পালাবদলের ক্ষণে
রাস্তার ঢাল গড়িয়ে ছোট্ট গাড়িটা যখন বিশাল সবুজ মাঠটায় নামলো তখন বিকেল শেষ হয়ে সন্ধে নামছে।মাঠের একদম এককোণায় ছোট্ট স্কুলবাড়ি।চারিদিকে ঘন সবুজ চা বাগান যেন অন্ধকারকে আরো আষ্ঠেপৃষ্ঠে জাপটিয়ে ধরে কাছে আনতে চাইছে।স্কুলঘরের কাছাকাছি একটা তাঁবু,গাড়ি থেকে নামতে নামতে খেয়াল করলাম।ডিসিআরসি থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল যে ফোর্স আগেই চলে গেছে।এটা যে বারের ভোটের কথা বলছি সেবারেই বর্তমান শাসকদলের ক্ষমতায় আগমন।গোটা রাজ্যেই মনে হয় সেবার ভোট হয়েছিল কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে।প্রাক্তন শাসক দলের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে বিরক্ত জনগণ,ঘটে গেছে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের মতো মারাত্মক ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলি,তাই হাওয়া অনেকটাই বইছে অন্যপালে।আবার শাসকদলও যে ছেড়ে কথা বলবে না তা বলাই বাহুল্য।
গাড়ি থেকে নিজে নেমেছি,পোলিংপার্টি-জিনিসপত্র সব ধীরে ধীরে নামছে।তখনই-স্যার!চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি পুরোদস্তুর সামরিক পোশাকে,কাঁধে অত্যাধুনিক রাইফেল,পেছনে আরো দুজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে,এক পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক আমায় স্যালুট করছেন।এই খোলা মাঠে এরকম আলো বুজে সন্ধ্যেতে যে এই ধরণের আপ্যায়ণের মুখে পড়তে হবে তা ভাবতেও পারিনি।তার আগে বেশীরভাগ ভোটই করেছি রাজ্য পুলিশ দিয়ে।আর আরো আগে কিছু কিশোর বয়সী ছেলেকে দিত সাথে,হাতে একটা লাঠি আর একটা পুলিশের পরিচয়পত্র দিয়ে,যারা গন্ডগোল শুরু হলে বাঁচানো বা সাহায্য করা তো দূরের কথা,নিজেরাই সবার আগে পালাতো।যাইহোক আমি তখন সম্পূর্ণ বাকরহিত।সম্বিত ফিরলো যখন তিনি দুবার বললেন-আপকা আইকার্ড।একই সাথে নিজেরটা বাড়িয়ে ধরে আমার সামনে।তারটা দেখার আমার তখন ক্ষমতা নেই।কোনক্রমে নিজেরটা দেখালাম।ভালোমতো দেখলেন।তারপর যা বললেন শুনে বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল।হিন্দিতে বললেন-আপকো তো পাতাহি হোগা কি ইয়ে হাই সেনসিটিভ এরিয়া হ্যায়(যদিও আমি বা আমরা এমন কিছু জানতামই না),কোই ফিকর নেহি,হাম সিআরপি পুরা ইন্ডিয়া মে ভোট করাতে হ্যায়।আমার তখন হাঁটু কাঁপছে।সেটা দেখেই কিনা জানিনা,উনি বললেন-তিনদিন পহেলে হাম ইধার আয়ে,বহুত সারে আর্মস সিজ কিয়ে হামলোগ।ইসকি বাদ ভি কাল কোই প্রবলেম আ যায়ে,তো আপ এক অর্ডার দিজিয়ে,ইয়ে পুরা গাঁও জ্বালাকে তাবাহ করনে মে হামকো পাঁচ মিনিট ভি নেহি লাগেগা।আমি তখন কি বলবো কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।এতো যুদ্ধ পরিস্থিতি।এরপর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল তাদের মজুত অস্ত্রশস্ত্র দেখাতে।দেখে চোখ কপালে উঠে যাবার যোগাড় আমাদের সকলেরই।সিনেমা ,টিভিতে যা যা দেখি তার প্রায় সমস্তটাই দেখলাম,প্রথম,জীবনে,ভোট করতে গিয়ে।রাতেই ফায়ারিং অর্ডারে সই করে দিতে হল।
প্রাথমিক ঝটকা কেটে যাবার পর ফ্রেশ হয়ে যখন কাজ করতে বসলাম স্কুল ঘরের দুই দরজায় দুই প্রহরী অতন্দ্র দন্ডায়মান থাকলেন।আমরা যখন রাতের খাবার খেলাম,উনারা পাহারায় থাকলেন।অনেক রাতে কাজ শেষ করে যখন ঘর থেকে বের হলাম দেখলাম একজন বারান্দায় জাগ্রত পাহারায়।বাইরে আসতে স্যার বলে উঠে দাড়ালেন।ছাপোষা মাস্টারমশাইয়ের জীবনে এ এক অন্য ভালোলাগা।গোটা রাতভর ওয়াকিটকিতে বার্তা আদানপ্রদান হতে লাগলো।সকাল হতেই শুরু হল আসল খেলা।ভোরে উঠেই দেখলাম বালির বস্তা একের পর এক দিয়ে গোতা স্কুল চত্বরকে যেন সামরিক বাঙ্কারের রূপ দেওয়া হয়েছে।পোলিং এজেন্টরা অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েই বুথের ভেতর ঢুকতে পারলেন।সারাদিন কারুর কোন ট্যাঁ ফো শোনা গেলো না।শুধু একটাই কথা তাদের-এপিক লেকে লাইন মে খাড়ে হো যাও।চা বাগানের সমস্ত শ্রমিক ভয়ে জড়োসড়ো।সেই যে কেউ দাঁড়িয়ে বা বসে লাইন দিচ্ছে,কোন সাড়াশব্দ নেই তারপর থেকে।কোথায় তাদের সেই হাসি ঠাট্টা আড্ডা মস্করা।চারিদিকে যেন নিয়মের বেড়াজাল জাঁকিয়ে বসেছে।কোন ভোটদাতা সামান্য টলমল করলেই তার কপালে জুটছে অর্ধচন্দ্র।এক বাবা তার অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন বলে ভোটটা তাড়াতাড়ি দিতে চেয়ে আমাকে অনুরোধ করতে আসতে চেয়েছিলেন,তাকে এমন শাসানি দেওয়া হল যে তিনি বাধ্য হয়ে ভোট গ্রহণ এলাকাই ত্যাগ করলেন।খারাপ লাগলো,কিন্তু কিছু করারও নেই।যাই হোক,সময় গড়াতে গড়াতে একসময় ভোট শেষ হল।তারপর এক থেকে দু ঘন্টার কাজ বাকি।কিন্তু এবারে আর বাহিনী থাকতে নারাজ।উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা বলে নাকি তখনই সেই স্থান ত্যাগ করতে হবে।তাদেরকে অনেক অনুরোধ করে এক ঘন্টার সময় চেয়ে নিয়ে কাজে বসলাম।এবারে কমপক্ষে আট থেকে দশজন বারান্দায় পাহারায়।কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠলাম।।রাস্তায় মুষলধারায় বৃষ্টি নামলো।ডিসিআরসি-র কাছে পৌঁছে অবধারিত জ্যাম।আমাদেরকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিলেন উনারা।ভোটের মেশিন নিয়ে নিলেন নিজেদের হেফাজতে।কাগজপত্র জমা দেবার পর যখন নিজের কাগজে রিলিজ লিখিয়ে উনাদের কাগজে রিলিজ লিখলাম আর উনারাও হাসিমুখে করমর্দন করে বিদায় নিলেন, মনে হল যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরলাম।
যোগাযোগ-9475893433/7908288548