Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

কেল্লা দেখতে রাজস্থান ।। দীপক কুমার পাল

 

কেল্লা দেখতে রাজস্থান

 দীপক কুমার পাল

সকালের পড়া বাংলা খবরের কাগজটা সন্ধ্যেবেলা আর একবার নেড়ে-চেড়ে দেখছিলাম, আমার ছেলে শুভ ইনস্টিটিউশন থেকে ফিরে সোজা আমার ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলো,

- ' বাবা রাজস্থান ঘুরতে যাবে নাকি? ' আমি তো অবাক।

- ' আরে না। এই বয়সে আমি ও তোর মা পারবো নাকি কেল্লা সব ঘুরে দেখতে? সবই তো পাহাড়ের ওপরে। আমাদের পক্ষে একেবারই অসম্ভব। তুই বৌমা আর নাতিকে নিয়ে ঘুরে আয়। আমরা এখানেই থাকবো।'

- ' তুমি বলেছিলে না যে তোমার মরুভূমি দেখা হয় নি। এবার সেই সুযোগটা এসেছে। আসলে এলটিসি টা একবছর আরও এক্সটেনশন হয়েছে। তুমি প্ল্যান বানাও। তোমাদের ঘুরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার। আমরা সবাই যাবো, যেটা মনে হয় পারবে না সেখানে যাবো না। কিন্তু আমরা সামসান্ড ডিউনসে যাবই। তৈরি হও।'

              ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো শুভ। ওর নিজের ঘরে ঢুকতেই বাবুসোনার কথা কানে এলো, 'বাবা, দাদুকে তুমি কোথায় নিয়ে যাবে?'

শুভর কথা ভেসে আসলো ‘শুধু দাদুকে নয় আমরা সবাই সোনার কেল্লা দেখতে রাজস্থান

যাবো। মরুভূমি দেখতে যাবো।'

'কি মজা হবে! আমি সেখানে বালির পাহাড় বানাবো।' আনন্দে বাবুসোনা হাততালি দিয়ে উঠলো। যদিও কয়েক মাস আগেই ও দুবাইয়ে মরুভূমি দেখেছে, উটেতেও চরেছে। আমি কিন্তু আমার স্ত্রী শীলার কথা চিন্তা করছি। আমাদের দুজনের জন্য ওদের রাজস্থান ভ্রমণ মাটি হবে না তো?

              ২৪সে ডিসেম্বর, ২০২২। কলকাতা বিমান বন্দর থেকে ডাইরেক্ট ফ্লাইটে উদয়পুর বিমানবন্দরে পা রাখলাম। ঘড়িতে তখন সকাল সওয়া এগারোটা। শুভ আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিল এক গাড়ির ড্রাইভার। পরে তার নাম জেনেছিলাম, গোপাল ভূঁইন। আমরা তার খোঁজে বিমানবন্দরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। গোপাল ভূঁইন গাড়ি নিয়ে আসতেই আমরা তাতে চেপে বসলাম। আমাদের হোটেল বুকিং করেছে শুভ জগদীশ মন্দিরের কাছে। দূর আছে এয়ার পোর্ট থেকে। গাড়ি রওনা দিল।

উদয়পুর শহরটা খুব সুন্দর। বিদেশি পর্যটকদের ভিড় খুব। উদয়পুর রেলওয়ে স্টেশনটাও সুন্দর খুব। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাথে রেলওয়ে যোগাযোগ আছে। অতি সুন্দর ব্যবস্থা। এছাড়া আছে অতি সুন্দর পিচের রাস্তা, যা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে বাস, ট্যাক্সি, ক্যাব বিভিন্ন দিকে অনবরত। কোনোটা যাচ্ছে চিতোর বা রনকপুর, কুম্ভলগড় হয়ে আজমীর বা আরও এগিয়ে রাজধানী জয়পুর। কোনোটা যাচ্ছে আবু রোড হয়ে মাউন্ট আবু বা গুজরাটের আমেদাবাদে। আবার কোনটা যোধপুর বা বিকানির হয়ে মরুভূমির দেশ জয়সালমিরে। এছাড়া উদয়পুর একটা ঐতিহাসিক শহর, এখানে আছে রাজপুত রানাদের নানা বীরত্ব কাহিনী। মহরানা উদয় সিংহ, রানা প্রতাপ সিংহ, মহরানা সংগ্রাম সিংহ ইত্যাদির বীরত্ব গাঁথা মিশে আছে এর পথের ধুলায়। দিল্লির বাদশা আকবরের কাছে চিতোর পতনের পর মহরানা উদয় সিংহ ১৫৬৯ সালে সমুদ্র প্রিষ্ঠ থেকে পাহাড়ের ৫৭৭ মিটার উঁচুতে এই শহর গড়ে তোলেন। তার নামেই এই শহরের নাম হয় উদয়পুর। তিনি ছিলেন সূর্য্য বংশীয় রাজা।

              আমাদের হোটেলটি ছিল জগদীশ মন্দিরের কাছাকাছি। আমরা হোটেলে ঢুকে স্নান খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম। গোপাল ভূঁইন গাড়ি নিয়ে নিচেই অপেক্ষা করছিল। শুভ গোপাল ভূঁইনের সাথে আমাদের গোটা টুর নিয়ে আলোচনা করে নিলো। আমরা তিনদিন উদয়পুর থাকবো। এখানে থেকে দুদিন লোকাল টুর করে তৃতীয় দিন চিতোর গিয়ে গোটা দিন চিতোর দেখে ফিরে আসবো। চতুর্থ দিন মাউন্ট আবু ঘুরে, থাকবো। পঞ্চম দিন সকালে যোধপুর যাবো, উমেইদ ভবন প্যালেস দেখে হোটেলে থাকবো। পরদিন সকালে মেহেরনগড় দুর্গ দেখে সোজা জয়সলমির। জয়সালমিরে দুদিন থেকে, অষ্টম দিন আবার যোধপুরে থেকে, নবম দিন সকালে বিমানবন্দর পৌঁছে দিয়ে ওর ছুটি। গোপাল ফিরে যাবে উদয়পুর।

            গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। রানা প্রতাপ মিউজিয়ামের গেটে গাড়ি দাঁড়ালো। ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়লো প্রিয় ঘোড়া চেতকের পিঠের ওপর রানা প্রতাপ সিংহের অপূর্ব ব্রোনচ্ মূর্তী। ওর কাছেই আছে লোহার তৈরি নানা সাইজের পুরুষ ও নারী মূর্তী। মূর্তিগুলোর মাথার দিকটা এমন ভাবে ফাঁকা আছে যে, যে কেউ ঐ ফাঁকা জায়গায় নিজের মুখটা রাখলে মনে হয় একজন রাজপুত বা রাজপুতানি দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনোটা আছে যুদ্ধের বেশে। সেখানে তাই ফটো তোলার ভিড়। ভিতরে বিভিন্ন  রানা মহারানাদের ফ্রেস্কো চিত্র সমেত নানা মূর্তী এমন ভাবে রাখা আছে যা গাইড নিয়ে না গেলে বোঝার অসুবিধা হবে। যদিও ঘটনা দেয়ালে সব লেখা আছে, সেটা শুধু হিন্দিতে। তাই অনেকের অসুবিধা হতে পারে। গাইড থাকলে সেই বুঝিয়ে দেবে একের পর এক ঘটনাগুলো। সেই সব ঘটনা রাজপুত রানাদের সব বীরত্বের ইতিহাস। এছাড়া আছে সাউন্ড অ্যান্ড লাইট। বেশ কয়েকটা ঘরের মধ্যে আছে পরপর রাজপুত ও মোঘল পাঠানদের নিয়ে সমগ্র ইতিহাসের সম্পূর্ণ ধারা বিবরণী। এরপর আমরা গেলাম পিছলা লেক। সিটি প্যালেসের পশ্চিমে প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে মহারানা উদয় সিংহ ১৪ শতকে এই পিছলা কাটিয়ে ছিলেন। আমরা যেখানে পৌঁছলাম সেটা সানসেট পয়েন্ট। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। আকাশে একদম নিচের দিকে একটা মেঘের আস্তরণ থাকায় সূর্যাস্ত পুরোটা দেখতে পেলাম না। লেকে বোটিং এর ব্যবস্থা আছে।

 

            পরদিন আমরা গেলাম সিটি প্রাসাদ দেখতে। বুকিং কাউন্টারগুলোতে ভীষণ ভিড়। ওই দিন ছিল ২৫সে ডিসেম্বর, তায় রবিবার, তাই এত লোকারণ্য। পূর্ণ বয়স্ক লোকের টিকিটের মূল্য ৩৫০ টাকা, ছোটদের ১৫০ টাকা আর বয়স্কদের জন্য ২৫০ টাকা। ১৬ শতকে এই দুর্গ বানান উদয় সিংহ। এরপর ১৭ শতকে জগৎ সিংহ আরও কিছু মহল তৈরি করান বিদেশি ঘরানায়। বড়ি মহল, শিশু মহল, দিলখুশ মহল, কৃষ্ণ ভিলা, ভীম ভিলা ইত্যাদির দেওয়ালের গায়ে কারুকার্য অতি মনোরম। চোখে দেখে মনে তৃপ্তি আনে। দেওয়ালে আঁকা চিত্র ও নানা ফ্রেস্কচিত্র অপূর্ব। অত্যন্ত ভিড় থাকায় ভালো করে দেখতে পারিনি। বিভিন্ন মহলে কাঁচ ও পোর্সিলিনের মূর্তী, মিনিয়েচারের কাজ, ফ্রেস্কচিত্র দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। চিনি মহলের টালির অলঙ্করণ অতীব মনোহর। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যেও যতটুকু দেখলাম সেটুকুই যথেষ্ট। এরপর লাঞ্চ খেতেও অনেক বেগ পেতে হলো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর যদিও বসতে পেলাম তো, অর্ডার নিতে আসেনা কেউ। যদিও অর্ডার নিলো তো টেবিলে খাবার আর আসে না। মোটামুটি ১ ঘণ্টার ওপর লাগলো হোটেল থেকে বেরিয়ে আসতে। তবে রাস্তার ওপারেই ফতে সাগর লেক ছিল বলে খাওয়ার টেবিলে বসে চারিদিকে পাহাড় ঘেরা লেক তার ওপর প্রাসাদ ও লেকে বোটিং এর দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। এরপর গেলাম ফতে সাগরের পুব পাড়ে সহেলীও কি বাড়ি ও বাগান। অবশ্য নেহেরু পার্ক দেখার পর। ওই পার্কে আমার নাতি বাবুসোনা কিছুটা সময় দৌড়াদৌড়ি করে নিল। সহেলিওকি বাড়ি দিল্লির সম্রাট ভেট দেন ১৮ শতকে মহরানা সংগ্রাম সিংহকে। এর ভিতর ঢুকতেই মনে হলো কি অপার প্রশান্তি বিরাজ করছে এখানে। কি সুনিবিড় পরিবেশ। পুকুরের ঠিক মাঝখানে ছত্রিশ আর তাকে ঘিরে পুকুরের চার পাশে অসংখ্য ফোয়ারা। পারে গেলে  ফোয়ারার হালকা জলে ভিজে যায় জামাকাপড়। অপূর্ব লাগে। পিছনের পুকুর পদ্মফুলে ঢাকা। সেটাও দেখতে দারুন সুন্দর। এই পুকুরগুলোতে সব সময় বৃষ্টির শব্দের মত ঝির ঝির শব্দ হতে থাকে তাই এর নাম বিন বাদল বরসাত। এছাড়া এখানের বাগানগুলো খুবই সুন্দর। কত রকমের ফুলগাছ আর তাতে কতরকমের যে ফুল কি বলবো। একেক রকম জাতের ফুলগাছের কত রঙের যে ফুল হয় না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সত্যি  ভীষণ ভালো লাগলো।

              পরদিন সকাল ৯ টায় স্নান ও ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম রাজপুত রানাদের বীরত্ব গাঁথা চিতোরে। এখানে চিতোরের রানী পদ্মাবতী জহর ব্রত পালন করে সমস্ত সখি সমেত অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। ছোট বেলায় ইতিহাসে এটা পড়ে মন খারাপ হতো খুব। বিশাল জায়গা জুড়ে এই চিতোর দুর্গ ও তার আশপাশটা গড়ে উঠেছে। এখন মনে হয় কিছুটা জায়গা দখলীকৃত হয়ে কিছু দোকান পাট গড়ে উঠেছে। বলা যায় ব্যবসা কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আবার কিছু বাসস্থান তৈরিও হয়েছে ও বসবাস করছে লোকে। প্রশাসনের অবহেলার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। রাস্তায় আমরা লাঞ্চ করে নিয়েছিলাম।  দুর্গে ঢুকতে পৌনে একটা। এই চিতোর দুর্গের ইতিহাস অতি দীর্ঘ। ১৩০৩ সালে আলাউদ্দিন খিলজীর হাতে ধ্বংস হয় এই নগরী। রানা রতন সিংহের পতনী রানী পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করতে চাওয়ায় ঐতিহ্য বজায় রেখে রাজপুত পুরুষ ও রমনীরা প্রতিবাদ করে ওঠে। কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজী কৌশলে রতন সিংহকে বন্দী করে সৈন্য সামন্ত নিয়ে দুর্গ আক্রমণ করে প্রবেশ করে দুর্গে। রানী পদ্মাবতী বহু রাজপুত রমনীকে নিয়ে আগুনে আত্মাহুতি দেন। খিলজী দখল করে দুর্গ। এর বহু বছর পরে রানা কুম্ভ পুনরায় দখল করে এই দুর্গ। গড়ে তোলে এক বিজয়স্তম্ভ। এরও পরে ১৫৬৮ সালে দিল্লির সম্রাট আকবর চিতোর আক্রমণ করে চিতোর দুর্গ দখল করে। রানা উদয় সিংহ পালিয়ে গিয়ে রাজ্য স্থাপন করেন উদয়পুরে। জাহাঙ্গীর দিল্লির সিংহাসনে বসে ১৬১৫ সালে চিতোর প্রত্যর্পণ করে রানাদের হাতে। কিন্তু রানাদের রাজ্যপাট থাকে উদয়পুরেই। কিন্তু এর আগে রানা প্রতাপ সিংহের বীরত্বের কথা ইতিহাস সমৃদ্ধ। তিনি কখনো বশ্যতা স্বীকার করেন নি। যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন ১৫৯৭ সালে। আমরা গভর্নমেন্ট নির্দিষ্ট রেটে গাইড নিলাম। ৪ জন পর্য্যন্ত হলে ফুল ডে ৪০০ টাকা হাফ ডে ২৮০ টাকা ৫ জন বা তার বেশি হলে ফুল ডে ৫৩০ টাকা আর হাফ ডে ৪০০ টাকা। ঘুরে দেখতে দেখতে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। রানা রতন সিংহ অন্য মতে ভীম সিংহের প্রাসাদ রানী পদ্মিনীর মহল চতুর্দিকে জলের মধ্যে অবস্থিত। এই জলেই রানী পদ্মিনীর ছায়া দেখে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয় খিলজী। রানী পদ্মিনী ঘৃণার সাথে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। খিলজী দুর্গ অবরোধ করে। যেখানে রানী পদ্মাবতী সহ অনেক রমণী আত্মাহুতি দেয় সেই জায়গাটি ২০০১ সালে সরকার পুরোটা ভরাট করে এবং ওর ওপর সৌধ স্থাপন করে। রানীর সাজগোজ করার প্রাসাদ ও বারাতির পালকি ইত্যাদি তার সাথে সহেলিদের এবং দাসদাসীদের থাকার জায়গা যে প্রাসাদে ছিল সেই সব প্রাসাদের কারুকাজ দেখার মতো। এছাড়া মীরা বাইয়ের মন্দির যেখানে মীরাবাই নিজেই থাকতেন সেটা ভারী সুন্দর। রাজপ্রাসাদে রাজার সাথে মতের মিল না হয়ায় তিনি নিজেই এই ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রটিও বেশ বড়ো। খুব  ভারাক্রন্ত মন নিয়ে চিতোর ছেড়ে যাত্রা করলাম উদয়পুরের দিকে।

পরের দিন অর্থাৎ ২৭ সে ডিসেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম মালপত্র নিয়ে মাউন্ট আবুর উদ্দেশ্যে। মসৃণ রাস্তায় গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো গোপাল। একসময় গাড়ি আবু রোড ছেড়ে পাহাড়ী পথ ধরলো। আবু শহরের উচ্চতা ৪০০০ ফুট। পাহারের রাস্তা সুন্দর এবং দৃষ্টি নন্দন। তবে পাহাড়ে সবুজের আধিক্য দেখা যায় না। পথের ধারে গার্ড ওয়ালে শয়ে শয়ে লম্বা লেজওয়ালা হনুমান বসে থাকতে দেখা যায়। পথ চলতি সব গাড়ি ও বাইককে ওরা নিরীক্ষণ করে পুলিশের মতো। দেখতে বেশ মজা লাগে। বেলা ১২ টার আগেই আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম। রাস্তার ধারে হোটেলটি ভারি সুন্দর। লাঞ্চ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়ি দিলওয়ারা টেম্পল দেখার উদ্দেশ্যে। সত্যি বলতে কি মনে মনে  একটা সুপ্ত বাসনা ছিল মাউন্ট আবুতে দিলওয়ারা টেম্পল দেখার বহু বছর ধরে। তাই এক দুর্গাপূজা নবমী সকালে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম যোধপুর পার্কের পূজা মন্ডপে। সে বছর সেখানে মন্ডপ তৈরি হয়েছিল দিলওয়ারা টেম্পলের আদলে। সেই মন্ডপ দেখে আসলটা দেখার ইচ্ছেটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। মনে মনে তাই খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম খুব। কিন্তু মামনি আসতে পারে নি ওর ইমার্জেন্সী ডিউটির জন্য। তাই একটু খারাপও লাগছিল। কিন্তু এটাও জানি যে সেও খুব তাড়াতাড়ি এই জৈন মন্দির দেখতে আসবে।

            এই ৫ টি জৈন মন্দিরগুলো তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০০ বছর। ১১ শতক থেকে ১৩ শতক। তখন তো রাস্তাঘাট ছিল না যাতায়াতের কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। পাহাড়ের রেঞ্জ বেয়ে হাতির পিঠে চাপিয়ে এই মার্বেল পাথরগুলো আনা হয়েছিল। কারিগরেরাও আসে এই পাহাড়ের রেঞ্জ বেয়ে। এই সব কারিগরদের হাতের কাজ দেখলে বিস্মিত হতে হয়। কি আশ্চর্য ছিল তাদের শিল্প প্রতিভা যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পাঁচটি মন্দিরের নাম আদিনাথ, নেমিনাথ, মহাবীর, ঋষভদেব ও পার্শ্বনাথ। এর মধ্যে পার্শ্বনাথ মন্দিরটি সবচাইতে পুরানো ও ভগ্নাবস্থা। কিন্তু  আদিনাথ আর নেমিনাথ মন্দির দুটোর কারুকাজ অসাধারণ। মন্দিরের ভিতরের স্থাপত্য ভাস্কর্য ও মর্মর পাথরে অতি সূক্ষ কারুকাজ দেখতে দেখতে মোহিত হতে হয়। প্রতিটা পিলারের আলাদা আলাদা সূক্ষ কারুকাজ। কোনটার সাথে কোনটার মিল নেই। আবার দুটো পিলারের মাঝের সিলিংগুলোরও আলাদা আলাদা কাজ। করভিং মার্বেল পাথরে কি করে যে খোদাই করে বিভিন্ন দেব দেবী, ফুল, লতাপাতা, পশুপাখি, মানুষে টানা পালকি ও রথ ইত্যাদি দিয়ে সিলিং, দেওয়াল ও পিলারগুলো সেটিং করেছে যে অবাক হয়ে খালি চেয়ে থাকতে হয়। চোখ ফেরানোকঠিন। একটাই আফসোস এ সবের কোনো ফটো তোলা গেলো না। কারণ ফটো তোলা নিষেধ। ক্যামেরা তো দূরের কথা মোবাইল পর্য্যন্ত কাউন্টারে জমা দিয়ে যেতে হয়। অতি আচ্ছন্ন চিত্তে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

              এরপর আমরা গেলাম নাককি লেক। লেকটি ভারী মনোরম। চতুর্দিকে উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা, লেকের মাঝে খুব সুন্দর সুন্দর ফোয়ারা আছে। লেকে বোটিং এর ব্যবস্থাও ভালো। এই সুন্দর পরিবেশের জন্য কিছুটা সময় বসতেই হলো। তারপর দু একটা ছোটখাটো পয়েন্ট দেখে গাড়ি সোজা গিয়ে দাঁড়ালো সানসেট পয়েন্টের অদূরে।  এখান থেকে অনেকটা ওপরে উঠতে হয় সূর্যাস্ত দেখতে।  ঘোড়ার চাহিদা খুব। আছে ট্রলির ব্যবস্থা। এতে সামনে পেছনে দুটো সিট আছে। পাশাপাশি দুজনকে নিয়ে ঠেলে ঠেলে দুজনে উপরে নিয়ে যায়। আমি আর শীলা ট্রলিতে আর শুভ ও শ্বেতা নাতিকে নিয়ে ঘোড়ায় উঠলো। সানসেট পয়েন্টে পৌঁছলাম। এই উপত্যকাটি এখানেই শেষ। নিচে গভীর খাদ। বেশ নির্জন জায়গাটা। ভিড় জনিত কারণে এখন কোলাহলে পরিপূর্ণ কিন্তু এর পরে আবার নির্জনতা নেমে আসবে। হেঁটে আর একটু ওপরে উঠলাম রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। সত্যি এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অপূর্ব। একটু সময় নিয়ে পশ্চিম আকাশটাকে লাল করে দিয়ে ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে সূর্য্য। তারপর একসময় টুপ করে ডুবে যায়। কিন্তু তবুও আকাশটা লাল থাকে কিছুক্ষণ। এর পরেই শীত বাড়তে থাকে। বহু লোক এসেছিল সূর্যাস্ত দেখতে। সবার সাথে আমরাও হেঁটে ফিরলাম গাড়ির কাছে। অবশ্য গাড়িটা খুঁজে পেতে একটু সময় লেগেছিল। হোটেলে ফিরলাম। যা দেখা হলোনা, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের মন্দির ৫০০০ ফুট ওপরে অন্য পাহাড়ে। আর আচলগড় দুর্গের শিব মন্দির। এই শিবমন্দিরে শিবের পায়ের আঙ্গুল পূজিত হয়।

পরের দিন সকাল সাড়ে নটায় স্নান  ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম যোধপুরের উদ্দেশ্যে। পথে লাঞ্চ করে নিয়েছিলাম। হোটেলে ঢোকার আগেই বিকেল ৪টায় আমরা গাড়ি নিয়ে উমেদ ভবনের সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। ঘড়িতে তখন বাজে বিকেল চারটা। পাঁচটায় এ প্যালেস বন্ধ হয়ে যায় পাবলিকের জন্য। শুভ টিকিটের জন্য লাইন দিলো। টিকিটের মূল্য বড়দের ৬০ টাকা আর ছোটদের জন্য ৩০ টাকা। লাল রঙের বেলে পাথরে তৈরি এই প্যালেস। উমেইদ সিং ১৯২৯ সালে এই ভবন নির্মাণ শুরু করেন ও শেষ করেন ১৯৪২ সালে। এই প্যালেসেই তিনি ১৯৪৭ সালে মারা যান।  প্রাসাদের মিউজিয়ামে আছে দেওয়ানী খাস দেওয়ানী আম ও লাইব্রেরি ভবন। সোনায় মোড়া বহু চিত্র ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক খুবই যত্ন করে সাজানো আছে। আর আছে ঘড়ি ঘর। কত রকমের ছোট বড়ো মাঝারি ও ক্ষুদ্র ঘড়ি যা বহু পুরানো আমলের ও নানা ডিজাইনের একটা বড় ঘরে দেওয়ালের ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত সাজানো আছে দেখলে অবাক হতে হয়। বড়ো বড়ো টেবিলে কাঁচের বাক্সেও আছে। হাত ঘড়ি এমন কি আঙ্গুলের ঘড়িও  আছে এখানে। বাইরের বাগানে আছে কলা শিল্পের নিদর্শন। বিভিন্ন জীব-জন্তু-পাখি ইত্যাদির সুন্দর প্রতিকৃতি। আর আছে কম করে ১২টা বিদেশি অতি দামী গাড়ির সংগ্রহশালা। rols rayes ই আছে ৪/৫ টা। এছাড়া আছে বুইক, মার্সিডিজ বেনচ্, ডজ ইত্যাদি। দেখে টেখে হোটেলে ঢুকলাম সন্ধ্যেবেলা।             

পরদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে হোটেল ছেড়ে দিলাম। প্রথমে গেলাম মেহেরনগড় দুর্গ। যোধপুরের এই দুর্গটি তৈরি করান যোধা রাও ১৪৫৯ সালে। চতুর্দিকে খুব উঁচু প্রাচির ও বাইরে পরিখা বেষ্টিত এই দুর্গটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। এর পরিধি দৈর্ঘ্য ৪৫৭ মিটার ও প্রস্থে ২২৮ মিটার। উচ্চতাও এর অনেক। দুর্গের বাইরের কারুকাজ দেখার মতো। বাইরের ফটক পেরিয়ে ভিতরে না ঢুকলে বোঝা যায় না এর বিশালত্ব। যুদ্ধে মুঘলরা এই দুর্গ করায়ত্ব করতে পারে নি। বরং বৈবাহিক সূত্রে তাদের সাথে মিত্রতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। উদয় সিংহের বোনের সাথে দিল্লির নবাব আকবরের ও আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরের সাথে উদয় সিংহের কন্যার বিবাহ হয়েছিল। তবে ১৭৬৮ সালে ঔরঙ্গজেব এই দুর্গ জয় করেন এবং নগরী ধ্বংস করেন। পরে অজিত সিংহ পুনরায় এই দুর্গ দখল করেন। যুদ্ধ জয়ের স্মারক স্বরূপ দুর্গের পশ্চিমে গেটওয়ে অফ্ ভিকট্রি তৈরি করেন অজিত সিং ১৭০৮ সালে। সম্মিলিত ভাবে জয়পুর ও বিকানীর রাজাদের আক্রমণ পরাজিত করতে পারেনি যোধপুরের রাজাকে। দুর্গের দেওয়ালে কামানের গোলার চিনহ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। দুর্গের স্থাপত্য শৈলী, ভাস্কর্য, অলঙ্করণ এবং জানালায় জাফরির কাজ অনিন্দ্য সুন্দর বলা যায়। ফুল মহল ৮০ কিলো সোনা দিয়ে তৈরি অনেকটা শীষমহলের মতো যা এক কথায় অনবদ্য। মতিমহলে রাজা রানিদের হাতির পিঠের হাওদা নানারকমের বা বিভিন্ন রকমের সুন্দর সুন্দর পালকি দেখে ভালো লাগে। রাজকীয় ব্যবস্থা ছিল দেখার মত। অস্ত্রশলায় অস্ত্রশস্ত্রের বিরাট প্রদর্শনী। দুর্গের প্রাসাদের বৈভব, রাজকীয়তা আর প্রাচুর্য্য প্রতিটি মহলে মহলে বিদ্যমান। দুর্গের প্রাকার হতে শহরের দৃশ্য ভারী সুন্দর। পাশেই আছে যশোবন্ত থারা। মহারাজা যশোবন্ত সিংহের স্মারক সৌধ। নির্মাণ করেন রানী ১৮৯৯ সালে। আরও তিনটি সৌধ আছে। সবগুলোই শ্বেত পাথরের তৈরি।

              মেহেরনগড় দুর্গ আর যশোবন্ত থারা ভালো ভাবে দেখে নিয়ে আমরা জয়সলমিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। যোধপুর থেকে ১৮০ কিলোমিটার যাওয়ার পর বাম দিকে পড়লো বুলেট বাবা টেম্পল। কথিত আছে ওম সিং রাঠর নামে এক বাইক আরোহী এই রামদেওরাতে রাতে হঠাৎ রাস্তার পাশে একটা গাছে ধাক্কা মেরে পাশে এক ট্রেনচে পড়ে গিয়ে মারা যায়। বাইকটা ছিল রয়েল এনফিল্ড বুলেট। স্থানীয় থানা থেকে পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে ও বুলেটটা থানায় নিয়ে গিয়ে জমা করে। কিন্তু সকালে দেখে যেখানে বুলেটটা রেখেছিল সেখানে নেই।  থানার আশপাশে কোথাও বাইক টাকে খুঁজে না পেয়ে আবার যেখান থেকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখে বাইক ঠিক সেখানে একই ভাবে পড়ে আছে। আবার সেটাকে তুলে থানায় নিয়ে গিয়ে চেন দিয়ে বেঁধে রাখে। পরদিনও গিয়ে দেখে যথারীতি বাইকটা নেই। পরে দেখে বাইক অ্যাক্সিডেন্টের জায়গাতেই আগে যেভাবে ছিল ঠিক সেই ভাবেই পরে আছে। বিস্মিত গ্রামবাসীরা বাইকটা গাছের পিছনে একটা বড়ো কাঁচের ঘর বানিয়ে তার ভিতরে সাজিয়ে রেখে নিয়মিত পূজা করে। কাঁচের ঘরে একটা দরজা রাখা হয়েছে নিয়মিত পরিষ্কার করার জন্য। এই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল ২ রা ডিসেম্বর ১৯৯১ তে। ওই গাছটিতে ওম বান্না নামে একটা স্ট্যাচু ও একটা বড়ো ফটো আর ওই বাইকটা নিয়ে একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করে গ্রামবাসীরা নিয়মিত পূজা দেয়। জয়সলমিরের যাত্রীরা সেফ জার্নির জন্য এই মন্দির দর্শন করে যান। যারা সেটা না করেছে তাদের নাকি জয়সলমির যাত্রা শুভ হয়নি।

পথে লাঞ্চ সেরে আমরা জয়সলমির ফোর্টের পাশে হোটেলে পৌঁছলাম তখন বিকাল ৫টা বেজে গেছে। হোটেলের জানলা খুললে বা বারান্দায় গেলে ফোর্টের কিছুটা আর ছাদে গেলে পুরোটা দেখা যায়। এই ছাদে রান্না আর খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। যারা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া সহ্য করতে পারেন তারা ছাদে বসে কেল্লার দৃশ্য দেখতে দেখতে আহারের মজা উপভোগ করতে পারেন। আমরা অবশ্য দুদিন ঘরে খাবার আনিয়ে খেয়েছি।

              পরের দিন ৩০সে ডিসেম্বর, শুক্রবার আমাদের কাছে একটা বিশেষ দিন হিসাবে চিরদিন মনে থাকবে। ঠিক সকাল ৯.৩০ মি: একটা গাইড নিয়ে জয়সলমির ফোর্টএ প্রবেশ করলাম। ফোর্ট এর দৈর্ঘ্য ৪৫৭ মিটার ও প্রস্থ ২২৯ মিটার তৈরি হয় ১১৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। দুর্গের প্রবেশ পথ ৪টি। গণেশ পোল, সুরজ পোল, ভূটা পোল, হাওয়া পোল। মোট ৮টি জৈন মন্দির ও ৪টি হিন্দু মন্দির আছে। আর আছে আম দরবার। রাজা বসতেন পাথরের সিংহাসনে। চলতো বিনোদনের আসর। একটি মন্দিরে মহাবীরের মূর্তী পান্নায় তৈরি। পর্শ্বানাথজী মন্দিরের কারুকাজ ভারী সুন্দর। পাথরের কারুকাজ করা জাফরী দেখতে অনিন্দ্য সুন্দর। সিলিং রঙিন অলঙ্করণে সমৃদ্ধ। আছে বেশ কয়েকটি হাভেলী। পাটওয়ান কি হাভেলির বৈশিষ্ট্য অতুলনীয়। সরকার অধিকৃত এর ছাদ থেকে চতুর্দিকের দৃশ্য দেখার মতো। এছাড়া আছে নাথমলজির হাভেলি, সেলিম সিংজিকি হাভেলীর মুরাল জাফরির কাজ বিশ্ব বিখ্যাত। রাজা কি মহলেও তাই। এখানে বাজারও বসেছে প্রচুর। সোনা রঙের বা বালী রঙের তৈরি পাথরের কাজ করা জিনিস পাওয়া যায়। এরকম একটা দোকানে ঢুকে ছিলাম যেই দোকানে বিশ্ব বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় তার তৈরি 'সোনার কেল্লা' বইটির শ্যুটিং করেছিলেন। এখানকার বসবাসকারী লোকেদের বা দোকানিদের কাছে তিনি অতি প্রিয়। সিনেমাটিও ওদের খুবই প্রিয়। কলকাতা থেকে এসেছি বললে ওরা খুব খাতির করে বলে, 'মুকুল বাড়ি দেখা? ঔর নেহি দেখা তো অভি দেখ লিজয়ে।' ভারী ভালো লাগলো ওদের ঐরকম ব্যবহারে। আমরা দেখেছিলাম সোনার কেল্লার শ্যুটিংয়ের জায়গাগুলো। মুকুল বাড়ি এখন প্রায় ধ্বংসস্তুপ। মেরামত চলছে।

              কেল্লা থেকে বেরিয়ে গেলাম গদিসর লেকে। এটা দুর্গের কাছেই। এমন কিছু নয় তবে সুন্দর। বোটিংএর ব্যবস্থা আছে। অনেক দোকানপাটও আছে। এরপর আমরা সাম স্যান্ড ডিউনসে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। যাবার পথে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার গোপাল একটা সুন্দর দ্রষ্টব্য স্থান দেখাতে নিয়ে গেলো। কুলেধারা সেই জায়গার নাম। ১৩০০ শতাব্দীতে এটা ছিল পালিয়াল ব্রাহ্মণদের এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কথিত আছে আজ থেকে ২০০ বছর আগে কোনো এক দেওয়ান কুলধারা গ্রামের উপর ধার্য্য কর আদায় করতে এসে গ্রামের মুখিয়ার মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করতে চায়। কিন্তু মুখিয়া আর তার মেয়ে কেউই এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তখন দেওয়ানজী ফিরে যায় কিন্তু যাবার আগে বলে যায় যে সে আবার পরদিন লোকজন নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আসবে, তারা রাজি না হলে তাকে জোর করে নিয়ে যাবে। তাকে কে আটকায় সে দেখতে চায়। এদিকে গ্রামের কেউই এই অসবর্ণ  বিবাহ মানতে চাইলো না। এই খবর আশেপাশের প্রায় ৮৪টি গ্রামে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। তারপর গ্রামের মূখিয়ার নির্দেশে এক রাতের মধ্যে সব গ্রামের অধিবাসী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। পরদিন দেওয়ানজী সম্পূর্ন প্রস্তুত হয়ে এসেও গ্রামগুলোর অধিবাসীদের কোনো হদিস করতে পারেনি। গ্রামগুলো সব শূন্য এবং খাঁ খাঁ করছে। এরপর এই গ্রামে আর কেউ থাকতে পারে নি। সব সময় খালি পড়ে থাকে। সম্প্রতি নাকি সরকার এখানে সার্ভের কাজ করছে। দেখতে পাইনি আমরা।

এরপর আমরা পৌঁছলাম সাম স্যান্ড ডিউনসে এ যাবার টিকিটের জন্য। টিকিটের মূল্য ২৫০০ টাকা জন প্রতি। এই টিকিটের মূল্যের মধ্যে বাইক সাফারি আর কেমেল সাফারি ধরা আছে। আমি আর আমার স্ত্রী শীলা কোনো সাফারি করি নি। তবে শুভ শ্বেতা আর বাবুসোণা সাফারি করেছে। আর dunes এ আমরা বহুক্ষণ আনন্দে কাটিয়েছি। আমার নাতি বাবুসোণা মনের সুখে বালি নিয়ে আপন মনে খেলা করেছে। খালি সাফারির সময় আর একবার চা খাবার সময়টুকু বাদ দিয়ে পুরোটা সময় বালিতে খোঁড়া খুঁডি করে গেছে অতি উৎসাহে। সবার শেষে পশ্চিম আকাশে দেখলাম এক অসাধারণ সূর্যাস্ত। সারাটা আকাশ কি সুন্দর লাল হয়ে গিয়ে একসময় ডুবে গেলো সূর্য্য। রেখে গেলো হিমেল হাওয়ার স্পর্শ। মনটা একদম ভরে গেলো। আমরা আরও দু ঘন্টা পরে হোটেলে ফিরলাম। শেষ হলো আমাদের রাজস্থান ভ্রমণ। এবার যোধপুরে এক রাত থেকে কলকাতায় ফেরা।

পরদিন যোধপুর শেষ বিকালে পৌঁছলাম অবশ্য যোধপুর বাজারটা ঘুরে। এত বিশাল ও আধুনিক বাজার এবং খুব সুন্দরও বটে, না দেখলে সেটা বাকি থেকে যেত। আমরা অবশ্য জয়সলমির থেকে ফেরার পথে ওয়ার মিউজিয়ামটি দেখে নিয়েছিলাম।

তার পরদিন অর্থাৎ ২০২৩ সালের প্রথম দিন গোপাল ভুঁই আমাদের সকাল ১০.৪৫ মিনিটে যোধপুর বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়ে নমস্কার করে আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে উদয়পুর চলে গেলো। আমাদের ফ্লাইট টাইম ছিল ১২.৩০ মিনিটে। আমরা বেলা ৩টায় কলকাতার অতি চেনা মাটিতে পা রাখলাম।

০-০-০-০-০-০-০-০-০-

 

Dipak Kumar Paul,

DTC Southern Heights,

Block-8, Flat-1B,

Diamond Harbour Road,

Kolkata - 700104.

Mobile No. 9007139853

 

মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩