বাঙালির ভোট-সিন্ড্রোম
--------------------------------
দিন শেষে অফিস-ক্লান্ত মধ্য চল্লিশের বাবা, বাস ট্রেনের ধকল সামলে সবে ঘরে ফিরেছেন।ক্লাস থ্রির ছেলে কাছে এসে বলল, বাবা আমরা কি টিএমসি না বিজেপি ? প্রশ্ন শুনে বাবা পড়লেন আকাশ থেকে । মা ছেলেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলেন পড়ার ঘরে, বকাবকি করলেন না-বোঝা বিষয়ে কথা বলার জন্য । বাবা থ হয়ে বসে থাকলেন সোফায় । পরে স্ত্রীর কাছে শুনে বুঝতে পারলেন, ওটা আসলে পুল-কারের ড্রাইভার-আঙ্কেল ছেলের কাছে জানতে চেয়েছিল।
ধরুন ভদ্রলোকের নাম রতনবাবু , তো তিনি ব্যস্ত অফিস আওয়ারে সম পর্যায়ের কোলিগদের কাছে ইতিমধ্যে বেশ কয়েক বার শুনেছেন, 'গ্রাম থেকে তো আসেন, তা ওদিকের ভাব ক্যামন এবার ? ক'টা পাবে ভাবছেন ?' নিরীহ নিপাট লোকটা মৃদু হেসে, না জানা ,না বোঝার ভানে পেরিয়ে যেতে চান উৎসাহী চোখ গুলোর প্রত্যাশা ।
দু'একদিন বাদে বাদেই অফিস ফেরতা পথে স্টেশনের কাছের মুদির দোকানে যেতেই হয় । ঘর সংসারের এটা ওটা নেবার ফাঁকে দোকান মালিক সামান্য অভিব্যক্তির শৈল্পিক কারুভঙ্গি করে বলেই ফেলে, ' কী দাদা শহরের ভাব কেমন ?' সঙ্গে সঙ্গে অবাক হয়ে রতন যদি জানতে চান , ' কীসের ভাব বলুন তো, ঠিক বুঝতে পারলাম না ?' ঠিক তক্ষুনি হে হে করে একটা বিরক্তিকর হাসি হেসে দোকানদারের বক্তব্য, ' আরে দাদা বলছি, ইলেকশনের ভাব কী বুঝছেন ?' উত্তরে রতনবাবু রীতিমতো অবাক, ভাবতে থাকেন পুরো সমাজটাই কি এই মুহূর্তে ভোটের আবহে ডুবে !
আকাশে ঘন মেঘ করেছে, কালবৈশাখী আছড়ে পড়বে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে, ব্যস্ত রাস্তার চৌমাথায় মানুষ জন গাড়ি ঘোড়ার প্রায় দৌড় চলছে । প্রত্যেকেরই লক্ষ্য কত দ্রুত ঘরের দিকে দৌড়তে পারে, অথচ এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্যতার মুহূর্তেও দিব্যি তারস্বরে মাইক বাজিয়ে আর মাইক্রোফোন হাঁকিয়ে চলছে ভোট প্রচারের পথসভা । পথচারী ঠিকমতো শুনতেই পারছে না পথ চলতি গাড়ির হর্ণ । ওষুধের দোকানদার প্যারাসিটামল দিতে প্যারালাইসিসের ওষুধ এক পাতা ধরিয়ে দিচ্ছে ।
সন্ধ্যা হতে না হতে গ্রাম মফস্বল আধা-শহরের পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে তাস-খেলা বন্ধ, কেউ সরকার পক্ষ কেউ বিরোধী, তর্ক আর তর্ক । পুরুষরা ঘরে ফিরে আগে যারা পান বিড়ি খেতে খেতে টিভির সিরিয়াল দেখে দেখে সংসারী কাহিনীর টান টান উত্তেজনায় সস্ত্রীক চোখা ডায়লগে মজে যেত----হঠাৎই তারা সব কেমন যেন কড়া রাজনৈতিক । খবর চ্যানেল ফুরসত দিচ্ছে না সিরিয়ালের সিরিয়াস ব্যাপারে । পরিবারের মহিলাদের টিভির অধিকার রীতিমতো খর্ব ! ' দাঁড়াও, দেখি আজকের মিটিংয়ে দিদি কী কী বললেন ! ' অথবা 'না, এখন রিমোট দেবো না, দেখি মোদীর সভায় লোক হয়েছে ক্যামন ?'
এতো গেল গৃহযুদ্ধ, কিন্তু বৃহত্তর সমাজে ? ভূসিমালের কারবারি এক বন্ধু সেদিন দুঃখ করে বলল, ' মাল সাপ্লাই দিয়ে খুব ফ্যাসাদে পড়েছি ভাই !' বললাম কেন কী এমন হলো ? উত্তরে বন্ধু বলল, 'পেমেন্ট আনতে গেলেই মহাজন বলছে , ইলেকশনের বাজার দাদা পরে আসুন ।' অর্থাত্ ইলেকশন না গেলে বন্ধুটি প্রাপ্য টাকা পাবে না। তো এমন উদাহরণ আরও আছে; কারও ব্যাঙ্ক-লোন হবে, ম্যানেজার বলছেন--- ইলেকশনের পর, কারও ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন--- তাও ইলেকশনের পর । এমনকি পাত্র-পাত্রী দেখাশোনা শেষ, পাকা কথা পোক্ত হয়ে গেছে, তবু শুভস্য শীঘ্রম হচ্ছে না --- ইলেকশন মিটে যাবার পর চার হাত এক করা হবে।
বিয়ে না হয় বিলম্বে হলো, কিন্তু প্রেম ? শোনা গেল অধিকাংশ পার্কে নব নব যুগলের বৈকালিক-বিহার নাকি সম্প্রতি একেবারে তলানিতে । কারন আন্দাজ করতে জানা গেল, ' আরে দাদা এখন ইলেকশনের সময় তো তাই। ' একইভাবে পাওনাদারের মুখোমুখি হলে দেনাদার চাওয়ার আগেই বলে দিচ্ছে---- ইলেকশনের পরে। ঘরের বৌ শাড়ি গয়না ডিমান্ড করলেই স্বামী বাবাজি তর্জনী উঁচিয়ে বলে দিচ্ছে---- ইলেকশনটা যাক। দোকান বাজারে ঘুরে দেখুন, দোকানিরা বলছে একদম বিক্রি নেই । যদি প্রশ্ন করেন কেন ? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাবেন, আগে তো ইলেকশন দাদা, কেনাকাটা তো তারপর ।
বিদেশ থেকে ছেলে-বৌমা এপ্রিলে ফেরার কথা ছিলো, কিন্তু বৃদ্ধা মাকে ছেলে ফোন করে জানালো, এখন নয়--- দেশে ফিরবো ইলেকশন কেটে গেলে । এমন লেটেস্ট গল্পও শোনা গেল, কোন সার্জিক্যাল ডাক্তার নাকি এক পেশেন্টকে বলেছেন---- আপনার গলব্লাডার অপারেশন করে দেবো, তবে ইলেকশনের পরে । তাহলেই বলুন 'ইলেকশন' কী অগস্ত্য ! যার সুতীব্র টানে অর্থ বানিজ্য জীবন দৈনন্দিন কেবল চোঁ চোঁ গিলে ফেলছে !
তবু, হ্যাঁ তবুও একটা ব্যাপার কিন্তু এই বিরাট গিলে ফেলা থেকে খানিকক্ষণের জন্য হলেও দম ছেড়ে দিচ্ছে, হাঙরের মতো ধরে রাখতে পারছে না ----- সে হলো আইপিএল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট । যা একমাত্র এই ভোট আগ্রাসনের মধ্যে সন্ধ্যে-রাত্রির একটি মাত্র রিফ্রেশ ছক্কা-চার বাতাস, একটু মুক্ত অক্সিজেন ।
==============================
------ সুব্রত বিশ্বাস
গ্রাম ও পোস্ট- ধর্মপুকুরিয়া
বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগণা
পিন- ৭৪৩২৩৫