পুঁজি
এযুগে একটা সৎ ছেলে? শুধু দুষ্প্রাপ্যই নয় অকেজোও বটে। অন্ধকারে ডুবে থাকা জগতে পাঁকের মধ্যে পদ্মফুলের মত এক টুকরো সততা জ্বলজ্বল করে কি হবে শুনি? মূল্যবোধ শব্দটা কেউ বললে আর আড়াল থেকে নয়, সকলের সামনেই হো হো করে হেসে উঠবে সারা জগত।
কিন্তু তবু হারেও তো একটা লকেট থাকে? ব্যতিক্রমের একটা উদাহরণ?
আর সেটা হল রথীন। তার সৎ কাজকর্ম বৌ ঊষসীকে পর্যন্ত উদ্বেগে ফেলে। এমন ছেলে কোনদিন কি বিপদে পড়ে কে জানে।
মাত্র ছ সাত হাজারে এই তিনজনের সংসারটা টানা যায়? আর একজন তো আসবেই। অনেক দিক সামলে তার আসার সম্ভাবনাটা আটকে রেখেছে ঊষসী। পরিবার কল্যাণের অনেক আধুনিক ধারা অনুসরণ করে। আবার একজন এলে কি যে অবস্থা হবে সেটা ভেবে কাঁটা হয় সে। কারণ সেই নবাগত যে আবার একটা বাচ্চা।
অফিসে বেরোনর জন্যে ব্যাগ নিয়ে তৈরি হয়েছে রথীন। শুনতে পেল বাথরুম থেকে মায়ের বমি করার শব্দ। মায়ের পেটে সাংঘাতিক রকমের ঘা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে এক্ষুনি অপারেশন না করালে ক্যান্সারে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। যখন তখন বমি করে। বমিতে অনেক সময়েই রক্ত থাকে। তাছাড়া থাকে অসহ্য জ্বালা।
মায়ের অপারেশনটা অনেক করে ঠেকিয়ে রেখেছে। অন্তত লাখ দেড়েকের ধাক্কা। চাকরিও তার খুব বেশিদিনের নয় যে প্রভিডেন্ট ফান্ডে অনেক টাকা জমবে। আত্মীয়স্বজন তেমন নেই। বন্ধুবান্ধবদের কয়েকজনকে বলেছিল।
--একটু লাখ দেড়েক টাকা ম্যানেজ করে দিবি ভাই? মানে ধার আর কি।
মণিময় আর স্বপন গুটি গুটি সরে পড়ল। কাশীনাথ বলল, এত টাকা ধার? কে দেবে তোকে? শোধ দিবি কি করে? করিস তো মোটে ছ'সাত হাজারের চাকরি।
সেও সরে পড়ার আগে একটা উপদেশ দিয়ে গেল, ভিক্ষে করবি কেন? কুপন টুপন ছাপিয়ে স্টেশনে বা বাস স্ট্যান্ডে বিলি কর। তা তোর আর সময় কই। সর্বদাই খাটছিস মালিকের গাধার খাটনি। তা বৌকে সে ভারটা দিলে পারিস। ওর তো এখনও বাচ্চা হয় নি। ফ্রি আছে।
মাথা গরম হলেও কিছু বলে নি রথীন। কি আর বলার আছে। কথায় বলে হাতি দঁকে পড়লে চামচিকের লাথিও খেতে হয়।
মায়ের রোগটা নাকি মন থেকে। অনেক ভেবে এটা ঠিক বুঝেছে রথীন। একটা ভাল সম্বন্ধে বিয়ে দিচ্ছিল মা তার। বেশ কিছু যৌতুক নাকি পেত। পাত্রিপক্ষকে বলা হয়েছিল ছেলে গ্র্যাজুয়েট আর মাইনে পনের হাজার।
নিজে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ হয়ে মাত্র ছ'সাত হাজার টাকার প্রাইভেট চাকুরে হয়ে এতবড় মিথ্যেটা বলতে রাজি হয়নি।
--বললে কি মহাভারতটা অশুদ্ধ হত শুনি? এত যে সম্বন্ধ হচ্ছে হুদো হুদো বিয়ের পর তো দেখা যাচ্ছে সব ভুয়ো। মায়ের গজগজানি আর থামে না।
মায়ের যুক্তি এতই অকাট্য যে তা খন্ডন করার উপায় নেই। কিন্তু মিথ্যে জিনিসটাকে যতটা না অপছন্দ করে সে তার থেকেও বেশি করে ভয়। যদি বিয়ের পর তার বৌ সব জেনে যায়? ভালবাসবে সে তেমন করে? করবে শ্রদ্ধা নাকি উঠতে বসতে শুধু খোঁটা দিয়ে বলবে, তুমিও তো সেই এক গোয়ালের গরু। বিশ্বাস আর করব কাকে?
বিয়েটা হলে অনেক কিছু যৌতুক দিত রথীনকে। একটা বাইক সমেত। পাকাদেখার আগে একবার হবু শ্বশুর একবার এসেছিলেন তাদের বাড়িতে। কিছু কথার পর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আক্ষেপ আমি বুঝি বাবা। বি-এ পাশ করার পর এম-এ পড়ার আর সুযোগ পেলে না। চাকরিতে ঢুকে যেতে হল। অবশ্য আক্ষেপ করার কিছু নেই চাকরি তোমার নেহাত খারাপ নয়। হাজার পনের কি আর এমন কম? তাছাড়া গ্র্যাজুয়েট ছেলে সরকারি চাকরিতে টক টক করে প্রমোশন পেয়ে যাবে। মাইনে কটা বছরের মধ্যেই একেবারে তিনগুন হয়ে যাবে।
মা আর ঘটক দুজনে মিলে এই পরিকল্পনা বানিয়েছিল তাকে না জানিয়েই? বর্তমান নয়, পরিণতির ভয় আর আশঙ্কা সতর্ক করে দিল তাকে।
--দেখুন আপনাকে কেউ ভুল খবর দিয়ে থাকবে। আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ। প্রাইভেটে ছোট একটা কাজ করি। দায়িত্বের হলেও মাইনেটা সাত হাজার তিনশ আশি। আর এদিক ওদিক করে মালিকের দয়ায়---
বিয়ে ভেঙ্গে গেল। মায়ের মনটাও। আর তার স্বপ্নটাও।
তারপর থেকে একটা প্রচন্ড অপমান বোধে ভুগত তার মা। খাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল। অনেক দিন তো না খেয়েই থাকত। কিন্তু এ অভিমান তো রথীনেরও। সে মানুষ নাকি তার মায়ের মনের ইচ্ছের পুতুল একটা?
পাঁচ সাত বছর কেটে গিয়েছিল তারপর। নিজের বিয়ের কথা ভুলতেই বসেছিল সে। মাও আর উত্থাপন করে নি। কেউ উত্থাপন করলেও কর্ণপাত করে নি। বিয়ের ইচ্ছেটাও করছিল পালাই পালাই। এমন সময় স্টেশনে দেখা হয়েছিল ঊষসীর সঙ্গে। বিরাট সুন্দরী না হলেও বেশ একটা আকর্ষণ আছে।
মাধ্যমিক পাশ মেয়েটা। অনেক বছর আগে পাশ করেছে। গরিব বাবার একমাত্র সন্তান। লেখাপড়ায় এমন কিছু ছিল না যে মাধ্যমিক পাশ করে একটা চাকরি পাবে। তবু চেষ্টা করছিল। কলোনিতে বাড়ি। ছিটেবেড়ার ঘর। একদিন নিয়ে গিয়েছিল। আবেগের বসে বুড়ো বাবা বলেছিল, মেয়েটার যে কি হবে। একটা চাকরি জুটল না।
প্রস্তাব দিয়েছিল রথীন। ঊষসীর বাবা বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, কিন্তু আমি তো বেশি কিছু দিতে পারব না—
--আমি তো আপনার মেয়েকে ছাড়া আর কিছুই চাই নি?
বিয়ে হয়ে গেল। মায়ের একরকম অমতেই ধরতে গেলে। মা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে ছিল। কিন্তু তারপর থেকে তার রোগটাও বেড়ে যেতে থাকে। তাই এটা মানসিক কারণে বলেই ধরে নিয়েছে রথীন। মায়ের জন্যে প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে যায়। খাওয়া দাওয়াও ভাল ব্যবস্থা করতে পারে নি ঊষসীর। এই অবস্থায় প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি নেওয়া যায় না।
কিন্তু ডাক্তার আর সময় দিতে চায় না।
--এরপর সময় নিলে সেই সময় তোমার মাকে খাবে বুঝতে পারছ?
রথীনের কাজটা ক্যাশিয়ারের। প্রচুর টাকার লেনদেন হয়। বেশ বড় একটা ব্যবসায়ের সমস্ত কাঁচা টাকা এখানে জমা হয়। যে সিন্দুকের সামনে বসে কাজ করতে হয় তাকে তার নগদ টাকা রাখার অনুমতি পাঁচ লক্ষ পর্যন্ত। বেশি হলে সেটা জমা দিতে হবে ব্যাংকে। ব্যাঙ্কে সমস্ত টাকার লেনদেন হয় রথীনের মারফত।
খুব খিটখিটে লোক হলেও মালিক কিন্তু রথীনকে খুব বিশ্বাস করে। নানা দিক থেকে কর্মচারিরা টাকা এনে জমা দেয়। মালিক দূর থেকে বলে, রথীনের হাতে দিয়ে গেলেই হবে।
-আপনি একবার নিজে দেখবেন না দাদা?
-হাসালে প্রবীর। মালিক বলে, এই রথীন হচ্ছে একেবারে খাঁটি সোনা। দেখবে এক পয়সা এদিক সেদিক হবে না।
একটু লজ্জা পায় রথীন। আবার বেশ গর্বিত হয়। ভাবে মালিক যখন এত ভালবাসে তো চেয়েই দেখা যাক না তার কাছে টাকাটা। মায়ের সঙ্গে মতের অমিল যতই হোক বা যতই হোক অকারণ অভিমান, সে তো তার মা বটে। তিলে তিলে মানুষটা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে এটা তো ঠিক নয়।
-দেড় লাখ টাকা! মালিকের চোখ উঠল কপালে, কর সাত হাজারির চাকরি আর স্বপ্ন দেখছ একসঙ্গে দেড় লাখের? শোধ করতে পারবে সারা জীবনে? বাড়ি ঘরও তো নেই তেমন যে বেচে শোধ করবে।
অনেক চেষ্টা করছে রথীন। কিন্তু সমাধান কিছু বেরোল না। এদিকে মায়ের যন্ত্রণাও আর সহ্য হচ্ছে না। তবে কি আত্মহত্যাই সমাধান? ভিতু লোকেরা কি আত্মহত্যা করতে পারে? তাছাড়া সে আত্মহত্যা করলে তার ভালবাসার বৌটার কি দুর্গতি হবে? তাছাড়া রথীনের অসুস্থ মায়ের কি হবে?
মাঝে মাঝে সরাসরি চেক লিখে দেওয়া হয় পাওনাদারের নামে। যারা এই কোম্পানীর সাপ্লায়ার কিন্তু ওরা কেউ অ্যাকাউন্ট পেয়ী চেক নিতে চায়না ইনকাম ট্যাক্সের ভয়ে। তখন ওদের নামে বিয়ারার চেক লিখে পেছনে ওদের দিয়ে সই করিয়ে সেই চেক দেওয়া হয় পাওনাদারদের।
কয়েকটা চেক লেখা হল। একই লোকের নামে। পাওনাদার বেশ ভাল লোক। তিনি যান না ব্যাংকে। বলেন, অত সময় আমার নেই। রথীন তুমি বাবা তুলে এনে দাও। এই নাও পেছনে সই করে দিলাম।
ব্যাংকের লোক চেনে রথীনকে। তাই চেকের পেছনে সে আর রথীনের সই করায় না। জানাশোনা একটা চায়ের দোকানে লেনদেন হয়। পাওনাদার সব চেক সই করে দিয়ে চলে গেছে। ওর অনেক কাজের তাড়া। আসবে সেই ঘন্টাখানেক পরে। চেক ভাঙ্গিয়ে টাকা নিয়ে এখানে বসে থাকবে রথীন। মালিকের খুব বিশ্বাসী আর সৎ লোক। সবাই জানে একথা।
বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবছিল রথীন। সঙ্গে একটা ব্যাগে পাওনাদারের টাকা। আর কোনও কিছু সম্বল নেই তার। বৌয়ের শেষ গয়নাটা বিক্রি হয়ে গেল গতমাসে। পাওনাদারের আজ যেন বড় দেরি হচ্ছে। চিন্তায় পড়ল রথীন।
সেই চিন্তা বিদ্যুৎ ঝলকের মত তার মাথায় জন্ম দিল আর একটা চিন্তার। সব পুঁজি তার শেষ হয় নি। একটা তো এখনও বাকি আছে। যেটাকে এই দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সযত্নে লালন করে চলেছে সে। কত লোককে খেপিয়েছে এ জন্যে। কত লোককে নিজের শত্রু করে তুলেছে। এমন কি নিজের মাকেও করে তুলেছে তীব্র অভিমানিনী। এমন কি মৃত্যুপথযাত্রীও।
তার সততা। এযুগে ওটা একেবারে নাকি বস্তাপচা সবাই বলে। ওটা এখন বিক্রি করলে কেমন হয়?
সব চেকগুলো মিলে ঠিক দেড় লক্ষ। আর চেকের পেছনে টাকা নিয়েছে তার প্রমাণ স্বরূপ জ্বলজ্বল করছে পাওনাদারের সই। আর অপেক্ষা নয়। গুটি গুটি উঠে পড়ল সে। ফিরে গেল বাড়িতে। আজ আর মালিক আসবে না। তাই সে না গেলেও টের পাবে না।
হবে মায়ের চিকিৎসা। একটা অদ্ভুত উন্মাদনায় সে মনে মনে বলে চলেছে, চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। ধরা তো সে পড়বে না। পাওনাদার এসে নালিশ জানালে আর কি হবে। প্রমাণ করতে পারবে না। মালিক বিশ্বাস করবে না তার অমন বিশ্বাসী সৎ কর্মচারি রথীনের বিরুদ্ধে নালিশ।
পরের দিন অফিস চলে গেল। মনে চোরা আনন্দ কিন্তু চোখে সেঁটে রইল এক চোরের দৃষ্টি।
-খুব শকিং নিউজ আছে রথীন। কাল তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দীপকবাবুর বাসে আক্সিডেন্ট হয়েছিল। বাসসুদ্ধ সবাই উলটে পড়েছিল। স্পটেই মারা গেলেন ভদ্রলোক। আহা বেচারা। মালিক বলল।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রথীন। প্রমাণ নেই সাক্ষীও চলে গেল। মুখে বলল, ভেরি শকিং স্যার।
-হ্যাঁ আর দুঃখের কি জান দেড়লাখ টাকা সমেত ব্যাগটা বোধহয় ছিনতাই হয়ে গেছে।
স্বস্তি দ্বিগুণ হল রথীনের। ভাবল ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে সত্যিই বয়। আজ বাড়ি ফিরে গিয়েই মাকে নিয়ে নার্সিং হোমে যেতে হবে।
কিন্তু সেদিন যাওয়া হল না। যাওয়া হল না পরের দিনও। মায়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে চেয়েও রথীন যেন অন্য কিছু ভাবছে। একটা চুরির টাকায় মায়ের চিকিৎসা হবে? এ চুরির প্রমাণ নেই, সাক্ষ্য নেই ঠিক। হয়ত কারোর কারোর মতে অন্তরালের ভগবানও নেই।
কিন্তু আর একজন আছে। তার নিজেরই মধ্যে। সেই যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল নার্সিং হোমের বদলে তার নিজের মালিকের কাছে। আদ্যোপান্ত সব স্বীকার করে নিজের পুঁজিটাকে আবার ফেরত আনতে।