বেলুড় মঠ ও দক্ষিণেশ্বর ভ্রমণ"
কলেজে রোজ ক্লাস করতে করতে কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম, বার বার মনে হচ্ছিল কোথাও যদি একটু ঘুরে আসতে পারতাম। সকালে কলেজে যাও বিকেলে বাড়ি ফেরো এই একঘেয়েমিটা আর মোটেও ভালো লাগছিল না। একদিন হঠাৎ জোস্না বলল
-- "কীরে বেলুড় মঠ বেড়াতে যাবি ?"
--"তোরা কে কে যাবি ।"
--"ওই তো আমি, রূপা, সহিনী, কবিতা, আর অতসী।"
--"আর আমি একা যাব "
--"আমি আছি তো "
--"জানি তুই আছিস, আচ্ছা ভেবে বলছি "
--" দেখছি ফেকছি নয়, তুই যাবি ব্যাস্ , আমি কিছু জানিনা তোকে যেতেই হবে "
সবার জীবনেই এমন একজন বন্ধু থাকে যার কথা তুমি না শুনলেও তোমার মন শুনতে বাধ্য, আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। পরের দিন কলেজে গিয়ে জানতে পারলাম ওরা বেড়াতে যাবার দিন পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছে ,৩০ শে নভেম্বর । কি আর করি ওর কথা ফেলতেও পারলাম না। বললাম
--"ঠিক আছে যাব "
আমি সবকিছু প্রায় ভুলতে বসেছিলাম, ২৯ শেষ নভেম্বর রাতে জোস্না ফোন করে বলল
--" কী রে মনে আছে তো ? কাল সকাল ৮:১০ এ ট্রেন।"
--" হ্যাঁ মনে আছে "
পরের দিন ৮ টার সময় আমি, জোস্না, রূপা ও সহিনী কালনায় মিট্ করলাম। কবিতা ও অতসী সোমড়ায় উঠবে। সেদিন সকালে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল, আকাশের গায়ে ভাসমান ধোঁয়া দেখে মনে হচ্ছিল মেঘ যেন ভেঙে পড়েছে, হাত বাড়ালেই তা ধরা যাবে। ট্রেনে চেপে বাইরে হাত বাড়াতেই আমার মনে হলো যে বাইরের শীতল বাতাস যেন আমাকে জাপটে ধরতে চাইছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সরিয়ে নিলাম। জানলার বাইরে সকালের স্নিগ্ধ, নির্মল আবহাওয়ায় হেসে ওঠা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে বেলুড় স্টেশনে এসে পড়েছি তা বুঝতেই পারিনি। সহিনী বলল
--" কীরে আর কতদূর যাবার ইচ্ছে আছে, এবার নামতে হবে তো "
--" হ্যাঁ চ নাব "
মনে তো হচ্ছিল এভাবেই চলছে থাকি কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি তাই নাবতে হবে। সত্যি জীবনেও যদি এরকম লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারত সবাই , তাহলে পৃথিবীর অবস্থা অন্যরকম হত। আমরা যখন নামলাম তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১০:২০ বাজে। এত বেজে গেছে! আর আমি বুঝতেই পারিনি। বেলুড় স্টেশনে নেমে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি অনুভব করলাম। আমার ভাবতেই আনন্দ হচ্ছিল যে , স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে এসেছি। এছাড়া রাস্তার এখানে ওখানে স্থাপিত স্বামীজির মূর্তি আমার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছিল। স্টেশন থেকে নেমে আমরা উত্তর দিকে এগোলাম, সামনেই টোটো স্ট্যন্ড। টোটো ওয়ালারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে প্যাসেনঞ্জার ডাকছে। আমরা একটা টোটোয় উঠে বসলাম। টোটোয় করে যখন মঠের দিকে যাচ্ছি তখন রাস্তার ধারের প্রাচীন বাড়ি গুলো দেখে আমার মনে হল এরা কত ভাগ্যবান, এরা সামনে থেকে স্বামীজি কে প্রত্যক্ষ্য করেছে। আর এখন যেন ওরা আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে। মঠে যেতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগল। টোটো কাকু আমাদের মঠের গেটের সামনে নামিয়ে দিলো। মঠের একদিকটা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আর অন্য দিকটায় স্বয়ং ভাগিরথী বহমান। মঠের ভিতর বাঁধানো রাস্তার দুপাশে আছে ফুলের বাগান। গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া সহ আরো নানান নাম না জানা রং বেরঙের ফুল শোভা পাচ্ছে সেখানে। ফুল গুলি দেখে আমার মনে হলো তারা এই পুণ্য ভূমিতে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত ও গর্বিত। কিছু দূর গিয়ে বাঁদিকে একটি সুন্দর অট্টালিকা চোখে পড়ল, যার উপর লেখা রয়েছে " বিবেকানন্দ ভিলা।" ভিলার ডানদিকে আছে উনবিংশ শতাব্দীর ঘোড়ায় টানা গাড়ির প্রতিকৃতি, যা সেই সময়কার ঐতিহ্য বহন করছে। এছাড়া ভিলার দেওয়ালে আছে অসাধারণ কারূকার্য , আমরা সব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে সব দেখতে লাগলাম। পাশের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে ভিলার ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে ঢুকেই আমার মনে হলো আমরা যেন কয়েক দশক পিছিয়ে গেছি। সারা অট্টালিকা জুড়ে গুরু-শিষ্যের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, অট্টালিকার প্রতিটি কোণায় তাদের কাহিনী ফুটে উঠেছে। অট্টালিকার ভিতরে ছোট ছোট অনেক কুঠুরি আছে তার কোনটাই বিবেকানন্দের ছোটবেলার দৃশ্য দেখানো হয়েছে তো কোনটাই তার সন্যাস জীবনের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া তার পড়ার ঘর, শোবার ঘর ও তার ব্যাবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী সাজানো রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কুঠুরিত। প্রাচীন পুঁথি, নথিপত্র স্বামীজির হাতে লেখা চিঠি সব কিছু আছে। এছাড়া আছে পরমহংস দেবের পাদুকা, তার ব্যবহৃত বস্ত্র , বাসনপত্র সহ আরও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী। এই সমস্ত কিছু প্রত্যক্ষ্য করতে পেরে অদ্ভুদ এক তৃপ্তি অনুভব করলাম। ভিলা থেকে বেরিয়ে তার পাশে অবস্থিত নির্মায়মান আর একটি সুন্দর অট্টালিকায় আমরা প্রবেশ করলাম। এখানে তেমন কিছু নেই বটে, তবে তার স্থাপত্য কলা খুব সুন্দর। সেই অট্টালিকার চারিপাশে একটু ঘুরে আমি নদীর ধারে চলে গেলাম, নদীর সাথে আমার কেমন যেন একটা আলাদা সম্পর্ক রয়েছে, আমার যখন খুব মন খারাপ হয় আমি তখন নদীর ধারে চলে যায়, একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করি । কারণ নদী সবসময় বয়ে চলার কথা বলে, ভালো মন্দকে সাথে রেখে এগিয়ে চলার কথা বলে, বয়ে চলায় নদীর ধর্ম থমকে থাকা নয়। এক মনে নদীর দিকে তাকিয়ে আছি , তখন জোস্না এসে বলল
--"ওই ফুলের বাগানটা দেখ , কত সুন্দর লাগছে।"
আমি বাগানটা খেয়াল করিনি এতক্ষণ, তাকিয়ে দেখি সত্যিই তো খুব সুন্দর লাগছে। সারা বাগানটা জুড়ে শুধু গোলাপ গাছ, যা দেখে মনে হলো যে সবুজ পাড়ের লাল শাড়ি পরে কোনো নববধূ একমনে নদীর স্নিগ্ধতা উপভোগ করছে। এদিকে রূপা, সহিনী, অতসীরা ছবি তুলতে ব্যাস্ত, তবে আমার বেশি হাসি পাচ্ছিল কবিতাকে দেখে, ও সব সময় সেলফি তুলছে, এমনকি খেতে বসেও সেলফি। খাওয়া দাওয়া সেরে এবার আমরা দক্ষিণেশ্বরের দিকে রওনা দিলাম। মা সারদা দেবী ও শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থান। বেলুড় ফেরিঘাট থেকে ট্রলারে করে আমরা দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছালাম। জীবনে প্রথম ট্রলারে চাপলাম , অন্যরাও তাই তবে ওরা একটু ভয় পেলেও আমি বেশ উপভোগ করছিলাম। নদীর উপর দিয়ে যাবার সময় দুধারের দৃশ্য ছিল দেখার মতন, নদীর দুই তীরে অবস্থিত প্রাচীন মন্দির গুলো সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের গায়ের লালচে ছোপ জানান দিচ্ছে যে তারা কত প্রাচীন প্রহরী। ট্রলার থেকে নামতে না নামতেই আবার সব ছবি তুলতে ব্যাস্ত, সত্যি "স্মার্টফোন আবিষ্কারের পর থেকে পৃথিবীতে ক্যামেরা ম্যানের অভাব নেই।"
এখানেও প্রচুর লোকের সমাগম, তার মধ্যে বিদেশি পর্যটকদেরও দেখা যাচ্ছে। মেনগেট দিয়ে ঢুকে আমরা বাঁদিকটায় গেলাম, ওই খানটায় একটা বাঁধানো পুকুর আছে। তার ধারে লাগানো বিভিন্ন ফুলের গাছ তার শোভা আরো বাড়িয়ে তুলছিল। পুকুরে নানান প্রজাতির মাছ খেলে বেড়াচ্ছে নির্ভয়ে, তারা জানে এখনে তাদের কেউ বিরক্ত করবেনা। তবে এখনে আমরা একটু দেরীতে চলে এসেছি, এখন মূল মন্দিরটি বন্ধ, বিকেলে খুলবে। কী আর করা যাবে "দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর" মত মন্দিরের চারিদিকে একটু ঘুরলাম। এখানেও একধরনের শান্তি বিরাজ করছে, এবার ফিরতে হবে। দক্ষিণেশ্বর থেকে বালিগামী বাসে উঠে বালি স্টেশনে পৌঁছালাম। বাসটি ব্রিজের উপর দিয়ে যাবার সময় নদীটি দেখতে অসাধারণ লাগছিল। বালি থেকে ট্রেনে করে এবার ফেরার পালা। যখন আমরা ফিরছি তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে, দিনের শেষ কিরণটি পৃথিবী শুষে নিচ্ছে, আর আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাদা মেঘগুলো রক্তাভ হয়ে উঠেছে। আর আমাদের সবার মুখে এক অজানা আনন্দ, তৃপ্তি ফুটে উঠেছে।
গ্রাম+পোস্ট- পিন্ডিরা
জেলা- পূর্ব বর্ধমান
থানা- কালনা
পিন- ৭১২১৪৬
মোঃ ৯৬৭৯২৬২৪১৭