" আকাশভরা সূর্য- তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ।। "
ক্যালেন্ডারের শেষ পাতাটাও ছেঁড়া হয়ে গেল আজ। দেওয়াল আলো করে আগামীতে ঝুলবে আর একটা নতুন। একটার পর একটা পাতা আসবে আর জাহির করবে তার অস্তিত্ব। সেই পাতাগুলো কেমন হবে, আমাদের আশা, আকাংখ্যা কতটা পূর্ণ করবে, বিগত পাতাগুলোর তৈরি করে দেওয়া আমাদের জীবনের ক্ষতে কতটা মলম লাগাবে সেই নিয়ে থাকে আমাদের উন্মুখতা।
বিশ্বকবির এই পংক্তিগুলি দিয়েই শুরু হোক আমাদের এই বর্ষ-বরণ। গ্রহতারা ভরা প্রকৃতির মধ্যে নিজের অস্তিত্বের চমৎকারিত্বে মুগ্ধ কবি। আর অবশ্যই আমরাও। কারণ কবির গুণ, কবির প্রতিভা, কবির বিচক্ষণতাই –এক কথায় বলতে গেলে কবির কলমই আমাদের প্রতিনিধি।
ভারি চমৎকার তাঁর নাম। যিনি তমসাময় রজনী অতিক্রম করে দিনের প্রথম আলো দেখান সেই সূর্যের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর নাম। দিনের প্রথমে যেমন তাঁর উদয় তেমনি বছরের প্রথমেই তাঁর জন্ম। এক দুরন্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রতিভার মতই ক্ষমতা ছিল মানসচক্ষের। সমগ্র সমাজ-জীবন ছিল তাঁর তালুর মধ্যে। তালুর মধ্যে থাকা সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাঁর হৃদয়ের মধ্যে থাকা মানবিকতার রসসিক্ত কলম সারাজীবন ধরে লিখেছে শুধু জীবনের কথা।
আমরা মানুষ। আমরা তো জীবনের কথাই বলব। আমরা বলব দিনের কথা। যতক্ষণ আকাশে সূর্যের অবস্থিতি ততক্ষণই আমাদের মনে আশার আলোর ঝলকানি। সেইজন্যে মানুষ দিনের বেলাতেই পরিশ্রম করে বা করতে পারে সবচেয়ে বেশী। কারণ আলোই হল শক্তির প্রধান উৎস। আর সূর্যই হল আলোর প্রধান উৎস। সায়াহ্ন হল পরিশ্রান্ত মানুষের বিশ্রামের কাল। কারণ সমস্ত শক্তির উৎস সূর্য তখন ঢলে পড়েছে আকাশে। চলে গেছে দিক চক্রবালের আড়ালে।
আলো হল সুনিশ্চিতির আশ্বাস তেমন অন্ধকার হল অনিশ্চিতির একটা আভাষ। বিপদের ধারণা পেলে মানুষ তার সঙ্গে লড়তে পারে। কিন্তু ধারণাহীন বিপদ মানুষের মনে আশংকা উৎপাদন করে। অন্ধকারে কি কেউ ছাদ থেকে লাফ দিতে পারে? অথবা কোনও উঁচু স্থান থেকে? কারণ অন্ধকারে সে আন্দাজ করতে অক্ষম কত উঁচু থেকে সে লাফ দিতে যাচ্ছে। তার শরীরে প্রতিক্রিয়াজনিত আঘাত কত হতে পারে সেটাও থাকে তার ধারণার বাইরে। আঘাত থেকে আত্মরক্ষার কোনও মানসিক প্রস্তুতিও তাই সে গড়ে তুলতে পারে না।
মানুষ জলকে ভয় করে ঠিক সেই কারণে। জলের গভীরে তার কোনও ধারণা থাকে না সে কোনও থই পাবে কিনা। জলের গভীরতা আর বিশালতা দুটোই তার কাছে আতঙ্কের। এমন কি কোনও সাঁতারুর কাছেও।
অন্ধকার মানুষের মনে সৃষ্টি করে একটা অজানা আতঙ্ক। তাই ভূত-প্রেত-দত্যি-দানোর গল্পের বিস্তার রাতের অন্ধকারে। অন্ধকার নিজেই মানুষের মনে অনেকটা শক্তি কেড়ে নেয়। নরম মাটিতে যেমন গাছ পোঁতা সহজ তেমনি দুর্বল মনে কুসংস্কারের বীজ পুঁতে দেওয়াও সহজ। মানুষকে ভয় দেখিয়ে নানা কুপ্রথায় বশ করিয়ে অন্য কিছু মানুষের পদানত করে রাখার কাজটা সহজ হয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত মানুষকে এই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করা সহজ হলেও শিক্ষিত মানুষ কুসংস্কার অস্ত্রে ঘায়েল হয়েছে এই ঘটনাও খুব একটা বিরল নয়। আসল হল মনের দুর্বলতা। দুর্বল মানুষ বিবেচনা হারায়। হারায় সমস্ত বোধবুদ্ধি। ঠিক যেমন করে ডুবন্ত মানুষ সামান্য খড়কুটোকে অবলম্বন করতে চায় সে সক্ষম কি সক্ষম নয় তা বিবেচনা না করেই। কারণ সে তখন দিশাহারা মৃত্যুভয়ে কাতর।
কুসংস্কারাচ্ছন্নতা মানুষের একটা দুর্বলতা। কিংবা বলা যেতে পারে দুর্বল মানুষের ধর্ম। কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষ সব হারিয়ে পথে বসে। আর লাভবান হয় কুসংস্কার ব্যবসায়ীরা। লাভের গুড়ে নতুন নতুন কুসংস্কারের আমদানি করে সমাজের মনকে দুর্বল করে দিতেই থাকে।
সমাজকে উন্নত করতে গেলে শিক্ষা আর সুশিক্ষার প্রয়োজন সবার আগে। কারণ শিক্ষা যুক্তি আর বিবেচনা বোধকে বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়। মানুষ নিজে যখন নিজের ভাল বুঝতে পারে সে তখন অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে না। বেশীর ভাগ কুসংস্কারের পেছনেই থাকে দুর্বল যুক্তি। যারা কুসংস্কারের প্রতিষ্ঠাতা তারা নিজেরাও খুব যে একটা শিক্ষিত হয় তা নয়। তাই নিজেদের কুকাজের পেছনে তারা যে যুক্তির জাল বোনে তা খুবই পচা সুতো দিয়ে তৈরি। শিক্ষিত আর যুক্তিবাদীরা তাদের সুযুক্তির তীরে সেই জাল ছিন্নভিন্ন করতে পারে। সেইজন্যে কুসংস্কারের বীজ পোঁতা হয় দরিদ্র আর অশিক্ষিতদের মনে। যারা না পারে যুক্তির জাল বুনতে না পারে এর প্রতিরোধ করতে। দারিদ্র তাদের মাথা নোয়াতে বাধ্য করে এই কুসংস্কারের পায়ের নীচে।
আজকের এই নববর্ষের প্রাক্কালে উঠবে নতুন এক সূর্য। নতুন এক আশার আলো নিয়ে। তার কাছে আমাদের নিরন্তর শুধু প্রার্থনা, হে নতুন সূর্য, তুমি আলো দাও। শিক্ষার আলো, জ্ঞানের আলো, যুক্তিবাদের আলো যা দিয়ে আমরা লড়াই করতে পারি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কারণ আলোই হল অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়ার প্রধান অস্ত্র।
কিন্তু শুধু কুসংস্কার দূরীকরণেই আবদ্ধ থাকলে চলবে না। কুসংস্কারকে জানতে হবে, চিনতে হবে আর বুঝতে হবে। তবেযে কোনও সংস্কারের গায়ে কুসংস্কারের লেবেল লাগিয়ে দেওয়াও কিন্তু একটা অপরাধ। জাতপাতের বিভিন্নতা নিয়ে মানুষকে হেয় করাও এক ধরণের কুসংস্কার। বড়ু চন্ডীদাসের সুন্দর কথাটা মনে এলঃ "সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।"
ওই দেখছি পূর্ব আকাশ লালে লাল। উঠতে চলেছে নতুন সূর্য। নতুন বছরের প্রথম সূর্য। সূর্য তো রোজ সকালেই ওঠে তবে আজকের সঙ্গে অন্যদিনের পার্থক্য কোথায়? কারণ আজকের সূর্যের মধ্যে মিশে রয়েছে একটা প্রার্থনা। সমস্ত অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বোধবুদ্ধির অভাব, সামাজিক অসাম্য আর বৈষম্য, অবিবেচনা, হৃদয়হীনতা, ধর্ম আর জাতিভেদ—মানুষের মন থেকে এই কালিমা মুছে দেওয়ার মত উজ্জ্বল আলো দেওয়ার প্রার্থনা। দেখা যাক নতুন বছর কতটা পূর্ণ করতে পারে আমাদের সেই আশা।
|