Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

প্রবন্ধ ।। অনুগ্রহের অর্থনীতি ও তার বিষময় ফল ।। রণেশ রায়

অনুগ্রহের অর্থনীতি ও তার বিষময় ফল 

রণেশ রায়



ভূমিকা:

খুবই দুঃখজনক যে রাষ্ট্রের গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি সাহায্যের
হাত বাড়িয়ে সমাজে তাঁদের মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করা, তাঁদের মধ্যে যে
সুপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে তার বিকাশ ঘটিয়ে তাকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে
লাগানো, বিপুল জনশক্তিকে সংস্কৃতিবান করে তোলার বিষয়টা আজ ভারতের মত তথাকথিত
সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনে শাসকগোষ্ঠীর হাতে হাতিয়ার হয়ে
উঠেছে।গরীব সাধারণ মানুষের শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়ে তাকে অনুৎপাদনশীল খাতে
প্রবাহিত করে দেওয়া হচ্ছে।এটা শুধু ব্যক্তি মানুষকে জাহান্নামে পাঠাচ্ছে তাই
নয় সমাজও জাহান্নামে যাচ্ছে। মানুষের অধিকার বোধ আত্মসম্মানবোধ ধ্বংস হচ্ছে।
মানুষ নিজের ওপর ভরসা না করে পরজীবী অনুৎপাদনশীল জীবে পরিণত হচ্ছে। একে
কেন্দ্র করে লুঠ চুরি দাঙ্গা বেড়ে চলেছে। দেশের অর্থনীতি একধরনের খয়রাতির
অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে।মেহনত করে নিজের
অধিকার বজায় রেখে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ লোপ পাচ্ছে। মানুষের ইজ্জত বলে কিছু
থাকছে না।সঠিক পথে উন্নয়নের দিশা থাকছে না, তা বিপথে চালিত হচ্ছে। শাসকের
ধমকানিতে জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে।আর এ সবই হচ্ছে তথাকথিত সাংবিধানিক
গণতন্ত্রের নীতি মেনে। এই বিষয়টা নিয়ে আজকের আমার এই প্রতিবেদন।

খয়রাতি অর্থনীতির পশ্চাদপট:

আজ পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতে এক সর্বগ্রাসী অনুদান তথা খয়রাতির অর্থনীতি চালু
হয়েছে।তার ওপর দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতি সংস্কৃতিতে এক বিকৃতি এসেছে। এই বিকৃত
অর্থনীতির সূত্রপাত অনেক আগেই, কার্যত কংগ্রেস আমল থেকেই।আজ পশ্চিমবঙ্গসহ
সাড়া ভারতে একে আরও উলংগ নির্মম করে তোলা হয়েছে যার ওপর দাঁড়িয়ে এক
স্বৈরাচারী শাসন চলছে।কার্যত এই খয়রাতির অর্থনীতিই শাসগোষ্ঠীকে ক্ষমতা ধরে
রাখার মদত যোগাচ্ছে।হ্যাঁ বলছি কংগ্রেস আমলেই এর সূত্রপাত। তবে সূত্রপাতটা
হয়েছিল রেখে ঢেকে একটা নীতিকে সামনে রেখে নীতিগত ভাবে এর গ্রহণযোগ্যতা বজায়
রেখে ঠিক স্বাধীনতার পর যখন ব্যাপক মানুষ এই নীতিগুলোকে প্রগতিশীল বলে মনে
করতেন। কিন্তু এর অপব্যবহার, একে কেন্দ্র করে সুবিধাবাদকে সরকার প্রশ্রয়
দিয়ে কার্যত এক ধরনের অনুগ্রহের খয়রাতির নীতিকে কার্যকরী করে তুলেছে যা আজ
শাসকের হাতে বিষবৃক্ষ হয়ে উঠেছে কিছু উন্নয়নের কর্মসূচির মুখোশে। কংগ্রেস
আমলে গৃহীত কিছু নীতি আমরা তুলে ধরছি উদাহরণ হিসেবে। শুরু করা যাক অর্থনীতিতে
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দিয়ে আর তার সঙ্গে সরকারি বিভাগে সরকারী চাকুরীর সুযোগ
বৃদ্ধি নিয়ে। যখন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে পরিকল্পনার অর্থনীতি ভারতে চালু হয়
১৯৫১ সালে তখন তা ব্যাপক জনসমর্থন পায়। প্রয়াত জহরলাল নেহেরু তখন ভারতের
প্রধান মন্ত্রী। যদিও নিজেদের বেসরকারি বিভাগে কাঠামো তৈরির স্বার্থে ভারতে
টাটা বিড়লারাও পরিকল্পনার অর্থনীতি চেয়েছিলেন তার রূপ রেখ নির্ণয়ে (বোম্বে
পরিকল্পনা যেটা গৃহীত হয়) সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাও জনসমর্থনের ঘাটতি
ছিল না। এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিভাগ গড়ে ওঠে অর্থনীতির কাঠামো তৈরিতে।
সাধারণ মানুষের টাকা রাষ্ট্রীয় পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরে ব্যাংক
ইন্সুরেন্স সবই এই পুঁজি যোগানের উৎসক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। নীতিগত ভাবে একে
বিরোধিতা করা যায় না। এর সঙ্গে সরকারি বিভাগে প্রচুর নিয়োগ বাড়ে। কিন্তু
দেখা যায় এর অপব্যবহার ঘটে। নিপুণভাবে একে চালাবার কোন প্রয়াস দেখা যায় না,
একে রাষ্ট্রের তত্বাবধানে রেখে নৈপুণ্য দেওয়ার চেষ্টা হয় না। একধরনের
সুবিধেভোগী দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মচারী একে নিজেদের মোশাহেবির জায়গা,
ফাঁকি মেরে ঘুষ খেয়ে আখের গোছানোর জায়গা করে তোলে। এর ফলে এখানে বিনিয়োজিত
সাধারণ মানুষের পুঁজির নিষ্কাশন (drain) হতে থাকে। সরকারি উদ্যোগের ওপর অনীহা
বাড়ে। কার্যত সরকারি বিভাগ আজকের অনুদানের অর্থনীতির পূর্বসূরি হয়ে
দাঁড়ায়। আজ বেসরকারিকরণের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সরকারি ক্ষেত্রগুলো একের পর এক
বেসরকারি কর্পোরেট বিভাগ জলের দামে কিনে নিচ্ছে। এই বিভাগগুলো সুবিধেবাদি
একধরনের কর্মচারীর কাছে যেমন অনুদানের অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় আজ বেসরকারি
কর্পোরেট বিভাগেরও এই কম দামে কিনে নেওয়াটা একধরনের অনুদানের বা খয়রাতির
অর্থনীতি। বি এস এন এল কয়লা উড়ান বীমা কোম্পানির বেসরকারিকরন এই বার্তাই বহন
করে। এমন কি শিক্ষা স্বাস্থ্য বিভাগে বেসরকারি বিভাগ থাবা বাড়ায়। দেখা যাবে
হয়তো সরকারি স্কুল ও হাসপাতাল বড় পরিকাঠামো সহ বিক্রি হয়ে যাবে জলের দামে।
রাজনীতিতে অধিষ্ঠিত কাউন্সিলর থেকে আরম্ভ করে এম এল এ এম পি সবাই এর অঢেল
সুযোগ পাচ্ছে। তাদের আকাশ ছোঁয়া মাইনে নানা ধরনের অঢেল সুবিধা তার সঙ্গে কাট
মানি। এরাই জনদরদী বন্ধু। পশ্চিম বঙ্গে ত্রিশ বছরের বাম রাজত্বও একে
নিয়ন্ত্রন করতে পারে নি। দেখা যাচ্ছে এককালের অনুসৃত জনপ্রিয় কল্যাণমূলক
নীতিগুলো অপব্যবহারের ফলে তা সময়কালে অনাকাঙ্খিত অনুৎপাদনশীল খয়রাতি নীতিতে
পরিণত হয়েছে।এর সুযোগ নিচ্ছে করপরেট দুনিয়া আর আজকের শাসক গোষ্ঠী আর তার দল।

এবার আসা যাক সংরক্ষণের নীতিতে। সরকারের নেতৃত্বে কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে গরীব
মানুষের নিজের অধিকারে নিজেকে দাঁড়াবার জন্য অসম প্রতিযোগিতার মুখে বর্ণ
ভিত্তিক ভারতীয় সমাজে কেবল গরীব নিম্ন বর্গের মানুষের জন্য সংরক্ষণের
প্রয়োজন ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা বংশ পরম্পরায় চালু করে তাকে একটা
সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর আখড়া বানিয়ে তোলা হয়েছে। দেখা হয়নি যে নিম্ন বর্ণের
মানুষের মধ্যেও ধনী সুবিধেভোগী একটা সম্প্রদায় আছে। কার্যত সংরক্ষণের সুবিধা
এরাই মূলত ভোগ করেছে ও করছে। নিম্নবিত্ত বনে যাওয়ার হাতিয়ার বানানো হয়েছে
তপশিলিভুক্ত মানুষদের জন্য তৈরি হওয়া সরকারি অফিসকে যেখানে কার্যত
নিম্নবর্ণের শংসা পত্র বিক্রি হয়। আমার পরিচিত কয়েকটি ব্যবসায়ী পরিবার নিম্ন
বর্গ না হয়েও এই শংসা পত্র জোগাড় করে বংশপরম্পরায় এর সুযোগ নিয়ে চলেছে।এটা
ব্যতিক্রম নয়। এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ দলিতদের অধিকারের নামেও সারা
ভারতে এটা চলছে। ফলে প্রকৃত গরিবদের সুবিধা হচ্ছে না। কার্যত একে সামনে রেখে
এক ধরনের খয়রাতির অর্থনীতির বীজ বপন হয়েছে যার শিকড় বহু তলে বিস্তৃত। এর
ফলে মানুষের আত্মমর্যাদা থাকে না গরিবদের মধ্যে বিভাজন দেখা যায় মানুষ
মেহনতের মর্যাদার কথা ভুলে যায়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণের মধ্যেও কাজের
সুযোগের অভাবে দারিদ্র বাড়ছে। এরাও সুযোগ পাওয়ার দাবিদার হয়ে উঠছে। সরকার এ
ধরনের সাহায্য করার প্রকল্পে মানুষের অর্থনৈতিক বিষয়টা তেমন গুরুত্ব দেয় না
বলে বর্ণ ধর্ম নিয়ে বিভেদের পথ খুলে যাচ্ছে। আজ এই নীতিগুলোর অপব্যবহার হয়ে
চলেছে, এগুলো অপরাধের প্রযোজনীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে যা পশ্চিমবঙ্গে উলংগ
রাজার জন্ম দিয়েছে। গণতন্ত্র সংবিধান সবকিছুকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে এক
স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে।

আজের খয়রাতি অর্থনীতি ও পশ্চিমবঙ্গ:

পশ্চিমবঙ্গে সরকার মানুষকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করার নামে খাদ্য শিক্ষা
স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০২২
সালের মধ্যে গোটা চল্লিশ প্রকল্প চালু করেছে যা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে কোন না
কোন ভাবে বেষ্টন করে আছে। এদের মধ্যে বেশিটাই ন্যুনতম নগদ দিয়ে সাহায্য করা।
মেয়েদের সাইকেল দেওয়া ঘরে ঘরে রেশন পৌঁছে দেওয়া রোগীর চিকিৎসায় সাহায্য
করা সরকারি নিয়োগ সংস্থায় নাম থাকা যুবকদের চাকুরী না পেলে আর্থিক সাহায্য
করা গরীব ঘরের মেয়েদের টাকা দিয়ে 'লক্ষীর ভান্ডার' পূর্ন করা ইত্যাদি। এর
সঙ্গে আছে ক্লাবকে বা বারোয়ারি পূজায় অর্থ সাহায্য দেওয়া। আমরা নিচে
কয়েকটি প্রকল্পের নাম উল্লেখ করলাম। কিন্তু স্বল্প পরিসরে এখানে প্রকল্পগুলো
নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়।

মাতৃযান প্রকল্প, মধুর স্নেহ প্রকল্প,শিশু সাথী প্রকল্প,কন্যাশ্রী প্রকল্প,
যুবস্রী প্রকল্প,শিক্ষা শ্রী প্রকল্প, গতিধারা প্রকল্প,খাদ্য সাথী প্রকল্প,
স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প,লক্ষী ভান্ডার প্রকল্প,মোট চল্লিশটি প্রকল্প প্রভৃতি
কয়েকটা উদাহরণ।

উল্লেখযোগ্য যে এর মধ্যে কতকগুলো কেন্দ্রের প্রকল্পের অনুরূপ। কিন্তু কোন
প্রকল্পই মানুষকে উপযুক্ত মজুরি দিয়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে না। অর্থাৎ
মানুষের খেটে রোজগার করে খাওয়া পরার তাগিদকে সন্মান দেয় না। সরকারি অনুগ্রহে
কোনমতে বেঁচে থাকার ওপর জোর দেওয়া হয়। অথচ এর জন্য অঢেল টাকা খরচ। দেশের
উৎপাদন বাড়ানোর জন্য খরচ হয় না। এই বিপুল টাকা পুঁজি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না।
সেই অর্থে খরচটা আর্থিক নিষ্কাশন। আর মানুষকে ক্ষমতার তাবেতে রাখার চেষ্টা
যাতে নির্বাচনে ভোট পাওয়া যায়। এর পরে প্রশ্ন ওঠে টাকাটা সত্যি কতটা কার
কাছে পৌঁছয়। এর থেকে আঞ্চলিক স্তরে রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা বখরা পায় কি না।এই
প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন কর্মী নেতাদের মধ্যে বাদ বিবাদ খুনোখুনি আমরা
প্রায়ই দেখি, খবর পাই। তারপরও প্রশ্ন সবকটা প্রকল্প কিভাবে কার্যকরী হয় বা
আদৌ হয় কি না। যেমন ধরুন স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প। কার্যত সরকারি হাসপাতালে
গরীব মানুষের জন্য বিনা পয়সায় চকিৎসা ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই আছে। এটা নতুন
নয় অর্থাৎ এটাকে নতুন স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প বলা চলে না। তবে প্রয়োজনের
তুলনায় হাসপাতাল খুব কম থাকায় বিনা খরচায় চিকিৎসার সুযোগ খুব কম মানুষ পেয়ে
থাকে। গ্রামে গঞ্জে যতটুকু স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে সেখানে কঠিন রোগের চিকিৎসার
পরিকাঠামো নেই। যেতে হয় শহরে। শহরে রোগীকে নিয়ে চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা
প্রান্তিক মানুষের নেই। চকিৎসা অধরাই থাকে। তাছাড়া হাসপতালে ভালো চিকিৎসা হয়
না বলে প্রচার আছে। আর সরকারি অফিসের গাফিলতির কথা আমরা আগেই বলেছি। তাই যারা
ঘটি বাটি বিক্রি করে হলেও ভালো চিকিৎসা চায় তারা নার্সিং হোম এ যায়।আর
আর্থিক সঙ্গতি যাদের যথেষ্ট তারা হাসপাতাল বর্জন করেছে। এখানেই স্বাস্থ্য
সাথীর কার্যকারিতা।স্বাস্থ্য সাথী কার্ড থাকলে সরকার স্বীকৃত নার্সিং হোমে
চিকিৎসা বিনামূল্যে করানো যায়। সরকার নার্সিং হোমকে টাকা দিয়ে দেয়। এখানে
প্রশ্নটা থেকে যায়। নার্সিং হোম যেগুলো এই প্রকল্পের আওতায় আসে তারা খুব কম
আসন স্বাস্থ্য সাথীর জন্য রাখে।আর দেখা গেছে যাদের যোগাযোগ আছে একটু উচ্চবিত্ত
তারাই এর সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের বক্তব্য হলো যাদের অর্থ আছে আর সামাজিক
মর্যাদার জন্য হাসপাতালে যায় না তাদের এই সুযোগ দেওয়া মানে গরীব মানুষদের
বঞ্চিত করা। আর সরকার থেকে টাকা পাবার সুবিধা পায় নার্সিং হোমগুলো।একে
হাসপাতাল বেসরকারিকরণের প্রথম পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। এতে হাসপাতালের ওপর
আস্থা আরও কমবে। আর সরকারি পুঁজি তথা জনগণের টাকায় লাভবান হবে বেসরকারি
প্রতিষ্ঠান।গরীব মানুষের উপকার হবে না। বিভিন্ন প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করলে এই
ধরনের নানা ছিদ্র ধরা পড়বে যার ভেতর দিয়ে বয়ে চলবে মুনাফার ফল্গুধারা,
সমাজের দুর্নীতি আর রাষ্ট্রের ফাঁকা আওয়াজ। নিষ্কাশিত হয়ে চলবে সামাজিক
পুঁজি যা উন্নয়ণের কাজে লাগতে পারত।আর এই প্রকল্পগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে
নগদে অনুদান দেওয়ার দিকটা গুরুত্ব পায়। তাই দেখা যায় মানুষের পরিশ্রম করে
রোজগারের গুরুত্বকে অমান্য করা হয়। মানুষের সংস্কৃতিতে বিনা পরিশ্রমে
খাওয়াযর প্রবণতা বাড়ে। তার মর্যাদা বোধ হারায় ।

বাজার অর্থনীতির দুটো দিক:

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বাজার ব্যবস্থার দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করব
যা আমাদের মূল আলোচনাকে বুঝতে সাহায্য করবে। দুটি দিকের মধ্যে একটি হল যোগানের
দিক আর একটি হল চাহিদার দিক। বাজার ব্যবস্থা মনে করে দেশে যদি উৎপাদন বাড়ে
তবে কলে কারখানায় ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োগ বাড়বে। কর্মে নিযুক্ত মানুষের হাতে
টাকা আসবে। কেনাকাটা বাড়ে। কেনাকাটা বাড়ে মানে চাহিদা বাড়ে। সরকারের বিশেষ
সাহায্য ছাড়াই অর্থনীতির চাকা ঘুরতে থাকে। উৎপাদন হওয়া মানে যোগান বাড়া।
আবার চাহিদার দিক দিয়ে বলা হয় চাহিদা বজায় রেখে তাকে বাড়িয়ে চলতে পারলে
উৎপাদকের ক্ষিদে বজায় থাকে সে পুঁজি নিয়োগে উৎপাদনে উৎসাহ পায়। শ্রম নিয়োগ
বাড়ে। ফলে যোগান বাড়ে। সরকারের তেমন অংশগ্রহণ দরকার হয় না। অর্থনীতি নিজ
গতিতে চলে। এইভাবে বাজার ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে যোগানের দিক থেকে আবার
চাহিদার দিক থেকে দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা এত মসৃণ
ভাবে চলে না। শ্রম বাঁচানোর প্রযুক্তির উদ্ভব দেশের আর্থিক বৈষম্য যাদের বেশি
টাকা আছে তার সবটা খরচ না করার তথা টাকা হাতে রাখার তাগিদ দেখা দেয় বলে যোগান
যতটা চায় ততটা চাহিদা থাকে না । ফলে মাল বিকৃতিতে টান পরে। বাজার সংকট দেখা
যায়। এই সংকট কাটাবার জন্য অনেক অর্থনীতিবিদ চাহিদা যে ভাবেই হোক বাড়িয়ে
বাজার তাজা রেখে সংকট কাটাবার কথা বলেন। এই চাহিদা উৎপাদন ও নিয়োগ বাড়াবার
দিক থেকে না এলে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের হাতে টাকা দিয়ে দরকারে চাহিদা
বাড়াতে হয়। তাতে উৎপাদন বাড়ুক বা না বাড়ুক। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেইনস
চাহিদা সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে বাঁচাবার কথা বলেন। দরকারে রাস্তা খুঁড়ে তা
বন্ধ করে দেওয়া হোক তাতে যে টাকা শ্রমিকের পকেটে আসে তা চাহিদার সৃষ্টি
করে।আর টাকার যোগান দেবে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে।সরকারি বাজেটে
ঘাটতি রেখে চাহিদা বাড়িয়ে তোলার তাগিদে এই নিদান যাকে ঘাটতি ব্যয় নীতি বলা
হয়। উন্নত পুঁজিবাদী দেশে চাহিদা সংকট কাটাবার তাগিদে এই নীতি অবলম্বন করা
হয়েছিল।উন্নত পুঁজিবাদী দেশে বাজার সংকটের সময় যোগান দেওয়া পণ্য অবিক্রিত
থেকে যায় বলে অর্থনীতির মন্দার সময় এই নীতি গৃহীত হয় কেইনসের নিদান
অনুযায়ী। একে কেইনসের অর্থনীতি বলে যা উৎপাদনশীল কাজে শ্রমের ব্যবহারের কথা
বলে না। সরকারের সহযোগিতায় টাকার যোগান বাড়িয়ে মাটি খুঁড়ে বন্ধ করার মত
অনুৎপাদনশীল কাজে শ্রমের ব্যবহারের কথা বলে। এও একধরনের অনুদান অর্থনীতিকে
সমর্থন করে যা আজ পশ্চিম বঙ্গে মমতা আর কেন্দ্রে মোদী সরকার চালু করেছে।তামিল
নাদুতে জয় ললিতা এই ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করে নিজের জনপ্রিয়তা বজায়
রেখেছিলেন। এই অনুৎপাদনশীল কর্মবিমুখ অর্থনীতিই আজ পশ্চিম বঙ্গের মমতা
অর্থনীতি যাকে আমরা অনুৎপাদনশীল অনুদানের অর্থনীতি বলেছি। এতে সত্যিকারের
কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে না। স্বল্পকালীন জোড়াতালির ব্যবস্থা হয় কৃত্রিম
চাহিদা সৃষ্টি করে। বাজার অর্থনীতিতে উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষের কর্মংস্থানের
সুযোগ সৃষ্টি না করে। টাকার যোগান বাড়িয়ে চাহিদা বাড়িয়ে এইভাবে অর্থনীতিকে
চালানোকে আমরা অনুৎপাদনশীল খরচ বলে মনে করি যা সত্যিকারের অর্থনীতির কাজ নয়।
সেখানে যোগানের দিক থেকে বাজার ব্যবস্থার গুরুত্ব কমে যায়। আজ পুঁজিবাদের এই
চাহিদা সংকট একটা স্থায়ী সংকট। কিন্তু ভারতে মত দেশে এই নীতি ভয়াভয় এক
মুদ্রাস্ফীতি ঘটায় অর্থনীতির নিশ্চলতা বজায় রেখে যাকে ইংরেজিতে stagflation
বলা হয়।

ওপরের আলোচনা প্রসঙ্গে কেইনসের ঘাটতি অর্থনীতি সম্পর্কে দু একটা কথা সংক্ষেপে
বলে নেওয়া দরকার। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশে
বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায় তাকে মোকাবিলা করার জন্য কেইনসের
উপদেশে টাকার যোগান বাড়িয়ে চাহিদা বারবার নীতি অবলম্বন করা হয় যাকে ঘাটতি
বাজেট নীতি বলা হয়।এই সংকটকালীন সময়ে চাহিদার অভাবে কলে কারখানায়
উৎপাদনক্ষমতা অব্যবহৃত রয়ে যায়। এই অবস্থায় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয় না
কারণ পণ্যের বাজার নেই। বাজারে চাহিদার অভাব দেখা যায় তিনটি কারণে।আয় বণ্টন
বৈষম্য যা ব্যাপক সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়তে দেয় না। দ্বিতীয়ত ধনী
মানুষদের ভোগ প্রবণতা প্রয়োজনের তুলনায় কম সেটা তেমন হারে বাড়ে না । তাদের
আয় বাড়তে থাকলেও অতিরিক্ত আয়ের স্বল্পাংশ খরচ হয়।ফলে চাহিদা সেই হারে
বাড়ে না। তৃতীয়ত যাদের হাতে টাকা থাকে শেয়ার বাজারে ডামাডোল দেখা দেয় বলে
তারা টাকা হাতে ধরে রেখে অপেক্ষা করে যা নিষ্ক্রিয় বা অলস অর্থ বলে বিবেচিত
হয়, চাহিদা সৃষ্টি করতে পারে না। এই অবস্থায় উৎপাদন বাড়িয়ে শ্রম নিয়োগের
মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো মালিকদের স্বার্থ সিদ্ধি করে না
কারণ বাজারের সংকট। তাই ঘাটতি ব্যয় নীতি অনুসরণ করা হয়।রাস্তা খুড়ে ভরাট
করার মত অনুৎপাদনশীল খাতে খরচের নিদান দেওয়া হয় যাতে উৎপাদন বৃদ্ধি নয় শ্রম
নিয়োগ বৃদ্ধি নয়, শুধু চাহিদা বাড়ে যাতে দেশের অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতার
ব্যবহার বাড়ানো যায়।কিন্তু আজকের ভারতে এই নীতি অনুসৃত হওয়া উন্নয়নের
স্বার্থবিরোধী কারণ তাতে দেশের উৎপাদন বাড়তে পারে না শ্রম নিয়োগ বাড়ে না।
ভারতে উন্নত দেশের মত পুঁজির বিকাশ ঘটে নি পুঁজি উদ্বৃত্তের সৃষ্টি হয় নি।
এটা স্বল্প পুঁজি স্বল্প উৎপাদনের দেশ।যদিও একক কোন উৎপাদন সংগঠন তথা ব্যস্টি
অর্থনীতির দিক দিয়ে চাহিদার অভাবে অতিউৎপদন ক্ষমতার সংকটে নিমজ্জিত হয়।তাই
বলে সামগ্রীক অর্থনীতির জন্য মাটি খুড়ে আবার গর্ত বন্ধ করার নীতি উৎপাদন
স্বল্পতার মুখে ঘাটতি ব্যয় নীতি অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ নীতি কার্যকরী হয় না।
বরং মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে মানুষের দুরবস্থা বাড়ায়। একে আমরা খয়রাতি
অর্থনীতি বলি।কিন্তু এই নীতি ব্যষ্টি স্তরে কর্পেরেট দুনিয়ার চাহিদা রক্ষা
করতে পারে বলে মনে করা হয়। আর সস্তায় গরীব মানুষকে ক্ষমতাসীন দলের তাবেতে
রাখা যায় একধরনের সস্তা জনপ্রিয়তার নীতির কল্যাণে। একেই আমরা অনুদানের
অর্থনীতি তথা খয়রাতি অর্থনীতি বলি।

উল্লেখ যোগ্য যে পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে অ্যাডাম স্মিথ রিকার্ডোরা যোগানের
দিক দিয়ে বাজার অর্থনীতিকে দেখেছেন । সেজন্য জে বি সের মত অর্থনীতিবিদরা বলেন
যোগান আপনা থেকেই চাহিদার সৃষ্টি করে কারণ যোগান বাড়াতে হলে উৎপাদন বাড়াতে
হয়। আর তাতে শ্রম নিয়োগ বাড়ে। শ্রমিক আয় অর্জন করে।।ধরে নেওয়া হয়
মানুষের হাতে যে টাকা আসে সবটাই সে খরচ করে। তাই বলা যায় তাদের আয় বাড়ে
মানে চাহিদা বাড়ে। কিন্তু কেইনসের মত অর্থনীতিবিদদের যুগে পুঁজিবাদের সংকটের
মুখে চাহিদার অভাবে অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতাই মূল সমস্যা । তাই চাহিদা বাড়াবার
জন্য এই নিদান ।

দেখা গেল যে আজ আমাদের দেশে খোরাকি দিয়ে জনগণের মঙ্গলের নামে এই চাহিদা বজায়
রাখার নীতি কেন্দ্র রাজ্য উভয় পক্ষই চাইছে দুটো কারণে। সরকার চায় এইভাবে
অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ করে মানুষকে খোরাকি দিয়ে নিজের ভোট ব্যাংক বজায়
রাখতে। এতে মানুষকে আনুগত্যে বেঁধে রাখতে পারে বলে ক্ষমতাসীন দল মনে করে।
সরকার জানে তাদের পক্ষে আজ বিশ্বায়নের নিদান বেসরকারিকরণের ঘটিয়ে
কর্মসংস্থান বাড়িয়ে চাহিদা বজায় রাখা সম্ভব নয়। আর কর্পোরেট দুনিয়া আজ
উন্নত শ্রম বাঁচানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাভ বাড়াতে চাইছে। কিন্তু তাতে
চাহিদার সংকট তৈরি হয়। সেটা মেটাতে সরকার যদি খয়রাতির অর্থনীতি চালায় তবে
তাদের চাহিদা সংকট কিছুটা হলেও মেটে। আর সেটা ঘটে সরকার তথা সাধারণ মানুষের
টাকায়। এর ফলে মানুষের কোমর ভেংগে যায় সে শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলতে পারে না।
মানুষের অধিকারের দাবিতে জীবন জীবিকার তাগিদে লড়াই দানা বাঁধতে পারে না। এটা
কর্পোরেট হাউস ও সরকার উভয়েরই বড় প্রাপ্তি। আজ যেটা আমরা দেখছি। আর বেসরকারি
বিভাগ কর্মসংস্থান বাড়িয়ে চাহিদা বাড়ানোর দিকটায় মদত করতে পারে না বরং
উন্নত প্রযুক্তিতে শ্রম সঞ্চয়ী উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আর এখন রোবট
কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থার সাংগঠনিক চেহারাটা বদলে গেছে।
উৎপাদন সংগঠন অল্প শ্রমে ছোট পরিসরে উন্নত প্রযুক্তিতে চলে। সেখানে নিয়োগ
সুযোগ খুবই সীমিত। আর বাজারের সীমাবদ্ধতার জন্য সেইভাবে উৎপাদন আর যোগানকে
নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা চলে। উন্নত প্রযুক্তিকে প্রয়োজনে ব্যবহার করেও আরো
শ্রম নিয়োগের ব্যবস্থা কি করে করা যায় তা নিয়ে ভাবা হয় না এই বিষয়ে আমি
দুচারটে কথা বলছি কিন্তু বিষয়টা বড় পরিসরে বিস্তৃত আলোচনা দাবি করে। উন্নত
প্রযুক্তিতে শ্রম কমিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শ্রমিককে দিয়ে অল্প
সময়ে বেশি উৎপাদন করানো যায়। এতে মার্কসের ভাষায় উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়ে।
যেমন উন্নত প্রযুক্তিতে আগে ১০ ঘণ্টায় যা উৎপাদন করা যেত আজ সাতঘনটায় তাই
করানো যায়। কিন্তু শ্রমিককে আগে সে চার ঘণ্টায় যে উৎপাদন করত তার বাজারমূল্য
ধরে মজুরি দিত। ফলে ছ ঘণ্টার উৎপাদন উদ্বৃত্ত মূল্য বলে বিবেচিত হত। এখন উন্নত
প্রযুক্তিতে অনেক কম সময়ে সমান উৎপাদন করে বলে আর তার মজুরি তেমন বাড়ে না
বলে উদ্বৃত্ত উৎপাদন মূল্য বাড়ে যার মালিক কোম্পানি। অর্থনীতিতে বণ্টন বৈষম্য
বাড়ে। ফলে গরীব মানুষের বাজারে ক্রয় ক্ষমতা বাড়তে পরে না। একদিকে
কর্মসংস্থানের অভাব অন্যদিকে সমাজের বৃহদাংশ গরীব মানুষের স্বল্প ক্রয় ক্ষমতা
বাজার সংকটকে ঘনীভূত করে। এই অবস্থায় স্বল্প সংখ্যক বিত্তশালীদের চাহিদা
মিটিয়ে টিকে থাকতে হয় কোম্পানি মালিক সম্রদায়কে। আমরা দেখি তাঁদের
প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন বাড়ে। সে সব দ্রব্য আধুনিক প্রযুক্তিতে
উৎপাদিত অভিজাত পণ্য সামগ্রী।গাড়ি আধুনিক ফ্ল্যাট নানা ধরনের সাজগোজের
পণ্যসামগ্রী দামী রেস্তোরায় বাজার ভরে যায়। এছাড়া আছে আজের স্বয়ংক্রিয়
প্রযুক্তি ভিত্তিক উৎপাদন।কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনিক প্রয়োজনের পণ্য
উৎপাদনে তেমন নজর থাকে না। সে সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকে।এর চাপ সহ্য করতে হয়
প্রধানত গরীব মানুষকে। অনুদানের অর্থনীতিতে টাকার যোগান বেড়ে যায় বলে চাহিদা
যা বাড়ে তাতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায় কারণ নিয়োগ বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটে
না অনুদানের অর্থনীতিতে।

বাজার বজায় রেখে চলতে পারলে কোম্পানির লাভ বাড়ে কারণ উৎপাদন বিক্রি হয়ে
যায়। কিন্তু বাজার সংকটের দরুন মাল বিক্রি না হলে উদ্বৃত্ত মূল্য লাভে
রূপান্তরিত হতে পারে না। সেটা মালিকের সংকট যার জন্য শ্রমিকরা দায়ী নয়।আর এর
থেকে রেহাই পেতেই মালিক উৎপাদনে শ্রম ও শ্রমিক নিয়োগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে
চাহিদা বজায় রেখে বাজার অর্থনীতিকে চালু রাখতে চায়। আর এর জন্যই দরকার
অনুদানের তথা খয়রাতি অর্থনীতির। আর এটা কর্পোরেট মালিক থেকে ভারতীয় লেবেল
লাগানো নোবেল জয়ী বিনায়ক ব্যানার্জী সবাই প্রচার করেন। এই ধরনের অনুৎপাদনশীল
অর্থনীতির পক্ষে শাওয়াল করেন যেটা আদাম স্মিথ বা ডেভিড রিকার্ডোর মত প্রথম
যুগের পুঁজিবাদী সাবেকি অর্থনীতিবিদরাও সমর্থন করতেন না।তখন পুঁজিবাদী
ব্যবস্থাতেও উৎপাদন বৃদ্ধি যোগান বৃদ্ধি তার সঙ্গে নিয়োগ বৃদ্ধির জোর দেওয়া
হতো। যুগটা ছিল বিকাশমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যুগ যে যুগের পুঁজিবাদকে মার্কস
এঞ্জেলস প্রগতিশীল পুঁজিবাদের যুগ বলেছেন কমিউনিস্ট ইস্তাহারে।

কখন সরকারি প্রকল্প আর অনুদানের অর্থনীতি থাকে না:

আজ সরকার যদি প্রতিটি প্রকল্পের সাথে উৎপাদনশীল কাজকে যুক্ত করত আর গরীব
মানুষকে সেই কাজে মেহনতের বিনিময়ে অর্থদান নয় মজুরি দিত তবে সেই প্রকল্পের
বিরোধিতা না করে আমরা তাকে স্বাগত জানাতে পারতাম।সেটা তখন আর অনুদানের
অর্থনীতি থাকত না। এর জন্য দরকার হত ন্যায্য মজুরি প্রদান। আমরা জানি অসংগঠিত
বিভাগে মহাজনী কারবারের মত কারবারিদের হাতে বড় জমি মালিকের হাতে প্রচুর
অর্থের সমাগম হয় যারা কর দেয় না । এদের থেকে কর আদায় করে অর্থের সংস্থান
করলে আপত্তির থাকে না। আজ আয় বৈষম্যের মুখে কর না দেওয়া এই অর্থবানদের ওপর
কর চাপানটা উন্নয়ন ও বৈষম্য দূর দুদিক থেকেই ন্যায় সঙ্গত। আর উৎপাদন ও
সেবামূলক কাজে শ্রম নিয়োগের ক্ষেত্রের অভাব নেই আমাদের দেশে। যেমন শ্রমের
বিনিময়ে কর্ম প্রকল্প চালু আছে যেটাকে তুলে দেওয়ার কথা সরকারি কোন কোন মহল
থেকে বলছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা দরকার। রাজ্য
সরকারের উদ্যোগে এ ধরনের কর্মসূচি আরও বেশি বেশি চালু করা কাম্য। যেমন
রাস্তাঘাত চিকিৎসাকেন্দ্র শিক্ষা ব্রিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি তৈরী ও
রক্ষণবেক্ষণের মত হাজার কাজ। সরকার নিজের উদ্যোগে ক্ষুদ্র শিল্প প্রকল্প গড়ে
তুলতে পারে। গরীব ঘরের ছেলে মেয়েদের সাইকেল দেওয়ায় আপত্তি থাকে না। সেটা
দরকার। আজ অল্প পুঁজিতে সরকারি উদ্যোগে ছোট ছোট এলাকা ভিত্তিক সাইকেন তৈরী করা
যেতে পারে। কার্যত এগুলো হয় সাইকেলের বিভিন্ন অংশ জোড়া দেওয়ার ছোট ছোট
আঞ্চলিক কারখানা যা খুব বেশী লাভ না রেখে গড়ে তোলা যায় সরকারি উদ্যগে। আর
পুঁজি আসে যে সাইকেলটা বেশি দামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয় সেই
অনুদানের অর্থটাকে কার্যকরী সরকারি পুঁজিতে রূপান্তরিত করে। তবে যারা সাইকেল
পাচ্ছে তারা জানবে তারা মেহনত দিয়ে সেটা পাচ্ছে তাতে তাদের সন্মান বজায়
থাকবে। এটাকে কারো অনুগ্রহ বলে মনে হবে না। সেটা তাদের অধিকার বলে প্রতিপন্ন
হবে। এতে দেখা যাবে গ্রামের বিত্তশালী যারা মাতব্বর তারা অনুদানের সুযোগটা
আত্মসাৎ করতে পারবে না কারণ তারা মেহনত দিতে হবে জানলে আর এ পথে আসবে না।এই
মেহনত দিতে তাদের ভুয়া মর্যাদায় আঘাত লাগবে। আমি একটা উদাহরণ দিলাম মাত্র।
আমাদের দেশে অর্থের অপচয় না ঘটিয়ে তা দিয়ে শ্রম নিয়োগ সাপেক্ষে অসংখ্য
উৎপাদনশীল কাজ করার সুযোগ আছে। সেখানে সরকারি প্রকল্পকে অনুদান তথা খয়রাতি
অর্থনীতি বলে গালি দেওযার সুযোগ থাকে না। সরকারি প্রকল্পকে আমরা সত্যিকারের
উন্নয়ণ প্রকল্প বলতে পারি।

উপসংহার:

আমরা ওপরের আলোচনায় আজকের ভারত বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে অনুসৃত অনুগ্রহের
অর্থনীতির ধরনটা বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখলাম যে এটা ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে
পরোক্ষে গৃহীত কিছু জনপ্রিয় কল্যাণমূলক নীতির অপপ্রয়োগের পরম্পরা। তবে সেটা
ধীরে সুস্থে পরিকল্পনা আর নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতির আড়ালে অনুসৃত হয়েছিল প্রথম
যুগে। আজ সেটা খোলা বাজারে কর্পোরেট অর্থনীতির মদতে চলছে রাষ্ট্র যেখানে
কর্পোরেট অর্থনীতির খোলাখুলি লেজুড় বৃত্তি করে চলেছে। আর মমতার মত নেত্রীরা
সস্তা জনসমর্থন নিয়ে এই অনুগ্রহের নীতি অনুসরণ করে চলেছে যা মানুষকে শ্রম
বিমুখ করে তুলছে, অর্থনীতির রাজনীতির দুর্নীতিকরণ ঘটিয়ে চলেছে। এই আলোচনা
প্রসঙ্গে আমরা অর্থনীতির কিছু তত্ত্বকথা এনেছি যা বিষয়টাকে সমগ্রকতায় বুঝতে
সাহায্য করবে। এটা যেমন তৃণমূল স্তরে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্বৃত্তায়নের
বীজ বপন করে মানুষকে শ্রমবিমুখ করে ব্যবস্থাটাকে অনুৎপাদনশীল করে তোলে তেমন
বৃহত্তর পরিবেশে কর্পোরেট দুনিয়ার অর্থনীতিকে স্বল্পকালীন অক্সিজেন দিতে
চায়। কিন্তু দীর্ঘকালীন প্রেক্ষাপটে অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় অনুৎপাদনশীল।
মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধকে দমিয়ে রাখতে চায়। তাদের সহযোগী হয়ে ওঠে
কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের শাসক গোষ্ঠী। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে অলিখিত বোঝাপড়া
তৈরি হয়। চেষ্টা করেছি দেখাতে কিভাবে এই ধরণের পরজীবী অনুগ্রহের অর্থনীতি
একটা জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দেয় অর্থনীতিকে অনুৎপাদনশীল করে তোলে আর
ক্ষমতালোভীদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। একে আমরা
অনুগ্রহের অর্থনীতির বিষফল বলে মনে করি। কিন্তু কখন সরকারি প্রকল্পকে
উৎপাদনশীল উন্নয়ণ মূলক প্রকল্প বলা চলে সেটাও আমরা আলোচনা করলাম।

==================

 


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩