স্কুলটা
অঞ্জনা গোড়িয়া
বছর পাঁচেকের অর্পিতা। ঘরের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছে। মা খাবার নিয়ে হাজির।" তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও সোনা।এখুনি ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। কী এত দেখছ? " অর্পিতা আজ আর কিছু বলল না।
মা স্কুল ড্রেস পরিয়ে দিল। পরিপাটি করে সাজিয়ে ক্লাসের জন্য প্রস্তুত করে দিল। কিছুক্ষণের জন্য মা কী একটা কাজে ঘর থেকে বেরিয়ে ছিল।
ঘরে এসে দেখে অর্পিতা ঘরে নেই। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
মা কাঁদোকাঁদো হয়ে আজ বলে ফেলল। ক'দিন ধরে বায়না করছে, আমায় স্কুলে নিয়ে যেতে হবে। নইলে একা চলে যাবো।
কোনো কথা শুনব না। কিছুতে ঘরে থাকব না। এই ভাবে আর কতদিন ভুলিয়ে রাখবে? আমি যাবো স্কুলে। সত্যি সত্যিই মেয়েটা আজ ---- ----কেঁদে ফেলল মা।
যেমন মিষ্টি স্বভাব তেমন মিষ্টি একটা মেয়ে। মুখে মুখে মুখস্থ করেছে বেশ কিছু ছড়া। মায়ের কাছে একটু একটু করে লিখতে পড়তে শিখেছে। আপন মনে রঙ পেন্সিলে আঁকতে শিখেছে গাছ পাখি ফুল ফল আর স্কুল।
এবছর তাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করার কথা । যেদিন থেকে শুনেছে সেদিন থেকে বায়না,"কবে স্কুলে যাবো? স্কুল কেমন দেখতে? স্কুলে কারা থাকে? কী হয়? কেমন করে থাকতে হবে ? অর্পিতার মনে কৌতুহলের শেষ নেই।
কাছাকাছি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। সেখানেই মেয়েকে ভর্তি করতে একদিন নিয়ে গিয়েছিল স্কুলে।
এপ্রিল মাস থেকেই নতুন ক্লাস শুরু। অর্পিতার আর তর সইছে না।
সমস্ত কিছু প্রস্তুত।নতুন জামা জুতা মোজা, ট্রাই স্কার্ট বই খাতা আরও কত কী? সব ঠিক ছিল।
কিন্তু তারপর সব চুপচাপ।স্কুলে যাওয়ার কথা জানতে চাইলে , একই উত্তর "আর কিছুদিন পর সোনা। এখন ঘরে থাকো। "
আর স্কুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। এখন জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি মানুষ। কিন্তু ছোটো অর্পিতা ওত বোঝে না।
হটাৎ একদিন মা একটা স্মার্টফোন হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,এটাই তোর স্কুল।
এখানে পড়াশোনা করতে হবে।
এখানে টিচার আছে। যা জানাবে তাই শিখবে। এটাই তোমার অনলাইন ক্লাস ঘর।
ছোট্ট মেয়ে অর্পিতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোবাইলের দিকে। প্রশ্ন করে মাকে, আমি যাবো না মা সেই দূরের স্কুলে? সেই বড় বিল্ডিংটায়। যেখানে আছে সাজানো ফুলের বাগান। কত ঘর। চেয়ার টেবিল আরও কত কী ।অর্পিতা ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছিল সারা স্কুল টা।
আজ যখন ফোনের মধ্যে দিদিমনিদের মুখ গুলো দেখছে।সবাই স্কুলের পোশাক পরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোনের ভেতর। কেউ ঘুম ঘুম চোখে কেউ বা খেলায় মেতে। দিদিমণি ফোনের ভেতর থেকে ই ডাক দিয়ে ওঠে, সাইলেন্স প্লিজ। everybody present now.
হেডফোন কানে বসে ফোনের সামনে। মা ও বসে মেয়ের পাশে। কাছে এসে দিদিমণি পড়া ধরে না। ফোনের ওপার থেকে শুধু পড়া আর লেখা। এ এক আজব চিড়িয়াখানা। অর্পিতার কিছুতেই ভালো লাগে না বিছানায় বসে পড়া পড়া খেলতে।
কিন্তু তা বলে, আজ সত্যি সত্যিই মেয়েটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। কেউ ভাবতে ও পারে নি।
এই করোনার পরিস্থিতিতে সবার মুখে দুঃশ্চিতার ছাপ। বেশ কয়েক ঘন্টা পর পাড়ার রাহুল বাড়ি এসে খবর দিল, অর্পিতাকে পাওয়া গেছে। আমাদের পাড়ার প্রাইমারি স্কুলের সামনে।
কিছুতেই আসতে চায় না। তাই খবর দিতে ছুটে এলাম।
বড় একটা তালা ঝুলছে স্কুলে। তার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে স্কুলের ভেতর। মা দৌড়ে গেল মেয়ের কাছে।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শোনালো সেই খুশির খবর । খবরের কাগজে বড় বড় করে লেখা, সামনের বছরে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই আবার স্কুল খোলা হবে। সরকারি বেসরকারি সমস্ত স্কুল। আর কিছু দিন একটু অপেক্ষা।
অর্পিতা খবরটা শুনে মায়ের হাত ধরে নাচতে নাচতে বাড়ি এলো।
হাসতে হাসতে ফোনটা হাতে নিয়ে শুরু করে দিল অনলাইন ক্লাস। এখন এটাই স্কুল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন