একাকীত্ব
একাকীত্ব আজ প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে,আপন আপন মহিমায় বিরাজমান । আধুনিক জীবন যাত্রার ভিন্নতার সাথে ঘুণপোকার বাসার মতোই অন্যতম অপ্রতিরোধ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে একাকীত্ব। বেড়েছে মানুষে মানুষে মোলাকাৎ, হই হুল্লোড় , কত রকমের গেট টুগেদারের আয়োজন আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততার জীবন পরিসরে, তবুও একাকীত্বের নখর আঁচড় বসাচ্ছে নিজের মতো করে গহন মনের আকাশে , আমাদের বাহ্যিক আচার-আচরণে ।
আপন মানুষ জনের পাশেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সংসার জীবন তবু যেনো একটা শূন্যতা ।বড্ড ব্যস্ত জীবনে একাকীত্বের চতুর থাবা । এই একাকীত্ব যাতে না আসে,একে নির্মূল করতে, আমরা নিজেদের ব্যস্ত রাখার কত চেস্টা করি,হটাৎ বেরিয়ে পরি সপ্তাহান্তিক ছুটিতে,একটু ফুরসৎ তো সুপার মার্কেট ,মল কালচার,আইনক্স,এক্সিভিসনে অবগাহন, দেখনদারি তবুও মুক্তি কই ?
একাকীত্ব তবু আপন খেয়ালে নিজ ভঙ্গিমায় এই দ্রুত গতির মানব জীবনে ঘাপটি মেরে বসে , সময়ে সুজোগে ঠিক মাথা তোলার অপেক্ষায় । এই একাকীত্বের অন্যতম দোসর আবার অবসাদ, তার মোকাবিলাতেও চিন্তার শেষ নেই । ঐ সব থেকে নিজেদের দূরে রাখতে , ভুলতে কতো রকম ভাবে নিজেদের ব্যস্ত রাখার প্রচেস্টা । যে ছেলে বা মেয়েটি সারাদিনের ব্যস্ততা, পড়াশোনা কিংবা কর্মক্ষেত্রের চাপের মধ্যে মুখ গুঁজে কাজ করে চলেছে , কত দেশ বিদেশের মানুষের সাথে ইন্টারনেটে কথোপোথন । কিন্তু যেই মুহূর্তে, সে একদম একাকী হয়ে নিজের সঙ্গ দেয় , অল্পেই অধৈর্য্য হয়ে ওঠে , সময় কাটতে চায় না , এই সব ভাবনার অনুপ্রবেশ ! কেড়ে নেয় ঘুম , একরাশ অবসন্নতা বুকে নিয়ে বাঁচা , অনুভবে যেনো "আমার দিন কাটে না ,আমার রাত কাটে না ' বিরক্তির বোঝা।
কখনো এই , মনের মানুষকে কাছে পেয়ে সব কিছু ভুলে থাকা , হাসি খুশির জগতে পদার্পণ তো আবার পরক্ষণেই একঘেঁয়েমির করাল ছায়া ! এ যেনো থোড় বড়ি খাড়া , খাড়া বড়ি থোড় জীবন যাত্রা আমাদের ,একাকীত্বের আস্টেপৃষ্ঠের বাঁধনে বন্দি।
এই একঘেঁয়েমি জীবনে মানিয়ে চলতে চলতে কখন যে, আমরা রোবট হয়ে পড়ি খেয়াল থাকে না । লোপ পায় দয়া মায়া , স্নেহ ভালোবাসা নামক অনুঘটকগুলো । কাকে কি বলা উচিত আর কি বলছি , কেমন আচার আচরণই বা করছি সেও উড়ে যায় চিন্তায় বুঁদ হওয়া মাথা থেকে । কেবল একটাই শব্দ মাথায় গেঁথে থাকে লক্ষ্যপূরণ। এর জন্য অনেক কিছু অ্যাডজাস্ট, কম্প্রোমাইজও করতে হয় । এখন অনেকটা পুতুল দের মতো আচার আচরণ আমাদের । এই বিরাট পৃথিবীর নাট্য মঞ্চে , আমাদের ভুমিকা যেনো সব কিছুই পূর্ব নির্ধারিত । জন্মগ্রহণ আর একটু বড়ো হবার সাথে সাথে , আমরা স্রোতে ভেসে ভেসে চলছি,jeনো পুতুল খেলা দেখানোর মতো আমরা এক একটা রঙিন পুতুল অদৃশ্য সুতোতে বাঁধা । আজ , পরিমিত হাসি , পরিমিত খাওয়া ,অভ্যাসে রপ্ত মানব কুলের দৈনন্দিন জীবন ধারণ একাকীত্বের ভেলায় চড়ে ।
ছোটো বেলায় সময় সুযোগ পেলেই মামার বাড়ি ছুটতাম গ্রামে । যোগাযোগ , উন্নতি না থাকায় ঘুরপথে ঘুরে রিকসা , বাস, নদীপাড়, হাঁটা ,গরুর গাড়ি আর দাদুর ব্যবস্থাপনায় পাঠানো গরুর গাড়ির ওপর বাঁশের ঘেরা ছদরিতে দিদিমার গুছিয়ে দেওয়া মুড়কি , নাড়ু খেতে খেতে হই হই করে এক দল ভাগ্না ভাগ্নী পৌঁছে যেতাম , বড়ো স্নেহের পীঠস্থানে । সন্ধ্যায় দাদুকে ঘিরে কত আগ্রহ নিয়ে রূপকথা থেকে ব্যঙ্গমা- ব্যঙ্গমি আরো কতো নীতি গল্প শুনে বিভোর হয়ে ক্লান্ত চোখে ঘুমের আড়স্টতা । একবারও মনে হতো না আজকের বাচ্ছা গুলোর মতো 'এর পর কি করবো , দূর বাবা বোর লাগছে '।এই প্রজন্ম যেনো বড্ড বেশিই অস্থির , একটুও তর সয় না ।
মামাবাড়িতে "ভারি মজা,কিল চড় নাই "পরিবেশে সকাল শুরু হতো হাঁসের ছোট ঘরটি থেকে কে প্রথম গুনে গুনে ডিম বার করবে এই তত্পরতা দিয়ে ! তারপর থালায় জল ঢেলে হাঁসেদের জন্য খাবার রেখে তৃপ্তির অপেক্ষা । ওরা খাবার খেয়ে সারিবদ্ধ ভাবে পুকুর অভিমুখে চলে গেলে , অদ্ভুত ভালো লাগা নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম । আবার বিকালে' চই চই, চই চই' ডাক দিয়ে , কি সুন্দর হাঁসের দলকে পুকুর থেকে তুলে বাড়ি ফেরানো ! একটা দুটো ছাড়া কি বাধ্য তারা , বাধ্য তাদের গতিবিধি ।
বেলা বাড়লে ,রাখাল দাদার সাথে গোয়াল ঘরে তার দৈনন্দিন কাজের খুঁটি নাটি গল্প , গরুর গলকম্বলে হাত দিয়ে আদর করার অদ্ভুত প্রশান্তি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না । পেয়ারা , আম ,জাম , গাব, খেজুর , তাল কতরকমের ফল ঋতু অনুযায়ি গাছ থেকে পেরে দেবার আবদার করে , কতো গ্রাম্য গল্পে গা ভাসানো । কখনো কিন্তু একাকীত্ব শব্দটা মনের মধ্যে আসতো না, আসার অবকাশও ছিলো না তখন । আজ ছোটো ছোটো বাচ্ছা গুলো একদম মিনি কম্পিউটার । এত টুকু সময় যে, বসে থাকবে , কিছু ভাববে তা কিন্তু করে না কেবল " ভালো লাগছে না , বোর হচ্ছি "এই সব শব্দ চয়ন !
শৈশবের বিকালের মাঠে কতো রকমের খেলা খেলতাম , খেলা দেখতাম ,কি অপূর্ব সে সব দিন। কত হারিয়ে গেছে সে সব খেলা ,পরিবেশ ও অসুস্থ আর বিভীষিকাময় । সেই সঙ্গে সময়ের বড়ো অভাবের সঙ্গী ,পিঠের ভারী ব্যাগ আর ইস্কুলের দৈত্যাকার সিলেবাস । জানালার গরাদ ধরে জুল জুল চোখে বাচ্ছা , ফ্লাটের খাঁচা বারান্দা থেকে নিজের লোক জন , গাড়ির গতিময়তা নচেৎ টেলিভিশনে সিনচেন , নবিতা , মোটু পাতলুর চওড়া মুখের হাসি দেখে বড়ো হয় আর ফাঁকা হলেই একাকীত্বের পিঠে সওয়ার ।
এই তিন দিন হলো বাড়িতে একটা সাধারণ বোতাম সুইচ মোবাইল এনে রেখেছি , উদ্দেশ্য মেয়েটা ছোটো তো , ঠিক ঠাক বাড়ি ফিরে , আমাদের একটু জানিয়ে দেবে সে ফিরলো কখন। সহধর্মিণী কাল দেখালো আমায় ,মোবাইলের খসড়া ম্যাসেজ লেখার স্থানে আমার নয় বছরে পা দেওয়া মেয়ে প্রায় সাতাশ টা ম্যাসেজ লিখে রেখেছে , তা কি লিখেছে শুনুন , নিজেই প্রশ্ন করেছে এক একটা ম্যাসেজে আবার নিজেই আর একজন সত্ত্বা হয়ে মনের মধ্যে ওর কাল্পনিক ব্ন্ধু সেজে , উত্তরও লিখেছে প্রতিটা ম্যাসেজের । এটা একটা উদাহরণ মাত্র , অর্থাৎ সময়ের তালে তাল মিলিয়ে একা সন্তান একাকী থেকেও একটা পরিবেশ গড়ে তুলেছে আপন মনের গহনে ।
দেখে খুব খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই , খেলবে কার সাথে এই বিছিন্ন দ্বীপের মতো একক পরিবারে ! এই এক সন্তানকেই ঠিক মতো মানুষ করতে পারবো তো এই আতঙ্কের ভয়ে এক সন্তান নিতে আগ্রহী আমরা অভিভাবকরা পাড়ি দেই, দাদু-ঠাকুমা ছেড়ে সুযোগ সুবিধা পেতে শহরে।
আর এই মিনি কম্পিউটার বাচ্ছারাও এই সব নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে নিজেদের মতো করে ভাবনার জগতকে সাজিয়ে নেয় । ওরা নিজেদের মতো করে থাকে, বড়ো হয় । স্কুল থেকে ফিরে একদম ম্যামের অনুকরণে যখন আমার বাচ্ছা, অদৃশ্য ক্লাস বানিয়ে হোয়াইট বোর্ড , চক ডাস্টার নিয়ে রীতিমতো স্টুডেন্ট দের নাম ডেকে পড়া ধরে ,বোর্ডে পড়া বোঝায় , বা নাচের ক্লাস করে এসে আপন মনে নিজেই নাচের ম্যাম হয়ে নাচ শেখায় , বেশ মজা লাগে , আবার ভাবি এর মধ্যেই বাচ্ছা তার আনন্দ খুঁজে পেয়েছে , নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে আর খেলছে খেলুক পড়া পড়া খেলা, আর যতদিন সম্ভব একাকিত্বকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে, ততই আখেরে ওরই লাভ ।
আগে যৌথ পরিবারে হই হই করে খেলা , পড়াশোনা ,যৌথ কাজকর্মে কি সুন্দর দিন গুলো কাটতো, ছেলে মেয়েগুলো মানুষ হয়ে যেতো ঘরের , কাজের মাসিদের ওপর ভরসা করে ,কোলে পিঠে চড়ে ! এখন পরিস্থিতি অনেক আলাদা । ভরসার লোকের অভাব , নানান সমস্যা সর্বত্রই । উপার্জন বেশি তবু দিশেহারা অভিভাবকগণ । এক সন্তান কে মানুষ করতেই চিন্তায় অস্থির , ত্রাহি ত্রাহি রব অন্তরে । আবার সন্তানের সঙ্গী হিসাবে ভাই কি বোন কে পৃথিবীর আলো দেখাবে , সে ইচ্ছে বা সাধ থাকলেও মধ্যবিত্ত পরিবারে লোকবলের অভাব, অর্থ সংকট, কাজের মেয়ের ওপর ভরসা করে দিন গুজরান। এক জন সন্তানকেই , এই তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে ভালো করে মানুষ করতেই জিভ অর্ধেক বেরিয়ে আসার উপক্রম! সুতরাং একাকীত্ব আছে , থাকবে আগামী প্রজন্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছায়ার মতো আর আধুনিক জীবনে একে উপেক্ষা করা কি সাধ্যি ! এই চিন্তা বুকে নিয়েই বাঁচা, আগামীর পথ চলা । সবেধন নীলমনি সন্তান কে , একটা বেস্ট ক্যারিয়ার দেবার ইচ্ছা, চেস্টা বা লক্ষ্যমাত্রার স্বপ্ন বুকে নিয়ে স্বার্থপরতার মোড়কে একাকীত্ব, অবসাদ নামক কিছু অতি আধুনিকতার অলঙ্কার গায়ে চাপানো ।