ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর ও আমরা
সুদাম কৃষ্ণ মন্ডল
কথিত আছে সীতার অশ্রুতে তমসা নদী -- আর অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে রক্তে ঘামে মেধা ও কৌশলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। এই সত্য ইতিহাসে মলিন হবেনা । সূর্য্য- চন্দ্র- নক্ষত্র -নদী -সাগর থাকবে যতদিন ঠিক ততদিন স্মৃতির মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে ।
সংস্কারের স্তব্ধতা নেই। যেমন আলোকতনুধারী আকাশ প্রতি মুহূর্তে তার বৈচিত্র্য রূপ ধারণ করে ঠিক তেমনি প্রতিটি মানুষও প্রতি মুহূর্তে প্রাপ্তির জলযোগটাও বা চাহিদা নতুন অবকাশে পেতে চায়। সব পাওয়া এক নিমেষে হয় না। অসম্ভব যা তা হাতের নাগালে নেই। সম্ভবপর যা তা আগে পেতে চায়। এই সম্ভাবনায় দুর্লভ সততা বিলোপ করে লোভ -লোলুপতা -লালসা -আত্মসর্বস্বতা- স্বার্থপরতা -সংকীর্ণতা অবলম্বন করে উপেক্ষা- বঞ্চনার মানসিকতা থেকে একশ্রেণীর স্ব-ঘোষিত নেতা-নেত্রী মিথ্যাচারের প্রশ্রয়ে স্বাধীনতার নির্মম সত্যিকে এবং অন্তর্নিহিত অর্থকে স্বেচ্ছায় ভারতীয় কৃষ্টি -সংস্কৃতি -উন্নয়ন ভাবধারার মানবিক মুখকে পদদলিত বা ভূ-লুণ্ঠিত করছে।
এই আগুনের শিখায় সর্বোপরি ভারতীয় মর্যাদা- আত্মসম্মান- গৌরবের উন্নত মাথাকে ক্রমে ক্রমে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র এবং প্রাদেশিক ক্ষেত্রে নীচু করছে যা আমরা ভুক্তভোগী,আজ তা মেনে নিতে পারছি না। তার মধ্যেও কিছু ভালো মানুষ স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করে কিছু জনহিতৈষী কাজ করেছেন। অন্তর্নিহিত অর্থও উপলব্ধি করেছেন। পঁচাত্তর বছর কম সময় নয় একটা মানুষের আয়ুর সমান । অনেক কিছু করা যেত কিছু অশিক্ষিত নির্বাচিত প্রতিনিধি মন্ত্রীমহোদয় স্বাধীকারের প্রভাব খাটাতে গিয়ে উন্নয়নের বিকৃতি ঘটিয়েছেন । ফলে প্রাপ্তিযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে জনগণ । আজও অভাব-অনটন অশিক্ষা সমাজবিরোধী সন্ত্রাসে- অপুষ্টিতে -বৈষম্য ধর্মান্ধতায় -শোষণ-বঞ্চনায় উল্লেখযোগ্য একটা বড় সংখ্যা ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রদেশে। যারা আদিবাসী অনুন্নত সম্প্রদায় উপেক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ ক্ষেতমজুর -চাষী -অসংগঠিত শ্রমিক তাদের উন্নতির জন্য সাড়া জাগানো বিপ্লব ঘটেনি। তেমন ভাবে ক্লিষ্টতার হাত থেকে বাঁচাবার পথ দেখানো হয়নি। আজও দেশব্যাপী ভূমি সংস্কার আমুলভাবে হয়নি। আজও দেশব্যাপী অসংগঠিত শ্রমিকের কোনও সংবিধানস্বীকৃত নিয়োগপত্রসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পায়নি। যার হাত আছে ভাত নেই।
শতসহস্র বিপ্লবী আছেন -সমাজ সংস্কারক আছেন -গায়ক- কবি-সাহিত্যিক কূটনীতিবিদ শুভানুধ্যায়ী আছেন- প্রচারক পত্রিকা যাদের অবদান স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে । কাকে বাদ দিয়ে কার নাম লিখবো । শ্রেণিচেতনা ভারতীয় মুক্তমনা ভাবধারার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে - মহাজ্ঞানী গুণীজনেরা আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাকে ধূলিস্মাৎ করছে ভারতের অধ্যুষিত আঞ্চলিক ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতি দলগুলি । ফলে জল চাইলে জলপাই পাচ্ছি চাল চাইলে চালতা পাচ্ছি। হিংস্রতা বাড়ছে স্বার্থের নেশা বাড়ছে। দ্বন্দ্ব তো আছেই । রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই । আর আমরা ? আমরা দর্শক -বধির- বোবা হয়ে দেখছি। পাইয়ে দেবার রাজনীতিকে ঘৃণা করছি না। স্বার্থ পাওয়ার রাজনীতিতে নির্ভর করে মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। খুন-ধর্ষণ -রাহাজানি রক্তচক্ষু আমলা মন্ত্রিত্বের অবচেতনায় ও গোপন ঈশারায় আমরাও হিংসাশ্রয়ী হয়ে পড়ছি । দুর্নীতি কর্কট রোগের সামিল।
সবুজ শস্য শ্যামলা সোনালী আত্মনির্ভরশীল দেশের নাগরিকের লক্ষ্যে , বিজ্ঞান আধুনিকতা প্রযুক্তিনির্ভর নির্ভরশীল ভারতবর্ষ গড়ার লক্ষ্যে বস্তাপচা নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিতে হবে । চাপানউতোর সংসদে যেন না হয় । যে দেশে হতদরিদ্র মানুষ কারও কিছু অর্থ গহনা হারিয়ে গেলেই পুলিশের কাছে ফেরৎ দিয়েই সততার উজ্জ্বল প্রতিভূ হয়ে ওঠে, আর সেই পুলিশের একাংশ আর নেতা মন্ত্রী রাজকোষ আর সাধারণের সম্পদ লুট করে সম্পদের পাহাড়ে বসেই নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর সাহসও রাখে।
আমরা কেমন আছি একথা কবি-সাহিত্যিক সমাজবিজ্ঞানীরা যত ভালো অনুভব করবেন সাধারণ মানুষ সম্পর্কে- গ্রামবাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে- হয়তো ঢের বেশি জানার অধিকার অনুভূতিবোধ আর কারো নেই । কোর্ট-কাছারি বিদ্যালয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রভাবমুক্ততায় আমরা বাঁচতে চাই । নিরপরাধ নিরন্ন নিঃস্ব মানুষের দায় সম্পর্কে স্বাধীনোত্তর ভারতের যুক্তরাষ্ট্র পরিকাঠামোয় মুখে যা বলা হয় তার দশমিক কিছু অংশ সেবা যদি হতো তাহলে আশ্বস্ত হতাম। পিছিয়ে পড়া মানুষের কথায় আমরা প্রতারিত হচ্ছি। দেশের আইন শাসকের পক্ষে । হাতের পুতুল করে যেমন খুশী নাচাতে পারে। দেশের স্বাধীনতার স্বাদ আপামর সাধারণ মানুষের কাছে দুর অস্ত । এটা বাস্তব যে ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভগুলিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আত্মসমালোচনা -আত্মসমীক্ষা কারোরই তুলনামূলকভাবে সার্বিক হচ্ছে না । নারী শিক্ষায় এখনো সার্বিক অগ্রগতি হয়নি । শিশুশ্রমিক সর্বক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি । নারীকে পণ্য ভোগ্য সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ফলে আমরা পঁচাত্তর বছরের কিছু প্রাপ্তিযোগ এর সাথে উপেক্ষা ও হতাশা নিয়ে প্রতিটি পরিবারে আছি । এই দায় সকলের । এই দায় রাষ্ট্রের । এই দায় পরস্পর সম্মিলিতভাবে স্বীকার করে সুস্থ সমাজ সংস্কারমূলক অর্থনৈতিক জীবনে কি করে আসা যায় তার জন্য ভাবতে হবে।
কম্পিউটারের প্রবেশে লক্ষ কোটি মানুষ বেকার হয়েছে । তারপরেও দেশে চাকরি ক্ষেত্রে পদ খালি লক্ষ লক্ষ । কিন্তু বেকার নিয়োগ না করে যুব মানসের মনকে চুরমার করা হচ্ছে । অজুহাত অর্থনৈতিক সংকট প্রযুক্তির অভাব নয় অভাব দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বিচক্ষণ নির্বাচিত প্রতিনিধির । মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা বিদেশে চলে যাচ্ছে। যার আছে বেশি সে আরও চাওয়ার জন্য রাজনীতিতে বাস্তু ঘুঘুর আনাগোনা । নিত্য দলবদল ব্যক্তি স্বার্থের কারণে । কারণ অকারণ ন্যায়-অন্যায় ছেঁদো যুক্তিতে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। আমরা কাঁহাতক এই লেজুড়বৃত্তির দিন অতিবাহিত করব ?
পঞ্চায়েতিরাজকে সর্বস্তরের সর্বাঙ্গীণ নিষ্কলুষ ভাবে সারা ভারতবর্ষে কাজে লাগাতে পারছে না অশিক্ষিত নেতৃত্বের জন্য । মাথায় বসে বিকৃত স্বার্থলোভী কুরুচিকর প্রতিনিধি। নতুন দল নিয়মিত গঠন করে মানুষের মানসপটে জাদুর খেলা দেখাচ্ছে । মান-অভিমান ভূলে আমাদের স্বাধীকার বোধে উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিক প্রাপ্তিতে যা পেয়েছি আর যা পাইনি মূল্যায়ন করে আরো বেশি সচেতন হতে হবে কারণ আমাদের রক্তক্ষয়ে অর্জিত জন্মগত অধিকার। আমরা মানুষ- আমরাই পারি - আমরা সব প্রাণীর থেকে অধিক বুদ্ধিমান। আমরাই সততাকে অবলম্বন করে সদুপায়ে সত্যি আইন নির্দ্ধারণে সচেষ্ট হলেই সব সম্ভবপর। সকলস্তরের কাজে আচরণে পারস্পরিক দুর্মূল্য বিশ্বাসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেই প্রাপ্তি - অপ্রাপ্তির ধোঁয়াশা পরিস্কার হবে। আসুন সেই উদ্দেশ্যকে সাফল্য দিতে সর্বতভাবে চেষ্টা করি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন