জায়ফলের অভিশাপ
সৌম্য ঘোষ
প্রকৃতির বিপর্যয়ের কথা উঠলেই আমরা শুনি, এটা মনুষ্যসৃষ্ট।
গত কয়েক দশক ধরে পৃথিবী ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা থেকে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, তুফান ইত্যাদির প্রকোপে মানুষের জীবন দুর্বিসহ ওঠার পিছনে মানুষের আচরণ সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু মানুষ বলতে আমরা কোন্ শ্রেণীর মানুষকে
এর জন্য দায়ী করবো?
ভারত মহাসাগরে জাভার পূর্বদিকে ছোট্ট একটি ভূখণ্ড বান্দা দ্বীপ। এই দ্বীপে প্রাকৃতিক ভাবে ফলতো জায়ফল (Nutmeg)।
সেই দ্বীপে হাজার হাজার বছর ধরে বাস করা আদিবাসী, জায়ফল গাছ
এবং নানান পশুপাখি, গাছপালা, তৃণগুল্ম , আদিবাসীদের ভাষা, সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও বিশ্বাস -- এই নিয়েই সেখানকার প্রকৃতি। সামগ্রিক অংশ। বান্দা দ্বীপের লোকেরা মনে করত, প্রকৃতি হচ্ছে তার অন্তর্ভুক্ত সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ, আকাশ ও ধরিত্রী, জল ও বাতাস -- সকলের।
১৬২১ সালে বর্বর ওলন্দাজ ঔপনিবেশিকরা তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এই শান্ত নিরীহ বান্দা দ্বীপ দখল করে। ইউরোপীয় লোভী দখলদারীরা মনে করতে শুরু করলো, প্রকৃতির ওপর তাদের একচ্ছত্র অধিকার। লুটেরাদের
যুক্তি হল, যার গায়ে জোর আছে তারাই প্রকৃতির অধিকারী হবে। শুধু তাই নয়, তারা এটাও মনে করতে লাগল যে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু মানুষের এই পৃথিবীতে থাকবার কোন দরকার নেই। সেই লোকগুলি 'অসভ্য' এবং লুটেরাদের 'সভ্য' পৃথিবীতে তাদের থাকবার অধিকার নেই। --- এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা ফ্রান্সিস বেকন। বস্তুত: ফ্রান্সিস বেকন এই দ্বীপবাসীদের "অধঃপতিত" এবং ''সভ্য আধুনিক পৃথিবীর নিয়ম উল্লঙ্ঘনকারী" হিসাবে চিহ্নিত করে। বর্বর ওলান্দাজ উপনিবেশিকরা জায়ফলের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে এবং দ্বীপের অধিবাসীদের উপর নামিয়ে আনে এক বীভৎস আক্রমণ।
এই দ্বীপের অধিবাসীদের তারা প্রথমে দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে আদেশ দেয়।
কিন্তু যারা হাজার হাজার বছর ধরে এই দ্বীপে বাস করে আসছে তারা কেন লুটেরাদের আদেশে দেশ ত্যাগ করবে? ফল হলো সাংঘাতিক!
পৃথিবীর ইতিহাসে সূচিত হলো এক নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচার। তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের 'সভ্য' ইউরোপীয়দের দ্বারা। কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং বাকিদের দ্বীপ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ওলান্দাজরা দখল করে নেয় বান্দা দ্বীপ। ওলান্দাজরা শুধু মানুষই নয়,
শেষ করে দিল দেয় একটা গোটা প্রকৃতির পরম্পরাকে স্রেফ লোভের বশবর্তী হয়ে। এইভাবে তারা জায়ফলের উপর একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করে।
এমন নির্মম ইতিহাস আমরা একটু পিছিয়ে দেখলেই অজস্র দৃষ্টান্ত পেতে পারি। সেই কালখণ্ডে, অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলি, যেমন, ব্রিটেন, পর্তুগাল, স্পেন প্রভৃতি শক্তিধর দেশগুলি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা মহাদেশের উপর। সেখানকার আদি অধিবাসীদের বহু গোষ্ঠীই কোথাও ৭০ শতাংশ, কোথাওবা ৯০ শতাংশ তাদের আক্রমণের মুখে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাদের ভাষা, সঙ্গীত, সংস্কৃতি।
কি বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ছিল এই হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাগুলো,
যার ভিত্তি ছিল প্রকৃতির অংশ হয়ে বেঁচে থাকা। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সমৃদ্ধশালী করে তোলা। সেই অধিবাসীদের সহস্রবছর ধরে গড়ে তোলা ইতিহাসকে লুটেরা ইউরোপীয় দেশগুলি শুধু নিশ্চিহ্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, যে অংশগুলি টিকে ছিল তাদের মানবিক মর্যাদা কেড়ে নিয়েছিল।
ভূমি ও প্রকৃতি লুণ্ঠন করে নিজেদের পুঁজির পরিমাণ বাড়িয়ে যাওয়ার উদাহরণ সারা বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্ত। আজও। আমাদের দেশেও এমন ঘটনা রয়েছে। সর্বত্র মানুষের দেশকে লুট করে পুঁজিপতি ও তাদের সাঙ্গাত রাজনেতাদের বিরাট আয়োজন। পুলিশ, সিপাহী, মিলিটারীদের প্রহারায় সুরক্ষিত তাদের লোলুপ সভ্যতার আগ্রাসনে কেবল আদিবাসীরাই নন, গোটা মানব প্রজাতি আজ বিপন্ন।।
_______________________________
ঋণস্বীকার:
"The Nutmeg's Curse : Parables for a planet in Crisis"
by Amitav Ghosh.
Penguin Books, 2021.
------------------------------------------------
সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন