Featured Post
স্মৃতিকথা ।। মনের স্মৃতিতে ।। দীপক পাল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মনের স্মৃতিতে
দীপক পাল
দুর্গাপুজো আমি বলতে গেলে আমার দীর্ঘ জীবনে তিন রূপে উপভোগ করেছি। ছেলেবেলা, যৌবনে বিয়ের আগে ও পরে, আর চাকরি থেকে অবসরের পরে অর্থাৎ বার্ধক্যে। সে যে ভাবেই হোক, আমার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভালো লেগেছে। এর মধ্যে আমি ছেলেবেলার কথাটাই বলবো যা ছিল বড়ো মধুর। আমার বাস ছিল মধ্য কলকাতার এন্টালী অঞ্চলে। আমাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি তিনটে দুর্গাপূজা হতো। দেব লেনে দেববাবুর বাড়ির বহু পুরাতন একচালার দুর্গাপুজো। এ বাড়ির দুর্গা দালানে একমাস আগে থেকে কুমোররা মাটি এনে ঠাকুর গড়তো। তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা থাকতো জমিদার বাড়িতে। আমরা প্রতিদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একবার ভিতরে প্রবেশ করে দেখে আসতাম। মনে মনে সেইদিন থেকে আমাদের পুজোর আনন্দ লেগে যেত। বড়ো রাস্তার ধারে আমাদের বাড়ির অদূরে জাঁকজমক পূর্ণ দুর্গা পূজা হতো শহীদ স্মৃতি সংঘের। এই পূজার সঙ্গে বহু বিখ্যাত জন যুক্ত ছিলেন। শ্রদ্ধেয় পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবির খলনায়ক শ্রী কামু মুখোপাধ্যায়ের বাবা বালাই মুখোপাধ্যায় সঙ্গে বিশিষ্টজনদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলতে আসতেন। এই পূজোর বিশেষত্ব ছিল - বড়ো প্যান্ডেল। ভিতরে প্রবেশ করলেই সামনে দেবীমূর্তি আর বাম আর ডানদিকে খোপে খোপে মা দুর্গার সৃষ্টি থেকে মহিষাসুর বধ পর্যন্ত ইতিহাসটা পর্যায় ক্রমে সাজানো হতো। তার সাথে লেখনীও থাকতো। তাই প্যান্ডেলে সব সময় ভীড় হতো। এ ছাড়া দেব বাবুর বাজারের মধ্যে ছিল চড়ক তলা। সেখানেও ধুমধাম করে দুর্গাপূজা হতো। একবার পায়ের গোড়ালিতে কাঁচ ফুটে সেপটিক হয়ে গেছিল। আমার বড়দা একদিন ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে আমার পায়ের গোড়ালি অপারেশন করিয়ে কাঁচ বের করে, আর ব্যান্ডেজ করিয়ে আনে। সেবার পুজোতে বেরোতে পারছি না। তাই ছিল খুব মন খারাপ। বাড়ির সবারই মন খারাপ। মা ছাড়া সবাই কিন্তু বেরোচ্ছে ও খাওয়ার সময় ফিরছে।অষ্টমীর দিন সকালে মনমরা আমাকে কোলে নিয়ে বড়দা ওই তিন দিকের তিনটে ঠাকুর দেখিয়ে এনেছিল। বড়দার খুব কষ্ট হয়েছিল আমাকে কোলে করে ঠাকুর দেখিয়ে আনতে। তাই মা বড়দাকে চা বানিয়ে দিয়েছিল সেইদিন।
এরপর সেই বড়দা আর মেজদা চাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেলো। দিদি, আমি আর সেজদা থাকলাম। আমি আর সেজদা ছোটদের লাইব্রেরীতে ভর্তি হলাম। আমাদের কোনো কোনো বন্ধুও মেম্বার হলো। আমার জানার একটা দিক খুলে গেলো। যদিও মাসিক শিশুসাথী রাখতাম আমি আর সেজদা রাখতো মাসিক শুকতারা। পুজোসংখ্যাও হতো দুটো। লাইব্রেরীর ঘরটার পাশে ছিল এন্টালি বয়েজ ইউনিয়ন ক্লাব। সেই ক্লাবের সেক্রেটারির নাম জানতাম না। সবাই তাকে বাবুছেলেদা বলে ডাকতো। ওনাদের বাড়িতেই ছিল ক্লাব। মা বাবা হয়তো আদর করে বাবুছেলে বলে ডাকতো। পরবর্তীতে সেই নামটাই হয়েছিল প্রচলিত। তিনি ব্যায়াম করতেন, গায়ে তার ছিল অসীম শক্তি। বাবুছেলেদা আমাদের মাঠে নিয়ে গিয়ে ব্রতচারী করা, প্যারেড করাতো, ও বিভিন্ন শারীরিক ব্যায়াম করাতো। এছাড়াও ফুটবল খেলাত খুব। বাবুছেলেদা আমাদের নিয়ে গিয়ে অন্য কোনো ক্লাবের সাথে ম্যাচ খেলাতো। বয়স আর চার ফুট দশ ইঞ্চির উচ্চতায়। আমরা ম্যাচ জিতে বাবু ছেলেদার মুখে হাসি ফোটাতাম।একবার হয়েছে কি, পুজোর দিন ব্রতচারী করছি। এদিকে একটা ষাঁড় এসে বাবুছেলেদার ভাই বাবলিদাকে মেরেছে এক মোক্ষম ঢুঁ। বাবলিদার ডান পাটা একটু ছোট ছিল, তাই পা টেনে টেনে হাঁটত। ষাঁড় গুঁতিয়ে বাবলিদাকে ফেলে আবার ঢুঁ মারতে যাচ্ছে, বাবলিদার পারিত্রাহি চিৎকারে বাবুছেলেদা ছিটকে গিয়ে ষাঁড়ের শিং দুটো চেপে ধরলো। ষাঁড়ও বাধা পেয়ে বাবুছেলেদাকে মাথা দিয়ে সামনের দিকে ঠেলতে লাগলো। বাবুছেলেদা ওর শিং টাকে ধরে মাথা তুলতে না দিয়ে, ভাইকে বাঁচাতে ষাঁড়কে পেছনের দিকে ঠেলতে লাগলো। আশ্চর্য ঘটনা, ষাঁড়টা রণে ভঙ্গ দিয়ে চলে গেলো।
এক পুজোর দিন আর এক কান্ড ঘটলো। আমরা বড়ো রাস্তার ধারে মাঠে খেলতাম।বল প্রায়ই রাস্তায় চলে যেত। দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসতে হতো। এমনি করে দুটো বল বাসের তলায় ফেটেছিল। বাবুছেলেদার বন্ধুরাও প্রসাদদা, গুপীদা, হুরোদারাও খেলতে আসতো। বলটা হুরোদার পায়ে লেগে রাস্তায় গিয়ে পড়লো। হুরোদা ছিল মোটাসোটা. থপথপে, স্লো। বলের উদ্দেশে পা ছোঁড়া ছারা আর কিছু করতে পারত না। যে বল পায়ে লাগাতো, সে বল কোথায় যে যাবে তার কোনো ঠিক ছিল না। ওই ভাবেই বল রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। হুরোদাই বলটা আনতে গেলো। ততক্ষণে এক গরুর গাড়ি কিছু জিনিস নিয়ে এসে গেলো বলের প্রায় সামনে। হুরোদা যে বল আনতে গিয়ে কি করলো কে জানে হঠাৎ ' উ: ' বলে বিকট চিৎকার করে ডান পাটা ধরে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে এসে ফুটপাথে বসে পড়লো। দেখে শিউরে উঠতে হয়। বাবুছেলেদা বললো 'কি রে, শেষ পর্যন্ত গরুর গাড়িতে চাপা পড়লি? তুই তো কলকাতার ছেলে।' শেষ-মেষ বাবুছেলেদাই রিকশা ডেকে চ্যাংদোলা করে হুরোদাকে নিয়ে চলে গেলো। পরে শুনি পায়ে অনেক উঁচু পর্যন্ত প্লাস্টার করে ব্যান্ডেজ করে পরে আছে। রেস্ট নাকি তিনমাস।
একবার ঠিক হলো প্রভাত ফেরি বার করা হবে। সেই মতো একজন এসে গেলো গান শেখাতে। দুটো গান বাছা হলো। একটা ষষ্ঠীর দিন ভোরের জন্য ' শরতের এই সোনালী প্রভাতে শিউলি আঁচল ছাড়ায়ে, এসেছ কি তুমি ওগো ও জননী ' , আর একটা অষ্টমী পূজোর দিন ভোরে 'মহা অষ্টমীতে এসেছ জননী স্মরিয় দমন সন্তানেরে, স্নেহের পরশে উথলী হরষে বন্দনা করি তোমারে'। প্রসাদদার গানের গলা ছিল ভালো হারমোনিয়াম ও বাজাতে পারত। দুদিনের সিটিং লাগলো তার। এরপর আমাদের টানা রিহার্সেল। সঙ্গে থাকতো আদা নুন। ষষ্ঠীর ও অষ্টমীর ভোর চারটেতে বাবুছেলেদা ডেকে যেত। আমিও চটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তাম। প্রসাদদা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে পিছু হাঁটত অতি ধীরে, আমরাও সাথে সাথে গাইতে গাইতে পথ পরিক্রমণ করতে করতে যেতাম। পরিক্রমা হয়ে যাবার পর ক্লাবে ফিরে লুচি আলুর দম সহযোগে চা পান করে বাড়ি আসতাম। খুব ভালো লাগতো।
এদিকে মেজদা পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায় বাড়ি এসে গেলো। থাকবে দুসপ্তাহ। কিন্তু বড়দা চিঠি দিয়েছিল দুদিন আগে, যে কাজের চাপে পুজোয় আসতে পারবে না। তাই সবার মন ভালো ছিল না। ষষ্ঠীর দিন ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরতেই মা বললো টেবিলে একটা পোস্ট কার্ড আছে, পড়ে দেখ। পোস্ট কার্ডটা হাতে নিয়ে তাতে চোখটা বোলাতেই মনটা ভরে গেলো। বড়দা আসছে আজ, সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে। পূজোর উৎসব যেন এবার সম্পূর্ণ হলো।
-০-০-০--০-০--০-০-০-
Address :-
---------
Dipak Kumar Paul
DTC Southern Heights
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata-700104.
Contacts: 9007139853
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন