কাকলী দেব
(1)
ছোট বেলার থেকে সোনালী শান্ত স্বভাবের। তারা মফস্বলে থাকত। সেখানকার বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে।
জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড় হয়েছে সে। বাবা যখন মারা গেল তখন তার মোটে তিন বছর বয়স। কিছুই মনে নেই। দাদা ন্যাড়া মাথা হয়েছিল আর খুব কাঁদছিল। এইটুকুই স্মৃতি! তার থেকে তিন বছরের বড় দাদার বয়স তখন ছয়। বাবার মুখ তার আর মনে নেই। বড় হয়ে ফটো দেখে, যেটুকু চেনা। কাকা জ্যাঠাদের সংসারের গলগ্রহ হয়েই তাদের তিনজনের জীবন কেটেছে। মা উদয়াস্ত খাটত। কাকীমা জেঠিমাদের সন্তুষ্ট রাখতে চাইত সবসময়। বাবার সামান্য রোজগার ছিল আর জমানো টাকা পয়সা মা'র কিছুই ছিল না। শুধু খেয়ে পড়ে, ছেলে মেয়ে কে নিয়ে যে বেঁচে থাকতে পারছে এই কৃতজ্ঞতা বোধেই মা সবসময় নুইয়ে থাকত। মাথার ওপর ছাদ থেকে যে তাদের কে এ বাড়ীর লোকেরা বঞ্চিত করেনি এই ভেবেই মা খুশী। শতশত অপমান, অবমাননার শিকার হয়ে মায়ের দিন কেটেছে। কিন্ত কিছুই গায়ে মাখেনি। কোনরকম অভিযোগ করেনি। ' কপালের লিখন ' বলে মেনে নিয়েছে।
সোনালী তাই সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। প্রতিদিন শুনেছে, দেখেছে, মেনে নিতে হবে সব কিছু। আপোষ করেই বেঁচে থাকা উচিত। মেয়ে জন্মের সার্থকতা সেটাই ! তাই তার মানিয়ে নেওয়ার অসীম ক্ষমতাও জন্মে গেছে।
দাদা ও ঠিক তাই। সবাইকে খুশী রাখতে গিয়ে তারা নিজেদের খুশীর হদিস করেনি কখনও।
সোনালীর সুশ্রী চেহারা, চামড়া র রঙ টা সাদা। তাই গ্র্যাজুয়েশনের আগে থেকেই বিয়ের কথা চলতে লাগল।
সোনালী লেখাপড়ায় বেশ ভাল, বন্ধুদের দেখেছিল অনেকেই মাস্টার্স ডিগ্রি করবে। সোনালীর মনের কোণে এরকম ইচ্ছা জাগলেও সে জানত কাকা জ্যাঠারা তাকে বা দাদা কে যে গ্র্যাজুয়েশন অবধি পৌঁছে দিয়েছে সেটাই অনেক। এর বেশী তারা আশাও করেনা। ভাল সেলাই করতে পারে সে। ছুঁচ সুতোর মধ্যে দিয়ে নানারকম ডিজাইন ফুটিয়ে তোলে । অসাধারণ এমব্রয়ডারির করার হাত তার! যখন সেলাই করে তখন সে সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যায় ! এই ধরনের কাজও যদি কোথাও আরও শিখে নিতে পারত তাহলে একটা টাকা রোজগারের উপায় হত।
কিন্ত না, সেটাও সম্ভব নয়, কিছু শিখতে গেলেই পয়সা লাগবে। বিয়ে করতে তার একটুও ইচ্ছে করতনা, তবে এছাড়া উপায় কি ? মাও চাইছে তার বিয়ে যত তাড়াতাড়ি হয়ে যায় তত ভাল, মা র কপালের চিন্তার ভাঁজ গুলো তাহলে বোধহয় একটু কমবে। দাদা চারিদিকে হন্যে হয়ে চাকরীর চেষ্টা করছিল, একটা ছোট প্রাইভেট কোম্পানির ছোটখাট একটা কাজও পেয়ে গেল ! মার বিষন্ন মলিন মুখে ঈষৎ হাসি দেখা দিল।
হঠাৎই ছোটকাকা একটি সন্বন্ধর প্রস্তাব নিয়ে এল। সোনালীর বয়স তখন মাত্র বাইশ বছর। ছেলে না বলে পাত্রকে লোকই বলা ভাল। লোকটির বয়স ছত্রিশ, মানে তার থেকে সে চোদ্দ বছরের বড়। বাবা মা এবং এক ভাই। সংসার ছোট, পাত্রের বাবা রিটায়ারড হয়েও তখনও আবার চাকরী করছেন। পাত্র বাবার মতই একটা প্রাইভেট কোম্পানির অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এহেন সুপাত্র হাতছাড়া করাটা বোকামী হবে, ছোট কাকা জোর দিয়ে বললেন।
সত্যিই তো সোনালীর এর থেকে ভাল বিয়ে কেমন করে সম্ভব! মা ও চাইছে, এই বিয়ে হয়ে যাক। সোনালীর রাজী হওয়া না হওয়া অত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। যদিও সোনালী মেনে নিল, খুশী হল নাকি দুঃখিত, নিজেই বুঝতে পারল না। অত বোধ বুদ্ধি কী আর তখন ছিল তার ?
পাত্রের গায়ের রঙ ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ! তাদের বাড়ীর সবাই তাই। তাই তারাও ফর্সা, কমবয়সী এই মেয়েটিকে হাতছাড়া করতে চাইলেন না।
হবু শাশুড়ী চালাক মানুষ, তিনি দেখলেন, এইরকম মফস্বলের, শান্ত, অল্প বয়সী মেয়েকে কাজে লাগাতে সুবিধে হবে। সুতরাং বিয়ে হয়ে গেল সোনালীর সঙ্গে সুব্রত পালের। বিয়ের আগে ছবি দেখেছিল দুজনে দুজনের। শুভ দৃষ্টির সময় চাক্ষুষ দেখল। নিকষ কালো গায়ের রঙ, চওড়া গড়ন, থ্যাবড়া নাক, তবুও সব মিলিয়ে মন্দ নয়। সোনালী মেনে নিল, যে, এখন থেকে এই তার স্বামী। ' পতি পরম গুরু ' এই বেদ বাক্য জন্ম ইস্তক শুনে এসেছে। তাই মেনে নিতে কোন অসুবিধাও হলনা। যাক তার জীবনের দায়ভার তো নিল এই লোকটা। সুব্রতর বেশ ভাল লাগল, এত কম বয়সী মেয়ে পেয়ে সে ভীষণ খুশী হল। আর ফর্সা চামড়ার ওপরে তার ভীষণ লোভ!
সুব্রতদের আদি বাড়ী গ্রামের দিকে কিন্ত কলকাতায় জন্ম কর্ম। ছত্রিশ বছরের জীবনে দু তিন জন মেয়ের সঙ্গে ভালবাসা হয়েছিল, একটায় তো শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল। সেই মেয়েটি তাদের আগের ভাড়া বাড়ী র এক ভাড়াটে ছিল। মা জানতে পেরে, তাকে সেখান থেকে বের করে আনে। কারণ মেয়েটি ছিল ছোট জাতের। তারপর থেকে, মার প্রতি ভক্তি তার আরও বেড়ে গিয়েছিল।
চাকরির পুরো মাইনে এনে চিরকাল ই মার হাতে তুলে দিয়েছে। তার বয়স বাড়ছে, বিয়ের ইচ্ছা তার ছিল কিন্ত মুখ ফুটে বলতে পারত না। বুঝতে পারত যে তারই মাইনের টাকা দিয়ে মা গয়না গড়াচ্ছে। এ বাড়ীর নতুন ফার্নিচার কিনছে। অবশেষে বাবা ই তদ্বির করে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন বিয়ের জন্য।
সোনালী বিয়ের পর এল কলকাতার শ্বশুর বাড়িতে। প্রথম উত্তেজনার ঘোর কাটল, বিয়ের দ্বিতীয় দিনে যখন শাশুড়ীর অর্ডার এল, সেদিন থেকে সংসারের সব রান্নার কাজ সোনালীকেই করতে হবে, কারণ এতদিন এই সংসারের জোয়াল টেনে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। এবার তার আরাম করার পালা। সোনালী পড়ল অথৈ জলে।
সোনালীর ঠিক রান্না করার দরকার হয়নি বাপের বাড়ীতে। কারণ অতজন মা কাকীমা জেঠিমাদের পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢোকা হয়নি। তবে প্র্যাকটিকাল অভিজ্ঞতা না থাকলেও থিওরিটিক্যালি সোনালীর সব জানা। শুনে শুনে, দেখে দেখে সে সব রান্নাই অল্প বিস্তর জানে। কিন্ত এইভাবে পাঁচজন লোককে রান্না করে যে কী করে খাওয়াতে পারবে এই ভাবনায় তার রাতের ঘুম উড়ে গেল। এদিকে সুব্রতর শরীরের ক্ষিদে মেটাতে হচ্ছে, রাত এমনিতেই নির্ঘুম কাটছে। এখানেও সোনালীর অনভিজ্ঞতায় সুব্রত মাঝে মাঝে বিরক্ত হচ্ছে। তার এত বছর ধরে জমানো পাকা পোক্ত জ্ঞানের সম্ভার!
ভোর ভোর উঠে পড়ে সোনালী নাইটি ছেড়ে শাড়ী পরে নিয়ে সংসার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিত। শাশুড়ীর পছন্দ নয় সে ম্যাক্সি পরে ঘুরঘুর করে। প্রথম দিন থেকেই তার কড়া নির্দেশ বার্তা দিয়ে দিলেন। সোনালীর বাপের বাড়ী তে এইটুকু স্বাধীনতা ছিল, তার কাকা জ্যাঠাদের সামনে তাদের বোনেদের ম্যাক্সি পরায় কোনও বাধা ছিল না।
সকালের চা করে, জলখাবার বানাতে হত, এক একদিন এক একরকম, সুব্রত আর তার ভাই এর একটু আবদার থাকত এটা ওটা খাবারের, সোনালীর ভালই লাগত!
শ্বশুর আবার ফরমান জারি করলেন, হাওয়াই চটি পরে বাড়ীর মধ্যে থাকা তিনি পছন্দ করেন না। আড়াল থেকে একদিন শুনে ফেলল, শ্বশুর মশাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির ভদ্রলোককে বলছেন, " আজকাল কার মেয়েদের কোনও ভব্যতা জ্ঞান নেই, সারা বাড়ীময় ফটর ফটর আওয়াজ তুলে চটী পরে সব ঘুরে বেড়াচ্ছে !"
অথচ তার ছেলেদের বেলায় এ নিয়ম লাগু নয়। শ্বশুর নিজেও রবারের চটি পরেই থাকেন বাড়ীতে। সোনালীর বুঝতে অসুবিধাও হয়না, সে বাড়ীর বউ , এইমাত্র! এই পরিবারের কেউ নয়। অন্তত এ বাড়ীতে স্বামী ছাড়া আর কেউ সেরকম ভাবে বলে মনে হয়না। মেনে নিল সোনালী। এই তো নিয়ম, এমনটাই তো হয়। স্বামীও তার শরীরটা ভালবাসে, তাকে ভালবাসে বলে মনে হয়না। অবশ্য ভালবাসা ঠিক কী, একথা সোনালী নিজেও বোঝেনা। এত ভাবনা চিন্তার ক্ষমতা তার ছিলনা সেই বয়সে।
(2)
সোনালীর এখন পঞ্চান্ন বছর বয়স। কেটে গেছে জীবনের দীর্ঘ তেত্রিশ বছর। চুল পেকেছে। চামড়া কুঁচকেছে, গায়ের রঙ জ্বলে বাদামী হয়েছে। সংসার যুদ্ধে সে পর্যুদস্ত ঠিকই, কিন্ত সে ফুরিয়ে যায়নি এখনও। তার জীবনের সমস্ত ঝড় ঝাপটা সে মেনে নিয়েছে। ভাগ্য খারাপ তার, তাই হয়েছে এসব। কোনও দিন মনে করেনি, তার সঙ্গেই কেন এতসব হল? শাশুড়ীর অত্যাচার শারীরিক ছিল না , কিন্ত মানসিক অত্যাচার সহ্য করা আরও কষ্টের ! ' মেয়েদের নীরবে সব সহ্য করতে হয়।' তার মা শিখিয়ে গেছে। 'মেয়েরা প্রতিবাদ কেন করবে? ওটা মেয়েদের শোভা পায়না। '
তাদের প্রথম সন্তান ছেলে। বাড়ীর সবার অত্যন্ত আদরের। গায়ের রঙ, বা মুখশ্রী তার মায়ের মতই হল। দাদু ঠাকুমার চোখের মণি । এমন ফর্সা নাতি পেয়ে তারা যারপরনাই খুশী হলেন। তবে সোনালীর অবস্থানের কোনও পরিবর্তন ঘটলনা। নাতি তো তাদের নিজের জিনিষ, ছেলের বউকে তাই বলে নিজের ভাবার কোনও কারণ নেই ! সোনালীর কাজ তখন আরও বেড়ে গেছে। শিশুটি কে আদর করা ছাড়া শাশুড়ী কোনও দায়িত্ব নিতে চাইল না। হিমশিম খাওয়া সোনালীর সব কষ্ট মুছে যেত শিশুপুত্রের মুখখানা দেখলে । এত সুন্দর তার ছেলে, যেন বিশ্বাস হয়না ! তার জীবনে প্রথম একটা ভাল জিনিস পাওয়া ! ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করেছিল! শাশুড়ী নাম দিলেন 'সুহাস ', তার মত অনুযায়ী সংসার চলে তাই সোনালীকে মেনে নিতে হল যদিও তার নিজের একটুও পছন্দ হলনা নামটা। শুধু সংসারে শান্তি বজায় রাখতে চেয়ে কোন কিছুর প্রতিবাদ করতে সে ভুলেই গেছিল তাই অগত্যা মেনে নেওয়া।
তবে নিজে ডাকত " দীপ্ত " বলে। দীপ্ত বাবু
বড় হচ্ছিল যত, দুরন্ত হচ্ছিল তার থেকে বেশী। ছোটখাট বাজার হাট সোনালীকেই করতে হত। বাড়ীতে শ্বশুর শাশুড়ী উপস্থিত থাকলেও, দুধ আনতে যেত সোনালী।
অত সকালে সুব্রত একটু আয়েসের ঘুম ঘুমায়। দেওর নিজের লেখাপড়া করে। কাজেই বাড়ীর দুধ আনত সে।
রোজকার মত সেদিনও বেরিয়েছিল। ছেলেকে রেখে গিয়েছিল শাশুড়ীর কাছে। তিনি নাতির বায়না সামলাতে না পেরে তাকে বাড়ীর সামনে মাঠে খেলার জন্য পাঠালেন। এ পাড়ার বস্তির ছোট ছেলের দলের সঙ্গে তার যত খেলা !
হঠাৎই নাতি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী চলে এল। হাত দিয়ে একটা চোখ চাপা দিয়ে রেখেছে। " কী হল, কী হল " বলতে বলতে দাদু ঠাকুমা ছুটে এসে দেখল , রক্তে গাল ভেসে যাচ্ছে, নাতি ও তারস্বরে কেঁদে যাচ্ছে। " সুব্রত, শিগগিরই আয়, কী সর্বনাশ হল দ্যাখ!" শাশুড়ী চীৎকার করে ওঠেন।
এমন আতঙ্কের ডাকে সুব্রত, ওর ছোট ভাই দৌড়ে এল। ইতিমধ্যে সোনালী দুধ নিয়ে ফিরে এসে দেখল, এই ব্যাপার। সব ফেলে দিয়ে ছেলে কোলে নিয়ে, সুব্রতকে বলল, " এক্ষুনি হসপিটাল যাব, ট্যাক্সি ডাক।"
দেওর বেরিয়ে গেল , কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যাক্সি নিয়ে এল। তারা তিনজন গেল হসপিটালে।
সোনালীর এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে সব। তারপর কত হসপিটাল কত ডাক্তার করা হল! কলকাতার বড় বড় চোখের ডাক্তার ও ছেলের একটা চোখ বাঁচাতে পারলনা।
তিনবছর ধরে নানা চিকিৎসার পরে বোঝা গেল, একটা চোখ সম্বল করেই ওকে জীবন কাটাতে হবে। চেন্নাই পর্যন্ত যাওয়া হল। কিছুই হলনা। একটু বড় হল যখন, তখন ঐ চোখ টা পাথরের বানানো হল। সোনালীকে মেনে নিতে হল! লেখাপড়ার মাথা ভাল, এক চোখ নিয়েই ভাল স্কুলে পড়াশোনার পাট শেষ করল। সুব্রত সামান্য কেরানীর চাকরি করেছে আজীবন, খুব আশা ছিল ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবে।
দেওর ততদিনে বিয়ে করে আলাদা থাকে। তার বউ কর্মরতা, ফলে শ্বশুর বাড়ির কোনরকম ঝামেলা সে নেবেনা।
দীপ্ত ইংলিশ নিয়ে পড়তে চেয়েছিল ।কিন্ত তার বাবা জোর করে অন্য শহরে একটা প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারীং কলেজে পড়তে পাঠাল ছেলেকে।
ছেলেটা ছুটী ছাটায় আসত বাড়ীতে, কিন্ত একটু মনমরা হয়ে থাকত। জিজ্ঞেস করলে বলত, " মা, আমার ইঞ্জিনিয়ারীং পড়তে ভাল লাগেনা, আমি তো ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে পড়তে চাই। "
সোনালী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, " মাত্র তো চারটে বছর, পাশ করে তুই আর বাবার কথা শুনিস না তখন তোর যেটা মন চাইবে করবি। "
এরকমই সেবার বাড়ী থেকে ঘুরে ফিরে গেল হোস্টেলে।তারপর একদিন ভোরবেলা মোবাইল বেজে উঠল সুব্রতর, ছেলের কলেজের ফোন এল।
ছেলেকে নাকি তার রুমে পাওয়া যাচ্ছেনা। সে কি আবার কলকাতার বাড়ীতে এসেছে, এটাই ছিল ওদের জিজ্ঞাস্য !
সোনালীদের মাথায় বজ্রাঘাতের মত হল! ছেলে বাড়ীতেও আসেনি, কলেজেও নেই, তাহলে কোথায় সে? মোবাইল সুইচড্ অফ আসছে। শ্বশুর ক্যান্সারে অনেক ভুগে ইহলোক ত্যাগ করেছে। চিকিৎসার খরচ তুলতে, ছেলের কলেজের ফিজ্ দিতে সুব্রতর জেরবার হবার জোগার! সুব্রতর বয়েস হয়েছে। নানারকম এজেন্সী করে এই বয়সেও খেটে মরছে। সে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। শাশুড়ী আর সোনালী বাড়ীতে থাকল, হাজার দুশ্চিন্তা বুকে চেপে।
সুব্রত তিনদিন পরে ফিরে এল, ওখানকার থানায় এফ আই আর করে। খাওয়া দাওয়া করার মত আর অবস্হা নেই তাদের। শাশুড়ী তার ঠাকুর ঘরে হত্যে দিয়েছে। সোনালী শয্যাশায়ী। সুব্রতর দিকেও তাকানো যাচ্ছে না।
সাতদিন পরে দরজার বেল মাঝরাতে বেজে উঠল। তারা দুজনে হুড়মুড় করে গিয়ে দরজা খুলে দেখল, প্রায় অর্ধ উলঙ্গ, ছেলে দরজার বাইরে পড়ে আছে। সারা গায়ে নোঙরা মাখা, মাথার চুল কাঁধ অবধি উশকো খুশকো। মুখ থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে। তাড়াতাড়ি ধরাধরি করে তাকে ঘরে নিয়ে আসা হল। ছেলের অস্ফুট কথার থেকে তেমন কিছুই বোঝা গেল না। তবে সে যে প্রাণে বেঁচে বাড়ী ফিরে এসেছে, তাতেই তারা খুশী। পরদিন শাশুড়ী একটু হাউমাউ করে কাঁদার চেষ্টা করলে তাকে থামানো হল যে এখন এই অবস্হায় পাড়া প্রতিবেশীকে কিছু না জানানোই ভাল। কলেজে শুধু জানিয়ে দেওয়া হল একথা। থানা থেকে এফ আই আর তুলে নেওয়া হল।
প্রায় দিন দুই অসম্ভব ঘুম ঘুমানোর পরে ছেলে যখন কিঞ্চিত সুস্থ তখন তার কাছে জানতে চাইল সোনালী। ঠিক কি ঘটেছিল?
সুহাস যেন হাসতে ভুলে গেছে, " মা, আমি আর যাব না কলেজে। আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই না। ওখানে সিনিয়ররা আমার সারা গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছিল ragging
এর সময়ে। আমি তোমাদের বলিনি। এবার ন্যাড়া ছাদে নিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করিয়ে হাঁটতে বলেছিল। আমি কোনওমতে ওদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছি। বাবা বকবে বলে বাড়ী ফিরতেও পারছিলাম না। গত তিনদিন আমি কিছু খাইনি, শুধু রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। "
সোনালী বুকে জড়িয়ে ধরে দীপ্ত কে। তারপর একবছর লাগল ছেলের মানসিক ভাবে একটু সুস্থ হতে। কিন্ত হতাশা
অবসাদ ততদিনে ওকে ঘিরে ফেলেছে। কোনরকম ভাবে অন্য একটা প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে অনলাইন ক্লাস করে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করল।
দীপ্তর ঘরের দরজা সবসময়ই বন্ধ থাকে। শুধু খেতে আর বাথরুম ব্যবহার করতে বেরোয় ঘর থেকে। মাঝে মাঝে বাড়ী থেকে বেরিয়ে সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে ফিরে আসে। অনেক পরে তারা বাবা মা বুঝতে পারে, ছেলে সিগারেট, মদ এমনকি গাঁজা খাওয়াও ধরেছে। সোনালী মেনে নিতে চেষ্টা করে। ছেলে তার চোখের সামনে আছে, এইটুকুই তার বিরাট শান্তি। ছেলে সুস্থ নেই, তবে বেঁচে তো আছে। সোনালী মানিয়ে নিচ্ছে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে। গত দশ বছর শাশুড়ী হোম ডেলিভারির খাবার খেলেন। বিনা কারণে তার সঙ্গে ঝগড়া করে। এখন নিউমোনিয়া হওয়াতে কিছুদিন হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরে এসে ঘোষনা করলেন, এবার থেকে বাড়ীর খাবারই খাবেন আগের মত।
শাশুড়ীর সেবায় আবার নতুন করে লাগতে হল সোনালীকে। সুব্রত আর দীপ্তর রান্নার পাট চুকিয়ে বৃদ্ধার জন্য আলাদা করেই রাঁধতে হয় ! যদিও তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ কিন্ত তার এই শেষ বয়সের বায়নার ঝক্কি সোনালীকে পোয়াতে হচ্ছে! তবে সে হাসিমুখে না হলেও মেনেই নিচ্ছে। শাশুড়ী, স্বামী পুত্রের সেবা করলে যে কতখানি পুণ্য সঞ্চয় হয়, সে তো জানে, শিখেছে ছোট থেকে।
সব কিছু মানতে মানতে, সোনালীর নিজের চাওয়া পাওয়ার হিসেব আর মেলাতে পারে না। সে নিজে কী কী খেতে ভালবাসত এতদিনে সেটা বেমালুম ভুলে গ্যাছে। তার যেন কোন চাহিদা, আকাঙ্খা বা ইচ্ছা আর নেই।
অনেকটা রোবট বা মেশিনের মত; সে সকাল থেকে উঠে, অন্যের চিন্তায় , সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
*************************
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন