পাখিপাহাড়ে
অরূপ কুমার গোপ মন্ডল
অফিসের সামনে পার্কিংয়ে গাড়িটা রেখেই রজতের চোখ চলে গেল মোবাইলে। সাতটা মিস কল । না পরিচিত কেউ নয়, এইটাই যা বাঁচোয়া । ঠিক দুটো বেজে পাঁচে আবার ফোন। সেই নাম্বার থেকেই। জ্বালাতন করে মারলে। ভাবতে থাকে রজত। ফোনটা কানে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ায়।
-"হ্যালো কে বলছেন ?"
-"রজতদা আমি ঝিমলি। ঝিমলি বলছি দাদা।"
আকাশ থেকে পড়ে রজত। না ঝিমলি নামে তো কাউকে চেনে না। ওপার থেকে ভেসে আসে হাসির শব্দ। শীতের সকালে মিষ্টি রোদের চেয়েও মিষ্টি মনে হয় রজতের।
-"কি চিনলে নাতো ? চিনবেই বা কি করে ? ভুল করেও তো একবার অরুণ কাকুর বাড়ি আসতে নেই ! কাকুকে ফোন করেছিলাম। তুললেন না। আচ্ছা কাকু কাকিমা ভাল আছেন তো ? কাকুর তো বাইপাস সার্জারি , সাবধানে থাকতে বলবে। আর কাকিমা নুনটা যেন একটু কম খান। আর শোনো কাকু বলেছিলেন পিজিতে আমি ফার্স্ট হবো। কালই রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফার্স্ট হয়েছি । উনাদের আমার প্রণাম জানিও। বলবে ঝিমলি ফোন করেছিল। রাত্রের দিকে একবার ফোন করি ?"
গড়গড় করে কথাগুলো বলার শেষে সংক্ষেপে হ্যাঁ বলেছিল রজত। ঝিমলি ? হয়তো বাবা-মা জানে। বাড়িতে ঝিমলির কথা হয়। সে শুনেনি। শুনবেই বা কি করে ? এতদিন তো হোস্টেলেই কাটলো। চারমাস হলো ঘরে ঘাঁটি গেড়েছে। মফস্বলের একটা অফিসে কাজ পেয়েছে।
বাড়িতে কথাটা বলতেই আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন সুখেনবাবু।
-"ওগো সেদিন অরুণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বললাম ঝিমলি ফার্স্ট হবেই হবে। হয়েওছে। বেটা অরুণ বলে কিনা অসম্ভব। হুঁ হুঁ বাছাধন ! বলব যা বিকালে ফলবে তা সকালে।" চেঁচিয়ে বলেন সুখেনবাবু। তারপর রূপকথার মতো শুনে যায় রজত। তখন ঝিমলিদের পাশেই ভাড়া বাড়িতে থাকতো তারা। খুব হেলমেল। অমাবস্যা পূর্ণিমার মতো মাসে একবার একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া হবেই। প্রতি বছর পিকনিক হতো। একবার পাখি পাহাড়ে গিয়েছিল। সারাদিন রজত আর ঝিমলি পাহাড়ের গায়ে নিজেদের নাম খোদায়ে ব্যস্ত ছিল। ঠক ঠক ঠক ঠক করে। শাল আর পলাশ গাছের ফাঁকে আলো-ছায়ায় কানামাছি খেলতে গিয়ে কখন যে দিনটা শেষ হয়েছিল বুঝতেই পারেনি কেউ। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় ঝিমলির কি কান্না ! বলে আরো একদিন এখানেই থাকবো।
-"আর ব্যাটা অরুণ, সারাদিনে একবারও দাবা খেলায় জিততে পারেনি। হারিয়ে ভূত করে দিয়েছিলাম।" বলেই প্রসন্নতার হাসি হাসেন সুখেন বাবু। তারপর ছেলের আবদারে খুঁজে বার করেন পুরানো অ্যালবাম গুলো। বাবাকে আড়াল করে ঝিমলির কয়েকটা ছবি খিচিক খিচিক করে নেয় রজত।
রজত শুনেছিল মেয়েদের স্মৃতি প্রখর হয় । তার তো কটা ইকুয়েশন মনে রাখতেই হাড় হালুয়া হয়ে যায়। অথচ ঝিমলি মনে রেখেছে কত কিছু। সেবার মাংস রান্না করেছিল বিপিন কাকা। একটু নাকি ঝাল হয়েছিল। তাই রজতের কি কান্না ! শেষে মাংস না খেয়ে বাড়ি আসতে হয়েছিল তাকে। আর ঝিমলি ? বেহায়া হাসিটাকে চেপে রাখতে পারেনি।সুর করে বলেছিলো
-"আহা গো ! বেচারির বৈষ্ণব পিকনিক হয়ে গেল !"
আজও হাসির হল্লায় মোবাইলে কান রাখতে পারছে না রজত। আচ্ছা ডেঁপো মার্কা মেয়ে তো ! কথার খই ফুটছে মুখে। ইচ্ছে করছিলো হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবে। ঝিমলিও কোনো ধোয়া তুলসী পাতা নয়। পাখি পাহাড়ে আরো একদিন থাকার জন্য সে কি কম কেঁদেছে ? কিন্তু রজত নিজেকে সামলে নিল। শ্রোতা হয়ে শুনতেই তার ভালো লাগছে আজ।
পাহাড়ের গায়ে নাম লিখতে গিয়ে ঝিমলির একটা আঙুল কেটে গিয়েছিলো। তার চোখে জল দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি রজত। শাল গাছের নিচে বড় একটা পাথরে বসিয়ে গাড়ি থেকে ব্যান্ডেজ আনে । নিজের হাতে ঝিমলিকে জল খাইয়ে দেয়। সেই ছিল রজতের প্রথম চিকিৎসা। ঝিমলির নাকি সেদিনই মনে ধরেছিল রজতকে। বলতে পারেনি লোকলজ্জায়।বলেছিল-
"রজতদা চলনা ওই মস্ত বড় পাথরটার উপর বরকনে খেলি আমরা।"
কিছুই মনে নেই। ভাবতে থাকে রজত। তবু সারাদিনের শেষে ফোনটাও যেন কার অপেক্ষায় বসে থাকে । রাত গভীর হয়। সব আলো নিভে আসে। তবু রাতচরা আর ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে। চাঁদ আর তারার রাতকথা চলতেই থাকে স্মৃতির বালিশে হেলান দিয়ে। ফিসফিস করে। চোখের সামনে ভাসে কত ছবি।
এক বালক পাখি পাহাড়ের কোলে আদ্দিকালের পাথরটাতে বর সেজে বসে আছে। তার মাথায় শালপাতার টোপর। গলায় আকন্দ ফুলের মালা। জাম জারুল আর শিমুল পলাশের শীতল ছায়া বরযাত্রী।পুটুস ফুলের মালা গলায় বউ সেজেছে কেউ। টানা চোখে হালকা কাজল, মন মেতেছে বরের। খোঁপায় গোঁজা কুড়চি আর কৃষ্ণচূড়ার থোকা । অস্তগামী সূর্যের তেরছা আলোয় মায়াবী মনে হয় সবকিছু।
কদিন থেকেই ঝিমলি বায়না ধরেছে "চলো না রজতদা, একদিন পাখি পাহাড়ে ঘুরে আসি। বান্ধবীদের কাছে শুনেছি পাহাড়ের গায়ে এখনো আমাদের নাম লেখা আছে ।"
কিছু উত্তর দেয়নি রজত। মাকে তো সে ভাল করেই চেনে। ম বললে মেয়ে বোঝে। পাখি বললে প্রেম শোনে। সে কিনা এক আইবুড়ো মেয়ের সঙ্গে যেতে দেবে ? তাও আবার পাখি পাহাড়ে। শেষে হয়তো বলে বসবে 'আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চল'। ঝকমারির শেষ নেই। বাবা তো আরও এক কাঁটা উপরে। সঙ্গে নিয়ে গেলে আর রক্ষে নেই। বায়না শুনেই পূবের সূর্য পশ্চিমে মুখ লুকাবে।
দুই
এলার্ম ঘড়ির ধমকানি শুনে ঘুম ভাঙ্গেনি আজ রজতের। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে তারারা মুখ লুকায় নি এখনো। পূব দিক আলো করে সূর্য ঠাকুরের উদয় হতে দেরি আছে। তবু তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নেয়। অনেকটা পথ পাখি পাহাড়ে যেতে। ঝিমলি বলেছে বাইপাসের ধারে বটতলায় বসে থাকবে। অভিসারিকা রাধার মতো নীল শাড়ি পরলে মন্দ হতো না। ঝিমলি বলেছে পিঙ্ক চুড়িদার পরবে। চিনতে ভুল হবার কথা নয়।
'জরুরী কাজ আছে। ফিরতে দেরী হবে' বলেই বেরিয়ে পড়ে রজত। রাস্তার পাশে দিনু কাকা আঁচ দিচ্ছে। একটু পরেই গরমাগরম চায়ে চুমুক দিয়ে মন্ত্রী থেকে পাড়ার মোগলির পিত্তি চটকাবে সবাই। সকালের অপেক্ষায় হাই তুলছে শহর। আড়মোড়া ভেঙে নিজেকে সচল করে নিচ্ছে পথ কুকুরের দল। চার আঙ্গুল পেটের জন্য লড়াই শুরু করতে হবে যাদের তারা নতুন দিনটাকে একবার দেখে নিচ্ছে।
বহুদিন সকালের শহরটাকে দেখেনি রজত। শীতল হাওয়ায় চনমনে লাগছে। চেনা ঘরবাড়ি পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বছর পনের আগের ঠিকানায়। বাইপাসের বটতলাটা তখনও জমজমাট হয়নি। ব্যস্ত জনতার মাঝে ঝিমলিকে দেখে খটকা লাগে। তবে চিনে নিতে অসুবিধা হলো না। ঝিমলিকে বসিয়েই এগিয়ে চলে।
-"দেখো দেখো রজতদা পাহাড়ের পাশ দিয়ে কেমন ট্রেন চলছে। আমরাও একদিন পাহাড় নদী পেরিয়ে কোন এক ঝর্ণার সামনে গিয়ে বসব। কেমন হবে বলতো ?"
মুচকি হাসে রজত। বুঝতে পারে খাঁচার পাখি আজ ছাড়া পেয়েছে। তাই ইচ্ছে ডানা মেলে দিয়েছে। নিশ্চয়ই তার মতোই কিছু একটা বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। যেতে যেতেই কয়েকবার সেলফি তুলে রজতের কাঁধে হাত রেখে, গলা জড়িয়ে।
নির্জন পথ ঘাট। পরিশ্রমী মানুষকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলে তারা। যেন কোনো সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে মহামূল্যবান কোন বস্তুর খোঁজে। মহামূল্যবান বস্তুই তো। পাহাড়ের গায়ে আঁকা উড়ন্ত এক ঝাঁক পাখি। শিল্পীর কি সুন্দর কারুকাজ ! চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু ঝিমলিকে আজ সেলফি তোলার ভূতে পেয়েছে। চলমান সময়টাকে বন্দি করে নিতে চায় মোবাইলের মধ্যে।
-"থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ঝিমলি। তুমি না বায়না ধরলে হয়তো এমন একটা সুন্দর দৃশ্য দেখাই হতো না। এগেন আই সে থ্যাঙ্ক ইউ।"
-"শুধুই থ্যাঙ্ক ইউ। আর কিছু ?"
-"বল কি চাও ?"
-"সেদিন কুড়চি আর কৃষ্ণচূড়া ফুলের থোকা তুমি খোপায় গুঁজে দিয়েছিলে। আজকেও দাওনা রজতদা ?"
সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। রজত বুঝতে পারে ঝিমলির বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র নেই। না জানি আজও আরো একদিন থাকার আবদার করে বসে ! বিদায় বেলায় চোখ ছল ছল দেখে মনে পড়ে যায় সেই পাখি পাহাড়ে পিকনিকের কথাটা।
বাড়িতে ঢুকেই থমথমে পরিবেশ দেখে রজত ঝড়ের পূর্বাভাস পায়। রান্নাঘর থেকে মা চেঁচিয়ে বলে-"দিন-দুনিয়া খারাপ। আর সারাদিনে ছেলের দেখা পাওয়া দায়। শোনো বাপু, ঝেড়ে কাশো। ওর একটা হিল্লে করে দাও। আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথাটা ওকে জানিয়েই দাও।"
খাওয়া-দাওয়ার পর শুতে যাওয়ার আগে বাবার ঘরে ডাক পড়ে রজতের।
-"আজ তোর অরুণ কাকুর বাড়ি গিয়েছিলাম রে। তোর অমত না থাকলে ঝিমলির সঙ্গে সম্বন্ধটা এগোতে চাই। ওর কয়েকটা ছবিও এনেছি। কয়েক দিনের মধ্যে মতামতটা জানাস।"
রজতের চোখের সামনে তখনও ভাসছে পাখি পাহাড়ের নিচে ছল ছল দুটি চোখ। হ্যাঁ না কিছু না বলেই ছবি নিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে। মনে মনে ভাবে একটা সারপ্রাইজ দিতেই হবে ঝিমলিকে। কিন্তু একি দেখছে ! নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না নিজের চোখকে ! স্বপ্ন দেখছে নাতো ? নাকি সারাদিন সে স্বপ্নই দেখেছে। সে কি মায়া ? নাকি ছায়া ? কিছুই বুঝতে পারছে না রজত। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। হন্তদন্ত হয়ে ফোনটা লাগায় ঝিমিলিকে।
-"তুমি কে ? কে বলতো ? কী চাও।" উত্তেজিত রজতের গলার স্বর শুনেই চুপসে যায় ঝিমলি। তবে হতাশ হয় না। কয়েকবার শ্বাস নিয়ে বলে
-"রজতদা জানতাম মিথ্যার চাদর দিয়ে সত্যকে বেশিদিন আড়াল করা যায় না। যাবেও না। তবে এত তাড়াতাড়ি বালির বাঁধের মতো সব ভেঙ্গে যাবে, স্বপ্নেও ভাবি নি। বান্ধবীরা আমাকে নিয়ে খুব ঠাট্টা করে। অট্টহাসি হাসে। বলে আমার নাকি কোনদিন বয়ফ্রেন্ড জুটবে না। ওরা তো পোশাক বদলের মত বয় ফ্রেন্ড বদলায়।"
রজত বুঝতে পারে ঝিমলির গলাটা ভারি হয়ে আসছে। ওর ছল ছল দুটি চোখ যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
-"রজতদা ধরেই যখন ফেলেছ সত্যি করে বলে দিই। সেদিন তোমার বাবা আর অরুণবাবু ট্রেনে গল্প করে যাচ্ছিলেন। পাখি পাহাড়ের গল্প। তোমাদের গল্প। আর আমি চোখ বুজে সব শুনছিলাম। তোমার নাম্বারটা উনাদের কাছ থেকেই পেয়েছি। ইচ্ছে ছিল তোমার মত যদি একটা বয়ফ্রেন্ড পেতাম। কিন্তু বান্ধবীরা ঠিকই বলেছে আমার ভাগ্যে বয়-ফ্রেন্ড নেই। ক্ষমা করো রজতদা। আমার সঙ্গ কি তোমার খুব খারাপ লেগেছে ? তোমাকে কি খুব আঘাত দিয়েছি ? ভুল করে পারো যদি ভুলে যেও।"
রজতও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই বলতে পারল না। ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটা ছবিতে এসে আটকে গেল তার চোখ দুটো। ঝিমলির খোঁপায় গোঁজা কৃষ্ণচূড়া আর কুড়চি ফুলের থোকা। অস্তগামী সূর্য রাঙিয়ে দিয়েছে তার সিঁথি। শুভদৃষ্টির মত রজতও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ঝিমলির দিকে। না না সে তো ঝিমলি নয়, অন্য কেউ।
=======================
অরূপ কুমার গোপ মন্ডল
নতুন বাঘমুন্ডি রোড
ঝালদা, পুরুলিয়া
৭০০১৯১১৮১০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন