গল্প ।। সান্ত্বনা চ্যাটার্জি ।। রঙিন পাথর - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Monday, November 27, 2023

গল্প ।। সান্ত্বনা চ্যাটার্জি ।। রঙিন পাথর


রঙিন পাথর

সান্ত্বনা চ্যাটার্জি

 

আজকাল  প্রতিমা নানা রঙের পাথর দিয়ে তার ঘরসাজানো শুরু করেছে। নানান রকম কাঁচের ফুলদানি, পেটমোটা, সরু গলা, ছড়ানো এগুলো আলমারি থেকে বার করে, ধুয়ে মুছে চকমকে করে, যেটাতে যাভালো লাগে, যেমন পেট মোটাতে জল ভরে রঙিনপাথর ফেলে মনি প্ল্যান্ট, ছড়ানো পাত্রে শুধুই পাথর, কাঁচের মোম দানি, টবের গাছ, কিছু বাদ রাখেনি।এমন কি দেবেশের ছবির পাশেও কাঁচের  ফুলদানীতেরঙিন পাথর আর জলরেখে, সূর্যমুখী ফুল কিনে সাজিয়েছে। একা আপন মনে সারাদিন এ ঘরে ও ঘরঘুরে বেডায়, কাঁচের আলমারিগুলো মুছে রাখছে, ঘরেকোথাও ঝুল নেই তো, দেবেশের যে খুব পরিস্কার করাবাতিক ছিল।

        এটা নয় যে প্রতিমা নিজে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে না। কিন্তু বাডিতে এতো কাজ, তার উপর দেবেশের দীর্ঘ সময় অসুস্থ থাকায়, বাড়ি আর রোগীর সেবা দুটোতে সমান মনোযোগ দিতে পারেনি। ফলে বাড়ির কাজে ঢিলা পরে ছিল। এখন তার অখণ্ড অবসর, কেউ নেই কিছু নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস বেডিয়েআসে।

        আজ দুপুরে পুরাতন সহকর্মী মীরা এসেছিল, দুপুরটা কাটিয়ে বিকেলে ফিরে গেল। এ রকম কিছু চেনামানুষ আছে বলেই একাকিত্ব তার হৃদয়ে থাবা গেড়ে বসতে পারে না। মীরা বেশ কিছুদিন পরে এসেছে তাই প্রতিমার রঙিন পাথর প্রেম জানতে পারেনি।

দেখে বলল বাহ্ ভারি সুন্দর লাগছে তো, কতো রঙেরমেলা, মনটা খুশি হয়ে যায় । আগে তো কখনো এতো ঘর সাজানোর ইচ্ছা দেখিনি। যদি ও জানি যে দেবেশ তোকে তোর নিজের ইচ্ছা মতন চলতে দিত না কোনওদিন। এ শাডিটা কেন পডেছ পাল্টে এসো। এ কিফুলদানি টা টেবিলের উপর রেখেছ কেন?

        তোমার কোনও সৌন্দর্য বোধ নেই, এতদিনে নিজেরমত আছিস, খুব ভালো ,সব অপূর্ন ইচ্ছা পূর্ন করেনে। জীবনে আফসোস থাকবে না।

        মীরা বোঝেনি তার সহানুভূতির কথা প্রতিমার হৃদয়ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছিল। কিছুক্ষন মাথা নিচু করে চোখের জল সামলে মাথা তুলল প্রতিমা। ধরা গলায় বলল, নারে সব ব্যাপারে দেবেশ বাধা দিত না আমায়।দেবেশশাডির দোকানে এসে দুটো শাডি পছন্দ করল, আমি বললাম দেবেশ এতো টকটকে লাল সিল্ক চওড়া কালো তেজরি পার, এ বয়সে কি পডা উচিত! রেগে গিয়ে বলল কেন তুমি কি বিধবা!

        খুব ভালো মানাবে তোমায়। দুটোই বেশ দামী আর রঙচঙে, আমার একটু হাল্কা, চাপা রঙ ভালোলাগে দেবেশের ঠিক উল্টো, সেদিনের কথা আমার আজও মনে পরে, কতো ভালোবাসত আমায়।

        দেবেশের রাগটাই মারাত্মক ছিল তাই সকলেই ও কেরাগী বলেই চিনত। দেবেশের অনুরাগ শুধু আমিজানি। তাছাড়া ও মানুষ টা ছেলে মানুষের মতন সরলছিল। যা মনে হতো সবার সামনেই বলে দিত। ঠাট্টাকরলে সত্যিভেবে বসত। মানুষ তো দোষে গুণে ভরা।

 

আমার উপর দেবেশের অগাধ আস্থা আর বিশ্বাসআমাকে অনেক কাজে এগিয়ে যাবার সাহস যুগিয়েছে। সবসময় পাশে থেকেছে, সুখে দুঃখে যেকানও পরিস্থিতিতে, কখনও একলা ছাড়েনি রে আমায়। আমার সহায়আমায় ছেডে গেছে, সে যে কি বেদনাদায়কএবার প্রতিমার কথা বন্ধ হয়ে যায়।

        অঝর ধারায় চোখের জলে বুক ভাসায়।

        মীরা চুপ করে থাকে, জানে এখন কোনও কথা বলাঠিক হবে না।

        কিছু পরে প্রতিমা আঁচলে চোখ মুছে বলে, দেবেশের সংগে আমার জীবনের সব রঙ চলে গেছে। শুধু ধূসর ফাঁকা মরুভূমি।তাই তো রঙিন পাথর কিনেছি এতো, আমার আর দেবেশের প্রাণে রঙ আনবার জন্য।

        মীরা চোখ বড় করে বলে, কি বলছিস রে, দেবেশেরপ্রাণ তো শেষ হয়ে গেছে, তোর কিন্তু একা থাকা একেবারেই উচিত নয়।

        প্রতিমা মৃদু হেসে বলে, নারে ভয় পাস না, যা বলছিভেবেই বলছ। হ্যাঁ মানছি দেবেশের শরীর জীবনের সাথে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সব প্রাণই তো অনন্তঅসীম প্রাণে মিলে যায়, সেখানে না জন্ম আছে নামৃত্যু না দুঃখ নাবিচ্ছেদ। রবি ঠাকুরের গান টা শুনিসনি, আমার তো খুব প্রিয় গান। ডাকার মতন ডাকতেপারলে ঈশ্বর ধরাদেন, অসীম অনন্ত প্রাণের স্রোতেকোথাও তো আছে সে, তাই আমার জীবন রঙিনকরতে আর সে রঙ অনন্তপ্রাণে ছডিয়ে দিতে এতোরঙের বাহার এনেছি ঘরে।


Santwana Chatterjee

No comments:

Post a Comment