বরুণ থমকে যায়। ব্রেক কষে সাইকেল থেকে নেমে পড়ে। সাঁকোর কাছে কয়েকটি ছেলে যেন কাউকে জোর করে ধরে রেখেছে। আসন্ন সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার এই জায়গায় দুতিনটি ল্যাম্পপোস্টের বাল্ব কারা যেন সবসময় ভেঙে রাখে। বরুণ টর্চ বের করে আলোকপাত করতেই ছেলেগুলো থতমত খেয়ে যায়। সেই ফাঁকে একটি পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে তাদের হাত ছাড়িয়ে বরুণের কাছে ছুটে আসে। মেয়েটির মুখে টেপ সাঁটানো। মুখ থেকে টেপের বাঁধন খুলে সে কাঁদতে কাঁদতে বলে —
কাকু আমাকে বাঁচান। আমি টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরছিলাম। এরা আমাকে এখানে আটকে সাইকেল আর বইয়ের ব্যাগ খালে ফেলে দিয়েছে। আমার মুখে টেপ সাঁটিয়ে টানতে টানতে সাঁকোর ওপারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আপনি এসে পড়ায় পারেনি।
ততক্ষণে ছেলেগুলো এসে বরুণও মেয়েটিকে ঘিরে ফেলেছে। সংখ্যায় তারা সাতজন, কারও মুখে রুমাল বাঁধা , কারও মুখে গামছা জড়ানো। তবে চেহারার আদল দেখে বোঝা যায় সকলেই কমবয়সী, ষোলো থেকে কুড়ির আশেপাশেই হবে। সব থেকে লম্বাচওড়া রুমালমুখো ছেলেটি বরুণের সাইকেলের বেল বাজিয়ে বলে —
কাকু বাড়ি যান বুঝলেন ! জানেন তো দিনকাল খারাপ !
একজন ফস করে মেয়েটির মুখের সামনে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরায়। মেয়েটি ভয়ে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়ে।
বরুণ, তারিফযোগ্য ধৈর্যের অধিকারী। তাছাড়া তার মুখের ভাব দেখে, কথাবার্তা শুনে সহজে মাপা যায় না। এজন্য অনেকেই তার সামনে খেই হারিয়ে ফেলে। সে বলে —
আমি জানি না, তোমরা এখনও পড়াশোনা করো কিনা ! যদি পড়ো, তাহলে আমার হিসাব বলছে তোমাদের এখন ইলেভেন থেকে ফার্স্ট ইয়ারের মধ্যেই পড়ার কথা ! আমি কলকাতার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করি। তোমাদের দেখে আমার ইলেভেন-টুয়েলভের ছাত্রদের কথা মনে পড়ে গেল। আমাকে আশেপাশে অনেকেই চেনে, তোমরা চিনলেও চিনতে পারো। আমার বাড়ি এখান থেকে বেশি দূরে নয়, চেতনগঞ্জে।
যে সিগারেট টানছিল, সে বরুণের মুখের উপর ধোঁয়া ছেড়ে বলে —
বেশি ডায়লগ না-ঝেড়ে এখান থেকে কাটুন তো মাইরি ! ওরম বালের মাস্টার অনেক দেখা আছে — আসি যাই মাইনে পাই / মাগভাতারে মাগনা খাই। বালগুলো ক্লাসেই শের, ডায়লগের কী বাহার। এদিকে বাইরে হেই বললে হিসি করে ফেলে। বেশি মাইনে হলে ওই হয়, জানের মায়া এসে যায়। আমরা মাগনা খাই না, রীতিমতো জান বাজি রেখে খেটে খাই। অনেকদিন থেকে তাক করে করে আজ এই মেয়েটিকে আমরা কবজা করেছি। আমরা একে বিশেষ কিছু করব না। ওই মানে পেপারে যে ধরণের নিউজ বেরোয় সেরম কিছু ! একে মুম্বাই পাঠাব। অনেক টাকার কেস। তবে আজ রাতে আমরা একে নিয়ে একটু হালকা করে ফুর্তি-আমোদ করব। কী মাস্টার, চাকরি করি না বলে কী ফুর্তি করা মানা !
বরুণ ধীরস্থির কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলে যেন কিছুই হয়নি ! যেন ছেলেগুলো তার বাধ্য ছাত্র। আর সে তাদের বুঝতে না-পারা বিষয়টি প্রাঞ্জল করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
— শোনো তোমরা বোধ হয় আমাকে চেনো না। আমি মোটেও ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পছন্দ করি না। কিন্তু যেহেতু তোমরা আমাকে ঘিরে ধরেছ, সেহেতু আমার মনে হচ্ছে তোমরা আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাও। আমি তোমাদের নিরাশ করব না। তাড়া থাকলেও ছোট্ট একটি গল্প শুনিয়ে তবেই আমি যাব। বেশি সময় লাগবে না, মিনিট পাঁচেক হলেই যথেষ্ট। বলেই সে ছেলেগুলোকে কিছু বলতে না-দিয়েই আচমকা শুরু করে —
আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, বাবা একদিন আমাকে একটি জাপানি সিনেমার গল্প বলেছিলেন। একজন লালদাড়িওয়ালা ডাক্তারের গল্প। ডাক্তারবাবু হাসপাতালের পাশের এক হোটেলে খেতে যেতেন। একদিন তিনি খেতে বসে দেখলেন, পাশের ঘরে একটি মেয়েকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তিনি হোটেলের মালকিনের কাছে মেয়েটিকে বেঁধে রাখার কারণ জানতে চান। মালকিন বলেন, আপনি ডাক্তার, আপনার কাজ রোগীর চিকিৎসা করা। তার বাইরে কোনও ব্যাপারে আপনার মাথা ঘামানো উচিত নয়। এখন খেতে এসেছেন, খেয়ে চলে যান। লালদাড়ি খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েন। তিনি মালকিনের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আমি চিকিৎসক, ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করা আমার ধর্ম ; সে ব্যাধি মানবদেহের হোক বা সমাজদেহের। তিনি পাশের ঘরে ঢুকে মেয়েটিকে বাঁধনমুক্ত করেন। হোটেলের মালকিন আসলে পাচারকারী, সে হাঁকডাক করতেই বেশ কয়েকজন ষণ্ডামার্কা লোক চলে আসে। লোকগুলো লালদাড়িকে ঘিরে ধরে। তিনি মেয়েটিকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দেন, তারপর লোকগুলোর চিকিৎসা শুরু করেন। লালদাড়ির হাত-পা চালনার সঙ্গে তাল মেলাতে না-পেরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই লোকগুলো ধরাশায়ী হয়। কারও হাত ভাঙে, কারও পা। কারও আবার মাড়ি থেকে খসে পড়ে দাঁত। সেদিন আর ডাক্তারের খাওয়া হয় না। তিনি হোটেলের মালকিনকে বলেন, তোমার লোকগুলোকে আমার হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা কোরো, ওদের চিকিৎসা করতে হবে। আমি মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছি। ওকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দেব। গল্পটি শুনিয়ে বাবা আমাকে বলেছিলেন, সকলের উচিত আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষার কোনও বিদ্যে শিখে রাখা। কয়েকদিন পরে বাবা আমাকে কলকাতায় একটা ক্যারাটে স্কুলে ভর্তিও করিয়ে দেন। প্রতি রোববার বাবা আমাকে নিয়ে কলকাতায় ছুটতেন। সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এমন একটা দিনও যায়নি, যেদিন আমি অন্তত আধঘণ্টা এই বিদ্যেটা প্র্যাকটিস করিনি। আর এখন আমি সিক্সথ ডান ব্ল্যাকবেল্ট। ছেলেগুলো সম্মোহিত হয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো গল্প শোনে। গল্পের মাঝখানে কয়েকটি সাইকেল ও বাইক তাদের পাস কাটিয়ে পড়িমরি গতিতে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। বরুণ, তাদের থামানোর চেষ্টাই করেনি। সে জানে তাতে কোনও লাভ তো হবেই না, বরং জল আরও ঘোলা হয়ে যেতে পারে। এমনিতে জায়গাটার একটা কুখ্যাতি আছে। সন্ধ্যার সময় এইসব মূর্তিমানদের দেখে এখানে কেউ দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাবে বলে তার মনে হয় না।
বরুণ মেয়েটিকে বলে —
তোর বাড়ি কোথায় ?
— হিজলতলা।
— কোন ক্লাসে পড়িস ?
— এবার মাধ্যমিক দেব।
— সাইকেলের পেছনে বোস। কাল আমার ছুটি আছে। সকালে এসে তোর সাইকেলের একটা ব্যবস্থা করব। বইয়ের জন্য ভাবিস না। সে আমি জোগাড় করে দেব।
ছেলেগুলি অল্পবয়সী হলেও মোটেই সুশীল বালক নয়। কয়েকজন মদ-গাঁজা অতিক্রম করে পাতায় পৌঁছে গেছে। এদের কাছে বোমা-বন্দুক থাকাও সম্ভব। বরুণ সব জেনেও এমন ভাব দেখায় যেন সে তাদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। বরুণ একটা দর্শন মেনে চলে, যতক্ষণ না, নাক পর্যন্ত জল পৌঁছাচ্ছে, ততক্ষণ সে কোনোমতে সাঁতার কাটবে না।এই দর্শন মেনে সে বহুবার দুর্দান্ত ফল পেয়েছে। তবে এবার বোধ হয় শেষ রক্ষা হবে না। বরুণ বুঝে গেছে জল ইতিমধ্যে তার বুক ছুঁয়ে ফেলেছে।
বারমুডা আর গেঞ্জি পরা ঝাঁকড়া চুলওয়ালা ছেলেটি বলে —
ও কাকুস্যার, দাঁড়ান, দাঁড়ান। কী ভেবেছেন আপনার ক্যারাটের গল্প শুনে আমরা ভয় পেয়ে গেছি, প্যান্টে হিসি করে ফেলেছি। আজ আপনাকে আমরা মায়ের ভোগে পাঠাব। এই বাপি, মাল নিয়ে আয় !
মেয়েটি সাইকেলের ক্যারিয়ার ধরে কাঁপতে থাকে। বরুণ বাইরে নির্বিকার থাকলেও ভিতরে ভিতরে মাপতে থাকে, জল কতটা উঠছে।
বাপি, সাঁকোর দিকে ছুটে যায়। মিনিট খানেকের মধ্যেই সে ফিরে আসে, তার হাতে তখন দুটো প্রমাণ সাইজের সোর্ড। ঝাঁকড়া চুলওয়ালা ছেলেটি তার হাত থেকে একটা নিজের হাতে তুলে নেয়। বরুণ বুঝতে পারে, তার থিয়োরিটিক্যাল ক্ল্যাস ফেলিওর হয়েছে, এবার প্র্যাকটিকাল করাতে হবে।
প্র্যাকটিকাল ক্লাসের আগে সে একটা ভূমিকা করে নেয় —
শোন, তোরা যে ধরনের মাস্টার দেখার কথা বলেছিস, আমি সেই ধরনের মাস্টার নই ! সিনেমার সেই লালদাড়ি ডাক্তারের মতো করে আমি শিক্ষকতাকে দেখি। আমার কাজ শিক্ষা দেওয়া, সে ক্লাসরুমের ভিতরে হোক বা বাইরে। আজ যেমন তোদের প্র্যাকটিকাল করাব।
কথাগুলি বলতে বলতে বরুণ তার কাঁধের ব্যাগ থেকে কী একটা বের করে নেয়। তারপর ব্যাগটি সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখে। জিনিসটি আর কিছুই নয়, দুটি ফুট খানেক দৈর্ঘ্যের গোলাকার কাষ্ঠদণ্ড একটি লৌহ শৃঙ্খল ও বেয়ারিং দ্বারা যুক্ত। বস্তুটি বিশেষ কায়দায় ধরে সে বলে, এটা নিশ্চয় তোরা চিনিস এর নাম নানচাকু ; ইমপোর্টেড, মেড ইন জাপান। বহুদিন কাজে লাগেনি, আজ তোদের বদান্যতায় এটা সম্ভবত ব্যবহার করতে পারব।
==========================
চন্দন মিত্র
ডায়মন্ড হারবার
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন