দুটি অণুগল্প ।। সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
পাষাণ ভারী
----
রাজীব বাবুর সঙ্গে দেখা হলো ? ছন্দার গলায় চিন্তা আর অস্বস্তির কালো মেঘ ।
পতিতপাবন ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল , তোমার জন্য জারদৌষি কাজের লেহঙ্গা পেলাম
না; বলল -- কলকাতার শপিংমলে ছাড়া পাওয়া যাবে না । উজ্জ্বল ফুসিয়া
পিঙ্ক লেহঙ্গা বললাম-- তাও না।
----- আমি বলেছিলাম তো পাবে না । যখন ওগুলো আনব তখন কুন্দন হারও এক সঙ্গে নেব। কিন্তু যে কথাটা বলেছিলাম আগে সেটার খবর কি বলো?
----- তা আমি কি ব্যাগ হাতে করে দাঁড়িয়ে থাকব?
----- সেটার কোনো উত্তর দিচ্ছ না, তাই ধরছি না।
----- বাহ -সত্যি পারো ! ধরো, বলছি । উফ্ এত ভারী যে বয়ে আনতে পারি ?
----- সংসারে যেটা ভারী সেটা নিয়ে আমি নাস্তানাবুদ খাচ্ছি ! আর উনি সামান্য এই ব্যাগটা নিয়ে ঘেমে উঠেছেন ? সত্যিই তুমি পুরুষ !
----- তুলে দেখো না আমি মিথ্যে বলছি কিনা ?
----- তোমার কথা শুনে ঘোড়ায় হাসবে। বাৎলা তো -
----- কি বলতে চাও বলো তো ?
----- কাগজটা কি পকেট থেকে চলে যাচ্ছে ?
----- হ্যাঁ । ওর জন্যই ভাবছি । তোমাকে বাজারে পাঠালাম । এক সপ্তাহ পরে মহালয়া । হুঁশ আছে ? একটা ওয়ার্থলেস । পূজার আগেই ----
---- উফ্ কি গরম ! কেন যে -- কালি পটকা না কে জানে ? জামা প্যান্ট স্খলনের সময় বলল ।
----- দেখো, বেশি বাজে বকো না ?
-----
বাবা ,আমার কিন্ডার গার্ডেন এনেছ? সে বলে পতিতপাবনের প্যান্টের পকেটে হাত
গলিয়ে কাগজের টুকরো সমেত বের করে কি কাগজ দেখছে । ততক্ষণে ছন্দা গজগজ
করতে ব্যস্ত। পতিতপাবন বাথরুমে ঢুকে হাত মুখ ধুচ্ছে ।
---- মৌরসি পাট্টা ! কোথাও যেতে পারলাম না । জীবনটা কয়লা করে ছাড়বে।
---- মনা প্যান্টের পকেটে কাগজটা তোর মাকে বের করে দে তো ।
----- ওমা আমি পাইনি। আমি তো কিন্ডার নিলাম । পতিত প্যান্টের সব পকেট মানিব্যাগ সহ জামার পকেটে খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না ।
----- তুমি এনেছ এই কথাটা বললেই তো হতো ?
---- বললে ? তুমি মাথায় করে নাচাতে ?
----- বাজে কথা বলো না তো । সংসারে ভারবাহী ঝামেলা হটাও । টাকা রোজগার করো ব্যয় করতে শেখো?
-- অ্যায় মনা কাগজটা কোথায় পড়ল রে ?
-- জানিনা। কি আছে তাতে ?
-- বৃদ্ধাশ্রমের ফোন নম্বর, পার হেড কত দিতে হবে তার একটা কাগজ । তারিখটাও লেখা ছিল।
-- তোমার মনে নেই লিখে আনতে হল?
--
ওটা কি আমি লিখেছি ? সাদেক ভাই অনেক গুলোর নাম ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে
একটা নাম বলে দিয়েছিল নামটা পেটে আসছে মুখে আসছে না। কাগজটা পেলে --
তাছাড়াও সেটা খুলিনি।
-- ফ্যান চলছে উড়ে গেল নাকি দেখো ?
মনার ঠাকুরদা ঠাকুরমা পাশে খাটে বসেছিলেন । চোখ যেন শরৎ শিশির স্নাত তৃণের মতো। ফোঁটা পড়ছে না ডগায় ধরে আছে। চিকচিক করছে।
-- অ্যায় মনা, তুই তো সাদা কাগজটা নিলি দাদুভাই ?
-- না দাদু আমি ওটা দেবো না । মনা বলল ।
-- কেন ? দু'ঘা দিলে টের পাবি ? ছন্দা বলল ।
-- না আমি ওটা লুকিয়ে রেখেছি। আমার ওটা লাগবে ।
-- আরে ওটা দে তোর মাকে । বাঁদরামো করিস না।
--
না বাবা, আমি দেব না । তোমরা যখন বৃদ্ধাশ্রমে যাবে তখন আমি ঠিকানা পাব
কোথায়? আমি ওটা আলমারিতে প্রোগ্রেস রিপোর্টের সাথে রাখব । আমি দেবোই না।
ছন্দা কালকেউটের মতো ফুঁসছে ।
পথ ও নিঃস্বতা
হন্যে হয়ে মেয়েটা ঘুরছে ! আজ তিন মাস গত হলো দাদা বৌদি ঘর ছাড়া । এখানে কোনও জীবিকার পথ না পেয়ে বাধ্য হয়ে কোলের একমাত্র পুত্র ছোটনকে নিয়ে ভিন দেশে পাড়ি দিয়েছে । কখনও গাছ তলায়- নদীচরে- মাঠে -বাজারে ঘুরে মন স্থির করতে পারছে না কি করবে । মা শয্যাশায়ী । বাবা গত বছর কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের পেটে । খাল -বিল- নদী- নালায় ভরা সুন্দরবনের জনজীবনের ভাগ্য লিপি বড়ই বৈচিত্র্যময় । বাবা গত হওয়ার পর দাদা সুরৎ সংসারে অর্থনৈতিক কারণে বেকায়দায় পড়েছে । বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে কিছু অর্থ জোগাড় করে মা বোনের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে অপেক্ষা করেনি ।
একটা সোমত্ত বিবাহযোগ্যা মেয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় কখন পেটে জুটছে -কখনও নেই এই অবস্থায় সুযোগ সন্ধানী বিকাশ -মথন - নটবরদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। ফাউ খেতে অসুবিধা কোথায়? কাঁহাতক প্রতিবেশীরা সহৃদয়তা দেখাবে । উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা মেয়েটাকে কে কি ভাষায় বোঝাবে ? অভাব সম্বন্ধে নতুন কোন সংজ্ঞা তার জানা নেই । কেবল প্রতিকারের পথ অনুসন্ধান ছাড়া।
সুলুক সন্ধানের দল মাছ ধরার মতো বঁড়শিতে আধার দিয়ে নাচায় । না হলে নটবর কেন বলে, দাদা বলেছিল একটা আনকোরা নতুন জিনিস উপহার দিলে আমার ঘরের লোনটা পাস করিয়ে দিবে । মথনও উপযাজকভাবে জুয়ার জেতা টাকা থেকে করকরে একশ' টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল , কথা শুনলে আরও পাবি ; পাঁচশ' হাজার কি লাগবে ! সোনায় সোহাগা বানিয়ে দেব ।
একটা রোজগার পাইয়ে দেবার হাতছানি । মনে মনে ভাবে এটাও তো উপকার ! মানুষের অসহনীয় বিপদে ভদ্রভাবে বাঁচার জন্য পথ দেখানোয় ক'জন এগিয়ে আসে ? কিন্তু ওরা তো সেই সহৃদয় ব্যক্তি নয় ।
নটবরের দাদা বলতে নির্বাচিত স্থানীয় দাপুটে নেতা । কীইবা ওর রুচি ! বয়সে যথেষ্ট বড় এবং বিবাহিত । আসলে ক্ষমতায় থাকলে তার স্বাদ চেটেপুটে খায় যারা তারাই তো দেশসেবার নামে শপথ নিয়েছে । মিনতিকে একদিন নটবর ডেকে নিয়ে বলল ; --- যাবি ? চল্ দাদার কাছে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কত মানুষের না উপকার করে ! মিনতি সম্মতি দিলে নিয়ে গেল দাদার চেম্বারে । দাদা নির্বিঘ্নে একাকে বসিয়ে রেখে সবাইকে চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। নামধাম জিজ্ঞেস করার পর মিনতি বলল , আমায় কাজ দিন যাতে অসুস্থ মাকে নিয়ে থাকতে পারি ।
----- নটবর কি তোমাকে আমি চাকরি দেবার এক্সচেঞ্জ অফিসার বলেছে ? আমি তো তা নয় । অস্থায়ী কাজ দেবো।
----- কি কাজ?
------ নো ওয়ার্ক নো পে । যেদিন কাজ করবে সঙ্গে সঙ্গে প্রেমেন্ট করে দেব । আমি যেদিন বলব সেদিন আমার সঙ্গে সময় দিতে হবে । ব্যস।
সে কেমন গোঁতা মেরে বলল , কাজটা যখন জানতে পারলাম না বুঝবো কি করে যে ওটা ভালো কাজ?
----- তোমাকে ব্যবসায় নামিয়ে দেব । প্রথম প্রথম আমার সঙ্গে যেখানে যেতে বলব-- যাবেই। তারপর -- ও লাইনে টাকা উড়ছে । শুধু ধরতে পারলে হয়।
----আমাকে এই কাজে না লাগিয়ে অন্য কোনও কাজ দিন না বাবু । বুঝেছি ওই কাজে টাকা আছে মান নেই।
----- ঠিক আছে । ভেবে দেখো কেমন ? যদি সম্মতি থাকে আগামী দিনের জন্য পথ খোলা আছে । ফোন নম্বর দেবো নাকি?
----- ঠিক আছে দিতে হবে না । আসছি । প্রয়োজন মনে হলে ফোন করে জানাব।
সে উঠে চলে আসল। বাড়িতে এসে শয্যাশায়ী মাকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে ।
================
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা
পিন কোড :743347
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন