বাঙালির বাঙালিয়ানা
বছর কয়েক আগে চাকরিসূত্রে দুবাইতে যেতে হয়েছিলো।ঝাঁ চকচকে জীবনযাপনের জন্য মন্দ নয়,কিন্তু মনে হতো জীবনের তরঙ্গে ছন্দপতন হচ্ছে।সুর তরঙ্গ ফিরে এলো নিজের মায়ের কাছে ফিরে।এক উষ্ণ অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করলো।
খাওয়ার পাতে পঞ্চব্যঞ্জন দেখে ভয় পেলাম।এ কটা বছর রুটি আর আলু সবজি খেয়ে কাটিয়েছি।পেট ভায়া এত ভার নিতে পারবেতো।মায়ের হাতের রান্না গুলো বেশ তাড়াতাড়ি ঢুকে গেলো উদরে। করপোরেট জীবন গ্রাস করেছিল আমার নির্ভেজাল বাঙালি সত্তাকে।
শুধু কি খাওয়া,আরো কত কিছুর মধ্যে দিয়ে বাঙালি পরিচয় বেঁচে আছে।ইতিহাসের পাতায় বাংলার পলাশীর যুদ্ধ আর কলকাতার উৎপত্তির ঘটনা ছাড়া বিশেষ কিছু থাকেনা। এরম চলতে থাকলে একদিন বাঙালি সভ্যতা হারিয়ে যাবে।খানা পিনা,পোশাক,অলঙ্কার, স্থাপত্য কীর্তি,সবার মধ্যেই ইতিহাস লুকিয়ে আছে,যা আমরা দেখতে নিস্পৃহ।সেই ইতিহাসকে খুঁজে বার করতে বাছাই করলাম মিষ্টিকে।
শুভ অনুষ্ঠান হলেই মিষ্টিমুখ করতে হয়,এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি। আনন্দের সূচনা হয় পায়েস বানিয়ে। গরীব, বড়োলোক, সবাই জন্মদিন,পুজোপর্বনে পায়েস তৈরি করে। গোবিন্দ ভোগ চল,দুধ,আর চিনি বা নলেন গুড়ের অপূর্ব মিশ্রণ হলো এই পরামান্ন।তবে তা বানানোর সুকৌশল গুলো এই প্রজন্মের বেশিরভাগ জানতে আগ্রহী নয়। পৌষ পার্বনের দৌলতে,দোকান গুলোতে পায়েস ,পিঠে, পাটিসাপটা, পুলি বেঁচে রয়েছে। বাংলা খেতে ভোলেনি,বাড়িতে বানাতে তার আলস্য কাটেনি।কিছু গৃহবধূদের হাত ধরে চালের পিঠে বংশানুক্রমে এখনও এগিয়ে চলেছে।
এবার আসি সন্দেশের কথায়।
সন্দেশের কথা কিছুটা পাওয়া যায় চৈতন্য চরনামৃতে।তবে তা নিয়েও দ্বন্দ।শোনা যায় বাসি দুধ ও নষ্ট দূধ ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবরা গ্রহণ করতেন না।অথচ ছানা ছাড়া সন্দেশ হয়না।চৈতন্য চরনামৃত নিয়ে দ্বন্দ থাকলেও, পর্তুগীজদের প্রভাবে সন্দেশের আবিষ্কার,সেটা উড়িয়ে দেওয়া যায়না।পাশ্চাত্য সভ্যতা বরাবরই চীজের প্রতি দুর্বল। চীজের বাঙালি রুপ হলো ছানা।এই ছানা ও চিনি,গুড়ের সংমিশ্রণে তৈরি হয় বহু জগতজয়ী মিষ্টান্ন।
সন্দেশের নামকরণে কলকাতার জুড়ি মেলা ভার। দেশের গরব,মানোরাঞ্জন, প্রাণ হরা,অবাক, নয়নতারা,বাঘ,আবার,খাবো, এসব নানান নামে সন্দেশ বিশ্ববিখ্যাত।লর্ড রিপনের নামেও এক সন্দেশের নাম রাখা হয়।তাছাড়া সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকোলাই বুলগানীনের নামে ১৯৬০ সালে একটি সন্দেশের নামকরণ হয়।বুলগনীনের বিষ্ময় নামে ওই সন্দেশ পরিচিত।
শোনা যায় কোনো এক ব্যারিস্টার কলকাতা হাইকোর্ট এর গোথিক বিল্ডিং-এর আদলে মিষ্টি বানিয়ে উপহার দিয়েছিলেন নিজের স্ত্রীকে।
সন্দেশের কথাই যখন উঠছে তখন জল ভরা সন্দেশের কথা না বলে থাকি কি করে।
শোনা যায় তেলিনীপাড়ার জমিদার গিন্নী জামাইকে নিয়ে রসিকতা করবেন বলে, সূর্য কুমার মোদক কে ডেকে পাঠান।সময়টা ১২৯০ বঙ্গাব্দ হবে।
মোদক মশাইয়ের কাছে জমিদার গিন্নী আবদার ছিল,এমন একটি মিষ্টির যা তার জামাইকে চমকে দেবে।
আবদার রাখতেই তৈরি হলো জলভরা সন্দেশ।দোলার রস পুরে তৈরি হলো সন্দেশ।জামাই বাবা জীবন যেই না একটা কামড় দিয়েছেন,অমনি রস বেরিয়ে এসে তার মুখে আর পাঞ্জাবী তে। ছবিটি চোখের সামনে ভাবতেই হাসি পাচ্ছে।সন্দেশের মরুভূমিতে মরুদ্যান ।
বিশ্বকবির বজরা প্রায়সই এসে থামত চন্দননগরের পাতাল বাড়ির ঘাটে। সূর্য্য মোদক নিজে হাতে জলভরা, মতিচুর সন্দেশ, ক্ষীর পুলি সন্দেশ নিয়ে যেতেন তার জন্য।
বর্তমানে কলকাতা জলভরার গর্ভে নলেন গুড় আর চকলেট দিয়ে চমক তৈরী করছে।
কবিগুরু রসগোল্লা খেতে খুব পছন্দ করতেন।
আইনি যুদ্ধে জিতে জি. আই এর তকমা পেয়েছে আমাদের সুন্দরী কলকাতা। রসগোল্লার গল্প শুরু হয় নবীণ চন্দ্র দাসের হাত ধরে। কে.সি.দাসের দোকানের পূর্বসুরী তিনিই।
১৮৬৪ সালে জোড়াসাঁকতে দোকান খোলার পর সেটা না চলায়, বাগবাজারে নতুন উদ্যম নিয়ে শুরু করলেন যুদ্ধ।তার কঠিন পরিশ্রমের ফসল হল রসগোল্লা। এই রস গোল্লাই তাকে বিখ্যাত করে তুললো।
পশুপতি ভট্টাচার্য নামে এক ডাক্তারের প্রাই যাতায়াত থাকত কবিগুরুর বাড়িতে।যাওয়ার পথে নবীন চন্দ্র দাসের রসগোল্লা নিয়ে যেতেন।তৃপ্তি নিয়ে নিশ্চয়ই খেতেন,না হলে কোনো এক বার অন্য দোকানের রসগোল্লা নিয়ে যাওয়াতে তিনি স্বাদের পার্থক্য ধরে ফেলেন।
ভগবান দাস বাগলা নামে এক রাজস্থানী ভদ্রলোক ,বাংলার বাইরে গোবলয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন,রসগোল্লার স্বাদ।
এই রসগোল্লা নানান রূপে এসেছে আমাদের সামনে।কখনো মোহনভোগ,তো আবার কমলা ভোগ।বাঙালি কিন্তু স্বীয় মুখগহ্বরে এদের প্রবেশের অধিকার দিয়েছে সানন্দে।
লেখাটা মন দিয়ে লিখছি।এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো।ফোনের ওপার থেকে খবর এলো,কিছু আত্মীয়রা আসছেন দুর্গাপুর থেকে।প্রথমে তো খুব রাগ হলো,এই ছন্দপতনের জন্য।পরে ভাবলাম,শক্তিগড়ের ল্যাংচা আসছে ভলভো তে চড়ে।কোথায় যেনো পড়েছি,একটা মিষ্টি গল্প ল্যাংচা কে ঘিরে।
তা গল্পটি কেন্দ্রীভূত দুই অভিজাত পরিবারের ভেতর। কৃষ্ণনগেরর এক রাজবাড়ির রাজকন্যার সাথে বিয়ে হয় বর্ধমানের রাজবাড়ির রাজপুত্রের।শুভ পরিণয়ের পর যথাসময়ে নব বধূ অন্তঃসত্ত্বা হলেন।এ সময় হঠাৎ করে খাবারের প্রতি তার অরুচি এলো।কিছুই খেতে তার ভালো লাগেনা,শুধুমাত্র এক ধরনের মিষ্টি ছাড়া। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত সমস্যা জটিল আকার নিলো। বিশেষ মিষ্টির নাম নতুন বউ বলতে পারছিলেন না।শুধু তার মনে ছিল এক ল্যাংড়া ভদ্রলোক এই মিষ্টিটা বাপের বাড়িতে বানাতেন। কৃষ্ণনগরের চারিদিকে সেই ভদ্রলোকের খোঁজ করতে গিয়ে অবশেষে ল্যাংড়া দত্ত নামে এক ভদ্রলোককে পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে আসা হয় বর্ধমানে। ক্রমশ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো ল্যাংচার স্বাদ।তাই ল্যাংচার নাম ডাকে কৃষ্ণনগরের ও অবদান রয়েছে।
লেডিকেনি, নিখুতি - এরা প্রায় ল্যাংচার মতন খেতে। ঊনবিংশ শতাবদীর মাঝা- মাঝি লেডি ক্যানিং ভারতবর্ষ ভ্রমণে আসেন। বহরমপুরে এক বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন তার নামে বানানো হয় আর সেটাই লেডিকেনি নামে পরিচিত পায়।
কৃষ্ণনগরের নেডিয়ারপারার শ্রী জগবন্ধু দাস নিখুতি তৈরি করা শুরু করেন।ছানা দিয়েই তৈরি হয় নিখুতি,তবে দেখতে অনেকটাই ল্যাংচার মতন।পায়েসের মধ্যে দিয়েও নিখুতি খাওয়া যায়।
পুরনো বহুমুল্যবান বিষয়বস্তুকে যেমন সংস্কার করা হয়,তেমনি মিষ্টিকে নানান ভাবে সংস্কার করে তার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য চেষ্টা করে চলেছেন ব্যবসায়ী শ্রেণী।এরা সবাই যে বাঙালি,তা কিন্তু নয়।অনেক অবাঙালি ব্যবসায়ী আছেন যারা নিত্য নতুন পদ্ধতিতে মিষ্টির গুণাগুণ জাগিয়ে রাখেন।নতুন রূপে,নানান সত্ত্বা দিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে আসছেন এরা।
একটা প্রবাদ আছে,মানুষ যেমন খান,তেমনি হতে চান।বাস্তব জীবনের যাঁতাকলে পরে রুক্ষতা এসেছে জীবনে।তবে মিষ্টির প্রতি আসক্তি বাঙালির কাব্যিক মনকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। । পয়েলা বৈশাখে বাঙালি এখনও কবিতা, গান, আর ব্যঞ্জনের মধ্যে দিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। যেকোনো সংস্কৃতিকে আজও বাঙালি উদার মনে গ্রহণ করে। বাঙালিয়ানা আজও বেঁচে আছে আমাদের আচার বিচারে। এই মিষ্টি যেনো আমাদের প্রজন্মের ইতিহাস বহন করে বুড়ো বট গাছের মতন দাঁড়িয়ে থাকে।
==========
সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়