Featured Post
আজকের দুনিয়ায় মে দিবসের তাৎপর্য ।। রণেশ রায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
আজকের দুনিয়ায় মে দিবসের তাৎপর্য
রণেশ রায়
দিনটা ১লা মে ১৮৭৬। স্থান আমেরিকার শিকাগো শহর। শ্রমজীবী মানুষের এক ঐতিহাসিক জমায়েত তাদের অধিকারের দাবিতে। রাষ্ট্রের সহযোগিতায় পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম মেনে শ্রমিক শোষণ চালিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন শ্রম সময় কমানোর দাবীতে। এই আন্দোলন সংগঠিত হয় শ্রমিক সংগঠনের সংগঠিত নেতৃত্বে। তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক' আমেরিকায় পুঁজিপতির স্বার্থে শ্রমিকের শ্রম সময়ের লাগামহীন যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে অবাধে শ্রম সময় চুরি করে অবাধ পুঁজিবাদী শোষণ চালু হয় সে দেশে পুঁজিবাদের আবির্ভাব লগ্ন থেকেই। তার বিরূদ্ধে শ্রম সময় কমাবার দাবীতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষিত হয় এই দিন। 'রাষ্ট্র' পুঁজিবাদের অনুগত থেকে আন্দোলন দমন করার জন্য গুলি চালায় যাতে ১১ জন শ্রমিক মারা যায়। সারা দুনিয়ার কাছে পুঁজিবাদী নিয়মে চলা গণতন্ত্রের আসল চরিত্র উদঘাটিত হয়।রাষ্ট্রের ভূমিকা দুনিয়ার মানুষের কাছে ধিকৃত হয়।মার্কিন দুনিয়াক বাধ্য হয় আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে শ্রম সময় কমিয়ে আট ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে। এ জয় শিল্প জগতে সংগঠিত বিভাগে দুনিয়ার মজদুরের ঐতিহাসিক প্রথম জয়। সময়ের সংগে সংগে এই বিজয়ের ফসল ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়া জুড়ে। একটা দেশে একটা আন্দোলন দুনিয়া জুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর জয় বলে বিবেচিত হয় এই প্রথম। দিনটা মে দিবস নামে অমর হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।
হে মার্কেটে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রের শ্রমিকের অধিকার মেনে নিতে বাধ্য হওয়ার পর বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এই দাবীর প্রতি সহানুভূতির ঢেউ ওঠে । এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী পালন উৎসব কালে লেভোন লভিনের প্রস্তাব মত ১৯৯০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে শিকাগো প্রতিবাদ বার্ষিকী দিবস পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।১৮৯১ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়।
পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে আধুনিক শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমিকদের ১৬ ঘণ্টা ধরে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। এরই বিরোধিতায় শ্রম সময় কমাবার দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার শ্রমিক দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল।আমেরিকার হে মার্কেটে একে কেন্দ্র করে যে সমাবেশ তার ওপর গুলি চালনাকে ধিক্কার জানানো হয় আর একে স্বীকৃতি দিতে এই মে দিবস।
আজ পৃথিবীব্যাপী প্রায় সব দেশে প্রতি বছর মে মাসের ১ তারিখটি পালিত হয় 'আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস' বা 'মে দিবস' বলে। তবে উল্লেখযোগ্য যে যে দেশে এই আন্দোলনের সূত্রপাত সেই আমেরিকায় মে দিবস পালিত হয় না। এটি আজ বিশ্বজুড়ে শ্রমিক আন্দোলন দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারত সহ বিশ্বের বহু দেশে এই দিনটি জাতীয় ছুটির দিন বলে আজ ঘোষিত।। দিনের পর দিন লড়াই এবং বহু সংগ্রাম পেরিয়ে এই দিনটি সারা বিশ্বের শ্রমিকদের কাছে এক গৌরবময় উজ্জ্বল দিন হয়ে ওঠে।এই দিনটি কোন উৎসব পালনের দিন নয়। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এর শপথ নেওয়ার দিন। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন উদযাপন দিবস। সেই সঙ্গে নতুন নতুন আন্দোলন গড়ে তুলে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার শপথ নেওয়ার দিবস।
১৮৯১ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে লেভনের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়। একে নেহাত কিছু সুবিধা আদায়ের আন্দোলন বললে এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য হারিয়ে যায়।কিন্তু আজ ভারতের মত দেশে এটা হয়ে দাঁড়ায় এক উৎসবের দিন। আজ পুঁজিবাদের রক্ষকরা বিষয়টাকে উৎসবের দিন বলে দেখতে চায় যাতে এই দিনটা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এর শপথ দিবস হিসেবে প্রতিভাত না হয়। আমরা আজের পরিবর্তিত দুনিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আজের এই দিনটার তাৎপর্য আলোচনা করব।
১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মে দিবসকে কেন্দ্র করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি গৃহীত হয় দৈনিক আটঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবিকে সামনে রেখে । দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই দাবী আদায়ের জন্য শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে 'বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার' সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।কোন কোন দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায়। অনেক দেশেই এটা কার্যকর হয়। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বিপ্লবী সংগঠনগুলি তাদের দাবি আন্দোলন তুলে ধরার জন্য মে দিবসকে বেছে নেয়। কোথাও কোথাও শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুন জ্বালানোর রীতি চালু হয়। বিপ্লব উত্তর সোভিয়েত রাষ্ট্র, চীন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন বলে বিবেচিত হয়। সেসব দেশে এমনকি এ উপলক্ষ্যে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
১৯৬৭ সালের ১ মে বুখারেস্টে অনুষ্ঠিত সমাবেশে আমেরিকা ও কানাডাতে সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একে সঠিক অর্থে মে দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয় না। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়নগুলি এই দিন পালনের উদ্যোক্তা। হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মে দিবসে দাঙ্গা হতে পারে অজুহাতে মে দিবস পালনকে অস্বীকার করেন। এর মধ্যে ১৮৭৬ সালে শিকাগো হত্যাকাণ্ডের পরপরই দাঙ্গা লাগে।। অনেকের মতে রাষ্ট্রের কুমতলবের অনুশাসনেই এই দাঙ্গা লাগে।
সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে ফরাসি বিপ্লব এগিয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদের আগমন ঘটেছিল সামন্তবাদকে উচ্ছেদ করে, সামন্তবাদের গর্ভে গড়ে ওঠা ভূমি দাস প্রথাকে উচ্ছেদ করে । তবে শোষণ দূর হয়নি।নতুন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শিল্প কারখানায় শ্রম সময় চুরি করে ভূমি দাস প্রথার শোষণের জায়গা নিয়েছিল পুঁজির শোষণ গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে। কার্যত সাম্য মৈত্র স্বাধীনতার শপথের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেই পুঁজিবাদী শোষনের প্রবর্তন হয়। আর সেটাই নক্কারজনক ভাবে তুলে ধরে মে দিবসের আন্দোলন। কার্ল মার্কস আর এঙ্গেল লিখিত কমিনিষ্ট মেনুফেষ্ট প্রকাশ পায় ফেব্রুয়ারি ২১, ১৮৪৮ সালে।সেখানে পুঁজিবাদী শোষণের কথা বলা হয়, তুলে ধরা হয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর লড়াই এর কথা। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়।কার্ল মার্কস তার ক্যাপিটাল গ্রন্থে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে শ্রম সময় চুরির মাধ্যমে পুঁজিবাদী শোষণের স্বরূপ তুলে ধরেন। শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে কমিউনিষ্ট ইস্তাহারের অনুপ্রেরণায় যেখানে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে।এরই অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠে আমাদের আলোচনায় সেই মে দিবসের শ্রমিক আন্দোলন।সেখানে শ্রম সময় কমাবার দাবি ওঠে যার মধ্যে নিহিত আছে পুঁজিবাদী শোষণের উৎস যার পৃষ্টপোষক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। সুতরাং পুঁজিবাদের বিকাশে পুঁজির সাহায্যে শ্রম চুরির বিষয়টা বাদ দিয়ে মে দিবসের তাৎপর্য বোঝা সম্ভব নয়।
আজ ১৮৭৬ সালের সেই ১ লা মে এর পর দেড়শ বছর কেটে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদের স্বরূপ বদলেছে।একদিকে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি তার অপব্যবহার অন্যদিকে পরিবেশ ধ্বংস ব্যাপক শ্রমিক শোষণ পুঁজিবাদকে সংকটে ফেলেছে।আবার এটাও সত্য যে সমাজতন্ত্রের লড়াই কোন কোন ক্ষেত্রে পিছু হটেছে। যে দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের জয় সূচিত হয়েছিল সে সব দেশ আবার পুঁজিবাদী পথে হেঁটে চলেছে। অবস্থার পরিবর্তনের চরিত্র না বুঝতে পারায় সমাজতন্ত্র গঠনের আন্দোলন নানা ভাবে পিছিয়ে পরছে পরাস্ত হচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য যে রাশিয়ায় সোভিয়েত বিপ্লবের পর ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রাক্কালে ৩০ এর দশকে পুঁজিবাদের সংকটকালে ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয় সমাজতন্ত্র অর্জনের লড়াই। পরবর্তীকালে চীনে জনগনতান্ত্রিক বিপ্লব সারা বিশ্বকে তোলপাড় করে। ভিয়েতানাম কিউবা কম্বোডিয়ায় বিপ্লবী লড়াই শুরু হয়। বিশ্বজুড়ে সামন্তবাদ পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এশিয়া আফ্রিকার মত পশ্চাতপদ দেশ। মে দিবসের তাৎপর্য বৃহত্তর মাত্রা পায়। এ শুধু পুঁজিবাদী দেশের সংগঠিত শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। যে পশ্চাদপদ দেশে তখনও পুঁজিবাদের স্বাধীন বিকাশ ঘটে নি, দেশগুলোতে সামন্তবাদের ধ্বংসাবেশ বর্তমান সেইসব আধা ঔপনিবেশিক দেশে মে দিবসের তাৎপর্য নতুন মাত্রা পায়। মানব সমাজের মুক্তির দিশায় মে দিবস দিশারী হয়ে ওঠে। তা আর কেবল উন্নত পুঁজিবাদী দেশের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। দেশে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই এর প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় মে দিবস বিভিন্ন স্তরের নিপীড়িত মানুষের জীবনে। মধ্য বিত্ত এমন কি উচ্চবিত্তদের একাংশকে বেষ্টন করে মে দিবস হয়ে ওঠে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সামন্তবাদের বিরূদ্ধে সমস্ত ধরনের নিপীড়ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ গ্রহণের দিন।এটা আর কিছু দাবিদাওয়ার লড়াই এর মধ্যে অর্থনৈতিক চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বৃহত্তর পরিসরে সমাজ বদলের রাজনৈতিক লড়াইয়ের দিশা হয়ে দাঁড়ায়। যা ছিল কারখানা ভিত্তিক শ্রমিক শ্রেণীর লড়াই তা রূপান্তরিত হয় বিশ্ব জনগণের মুক্তির লড়াইয়ের নিশানায়। মুক্তি যুদ্ধের প্রতীকী হয়ে দাঁড়ায়। যদিও সাম্রাজ্য বাদী শক্তি আর তাদের সহযোগী সংশোধনবাদীরা একে অর্থনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে একটা উৎসবের দিনে পরিণত করতে চায়।
শিকাগো শহরে ১ লা মে যে আন্দোলন ও তাকে কেন্দ্র করে মে দিবস সে আন্দোলনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন ছিল না এটা ছিল শ্রমিকের কাজের শ্রম সময় কমাবার দাবিতে আন্দোলন যা মার্কসের শ্রম সময় চুরি করে উদ্বৃত্ত মূল্য পুঁজির মালিকের আত্মসাৎ এর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এই দিক দিয়ে আন্দোলনের তাৎপর্য ভিন্ন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দাম বৃদ্ধির মুখে আর্থিক মজুরি বৃদ্ধি প্রকৃত মজুরী বৃদ্ধিতে সহায়তা করে না। শ্রমিকের আর্থিক অবস্থার প্রকৃত উন্নতি হয় না। মালিকের মুনাফায় টান পড়ে না। শোষণের হার কমে না। কিন্তু শ্রম সময় কমাবার দাবী মালিকের স্বার্থ হানি ঘটায় প্রকৃত অর্থে শ্রমিকের ওপর শোষণের ভার কমে। সেইজন্য এই দাবী মালিক মানতে চায় না। সেইজন্য এই আন্দোলন অনেক বেশী তাৎপর্য পূর্ণ যা শোষণের গোড়া ধরে টানে।সেদিক দিয়ে বিচার করে মে দিবসের ঐতিহাসক গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি।আর কার্ল মার্কস শ্রম সময় চুরি করে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির বিষয়টা উন্নত পুঁজিবাদী দেশে কারখানা শ্রমিক মালিককে কেন্দ্র করে তুলে ধরেছিলেন।পরবর্তী কালে ভারতের মত ঔপনিবেশিক দেশে বিষয়টা পুঁজিবাদের বাইরের সমাজে কিভাবে তাৎপর্য পূর্ণ হয়ে ওঠে সেটা আমরা দেখি। সেটা স্বল্প পরিসরে ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়টা আবার নীচের আলোচনায় উঠে আসবে।
আজ প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক কারখানা শিল্পে এক কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। কম শ্রমিক ব্যবহার করে বেশি উৎপাদন করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে শ্রম সময় চুরির হার বেড়ে চলেছে।শ্রম নিয়োগের সুযোগ কমছে। বেশি বেশি উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি হয়ে চলেছে। তাছাড়া প্রতিযোগিতার পরিসর কমে এসেছে একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। এই একচেটিয়া কারখানা মালিক শ্রমিক নিয়োগ করে নিজের কারখানায় আর বেশি উৎপাদন করছে না । তারা ছোট ছোট কারখানায় নিজেদের পণ্য শর্ত সাপেক্ষে উৎপাদন করছে।ছোট উৎপাদকরা শ্রমিক নিয়োগ করে তাদের যথেচ্ছ ভাবে খাটিয়ে নেয়। ফলে শ্রম সময় চুরির হার বাড়ে। এ ধরনের ছোট ছোট কারখানায় শ্রম আইন বলবৎ হয় না।অর্থনীতিতে এইসব অসংগঠিত শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক সংখ্যায় অনেক বেশী। এদের ঠিক মার্কসীয় ব্যাখ্যায় আলোচিত কারখানা শ্রমিক বলা যায় না যারা একত্রে পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণী বলে চিহ্নিত। বরং এরা সামন্ত ব্যবস্থা ধরনের শোষণের যাঁতাকলে আবদ্ধ যেখানে শ্রম নিয়োগে তাকে খাটাবার ব্যাপারে কোন আইন থাকে না।এরা অনেকটা পারিবারিক শ্রমিকের মত। এতে শ্রমিক আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। আর তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক অপব্যবহার ঘটে যা শ্রমিকের শ্রম সময় বাড়িয়ে দেয়, শ্রমসময় চুরির সুযোগ বাড়ে।আজ শুধু কারখানায় যারা মেহনত করে তারাই শ্রমিক নয়।যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ করে তারাও শ্রমিক। যেমন ঘরে বসে অন লাইনে কাজ করা।এরা সেবা পণ্য উৎপাদন করে। আজ শিল্প অর্থনীতির জগতে বানিজ্য শিল্প খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে অন লাইনে ব্যবসা চলে। কার্ল মার্ক্সের আমলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে ব্যবসা বানিজ্য উৎপাদন শিল্পের অধীনস্থ ছিল। তার বহর ছিল সীমিত।আজ ব্যবসা বাণিজ্যের জগৎটা অনেক বড় হয়েছে উৎপাদন শিল্পের ওপর কর্তৃত্ব করছে। আর বৃহৎ কারখানা শিল্প সেখানে নিযুক্ত বিরাট শ্রমিক বাহিনী আগের মত নেই। আইটি তথা তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে যে প্রশিক্ষিত কর্মীরা কাজ করে তাদের কাজের ধরন আলাদা। কর্মরত শ্রমিকদের কাজের সময়ের সীমা পরিসীমা নেই। চাকুরীর নিশ্চয়তা নেই।এরা সঙ্গবদ্ধ হতে পারে না। শ্রেণী হিসেবে এদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।অথচ এরা শ্রম দেয়।এদের শ্রম সময় চুরি হয়।আর এর জন্যই প্রযুক্তির অপব্যবহার করে ডিজিটাল অর্থনীতি চালু করার তাগিদ যার পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র। আজকের এই পরিস্থিতিতে মে দিবসের তাৎপর্য বিশেষ গুরত্ব পূর্ণ।এদের বুঝতে হয় এদের ব্যতীত মালিকের চলে না।প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে কাজের এই দম বন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি নেই। তাই তাদেরও কারখানা শিল্পের শ্রমিকের সঙ্গে আন্দোলনে কাঁধ মেলাতে হয়। নেহাত মজুরি নয় শ্রম আইন শ্রম সময় কার্যকরী করার লড়াই করতে হয়। আর এখানেই শ্রমজীবী মানুষের কাছে মে দিবসের তাৎপর্য।মে দিবসকে শপথ গ্রহণের দিবস হিসেবে দেখতে হয়।
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা উন্নত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ১ লা মে এর আন্দোলন আর তার থেকে উদ্ভুত মে দিবসের তাৎপর্য যেমন আলোচনা করলাম তেমনি আজকের পরিবর্তিত পরিবেশে তার গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এই দিনটাকে আজ ছুটির দিন ঘোষণা করে বা তার মাহাত্ম বন্দনা করে তার সত্যিকারের তাৎপর্যকে অস্বীকার করা হচ্ছে।কোন পরিপ্রেক্ষিতে মে দিবসের তাৎপর্য কি সে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে একে এক উৎসবে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে।সেটার বিপক্ষে গিয়ে তার বিরোধীতা করে মে দিবসের প্রকৃত তাৎপর্যটা তুলে ধরা দরকার।আজকের পটভূমিকায় মে দিবসের তাৎপর্য কি সেটা বোঝা না গেলে মে দিবসকে উৎসব দিবসে পরিণত করার অপচেষ্টাকে আটকানো যাবে না।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন