আমার প্রথম নির্বাচনী অভিজ্ঞতা
আমি তখন কাজের সূত্রে ময়মনসিংহ ছেড়ে সিলেটের মৌলভী বাজারে। মোলভীবাজারকে চায়ের রাজধাণী বলা হয়। বাংলাদেশের সবচে বেশি চা বাগান রয়ছে মৌলভীবাজারে। এছাড়াও মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, মাধবকুন্ডু ইকো পার্ক, হাকালুকি হাওর, বাইক্কাবিল, লাউয়াছড়া ইকোপার্ক ও বিভিন্ন নৃতাত্বিক গোষ্টির বৈচিত্রময় জীবন যাপনের মৌলভীবাজার অনন্য। সেবার সংসদ নির্বাচনের জন্য আমি প্রথমবার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমার শহরের কর্মস্থল থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় আমার দায়িত্ব পড়েছিল। ভয় পেয়ে গেলাম। প্রথমবার নির্বাচনী দায়িত্ব। কিছুই চিনি না। তার উপর পরিচিত কেউ নেই। মৌলভীবাজার-সিলেট অঞ্চল বাংলাদেশে হিন্দু অধ্যুষিত। আমার পরিচিতদের মধ্যে খোজ নিলাম। কেউ কোন হেল্প করতে পারে কি না। সবাই অপারগতা প্রকাশ করলে আমি আরো হতাশ হয়ে পড়লাম। শেষে পুলক পাল নামে আমাদের ব্যাংকের একজন গ্রাহক ব্যাপারটা জানতে পেরে আমাকে ফোন দিয়ে বলল,
-"ভাই টেনশন করবেন না, আমার পরিচিত অনেকেই আছে ওখানে। একটা ব্যবস্থা করতে পারব আশা করি।" পুলক পাল আমাদের সমবয়সী। আমার সাথে ভালো সর্ম্পক। প্রতিদিনই ব্যাংকে আসে। এলাকার বড় ব্যবসায়ী। আমি ভরসা পেলাম।পুলকদা আমাকে বলল,
-"নির্বাচনের দিন যেহেতু গাড়ি চলবে না আপনি আজ বিকেলে চলে যাবেন।আমি একটা অটো রিকশা বলে রেখেছি।"
আমি বললাম, "আজ গেলে থাকব কোথায়?"
-" আমি একজন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে বলে রেখেছি। তার বাড়িতেই থাকবেন।"
কি আর করা, সন্ধায় ব্যাকগ্যাক নিয়ে পুলকদার ঠিক করা অটোতে আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা হলাম। দুর্গম পাহাড়ী ভাঙ্গা রাস্তা আর ঘন জঙ্গল আমাকে আরো ভয় পাইয়ে দিল। সন্ধা আটটার দিকে আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় পৌছালাম। নির্দিষ্ট ষ্টেশনে নামতেই ষাটোর্ধ বয়স্ক এক ব্যাক্তি আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। দেখে মনে হলো ভদ্রলোক হিন্দু। আমি একটু মনোঃক্ষুন্ন হলাম। মুসলমান হয়ে হিন্দু বাড়ীতে থাকতে হবে? আমার অনেক হিন্দু বন্ধু আছে। ক্লাসমেট, সহকর্মী। তাদেও সাথে উঠাবসা, রেষ্টুরেন্টে খাওয়া ধাওয়া হয় বটে কিন্তু কারো বাড়িতে থাকা হয় নি। কেমন অচ্ছুত অচ্ছুত লাগছিল। কিন্তু এখন কিছই করার নেই। আমি অসহায়। বৃদ্ধ ভদ্রলোক মনে হয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন,
-"স্যার মনে হয় একটু সংকোচ বোধ করছেন?"
আমি বিব্রত হলাম। বললাম,
-"না, না, তেমটা নয়।"
ভদ্রলোকের বাড়ী কাছেই। পৌছে আমার অবাক হওয়ার পালা। বাড়ী তো নয় রাজপ্রসাদ। তিন তলা বিশাল বাগান বাড়ি। আমাকে দু'তলায় গেষ্টরুমে নিয়ে গেলেন। সুন্দর গোছানো গেষ্টরুম। হিন্দুয়ানার কোন ছাপ নেই। আমি আশ্বস্ত হলাম। ভদ্রলোক প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এলাকার চেয়ারম্যান। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে জনপ্রিয়। ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলেন। আমি ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসতেই দেখি আমার জন্য বিশাল নাস্তার আয়োজন।আমার অবাক হওয়া আরো বাকি। নাস্তা খেয়ে বিশ্রাম নেবার পর ভদ্রলোক আমার জন্য একটা জায়নামাজ নিয়ে এসে বললেন,
-"যদি নামাজ পড়েন দিয়ে গেলাম।"
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-"আপনি তো হিন্দু আপনার বাড়িতে জায়নামাজ কেন?"
তিনি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,
-"দেখুন আমি মানুষকে কখনো হিন্দু বা মুসলিম এভাবে দেখি না। আমার কাছে মানুষ শুধুই মানুষ।"
এবার আমি বুঝতে পারলাম কেন এই প্রবীন লোকটি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এখানকার জনপ্রতিনিধি!
-----ঃ-----
আনোয়ার হোসেন
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।