ভেজা জুঁইয়ের গন্ধ ...
ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ট্রেন টা অবশেষে প্লাটফর্মে ঢুকতেই বৃষ্টির ছোয়া বাঁচিয়ে মস্ত একটা লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠলো নির্ঝর। মাথায় বাধা রুমালটাকে এক ঝটকায় খুলে চোখে, মুখে, চশমার উপর এসে পড়া অবাঞ্ছিত বৃষ্টির ফোটা গুলো মুছতে মুছতে জানালার ধারের একটা ফাঁকা সিটে বসে স্বস্তির একটু নিঃশ্বাস ফেললো সে।
যাক বাবা প্রায় চল্লিশ মিনিটের উপর লেট এ চললেও,এই ঘোর নিম্নচাপের অকাল বর্ষায় ট্রেনটা এসেছে এই ঢের। এবার ঠিক মতো বাড়িতে পৌঁছাতে পারলে হয়। এই ভেবে মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে থাকে সে।
এইরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে হেড অফিস কেন যে আগে থেকে মিটিংটা পিছিয়ে দিলো না ! এই ভেবে মনে মনে খুব বিরক্ত হয়ে ম্যানেজমেন্টকে শাপশাপান্ত করতে করতে পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ।
ক্ষীণ একটা আওয়াজ করে ট্রেন ছাড়তেই সে মোবাইল থেকে মুখ উঠিয়ে দেখলো কামরার বেশির ভাগটাই ফাঁকা। দুই একজন ছাড়া প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। হোয়াটস অ্যাপএর মেসেজে মনোনিবেশ করে নির্ঝর। এতক্ষনে প্রায় ধরে আসা বৃষ্টিটা আবার জোরে শুরুহলো। কর কর করে কোথায় যেন একটা বাজে পড়লো।
দুই একটা মেসেজের প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে নির্ঝরের চোখে মুখে বিরক্তির অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। নেটওয়ার্কের প্রব্লেম। নেটওয়ার্কের আর দোষ কি !!! কয়েক দিনের নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক ও যেন দেহ রেখেছে। গত্যান্তর না দেখে জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
দিনমানের এই বাকি সময়টাতেই বাইরে অন্ধকারের ঘনঘটা। মুমুক্ষু সূর্যদেব আলগোছে কবে দৃশ্যমান হবে কে জানে ! চিন্তাক্লিষ্ট মুখে মাথাটা পিছনের দিকে এলিয়ে দেয় নির্ঝর। হালকা ঠান্ডা লাগে তার ,চোখ বুজে আসে।
কয়েকটা স্টেশন সাই সাই করে পিছনে চলে যায়। ট্রেনটা কোথাও থামে কোথাও নয়। চোখটা বেশ লেগেই এসেছিলো নির্ঝরের। হঠাৎ একটা প্লাটফর্মে ট্রেনটা থামতেই হৈ চৈ করে বেশ কিছু লোক সঙ্গের বিবিধ লটবহর নিয়ে দুমদাম আওয়াজ করতে করতে ট্রেনের একদম ফাঁকা কম্পার্টমেন্টে গোল বাঁধিয়ে দিলো। নির্ঝর যারপর নাই বিরক্ত হয়ে প্রবল অনিচ্ছা স্বত্বেও চোখ খুলে দেখলো তার ঠিক উল্টো দিকের সিটে ফর্সা সৌমকান্তি সুদর্শন এক যুবা সাথে তার যুবতী স্ত্রী গা ঘেঁষা ঘেসি করে বসে আছে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সঙ্গের বেশ কিছু লোক। প্রলাপ বাক্যালাপ ব্যাস্ত তারা।
এতক্ষনে ঠিক মতো খেয়াল করেনি। সামনেই যে স্ত্রী লোকটি বসে আছে তাকে খুব চেনা ,খুব আপনার মনে হলো নির্ঝরের। পথ চলতে গিয়ে কোনো সাপ এর গায়ে পা পড়লে পথিক যেমন করে আৎকে ওঠে ঠিক তেমন ভাবেই বিস্ময়াবিভুত নির্ঝরের একটা হিম শীতল ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া বয়ে যেন নিচে নেমে গেল। হ্যা। এতো সেই ! এই মুখ তো আর এই জড় জগৎ সংসারে ভুলবার নয়। কান দুটো গরম হয়ে ওঠে। জীবনে কোনোদিন এই ভাবে মুছে যাওয়া অতীতের সামনা সামনি দাঁড়াতে হবে, বলা ভালো মোহরের মুখো মুখি হতে হবে ! তা কোনো দিন স্বপ্নের অবচেতনেও ভাবেনি নির্ঝর।
এক ঝটকায় চোখের থেকে রিমলেস চশমাটা খুলে হয়ে বিস্ময়ের আবেশ মাখানো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মোহরের দিকে। অজানা এক বিস্ময়ে কাঁপছে সারা শরীর। কেমন যেন এক নিরবিচ্ছিন্ন স্তব্ধতা নেমে আসে মনে। নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে সোজা হয়ে বসে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে নির্ঝর। ফিনফিনে দুধ সাদা আর উজ্জ্বল গোলাপিতে মাখামাখি শাড়িতে বেশ লাগছে মোহর কে। সেই টানা টানা চোখ ,সেই তীক্ষ্ন নাখ। ঠোঁটে বেদানা রাঙা লিফস্টিক এর প্রলেপ । দুধেআলতা গায়ের রঙে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে ওকে। তবে চেহারাতে আমূল পরিবর্তন। আগের থেকে প্রায় অনেকটাই মোটা মনে হলেও শরীর থেকে চুইয়ে পড়ছে অপূর্ব এক লাবণ্য।
এতক্ষনে বোধ করি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মোহর ও লুকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নির্ঝরের থেকে চোখ সরিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে অলীক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিশমিশে ঘন কালো মেঘের দিকে ,যে ভাবে তৃষ্ণর্ত শিকড় চেয়ে থাকে জলের জন্য।
কপালের দুপাশ থেকে চোখের উপর এসে পড়া অবাধ্য চুলগুলোকে ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে সরাতে সরাতে নির্ঝরের মতোই সে ও যেন হারিয়ে যেতে চাইছে অতীতের বাঁকে ফেলে আসা নিভৃত কোনো সুখ স্মৃতিতে।
এই তো সেদিনের কথা। ইউনিভার্সিটিতে প্রথমদিন। নবীন বরণের উৎসবে মাতোয়ারা ইউনিভার্সিটি চত্বর। চারিদিকে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। ক্যান্টিন থেকে ক্লাসরুম সকলের ব্যস্ততা চোখে পরার মতো। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটু নির্জনে একটা বকুল গাছের গোড়ার চাতালে নীল জিন্টসের উপরে দুধ সাদা একটা পাঞ্জাবি পরে একাকী বসে ছিল নির্ঝর। শুকনো বকুলের ঝরা পাতায় অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসংগীতের সুর। অনির্বচনীয় মাদকতাময় মহিলা সে কণ্ঠ ! " যদি তারে নাই চিনি গো সেকি ....."
নির্ঝরের মুখে নির্লিপ্ততার ছাপ। কল কোলাহল আর আনন্দ মুখরতা থেকে অনেক দূরে। গ্রামের থেকে শহরের একদম মূলস্রোতে এসে পড়াটাও তার এই আত্মকেন্দ্রিকতার কারণ ও বটে।
সহসা নির্ঝর খেয়াল করলো একদল মেয়ে বাক বিতন্ডা করতে করতে তার দিকেই যেন এগিয়ে আসছে। সবাই কে অবাক করে দিয়ে তাদের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এল তার কাছে।
তন্বী চেহারায় সর্ষে ফুল রাঙা শাড়িতে মাথায় লাল পলাশের আগুন। কাজল টানা গভীর দুচোখে যেন কিসের আবেদন। হাতে ধরা গীতবিতান। কক্ষ পথ থেকে ছিটকে আসা ধূমকেতুর মতো একদল সঙ্গীদের ছেড়ে সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পনে এসে দাঁড়ালো নির্ঝরের সামনে।
---" আমি মোহর। তুমি এখানে মনমরা হয়ে একা একা বসে কি করছো ? "
নির্ঝর ঘটনার আকস্মিকতায় খানিক ভ্যাবাচাকা খেয়ে চোখের কালো ফ্রেমের মোটা চশমাটা ঠিক করে চোখে আটকে আড়ষ্ঠ গলাটা একটু স্বভাবিক করার চেষ্টা করে বললো
---" মোহর ! বাঃ বেশ নাম তো ! "
---" নামের ভালো মন্দে কি বা আসে যায় ? আসলে নামটা আমার ঠাম্মার দেওয়া। ঠাম্মা আজ আর নেই ,নামটাই শুধু রয়ে গেছে। তাই ভালো বা মন্দ ,বা প্রশংসা যাই বলো না কোনো সেটা আমার ঠাম্মারই প্রাপ্য।
---" হুম ,তা অবশ্যি ঠিক। আমি নির্ঝর চক্কোত্তি। তোমাদের শহরে নতুন "
---" তুমিই নির্ঝর !!! তুমি ই তাহলে সে… ই ই ই !!! এবারের ডিপার্টমেন্টাল লিস্টের টপার। তাহলে তোমার কথাই স্যাররা সেদিন আলোচনা করছিলেন। "
একটু থতমত খেয়ে নির্ঝর জিজ্ঞাসা করলো
---"কোনো ? কী বলছিলেন ওনারা ? "
---"ওনারা বলছিলেন যে উচ্চমাধ্যমিকে ফাটাফাটি রেজাল্ট করার পর ডাক্তারি বা নিদেন পক্ষে ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে ম্যাথস এ এমএস সি !!! একটু অবাক করার মতো ঘটনা। "
নির্ঝরের একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস সবার অলক্ষ্যে মিলিয়ে গেল শেষ দুপুরের তপ্ত বাতাসে।
খুব ছেলেবেলায় এক কঠিন রোগে বাবাকে হারিয়ে শৈশবের বেশির ভাগটাই কেটেছে মায়ের সাথে বর্ধমানে মামার বাড়ির গ্রামে। অন্যদিকে পৈতৃক ভূসম্পত্তি রক্ষার তাগিদে বেশ বছর কয়েক পর মায়ের সাথে ফের ফিরে আসতে হয় নদিয়ার দীগনগরে। আত্মীয়ও স্বজনদের কাছে তত দিনে প্রতারিত হয়ে তিলমাত্র সম্পত্তি বুকে নিয়ে প্রবল অস্তিত্ব সংকটে ভুগেছে বিধবা মা ও ছেলেতে। অবর্ণনীয় আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেই একটার পর একটা শক্ত বাধা পার হতে হয়েছে নির্ঝরকে। দুবেলা দুমুঠো নুন ভাতের সংস্থান যার কাছে প্রায় স্বপ্নাতীত, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিমোহিত অলীক স্বপ্ন দেখতে যেন তার বারণ ছিল।
নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে একটা ঢোক গিলে বলে
---" আমার হয়তো সে যোগ্যতা ছিল না ! নাঃ! এই বেশ ভালো আছি। এ আমার একান্তই ভালোলাগার বিষয়। জীবনটাও তো খুব জটিল একটা অংকের গোলক ধা ধা ! তাই না !!! সমাধান গুলো সব অদৃশ্য কোন গোপন ঘেরাটোপে বন্দি। জীবনের যোগ বিয়োগ গুন্ ভাগ আমরা করি ঠিকই কিন্তু ...কখনো মেলে ...কখনো মেলে না। "
---" আচ্ছা বাবা তা না হয় বুঝলাম কিন্তু ওদিকে তো প্রায় সব অনুষ্ঠান শেষ, তুমি এখানে একা একা বসে কি করছো সেটা বললে না তো ?"
---" না। বিশেষ কিছু না। এই এমনি। ..."
ডান হাত ভাঁজ করে মোহরের বুকের কাছে রাখা গীতবিতান দেখে নির্ঝরের মনে প্রশ্ন এলো
---" আচ্ছা ঐ রবীন্দ্র সংগীতটা কে গাইছিলো ? তুমি ?"
---" কেন বলো তো ?"
---" অসাধারণ !!! সুর ,তাল ,লয় আমি বুঝিনা বটে কিন্তু কী অসাধারণ ওই গায়কী , কী অসাধারই ওই অভিব্যাক্তি !"
একটু মুচকি হাসলো মোহর। উৎসব মঞ্চ থেকে পাওয়া রাংতা দিয়ে জড়ানো একটা হলুদ গোলাপ মোহরের দিকে এগিয়ে দিল নির্ঝর।
---" এটা আমার রিটার্ন গিফট। খানিক টা বন্ধুত্বের আবেদন ও রাখলাম ওর সাথে । "
একটা সম্মতি সূচক হাসিতে দিকবিদিক আলোড়িত করে মোহর এক ছুট্টে চলে গেল ,নির্ঝরের শান্ত ও নিস্তরঙ্গ হৃদমাঝারে হিল্লোল তুলে,ওকে একলা করে ! ও চলেযেতেই নির্ঝরের মনে হলো অপূর্ব এক গন্ধ ,ঠিক গন্ধ না বলে সুগন্ধই বলা ভালো। ঠিক যেন বর্ষায় ভেজা জুঁই ফুলের মাদকতাময় ঝিমধরা একটা সৌরভ যেন জড়িয়ে রেখেছে তাকে ! মেয়ে টি কে ? ও যেন বহু যুগের চেনা বহু জীবনের আপনার মনে হলো নির্ঝরের।
এর পর শুধুই ঘটনা। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত নিপাট আধুনিকা মেয়েটি জানি না কি দেখে মনে মনে একদিন ভালোবেসে ফেলেছিলো চূড়ান্ত অগোছালো ক্যাবলাকান্ত নির্ঝরকে। হয়তো একান্তে গ্রাম্য ওই সরলতার কাছে হার মানতে চেয়েছে বারবার। নির্ঝর প্রথমে বুঝেও সেভাবে গভীর করে নিতে চায়নি। যাদবপুরের অভিজাত সম্ভ্রান্ত ঘরের একমাত্র মেয়ে মোহর। পড়াশোনা ,উচ্চ শিক্ষা ,ডিগ্রি তার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ না হলেও নির্ঝরের জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল তার মায়ের মুখের হারিয়ে যাওয়া হাসি ফেরানো, বেদখল হয়ে যাওয়া ভাদ্রাসনের পনুরুদ্ধার। দাঁতে দাঁত চেপে অনেক অভাব অনটনের মধ্যেও নির্ঝরের উচ্চ শিক্ষার জন্য কোনো খামতির আঁচড় বুঝতে দেয়নি তার মা।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। ওঝা যেভাবে উদ্ধত বিষধর সাপের মাথায় শিকড় ছুঁইয়ে নিজের বশে আনে। ঠিক তেমনি নির্ঝর মোহরের নিঃস্পাপ প্রাণচাঞ্চলতার কাছে হার মেনে ভরা বর্ষার বাঁধ ভাঙা জলোচ্ছাস এর মতো নিজেকে একদিন ভাসিয়ে দিলো মোহরের প্রেম সুধারসের জোয়ারে।
মোহরের হাতে হাত রেখে নন্দন,ভিক্টরিয়া থেকে গড়ের মাঠে একান্ত নিভৃতে চলেছে নিরন্তর প্রেমালাপ। থেমেছে কথা। চোখে চোখ রেখে নির্বাক থেকে হৃদয়ের গভীরের উষ্ণতা মেপেছে অবুঝ দুটি মন।
সেদিন নির্ঝরের দেরি হচ্ছে দেখে মোহর সটান ওর মেসে গিয়ে হাজির। ঘরের ওর রুমমেট ছিল না তখন। নির্ঝরকে দেখে দুমদাম করে ঘরে ঢুকে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে একটু ঝাঁজালো গলায় ছুড়ে দিলো প্রশ্ন বাণ
---" আজকের দিনেও তুমি লেট নির্ঝর !!! তুমি কি ভুলে গেলে আজ আমার জন্মদিন ? "
মুখে একটু স্মিত হাসি হেসে নির্ঝর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ওকে । বাধা দিলো না মোহর , শুধু চুপ করে রইলো কিছুক্ষন ।
একবুক ভেজা জুঁই ফুলের গন্ধে যেন ভেসে গেল নির্ঝর।
সেদিন পুরো দিনটাতেই মোহরকে যেন খুব ম্রিয়মান লাগছিলো। নির্ঝরের মনে হলো কে যেন তার স্বভাবসিদ্ধ প্রাণচঞ্চলতা কে চুরি করেছে। গড়ের মাঠের এক কোনায় বসে নীল শাড়ির আঁচলের খুটটা বারবার সে আঙুলে প্যাচাচ্চিলো একটু অন্যমনস্ক ভাবে। মোহরের কাজলটানা দু চোখ দিয়ে যেন গলার কাছে পেঁচিয়ে ওঠা কষ্টটা বাস্প হয়ে বেরিয়ে আস্তে চাইছে বারে বারে। ভরা শ্রাবনের আঁধার করা অপরাহ্নে দিকবিদিক বিদ্যুৎ চক মকিয়ে বৃষ্টি নামে গাছের পাতায় ,দূরের ঘাসে দক্ষিণ দিগন্তের বলয়ে। নির্ঝর চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। টেনে তোলে মোহরকে। মুহূর্তেই ধেয়ে আশা বৃষ্টিতে একটা আমলকি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে দুজনে। মোহরের এলোচুল ,ওষ্ঠ ,চিবুক ,বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টির ধারা দু হাতে অঞ্জলি ভরে ধরতে দেখে মোহর বলে
---" কী পাগলামি করছো তুমি !!! "
---" এতে তোমার গায়ের গন্ধ আছে মোহর ! এ গন্ধ আমার সর্বাঙ্গে বিলিয়ে দিচ্ছি দেখোনা কেমন করে। যেন গভীর ঘুমের অবচেতনেও আমি বুঝতে পারি তুমি আমার সঙ্গে আছো। "
দুই চোখের বোবা কান্নার জলে কাজল ধুয়ে যায় মোহরের।
---" পাগল একটা ! "
---" একি মোহর তুমি কাঁদছো !!! "
---" ধরো যদি আমি হারিয়ে যাই তোমার কাছ থেকে কোনোদিন ? "
বড়ো পাথরের নিচ থেকে বেড়ে ওঠা কচি গুল্ম লতার মত ক্রমেই পরিণত হয়ে উঠছিলো ওদের অকৃত্তিম ভালোবাসার রূপকথার আখ্যান। কিন্তু যেন কার কুনেত্রপাতে দিগ্বিদিক এক বিরহের অস্তরাগ ছড়িয়ে শ্রাবনের ভরা বারিধারার মধ্যে ভিজতে ভিজতে ক্রমে ধরে আসা গলায় মোহর নির্ঝরের দিকে সাশ্রু নয়নে তাকিয়ে বললো
---" আজ এই ক্ষনে পারবে আমাকে তোমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে ? বলো পারবে ? "
মোহরের এ হেন প্রলাপ বাক্যালাপে আকাশ থেকে পড়লো নির্ঝর। কথার খেই হারিয়ে ফেলে একটু আশ্চর্য হয়ে বললো
---" কী বলছো তুমি ? পাগল হলে নাকি ?"
--- " হ্যা ঠিক ই বলছি। তুমি কষ্ট পাবে তাই বলি নি। বাবা, আমার বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছে আমাকে না জানিয়ে। বাবার কথার অবাধ্য হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই নির্ঝর কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে এ জীবন মেনে নিতে পারবো না। তাই আজ এই মুহূর্তেই আমাদের কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করা ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই নির্ঝর….বলো তুমি রাজি ? "
নির্ঝরের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। অসাড় হয়ে গেল গোটা শরীর। বুকের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো বিসমিল্লার সুকরুণ বিষন্নতার সুর। প্রিয়া হারানোর যন্ত্রনায় কেমন অস্থির আর নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হলো ওর। শুরু হলো হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।
---" কিন্তু আমি তোমাকে রাখবো কোথায় ? খাওয়াবো ই বা কী ? নিজেরই তো চলে না ঠিক মতো !!! "
পাথরের মতো শক্ত হয়ে থাকে নির্ঝর। বুকের ভিতর থেকে চাপা একটা যন্ত্রনা ফেটে বেরিয়ে আস্তে চাইছে বাইরে।
---" ও ও ও .. বুঝেছি ! পারবেনা ! তুমি পারবে না !!! আজ জন্মদিনের সেরা উপহারটা পেয়ে গেলাম তোমার কাছ থেকে। ভালো থেকো তুমি। "
বিদ্যুৎ বেগে দৌড়ে গিয়ে একটা বাসের ভিতরে ঢুকে গেল মোহর। পিছনে একটি বার ও না তাকিয়ে। প্রবল বৃষ্টিতে চোখ মুছতে মুছতে নির্ঝর পাগলের মতো বাসের পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে হতোদ্যম হয়ে জল জমা রাস্তার ঠিক মাঝখানে দুহাটু মুড়ে দুই হাতের উপর ভর দিয়ে কান্না ভেজা মুখটা লুকাতে চেষ্টা করলো।
একটা দুটো করে ঝরে পড়া পাতার মতোই মাঝে কেটে গেল বেশ কয়েকটা মাস। এর মধ্যে ইউনিভার্সিটিতে আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেমোহর। নির্ঝর ও নিজেকে উদভ্রান্তের মতো গুটি রেখেছে অন্যদের থেকে অজানা অচেনা এক বৃত্তে। বাতাসে বসন্তের গন্ধ। নির্ঝরের কাছে খবর গেল মোহর ডেকেছে ওকে।
বসন্তের ঝিম ধরা অপরাহ্নে দিগন্ত রাঙানো লাল পলাশের হিল্লোলে দিগ্বিদিকে যেন বাঁধন হারা যৌবনের ঢেউ উঠেছে।
ইউনিভার্সিটির সেই বকুল গাছের চাতালে সবুজ ছাতা মাথায় আগুন রাঙা লাল জামদানি শাড়িতে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা মোহরকে দূর থেকে যেন ঝরা পলাশের মতো ই লাগছিলো। নির্ঝর এগিয়ে গিয়ে বসল অল্প দূরত্বে। কাছে গিয়ে জানালো সেকথাটা। চৈতি হওয়ায় কপালে উড়ছে অবাধ্য এলোচুল। মুখে স্মিত হাসি। মিষ্টি সে হাসি তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করায় বুকের বাঁ ধারটায়।
হাতটি বাড়িয়ে দিলো। কার্ড, ওর বিয়ের। সোনালী জরির কাজ করা তাতে। সাথে কিছু চকলেট,আরো কত কি।
আগামী বৈশাখে ওর বিয়ে। নির্ঝর হাসলো মৃদু। হাতটি বাড়িয়ে নিল ওটা ।
মোহর তাকিয়ে রইলো নির্ঝরের চোখে ,কী খোঁজে ? বিষাদের পোড়া গন্ধ ? নাকি অনুনয় ? না শুধুই প্রতি হিংসা পরায়ণ একরাশ বিষাক্ত ঘৃণা?
খানিকটা গা ঘেঁষে সরে এসে ঠোঁট এগিয়ে দিলো নিঃশ্বাসের দূরত্বে।
---" বসন্তের ঝরা পলাশের রং ছুঁতে ইচ্ছে করে না ? এই শেষ সুযোগ !.!.! "
উঠে পড়ল নির্ঝর। যেন বসে আছে এখানে সুদীর্ঘ অনন্ত সময় ধরে।
মোহর হাত দিয়ে ইশারায় থামালো একটা রিক্সাকে। উঠে বসলো ও। পা-দানিতে আটকে যাওয়া শাড়ির পাড় তুলে দিল নির্ঝর সযত্নে।
হৃদয়ের রক্তক্ষরণ খানিক শান্ত হতেই , ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এলো চোখের উপরের মোটা কাঁচের চশমাটা ।
অতি মন্থর গতিতে চলা ট্রেনের মধ্যে হঠাৎ পকেট থেকে ফোনটা বেজে উঠতেই সম্বিৎ ফিরলো নির্ঝরের। ফোনটা ধরতে ইচ্ছা করলো না , একটানা বেজে কেটে গেল ওটা। সেই কত্তো দিন পর আবার দেখা হলো মোহরের সাথে। নির্ঝর এগিয়ে গিয়ে কি কথা বলবে ? কিন্তু কিবলবে সেটা ভেবে পেলো না।
নাঃ ! মোহরের প্রতি কোনো অভিমান বা অভিযোগ আজ আর নেই। একমুখী এই যাত্রা পথ নির্ঝরের হঠাৎ যেন গন্তব্যহীন মনে হল। আজ সে সুপ্রতিষ্ঠিত। নামকরা এক কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার। সুখ , সমৃদ্ধি আর ঐশ্বর্য আজ তার পকেটস্থ। এক মাত্র মোহর ছাড়া। যে একদিন তার ছেতলা পরা ডোবার মতো নিস্তরঙ্গ হৃদয়ে নতুন করে ঢেউয়ের আন্দোলন তুলে বাঁচতে শিখিয়েছিলো , সে আজ অন্য কারোর। কিন্তু একমাত্র নির্ঝরই ভালোবাসতে পারেনি অন্য কাও কে। ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলবার জিনিস নয় ! বেশ তো ছিল সে এতদিন সব ভুলে এন্ডলেস মেকি ব্যাস্ততার অছিলায় ! আজ আবার সেই হারিয়ে যাওয়া অতীতের মুখ মুখি হতেই চারি দিকটা এরকম করে এত ফাঁকা লাগেনি আর কখনো। বুকের মধ্যে এত হাহাকার ও জমেনি কোনো দিন ও।
উঠে পড়লো মোহর ওর সঙ্গীর হাত ধরে, নির্ঝরের চোখের থেকে চোখ সরিয়ে। সামনেই একটা স্টেশন আসতে নেমে গেলো ওরা। রয়ে গেল একা নির্ঝর গন্তব্যহীন অনন্ত যাত্রার পথে।
বিসর্জনের পর ফাঁকা মণ্ডপে তিরতির করে জ্বলা একলা প্রদীপ দেখলেই বুকের ভিতরটা যেমন মুচড়ে ওঠে। একরাশ বিষণ্ণতা যেন নেমে আসে হেমন্তের বিষাদময় মৃত জ্যোৎস্নার মতো। মোহরের ফাঁকা রেখে যাওয়া সিট টার দিকে তাকিয়ে কী জানি কখন মনের অজান্তেই চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে নির্ঝরের। ট্রেনের ফাঁকা হয়ে যাওয়া কামরার ওই সর্বগ্রাসী শূন্যতার মাঝে ভেজা জুঁই এর মাদকতা মেশানো সেইইই গন্ধটা যেন আরো একবার ঝিম ধরিয়া দিলো নির্ঝর কে। এই এত বছর পর মোহর কী গভীর করে বুকের মধ্যে রয়ে গেছে নির্ঝরের , সে আরো একবার বুঝতে পারলো নতুন করে।
------------
তরুণ প্রামানিক
৯৩৩২৮৮১৮৫৫