা উল্কির দাগ এক একটা যুগের ইতিহাসের সাক্ষ্য রূপে।
হাসোহা সামনের নিকষ অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। তার চোখের গহন কালো মণির অন্দরে কষ্টের লেশমাত্র পড়েনা কোনোখানে। সেই ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে তৈরি হয়েছে সে শুধু আজকের এই দিনটার জন্য, এই বিশেষ বিস্তৃত ক্ষণের জন্য — নাঃ, মেয়েরা এত সহজে হার মানেনা তাদের সম্প্রদায়ে, কোনোদিনই। তাকেও এত সহজে কোনোমতেই প্রতিহত করবে না তার একটুকরো নিজস্ব আপন নিস্তব্ধ জমাট আত্মা।
এ যুদ্ধ তো তাদের আজকের নয়, অনন্তকাল ধরে। নারী মানবতার অর্ধেক আকাশ জুড়ে ঢেউ তুলে চলেছে অনবরত, অথচ বংশ পরম্পরায় বাহিত নিগূঢ় সব জটিল মনস্তত্ত্বিক পাণ্ডিত্য এতকাল যাবৎ শুধুমাত্র আহরণ করে এসেছে পুরুষেরা। এই দ্বিচারিতার শেষ হবে যেখানে — সেখানেই আজও মিলেমিশে যাবে সোনালি পরশমণি মাখা অনাবিল প্রজাপতির সন্ধান। এমনই স্বপ্নবৎ জল্পনা এঁকেছিলেন প্রাজ্ঞ অশিতিপর "প্রাচীন পুরুষ" - যাঁর কথাই তাদের সমাজের আজ অলিখিত নিয়ম ও আচরণ।
হাসোহা এসব চায়নি যদিও। ছোটবেলার অনাবিলতা গায়ে জড়িয়ে সে শুধু প্রাচীন পুরুষের পায়ের কাছে বসে শুনতে চেয়েছিল প্রজাপতির রঙিন গল্প। হেসেছিলেন বৃদ্ধ। "প্রজাপতি বুঝি খেলনাবাটির কথন? নারে মা, সোনালী ঝকঝকে এইসব আস্তানাগুলো আসলে এক একটা জীবনের স্তম্ভ! এর খোঁজেই এত পথ ধরে চলা - এই ডানারাই সভ্যতার আদিম উৎস!"
হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছিল হাসোহা। "কিভাবে? বলো না আমায়! সেই গল্পটাই বলো!"
বৃদ্ধের কপালে প্রকট হয়ে উঠেছিল অগুনতি ভাঁজ। গালের রেখার আভায় যদিও মিলিয়ে যায়নি প্রশান্তি। "কি জানিস মা, প্রজাপতিদের আয়ু আসলে বড্ড কম। পাতায় জমে থাকা জলের এক একটা ফোঁটায়ই তাদের একচিলতে প্রাণের স্পন্দন। এত স্বল্প পরিসরে কোনো জটিলতা তাই জন্মাতে পারে না ওদের মনে আমাদের মানুষদের এত ভেদাভেদ আর দুরত্বের মতোন। ওদের স্বপ্নগুলোও তাই ভীষণ প্রাণবন্ত - আসল খনিজ রত্ন! যা লুকিয়ে থাকে মধুলেহনের সময়ে গাছের পাতায়, ফুলের পাপড়ির ভাঁজে আর এই সব ছোট্ট দানার মতো পরাগে - সেটুকু খোঁজাই তো এই নশ্বর জীবনের উদ্দেশ্য।পারবি না মা, আমাদের ছেলেদের সব দর্প চূর্ণ করে আমাদের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে শুধুমাত্র সেই একককে খোঁজার উদ্দেশ্যে?"
হাসোহা শুনেছিল, প্রাচীন সেই পুরুষ ভবিষ্যত আঁকতে পারতেন। তাঁর প্রতিটা ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া, ভাষা, ভাব ছিল যেন এক একটা তুলির আঁচড় প্রকৃতির মাঝের এই খোলা পাতায়। তাদের সমাজের অনেক মেয়েরাই তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে এগিয়ে এসেছিল তাই শিক্ষিত হতে, মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে আরেক কদম দীক্ষিত হতে। আজ অবশ্য তার সবটাই ইতিহাস যা বাঁধা পড়ে থেকে যাবে কোনো আগামীর সূচনায়।
গোষ্ঠীর অন্যান্য পুরুষেরা মেনে নিতে পারেনি মেয়েদের এই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার স্পর্ধা। প্রাচীন পুরুষ চোখ বুঁজতেই পুড়িয়ে মেরেছে তাই তারা অর্ধেক আকাশ - নির্বিঘ্নে, নির্দ্ধিধায়। পড়ে আছে তবু পোড়া কাঠের গন্ধ মেখেই হাসোহার প্রাণ বাকি মেয়েদের মতো জমাট বেঁধে এখন এক ঘুমন্ত প্রজাপতির স্বপ্নের ডানায়।
____________________________________