Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। হারানের ভেলকি ।। মিঠুন মুখার্জী

               ।।  হারানের ভেলকি ।।

                                 মিঠুন মুখার্জী 


আজ যার কথা বলতে যাচ্ছি সে বয়সে নবীন হলেও বুদ্ধিতে ও কর্মে অনেক বিদ্বানকেও হার মানিয়ে দিতে পারতো। বরিশালের বিখ্যাত তাঁত শিল্পী মদন হাতির ছেলে হারান হাতি। ছোটবেলা থেকেই হারানোর সঙ্গে বুদ্ধিতে কেউ পেরে উঠত না। বাবা-কাকা-মামা ও মাকেও ঘোল খাইয়ে দিত এই বালকটি। তার বয়স এগারো থেকে বারো বছরের মধ্যে হবে। তাকে অনেকে গোপাল ভাঁড়ের সঙ্গে তুলনা করতেন। গোপালের মতো তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল। পাড়ায় কোনো অনুষ্ঠান হলে হাসির গল্প ও ধাঁধা বলার জন্য তাকে ডাকা হতো। তার কথা শুনে সকলে হেসে গড়াগড়ি দিতেন। তারা মদন হাতিকে বলতো-- 'একটা ছেলে জন্ম দিছো বটে, তোমার নাম রাইখবে।' এই তো বছর খানিক আগের কথা। পাড়ার একটা অনুষ্ঠানে হারানকে মঞ্চে তুলে দেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ ভেবেছিল এইটুকু বালক মানুষকে কি বিনোদন করবে। কিন্তু তাদের চিন্তা ভুল প্রমানিত হয়েছিল। প্রথমেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে হারান বলে-- "আজ্ঞে আমি হাতি বলছি। মানে আপনাদের হারান হাতি। আচ্ছা বলুন তো 'একটুখানি গাছে কেষ্ট ঠাকুর নাচে'--- আমি কোন জিনিসের কথা বলছি? সবাই হারানের প্রশ্নের উত্তর দিতে অসমর্থ হয়। কেউ কেউ মনে করার চেষ্টা করেও পারেন না। তখন সবাইকে বুঝিয়ে হারান বলে দেয়, এর উত্তর বেগুন গাছ। সবাই তার বুদ্ধির প্রশংসা করেন। এরপর আবার হারান প্রশ্ন করে--- আচ্ছা বলুন তো 'স্বপ্ন বড় না বাস্তব?' সবাই এক বাক্যে বলেন বাস্তবই বড়। কিন্তু ছোট্ট হারান হেসে বলে--- "আমি যদি বলি স্বপ্ন বড়। আমরা যদি স্বপ্ন না দেখি তবে বাস্তবে তা পূরণ করব কিভাবে?"
            একবার স্কুলের অঙ্কের শিক্ষককেও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল হারান। তাকে হারান বলেছিল--- 'আচ্ছা স্যার, আপনি আটটা আট বসিয়ে হাজার করতে পারবেন?' শিক্ষক বলেন, না করার কি আছে। কিন্তু দশ মিনিট চেষ্টা করেও তিনি তা পারেননি। স্কুলের ছাত্ররা সবাই হেসে উঠেছিল। টেনশনে শিক্ষকের শরীর  দিয়ে শীতকালে ঘাম ঝরেছিল। তখন হারান  আটটা আট ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে হাজার বানিয়ে সবাইকে দেখায়। অংকের শিক্ষক বুঝতে পারেন এই ছেলের পেটে এলাম আছে। মাঝে মাঝে শিক্ষকদের ভুল পড়ানো সবার সামনে ফাঁস করে দিত সে। সবাই তার বিচক্ষণতার প্রশংসাও করতেন এবং ওকে ভয়ও পেতেন।
            কলকাতার এক স্কুলে একবার কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। জেলার বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। তার মধ্যে হারানের স্কুল সুভাষচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও ছিল। বয়সে ছোট হলেও হারান এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। কারণ বয়সে ছোট হলেও মেধা ও বিচক্ষণতার জন্য শিক্ষকরা তাকে এই প্রতিযোগিতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে দেখে কোনো স্কুলের প্রতিযোগীরা আমল দেয়নি। বরং করেছিল তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। কিন্তু তারা জানতো না কখনো কখনো ছোট্ট লঙ্কা ধানি লঙ্কাকেও বাজিমাত করে দেয়। যতগুলি পর্যায়ে খেলা পরিচালিত হয়েছিল সব পর্যায়েই হারানোর জন্য তার স্কুল জিতেছিল। প্রতিটি পর্যায়ে তার দ্রুত উত্তর বলার ভঙ্গি দেখে পরিচালন কমিটির সদস্যরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তারা হারানের নাম  দেন এটমবোম। মাঝে মাঝে এমন এক একটা কথা  বলছিল, যা শুনে সকলে হেসে উঠেছিলেন। একবার সে বলেছিল--- "স্যার আমায় চুনাপুটি ভাববেন না। আমি গভীর জলের মাছ।" আবার কখনো বলে--- "আপনারা কেউ বলতে পারেন জ্বলে না নেবে মাছ কিভাবে ধরা যায়।" সবাই উত্তরের চিন্তা করেও অসমর্থ হয়। তখন হারান বলে--- "অবশ্যই সম্ভব। ছিপ দিয়ে অথবা ডাঙ্গায় দাঁড়িয়ে জাল ফেলে মাছ ধরা যায়।" তার কথা শুনে সবাই হেসে ওঠেন। তার কথায় যে যুক্তি থাকে না, এমন কিন্তু নয়। তবে অসম্ভব হাস্যরস থাকে তার কথায়। ফাইনাল রাউন্ড প্রতিযোগিতা হওয়ার সময় একটা নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, উভয় স্কুলের প্রতিযোগীরা তিনটি করে প্রশ্ন করবে একে অপরকে। এক একটি পাঁচ পয়েন্ট করে। শেষ প্রশ্নটি করেছিল হারান হাতি। সে জিজ্ঞাসা করেছিল--- "আমরা হাসি কেন?" তার প্রশ্নের উত্তর বিপক্ষ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা নানান ভাবে দিয়েছিল, কিন্তু সঠিক উত্তরে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। হঠাৎ একজন অংশগ্রহণকারী চেয়ার থেকে পড়ে যায়। সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। ঠিক তখন হারান বলে--- "এই ঘটনায় প্রমাণ দেয় আমরা হাসি কেন। অর্থাৎ আমরা হাসি অসঙ্গতির জন্য। নিয়মের অসঙ্গতি ঘটলেই হাসির সৃষ্টি হয়। তবে অসঙ্গতি যদি অতিমাত্রায় হয় হাস্যরস তখন করুন রসে পরিণত হয়।" ওইটুকু বালকের এই জ্ঞান দেখে সকলে অবাক হয়ে যান এবং হাততালি দেন। হারানের জন্যই এই প্রতিযোগিতা জিতে গিয়েছিল সুভাষচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলের শিক্ষকদের ও অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের অভ্যর্থনায় খুব আনন্দ পেয়েছিল সে।
             ছোট্ট হারানের জীবনে এরকম অনেক ঘটনা দেখা যায়, যে সকল ঘটনা তার আশ্চর্য ক্যারামতির পরিচয় দেয়। একবার হারান ট্রেনে করে কলকাতায় মামার বাড়িতে যাচ্ছিল। তার বাবা-মাও সঙ্গে ছিলেন। ট্রেনে বসে ও এমন সব অঙ্গভঙ্গি করছিল, যা সবাই দেখে হেসে ফেলছিলেন। সকলে অবাক হচ্ছিল এইটুকু ছেলের প্রতিভা দেখে। হারানদের সিটের সামনে এক দম্পতি তার তিন ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছিলেন। তাদের বয়স যথাক্রমে তিন, পাঁচ ও সাত। তারা কেউ কাউকে চেনেন না। তিনটি শিশুর মনোরঞ্জনের জন্য হারান কখনো পাখির ডাক, কখনো বিড়াল, কখনো কুকুর আবার কখনো গরুর ডাক দিচ্ছিল। একেবারে হুবহু সব পশুর ডাকগুলি। তার এই প্রতিভা দেখে ট্রেনের অন্যান্য যাত্রীরা তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। হারানের বাবা-মার কাছে হারান সম্পর্কে অনেক কিছু জানার কৌতূহল প্রকাশ করেন তারা। একজন বলেন--- "আপনার ছেলের প্রতি যত্নশীল হবেন। এ বড় হয়ে আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। ঈশ্বরের অসীম কৃপা আছে এর মধ্যে।" মদন হাতি ছেলে সম্পর্কে এই প্রশংসা শুনে মনে মনে  গর্ব অনুভব করেন। সকলে যখন হারান হাতিকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ ওই দম্পতির ছোট ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে খুব খারাপ অবস্থা হয়ে যায়। সকলে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে? কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারেন না। ছোট্ট ছেলেটির বাবা-মাও বুঝে উঠতে পারেন না। ঠিক তখন তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন হারান হাতি দুচোখ বুঝিয়ে একটু মনে করে বলে-- "ওর হাতে একটা পয়সা দেখেছিলাম আমি। ওটাই হয়তো গলায় বেঁধে গেছে!" হারানের কথা শুনে ওই দম্পতি  কান্নায় ভেঙে পড়েন। ঠিক সেই সময় ছোট্ট হারান তার উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দেয়। পয়সাটি তখনো বাচ্চাটির গলায় আটকে ছিল। একজন হকার সেই সময় তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হারান তার কাছ থেকে একটা শোন নিয়ে বাচ্চাটির মুখের ভিতর মোবাইলের আলো মেরে অতিসাবধানে পয়সাটিকে বের করে দেয়। পয়সা বেরোনোর সাথে সাথে বাচ্চাটি স্বস্তি পায়। ওই বগির সকল যাত্রী হারানের এই অসামান্য সাহস দেখে  হাততালি দিয়ে বাহবা দেন। ছোট্ট  ছেলেটির বাবা হারানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন। বলেন--- "তোমার জন্য আজ আমার ছেলের জীবন ফিরে পেলাম। তুমি  সাধারণ মানব নও। তোমার মধ্যে নিশ্চয়ই দৈবশক্তি আছে। তুমি অনেক দূর যাবে। দেশের নাম অবশ্যই উজ্জ্বল করবে।"
           মামার বাড়ি থেকে ফেরার দিনও একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। এই ঘটনা হাসির যেমন উদ্রেক ঘটায়, তেমনি মনটাকেও ভারাক্রান্ত করে তোলে। হারানের ছোট মামা রামচন্দ্র বহুরূপীদের মতো বিভিন্ন সাজ সেজে মানুষের মনোরঞ্জন করতেন। কখনো শিব ঠাকুর, কখনো রামচন্দ্র, কখনো রামভক্ত হনুমান, কখনো নারায়ন আবার কখনো মহাশক্তি কালির রূপও ধরতেন। ছোট্ট হারানের মামার এই সাজগুলি দেখে খুব ভালো লাগে। আনন্দে নেচেও ওঠে সে। যে কদিন তারা মামার বাড়ি ছিল, সেই কদিন সব কটি সাজই দেখেছে সে। আনন্দে ছোট্ট মামাকে বলেছে--- "মামা, আমাকেও একটু সাজিয়ে দেবে? আমিও সবাইকে আনন্দ দেব।" ছোটমামা অভিরূপ তাকে রামভক্ত হনুমান সাজিয়ে দিয়েছিলেন। আয়নার সামনে নিজের রামভক্ত হনুমানের রূপ দেখে হারান আনন্দে আটখানা হয়ে যায়। মাকে বলে-- "মা, আমি কালকে এই সাজেই বাড়ি যাবো।" তার কথা শুনে মা বলেন-- "লোকে তোকে নিয়ে হাসবে। তাছাড়া ট্রেনে খুব ভীড় হয়। মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে। বাচ্চারা দেখে ভয়ও পেতে পারে। পরে আবার কোনদিন সাজিস, এভাবে যেতে হবে না।" কিন্তু হারান তার মায়ের কথা শোনেনি। বাড়ি ফেরার দিন সকাল বেলা ছোটমামা আরো ভালো করে তাকে হনুমানের সাজে সাজিয়ে দেন।  বাড়ি ফেরার জন্য ওইভাবেই সে শিয়ালদহ স্টেশনে ঢোকে।  প্ল্যাটফর্মে ঢোকামাত্রই সকল যাত্রীরা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। হারান কখনো কখনো মুখ ফুলিয়ে হনুমানের মতো করে। আবার কখনো লেজ অন্যের গায়ে বুলিয়ে দেয়। এই কান্ড দেখে যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই হেসে দেন। কয়েকটি বাচ্চা বলে--- "ও হনুমান, কলা খাবি? জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি?" কেউ কেউ তার লেজ ধরে টান দেয়। হারান রেগে গিয়ে তাদের একটু ভয় দেখিয়ে দেয়। বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। সে মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলে উঠছিল, 'জয় শ্রীরাম'। একটি বুড়ি তার কাছে এসে পা দুটি জড়িয়ে ধরে বলেন--- "প্রভু, আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। আপনার এভাবে দর্শন পাবো তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।" বুড়ির এই কান্ড দেখে কয়েকজন যাত্রী খুব হেসে দেন। হারান কিন্তু হাসে না, কিংবা কোনো সংকোচবোধও করে না। বুড়িকে তুলে বলে--- "ঠাকুমা কাঁদছো কেন? তোমায় কেউ বকেছে? তোমার ছেলেরা তোমায় তাড়িয়ে দিয়েছে?" ছোট্ট হারানের এই কথাগুলি শুনে বুড়ি আরো কান্না করেন। এরপর হারান তাকে এক জায়গায় বসিয়ে বাবার কাছ থেকে একশো টাকা চেয়ে  হাতে দেয়। এরপর বলে--- "বুড়িমা এই টাকাটা রাখো। খাবার কিনে খাবে। আর একদম কাঁদবে না। আমার প্রভু শ্রী রামচন্দ্র তোমাকে অবশ্যই পথ দেখাবেন।" এরপর হাত দিয়ে বুড়ির চোখের জল মুছে দিয়ে বলে---"এবার একটু হাসো, হাসো বলছি।" এই বলে লেজ দিয়ে বুড়ির মুখে সুড়সুড়ি দেয়। বুড়ি এবার না হেসে পারেন না। তাকে বলেন---"বেঁচে থাকো বাবা, অনেক বড় হও।"এরপর হারান ও তার বাবা-মা ট্রেনে গিয়ে বসে।
            ট্রেনের মধ্যে থাকা যাত্রীরা কেউ কেউ তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে। বলে---"এই দেখো, একটা বান্দর এসেছে।" আবার কেউ বলে-- "কি অসাধারণ লাগছে! সকালবেলা হনুমানজিকে দেখে যাত্রা, মানে আজ ভালো কিছু হতে চলেছে।" ট্রেনের মধ্যেও মাঝে মাঝে হারান 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি দিতে থাকে। কয়েকজন যুবকযাত্রীও তার সাথে বলে ওঠে 'জয় শ্রীরাম'। হারানের পাশে বসে থাকা একটি সাত-আট বছরের ছেলে মাঝে মাঝে হারানের নকল লেজটা হাত দিয়ে টিপে টিপে দেখছিল, আর বারবার হারানোর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। সেই ছেলেটি একবার হাততালি দিয়ে বলে ওঠে--- 'হনুমান।' হারান তাতে কিছুই মনে করে না। হারানদের সামনে থাকা একটি বছর চার-পাঁচের মেয়ে হারানের হনুমান রূপ দেখে খুবই ভয় পাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই তার বাবাকে কান্না করে বলছিল--- 'বাবা হনুমান। আমি ভয় পাচ্ছি।' সেই লোকটি বুঝতে পারেন তার মেয়ে হনুমানের অবয়ব দেখে ভয় পাচ্ছে। তখন সে একটু উগ্রভাবে মদন হাতিকে বলে--- "দাদা, আপনার ছেলেকে দেখে আমার মেয়ে ভয় পাচ্ছে। আপনারা অন্য বগিতে যান। তাছাড়া ওকে অনেকেই নিতে পারছেনা।" জনৈক লোকটির কথা শুনে মদন হাতিরা চুপ করে থাকেন। মদন হাতি হারান হাতিকে বলে--- "বাবা, আমরা অন্য বগিতে চলো। এখানে অনেকে ভয় পাচ্ছে।" হারান বাবার কথা শুনে বলেন--- "আমি এই জায়গা থেকে উঠব না।" ওই জনৈক লোকটি আবার তাদের উঠে যেতে বলে। কিন্তু হারান ওঠে না। এরপর লোকটি প্রচন্ড মাথা গরম করে মদন হাতির সঙ্গে ঝামেলা শুরু করে। কথা কাটাকাটি হতে হতে হঠাৎ লোকটি মদন হাতির গালে একটা চড় মারে। মদন হাতিও তাকে মারেন। এরপর ওই লোকের সঙ্গে থাকা আরো দুজন যুবক মিলে হারান ও মদন হাতিকে খুব মারধর করে। অন্যান্য যাত্রীরা থামানোর চেষ্টা করেও থামাতে ব্যর্থ হয়। তারা যখন দেখে ছোট্ট হারানকে মারছে, তখন কয়েকজন যাত্রী সেটি মেনে নিতে পারেন না। ফলে তারা  ওই আগন্তুক তিনজনকে রাম ধোলাই  দেয়। রেল পুলিশ এসে বিষয়টা সামলে নেন। তারপরে একটা স্টেশনে মদন হাতি  ও আগন্তুক লোকেদের সবাইকে পুলিশ নামিয়ে দেন। এরপর একজন আরপিএফ বলেন--- "আপনাদের কপাল ভালো যে, লকাপে দিলাম না। বাচ্চা গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ছেড়ে দিলাম।" হারান ও মদন হাতির কপাল থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। দুজন সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে এসে তাদেরকে একটা দোকানের বেঞ্চের নিয়ে গিয়ে বসান। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা করে এই অবস্থার কারণও জানতে চান। সব শুনে খুবই দুঃখপ্রকাশ করেন তারা। একজন বলেন--- "ওই ব্যক্তি মানুষ না শয়তান! এইটুকু ছেলেকে কেউ এভাবে মারে!!" হারানের বাবা ও মায়ের দুচোখের কোণে জল গড়ায়। তারপর ঘন্টাখানেক বাদে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে তারা সেদিন বাড়ি ফিরেছিল। এই ঘটনাটা বহুদিন তাদের মনে দাগ কেটেছিল। সেই থেকে হারান আর কখনো বহুরূপীদের মতো সেজে মানুষের মনোরঞ্জন করেনি। সে বুঝেছিল, যা একজনের মনোরঞ্জনের, তা অন্যের ভয়েরও কারণ হতে পারে।

==========================

মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩