Featured Post
ছোটগল্প ।। উড়ো মেঘের ইচ্ছে ডানা ।। দীপক পাল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
উড়ো মেঘের ইচ্ছে ডানা
দীপক পাল
ছেলেটাকে প্রতিদিন দেখা যায় বাম দিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে। জামাটা প্যান্টে পরিপাটি করে গোঁজা। কোমরে বেল্ট, পায়ে মোজা জুতো পরা। চলার মধ্যে একটা ছন্দ আছে। মোটামুটি স্মার্ট বলা যায় তাকে।আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছে। তারপর জেব্রা লাইন দিয়ে টু ওয়ে রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে লেডি ব্রাবর্ন কলেজের গেট পেরিয়ে ডান দিকের একটা সিগারেটের দোকান থেকে দুটো সিগারেট কিনে একটা বুক পকেটে রেখে আর একটা সিগারেট উল্টো দিকের একটা গাছে ঝোলান জ্বলন্ত দড়িতে ধরিয়ে নিয়ে খুব বড়ো করে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে যে রাস্তা দিয়ে এইমাত্র আসলো সেই রাস্তাটার দিকে একবার ভালো করে তাকাল। আসলে এই রাস্তাটা ওর খুব ভালো লাগে। রাস্তার দিকের ফুটপাথে সারি সারি দেবদারু গাছগুলোর কারণে। দেবদারু ওর খুব পছন্দের গাছ। যখন ফিরবে তখনও এই রাস্তা দিয়েই ফিরবে। তারপর আর একটু এগিয়ে সাত রাস্তার মোড়ের আগে জেব্রা ক্রসিং পেরিয়ে ময়দানের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে। ঢুকে থামেনা সে, হাঁটতে থাকে। গোটা ময়দানের ভিতরের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা চক্কর দিয়ে ময়দানের দক্ষিণ পশ্চিমে একটা ছোট্ট সাঁকো আছে আর তার নিচে একটা ছোট্ট লেক তাতে শাপলা ফুলের মতো কিছু ফুল ফুটে আছে। পাশে একটা টিলা আছে। সবটাই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের খেলার জন্য বানানো। এছাড়া আছে ছোট ছোট ফুল গাছের সারি, তার মধ্যে সিমেন্টের বসার জায়গা আছে। বেশ বড়ো সিমেন্টের সুন্দর ছাতাওয়ালা বসার জায়গা আছে। হঠাৎ করে বৃষ্টি নামলে যাতে করে বাচ্চারা সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ছেলেটি ওই সাঁকোর ওপর উঠে রোজ একটুক্ষণ রেলিং ধরে দাঁড়ায়। নিচের লেকের জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটদের দৌড়াদৌড়ি দেখে। তারপর সাঁকো থেকে নেমে টিলাটার ওপর উঠে বসে। এইসবগুলো ছেলেটির খুব ভালো লাগার ব্যাপার। রোজকারের অভ্যাস। এটা ওর একান্ত চিন্তার জায়গা। সে নিজের সাথে কথা বলে। এই সময়টার পর সে ফিরবে বন্ধুদের আড্ডায়। তখন সব আবার অন্য রকম পরিবেশ। সেখানেও ও খুব মানিয়ে যায়। ফেলে আসা পরিবেশের কোনো ছাপ পরে না তখন।
আজ ছেলেটি ভীষণ অন্যমনস্ক। একটু যেন চিন্তাক্লিষ্ট। প্রতিদিন যেখানে বসতে ভালোবাসে সেখানে আজ সে বসলো না। কেয়ারি করা ফুলেদের ঘেরাটপের মধ্যে রুমাল পেতে ঘাসের ওপর বসলো। সিমেন্টের বেঞ্চ দুটো খালি থাকলেও সেখানে বসলো না। আজ কয়েক মাস হোল ওর কোনো চাকরি নেই। লসে রান করার জন্য আর দুই পার্টনারের মনোমালিন্যের দরুন কোম্পানিটাই তুলে দিলো কর্মচারীদের কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে। মুস্কিল হলো এই, প্রথম থেকে চাকরি না করলে এক রকম. আর চাকরি করে তারপর চাকরি চলে গেলে প্রচন্ড মানসিক ও আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। ছেলেটিরও অবস্থা ঠিক হয়েছে সেইরকম। তাই বুঝি সে চিন্তিত আজ একটু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক তা নয়।ব্যাপারটা অন্য একটা কিছু নিয়ে।
ছেলেটি পার্ক সার্কাস ময়দানে আসতে গিয়ে পথের মাঝে ওই ফুটেই একটা সুন্দর দোতলা বাড়ির বারান্দায় একটি মেয়ে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে। খুব একটা সুন্দরী না হলেও মোটামুটি সুন্দরী বলা যায়। ছেলেটি ওই পথে হাঁটতে হাঁটতে দুর থেকেই ওই মেয়েটিকে দেখতে পায় বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে চুপচাপ। মেয়েটিও ওর আসার পথে তাকিয়ে থাকে। কাছাকাছি হলে দুজনে দুজনের চোখে নিবিড় ভাবে তাকায়। যতক্ষণ না ছেলেটি ওর চোখের বাইরে চলে যায় ততক্ষণই মেয়েটি চোখ সরায় না ছেলেটির চোখের থেকে। খুব ইচ্ছে থাকলেও ছেলেটি কিন্তু আর পেছন ফিরে তাকায় না, সেটা তার স্বভাবও না। সে এটাকে একটা খেলা মনে করে। আজ কিন্তু মেয়েটি ও কাছাকাছি আসলে ওর চোখের দিকে হাসিহাসি চোখে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না সে পেরিয়ে যায়। তারপর কিছুটা এগিয়ে যাবার পর আগে যা কোনো দিন করে নি সেটাই সে করলো। পেছন ফিরে মেয়েটিকে দেখলো। মেয়েটি কিন্তু তখনও তার চলার দিকে চেয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই মনে হলে সে তখনও হাসছে। তখন থেকেই তার মনে হলো এই বিড়ম্বনা থেকে কি ভাবে বেরোনো যায়। কারণ চাকরি চলে যাবার পর এখন সে যে সংকটের মধ্যে আছে সেই সংকট আর সে বাড়াতে চায় না। তবে কি সে এই সময়টাকে এড়িয়ে চলবে। আর এবার থেকে ডানদিকের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটবে। জ্ঞানত একটু বড়ো হবার সাথে সাথে এই পার্ক সার্কাস ময়দান তার সবকিছুর মধ্যে জড়িয়ে গেছে প্রতিটাদিন। মর্নিং ওয়াক, ইভিনিং ওয়াক, একসময় রোজ বিকালে ফুটবল খেলা, কখনও ক্রিকেট খেলা বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা, প্রতি বছর সার্কাস আর দুর্গাপূজা আর তার মেলায় ঘোরা ও আরো কত কি যে বলে শেষ করা যাবে না। না যে ভাবে সে রোজ হাঁটছে সেভাবেই হাঁটবে। তাছাড়া মেয়েটি তাকে কাপুরুষ ভাবতে পারে। ওর দিকে চোখ না তুললেই হলো। মনে মনে এটাই স্থির করে উঠে পড়ল ছেলেটা।
পরদিন যথারীতি ও যথাসময়ে সে ওই ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সেই সুন্দর বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই দেখে সেই মেয়েটা আজ আর নেই। ভারী অবাক হয় ছেলেটি। এতদিন ধরে যাকে প্রতিদিন ঠিক এই সময়টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে তার সাথে চোখা চোখী হয়েছে নিবিড় ভাবে তার হঠাৎ দুদিন এই অদ্ভুত আচরণ ছেলেটিকে বিস্মিত করে। গতকাল তার দিকে তাকিয়ে হেসে আজ অনুপস্থিত! ছেলেটি ভাবলো এটা হয়তো বড়লোক বাড়ির মেয়ের খামখেয়ালীপনা। কিন্তু সেটাতেও মন ঠিক সায় দিচ্ছে না। যাই হোক ও যেটা থেকে মুক্তি চেয়েছিল সেটাতো অতি সহজেই হয়ে গেলো, তবে আবার কি চলো মন আপন মনোবিতানে। তবু বুকে একটা কষ্ট হচ্ছে কি। ছেলেটি ঠিক বুঝতে পারে না। এদিকে সে পার্কের অদূরে এসে গেছে। যেখান থেকে জেব্রা ক্রসিং ধরে টু ওয়ে রাস্তা পেরিয়ে সে একেবারে উলটো দিকের ফুটপাথে গিয়ে ওঠে ঠিক সেই জায়গায় সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। তবে কি মেয়েটি তারজন্য দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি প্রতিদিনের মতো জেব্রা ক্রসিং ক্রস করার জন্য এগোলো ঠিক সেই সময় মেয়েটি হাত নেড়ে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলে,' এই যে একটু শুনুন '।
আশেপাশে অনেকেই মেয়েটির দিকে চোখ ফেরায়। ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে এক পা এগিয়ে গিয়ে বলে,
' আপনি কি আমাকে ডাকছেন '?
' ঠিক আপনাকেই ডাকছি, ভয় নেই বেশি সময় নেব না।'
-' বলুন কি বলবেন '?
-' সেটাকী এখানেই বলতে হবে? দেখছেন না আশে পাশের কেউ কেউ কেমন ভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে '। মেয়েটি খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো বললো।
' ঠিক আছে তবে চলুন ডন বস্কোর ওদিকে '।
' চলুন ' বলে মেয়েটি হাঁটতে লাগলো।
ছেলেটি তার রোজকারের যাওয়ার রাস্তাটার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো তারপর মেয়েটির ধীর পায়ে চলার ছন্দ মিলিয়ে তার পাশে পাশে চলতে শুরু করলো। এবার মেয়েটি ছেলেটিকে বলল,
-' কাল বিকেলে আপনাকে দেখে যে হেসেছিলাম আমি তাতে আপনার খুব রাগ হয়েছিল তাই না? সেই সময় আপনি ছিলেন খুব গম্ভীর। আমার যে কি হয়েছিল কাল কোনোদিন যা করিনি তাই করে এত আফসোস হচ্ছিল কালকে যে কি বলবো। আপনি আমাকে মাফ করবেন। এই কথাটা আপনাকে বলতেই আমি এসেছি '।
-' না না না, আমি মোটেই রাগ করি নি। কিন্তু অবাক হয়েছিলাম আমি। মাফ চাওয়ার আপনার কোনো কারণ নেই। আফসোসেরও কোনো কারণ নেই '।
' সত্যি তাই! শুনে খুব নিশ্চিন্ত বোধ করছি। আসলে কি জানেন আমি আপনাকে প্রতিদিন দেখি বিকেলে ঠিক একই সময় অত্যন্ত ফিটফাট হয়ে খুব স্মার্টলি হেঁটে আসতে। জামাটা প্যান্টের মধ্যে এত সুন্দর করে গোঁজা থাকে যে দেখলে আপনার রুচির পরিচয় প্রকাশ পাওয়া যায়। তারপর যেতে যেতে যখন ওপরে দাঁড়ানো আমার দিকে তাকান, আমি দেখি কি সুন্দর আপনার চোখের দৃষ্টি, একদম নিষ্পাপ মনে হয়। নিচে দিয়ে যেতে যেতে একবারের জন্যও আপনি পেছন ফিরে তাকান না। এতে আপনার চারিত্রিক দৃরতা প্রকাশ পায়। আমি কিন্তু আপনার চলার দিকে তাকিয়ে থাকি শেষ পর্য্যন্ত প্রায় '।
' আপনি কিন্তু আমায় ভারী লজ্জায় ফেলছেন। এটা কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে '। লজ্জিত ছেলেটি।
' না একটুও বাড়াবাড়ি না। আর একটা কথা, কদিন পরে আমার বিয়ে। সামনে প্রাইভেটে এম এ পরীক্ষা দেবো। আর পরীক্ষার পরেই বাড়ি থেকে আমার বিয়ের ঠিক হয়েছে। সারাদিন পড়াশোনা করে ঠিক ওই সময়টাই আমি একটু বারান্দায় দাঁড়াই। ওটা আমার বিশ্রামের সময়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি ওই সময়টার আকর্ষণ কি আমার কাছে। কালকে একটু বেশি উৎসাহ দেখিয়ে ফেলেছিলাম আমি, সেই জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আর কোনোদিন হবে না। একবার ভেবেছিলাম এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাবো, তারপর ভাবলাম আপনার কাছে আমার মাফ চাওয়া উচিৎ। আপনি অনেকের থেকে আলাদা। তাই আপনাকে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারলাম না। আপনি নিশ্চই ভুল বুঝবেন না। কি বলুন '।
'দেখুন আপনার সাথে আমার সেরকম কিছুই হয়নি। আমরা কেউ কাউকে চিনি না, পরিচয় তো দুর। আমরা কেউ কারো নাম জানি না আর জানার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার বিবাহ ঠিক হয়ে গেছে। আমিও এখন ঠিক কোনোভাবেই প্রস্তুত নই কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার, জড়াতে চাইও না। অতএব যেরকম চলছে সেরকমই চলুক। আমি না হয় উল্টো দিকের ফুটপাথটা দিয়ে হাঁটবো আর আপনিও বিশ্রামের সময়টা একটু আগে পিছে করে নিতে পারেন। আপনি কি বলেন '?
' ঠিক আছে সেটাই না হয় করতে চেষ্টা করবো '।
হাঁটতে হাঁটতে তারা আগের জায়গায় ফিরে এল। দুজনে দুজনকে বিদায় জানাল প্রথম ও শেষবার। আর ছেলেটি জেব্রা ক্রসিং পেরিয়ে এসে তার ভালো লাগার রাস্তাটা যার ধারে ধারে সারি সারি দেবদারু গাছের উপস্থিতি তার পাশ দিয়ে চলতে শুরু করলো।
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.
---------------------
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন