"তোর মা থাকলে আজকে কতই না খুশি হতো বলত।" অনেক দিন পর সামান্য পুজোর বাজার করার অভিপ্রায় কলকাতায় এসে হাতিবাগান এর জনবহুল রাস্তায় নিজের আট বছরের মেয়ের উদ্দ্যেশে কথাটা বললো রফিক। করোনা মহামারীতে নিজের স্ত্রীকে হারিয়ে বেদনায় প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিল রফিক তবে একমাত্র মেয়ের দেখাশুনা করার জন্য নিজেকে বেশিদিন স্ত্রী বিয়োগ এর অবসাদ এও মুহ্যমান করে রাখতে পারেনি। কলকাতার মত এত বড় শহরে কোনোদিন পুজোর বাজার করতে পরিবার নিয়ে রফিক এর আসা হয়ে ওঠেনি এর আগে। যদিও পরিবার এখন তার আর অখন্ড নেই। যতবারই কিছু কেনাকাটা করেছে পুজোর জন্য তা সে করেছে গ্রামের যদু মাইতির দোকান থেকে। আসলে শহরে আসার সুযোগ তার নেই বললে মিথ্যে বলা হয় তবে আর্থিক অবস্থা দূর্বল হওয়ায় সে শহরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার ভয়ে এইমুখো খুব কমই হয়েছে। তবে,ভেবেছিল একদিন সপরিবারে কলকাতা থেকে পুজোর বাজার করবে সে তবে এখন কলকাতায় এসে স্ত্রী এর কথা বেশ মনে পরছে রফিক এর।
রফিক এর মেয়ে বললো," বাবা কলকাতা এত বড়? এত লোকজনের ভিড়? আমাদের ওখানেতো কোনোদিন এত লোক একসাথে দেখিনি বাবা। মা থাকলে কতই না আনন্দ পেত।" মায়ের কথা মনে করে ছোটো মেয়েটিরও চোখ ছল ছল করে ওঠে। মেয়ের চোখ ছল ছল করতে দেখে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে রফিক বলে," হ্যা মা সত্যিই অনেক লোক। চল আজ তোকে তোর মনের মত জামা কিনে দেবো।" রফিক বললো ঠিকই মেয়েকে মনের মত জামা কিনে দেবে তবে সে নিজেও জানে মেয়ে যদি দামী পোশাক পছন্দ করে তাহলে সেটা কিনে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। আসলে রফিক এর নিদ্রিষ্ট কোনো পেশা ছিলনা এতদিন। সে যা পেতো তাই করত এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে। তবে এবার তার আয় সাধারণের থেকে খানিক বেশি কারণ পুজোর কিছুদিন আগেই সে একটা স্থায়ী চাকরি পেয়েছে।
এত বছর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে এখন একটু সচ্ছলতার আশ্বাস পেয়েছে সে, যদিও খেদ রফিক এর রয়েই গেছে স্ত্রী এর অনুপস্থিতির কারণে।
যখন করোনা মহামারী তুঙ্গে তখন স্ত্রী এর করোনা ধরা পরায় পাড়া প্রতিবেশী তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। জানি ওই পরিস্থিতিতে সবারই দরকার সতর্কতা অবলম্বন করার তবে সতর্কতা অবলম্বন করেও একে অপরের সাহায্য যে করা যায় সেটা আমরা সাধারণ পরিস্থিতিতেও ভুলে যাই। কোনো রকমে একটি সমাজ সেবামূলক সংস্থার সাহায্যে পারুল কে নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তবে সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের গাফিলতির ফলে রফিক ও নিজের একমাত্র মেয়েকে বেদনায় ফেলে পরলোকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায় পারুল। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে স্ত্রী এর সৎকার করার জন্য দেহটা পর্যন্ত পায়নি রফিক এবং মাকে শেষ বারের মত দেখার সুযোগও পায়নি রফিক এর মেয়ে। দেহ পরিবারের কাছে দেওয়া সম্ভবও ছিলনা কারণ মানুষটা আপন হতে পারে রোগটাতো আর আপন নয়। তবে জীবন নদীর জলের মতো বয়েই চলে। কারুর আপনজনের সংযোজন কিংবা বিয়োজন এ জীবনের প্রবাহমানতার কোনো পরিবর্তন হয়না।
তবে আজ হয়তো এতগুলি বছরের দুর্দশার পর একটু সুখের মুখ দেখতে পেয়েছে রফিক ও তার মেয়ে।
এ দোকান সে দোকান দেখার পর রফিক তার মেয়েকে নিয়ে ঢুকলো একটি দোকানে। দোকানটি বাকি বড় বড় দোকান এর তুলনায় খুব একটা বড় কিংবা উল্লেখযোগ্য নয়। সেকারণেই হয়তো রফিক এই দোকানটিতে ঢোকার খানিক সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছে। তবে দোকানদার অন্য খরিদ্দার এর সঙ্গে কেনা বেচা করতে করতে একবার আর চোখে তাকিয়ে নিলো রফিক আর ওর মেয়ের দিকে। আসলে রফিক আর ওর মেয়ের চেহারা এবং পোশাক এই মস্ত শহরে মোটেই বেমানান নয় যেখানে বেশিরভাগ মানুষ রাস্তায় শুয়ে কিংবা স্টেশন এর সিড়ি তে শুয়ে রাত অতিবাহিত করে, তবে এই দোকানে অবশ্য বেমানান। কারণ, বাকিরা বেশ ঝা চক চকে জামা কাপড় পড়ে আছে আর সেখানে রফিক আর তার মেয়ের পোশাক খানিক নোংরা, খানিক ছিদ্র। তাই খরিদ্দাররাও খানিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে তাদের থেকে।
ছোট্ট মেয়েটি দোকান এর খুঁটি নাটি সব মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল আসলে এরকম দোকান এর আগে কখনো দেখেনিতো সে। দোকানের একজন কর্মচারী খানিক বিরক্তি মেশানো গলায় রফিক এর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে," কি চাই তোমাদের?" রফিক মৃদু স্বরে জবাব দেয়," মেয়েটির জন্য কমের মধ্যে ভালো একটা জামা দেখবেন দাদা?" লোকটি একবার মেয়েটিকে দেখে নিয়ে কয়েকটি জামা দেখতে আরম্ভ করে। তবে রফিক এর মেয়ের এর মধ্যে কোনোটিই যেনো পছন্দ হয়না। হঠাৎ সে দেওয়ালে ঝোলানো একটা গোলাপী রং এর জামা দেখিয়ে বাবাকে বলে,
" বাবা আমাকে এই জামাটা কিনে দেবে? এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।"
মেয়ের আবদারে রফিক হাসতে হাসতে বলে," মা তোমার ঐ জামা টা পছন্দ হয়েছে দাড়াও দেখছি।" এই বলে দোকানদার কে ওই দেওয়ালে ঝোলানো জামাটার দাম জিজ্ঞেস করে রফিক। তবে দোকানদারও রফিককে দেখেই বুঝতে পেরেছে ওই জামাটা কেনার সামর্থ তার নেই তাই বেশ ব্যাঙের সুরেই সে বলে," ও জামা কেনার ক্ষমতা তোমার নেই ভাই, ওটার দাম আট হাজার টাকা।" শুনে অবাক হয়ে যায় রফিক। তার মাসের আয়ই ছয় হাজার টাকা তাও এই মাসেই সে স্থায়ী একটি চাকরি পেয়েছে। আট হাজার টাকার জামা কীকরে কিনে দেবে সে মেয়েকে।
আসলে বাবারা সত্যিই কোনোদিন নিজের কথা ভাবতে শেখেনি। ক্ষমতা থাকুক এর নাইবা থাকুক সন্তানের ভালোর জন্য কিছুতেই আপস তারা করতে জানেনা। কখনো সুযোগ পেলে সন্তানের জন্য চাঁদও এনে দিত বাবারা। তবে, সন্তান কিছু চেয়েছে আর সেটা দিতে সক্ষম না হলে সন্তান এর কষ্ট যা হয় তার শত সহস্রগুণ বেশি কষ্ট হয় বাবার। সেই কষ্টটাই হচ্ছিল রফিক এর তখন। তবে ইতিমধ্যেই ঘটলো একটি ঘটনা যা সমস্ত কিছু যেনো ওলটপালট করে দিলো। দোকানের মালিক বসে ছিল দোকানের একটি কোনার দিকে কোষাধক্ষ্য এর টেবিল এ। তিনি হঠাৎ দোকানের সমস্ত কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করতে লাগলেন তার ঘড়ি কোথায়। শেষবার তিনি টেবিল এর উপরেই রেখেছিলেন।
যথারীতি সমস্ত দোকান খোঁজা আরম্ভ হলো, কারণ ঘড়িটি বেশ দামী ছিল। রফিক চুপ করে দাড়িয়ে ব্যাপার টা বোঝার প্রয়াস করছে এমন সময় এক কর্মচারী রফিক এর মেয়ের হাতের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলে," দাদাবাবু ওটাই কি আপনার ঘড়ি? ওই যে মেয়েটার হাতে।"
দোকানের মালিক এগিয়ে এসে রফিক এর মেয়ের হাত থেকে একটানে ঘড়িটা নিয়ে বললো," হ্যা এটাই তো তবে এই মেয়েটির হতে এলো কীকরে?"
আসলে রফিক এর মেয়ে কিছু না বুঝেই ঘড়িটি টেবিল থেকে নিয়ে নারা চারা করে দেখছিল। এর আগে এরকম জিনিস হয়তো সে দেখেছে তবে হাতে নিয়ে নয় তাই একবার দেখছিল। তবে এবার দোকানে উপস্থিত সকলে রফিক এর উপর চোটপাট করা আরম্ভ করে। কেউ কেউ বলে," এত ছোট মেয়েকে দিয়ে কলকাতায় এনে চুরি করাচ্ছিস।" আবার কেউ কেউ তো রফিক কে পুলিশ এ দেওয়ারও প্রস্তাব দেয়, আবার কেউ কেউ রফিক কে মারতেও পর্যন্ত উদ্যোগী হয়। এ সবকিছুই ঘটে যাচ্ছিলো রফিক এর কিছু বুঝে ওঠার আগেই। হঠাৎ কেউ একজন রফিক এর গালে সজোরে একটি চর বসিয়ে দেয় এবং অনেকে মিলে তাকে ও তার মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে দোকানের বাইরে বের করে দেয়। কয়েকজন তাকে হুমকি দেয়," এর পর থেকে এ এলাকায় দেখলে সোজা পুলিশ এ দেবো। যা বেরিয়ে যা আর যেনো এখানে না দেখি।" প্রতিবাদ করতে চাইলে রফিক করতে পারতো তবে সে করেনি কারণ সে জানতো এই শহরে তার প্রতিবাদ কেউ শুনবেনা। তাকে কেউ বিশ্বাস করবেনা যে সে চোর নয়। সে যে একমাত্র মেয়েকে শুধু সখের বশে কলকাতা থেকে জামা কিনে দিতে এসে এক ঝামেলায় পরেছে। তাই সে আর প্রতিবাদ করেনা এবং মনে মনে এই ভেবে এত অপমান এর মধ্যেও আশ্বস্থ হয় যে তাকে পুলিশ এ অন্তত কেউ দেয়নি।
রফিক এর মেয়েটিও এই অপ্রত্যাশিত ব্যাবহার এবং বাবাকে সবার কাছে মার খেতে, অপমানিত হতে দেখে কাঁদতে আরম্ভ করে। রফিক কে এরকম ভাবে বের করে দেওয়ায় কি ঘটছে এটা বোঝার জন্য হঠাৎ অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছিলো সেই জায়গায় অতি অল্প সময়ে। এত কিছু হওয়ায় বেশ অপমানিত বোধ করছিলো রফিক। অপমানিত বোধ করাটাইতো স্বাভাবিক এই পরিস্থিতে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েকে কোলে নিয়ে সেখান বেরিয়ে অপরিচ্ছন্ন জামার কলার দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে হাতিবাগান এর মোড়ে এসে শিয়ালদহ স্টেশন এ যাওয়ার জন্য বাস এ উঠে বসে। কলকাতা থেকে পুজোর বাজার আর করা হলোনা তাদের।
আসলে কলকাতা সবার জন্য বলে মনে হলেও তা নয়। মহানগর এর এই চাকচিক্য সর্বজনীন নয়। মানুষ এর বেশভুশা, মানুষ এর চাল চলন দেখেই মানুষ কে চেনার ভুল সর্বদা হয়েই চলে এই মহানগর এ। চোর নয় এমন মানুষকে চোর সাব্যস্ত করতে সময় লাগেনা বেশি আবার আসল চোরকে চোর প্রমাণ করতে কালঘাম ছুটে যায় অনেকের। তবে রফিক দের গ্রামের যদু মাইতির দোকানই অনেক ভালো অন্তত সেখানে মানুষ এর রূপ দেখে তাকে চোর সাব্যস্ত করা হয়না।
বাস এ উঠে রফিক নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুবিগলিত চোখে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি রাখলো। এতক্ষণে বেশ মুশল ধারেই বৃষ্টি নেমেছে। রফিক এর ভাগ্য দেখে আকাশও আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি অশ্রু বিসর্জন এর থেকে। ছোটো মেয়েটিও একরাশ দুঃখ মনের কোণে নিয়ে নিজেদের গ্রামে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। সেই গ্রামে যে গ্রামে নেই শহরের মত চাক চিক্য তবে আছে মাধূর্য, মনুষ্যত্ব, এবং সরলতা।।, যা মানুষ কে মানুষ বানিয়ে তোলে।
সর্বশেষে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেই বলে রফিক," তোর মা থাকলে আজকে খুশি হতনা রে মা, খুশি হত না।"
রূপংকর গোস্বামী
Baishakhi Abasan, saltlake, Ag block, Kolkata- 700091
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন