Featured Post
প্রসঙ্গ ভাদুগান : দার্শনিকতার প্রেক্ষিতে // উপানন্দ ধবল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
– উপানন্দ ধবল
ভাদু মূলত লোকদেবী। ভাদুগীত ও নৃত্যকে আশ্রয় করে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার বাউরি, বাগ্দি, মাহাত, কুম্ভকার, মাল, মাহালী, কুড়মী, সাঁওতাল প্রভৃতি প্রান্তিক সম্রদায়ের মানুষেরা ভাদ্র মাসের পয়লা (১ তারিখ) থেকে সংক্রান্তি অর্থাৎ সমগ্র ভাদ্রমাস জুড়ে যে লোকোৎসব পালন করে, তা-ই হল ভাদু-পরব।
ভাদু গানের এলাকা :
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল তথা মানভূম হল ভাদু গান ও উৎসবের প্রধান ক্ষেত্রভূমি। বর্তমানে পুরুলিয়া জেলার কাশীপুর, মানবাজার, হুড়া, বলরামপুর, বান্দোয়ান, পাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ যেমন তালডাংরা, সিমলাপাল, সারেঙ্গা, রায়পুর, মটগোদা, রাণীবাঁধ, খাতড়া প্রভৃতি অঞ্চলে, বর্ধমানের পশ্চিম অংশে, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলা, ঝাড়খণ্ডের সিংভূম, রাঁচী ও হাজারীবাগ জেলার কিছু অংশ ছাড়াও বীরভূম জেলায় ভাদুগান প্রচলিত।
ভাদুগানের উৎস ও নানা কিংবদন্তি :
ভাদুগানের উৎস সম্পর্কে নানা কিংবদন্তি ও মতামত প্রচলিত আছে। এগুলির মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কালকেন্দ্রিক ও ফসলকেন্দ্রিক নামকরণই ব্যাপক প্রচলিত। কারো কারো মতে ভাদোই ফসল থেকে 'ভাদু' নামের উৎপত্তি। এই ভাদোই ফসল হল ভাদোই ধান যা ভাদ্র মাসে উৎপাদিত হয়। আবার আদিবাসী সমাজে প্রচলিত 'করম' উৎসবের রূপান্তর ঘটেছে ভাদুতে। ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য্য এ বিষয়ে লিখেছেন– "পশ্চিমে ছোটনাগপুরের অরণ্যভূমি যখন আদিবাসীর বর্ষা-উৎসবের ‘করম’ সঙ্গীতে মুখরিত হইয়া উঠে, তখন পশ্চিম বাংলার সীমান্তবর্ত্তী অঞ্চলের অধিবাসিনী কুমারীদিগের কণ্ঠনিঃসৃত ভাদুগানের ভিতর দিয়া তাহারই প্রতিধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়৷ পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ মানভূম, পশ্চিম বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্দ্ধমান ও দক্ষিণ বীরভূম এই অঞ্চল ব্যাপিয়া কুমারীদিগের মধ্যে ভাদ্রমাসে যে গীতোৎসব অনুষ্ঠিত হয়; তাহা হিন্দুপ্রভাব-বশতঃ বর্তমানে একটি পূজার আকার ধারণ করিয়াছে—তাহা ভাদুপূজা নামে পরিচিত; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে
ইহা আদিবাসীর ‘করম’-উৎসবেরই একটি হিন্দু সংস্করণ মাত্র। নৃত্য এবং গীতই করম-উৎসবের প্রধান অঙ্গ, ভাদু পূজারও তাহাই; তবে উচ্চ শ্রেণীর
হিন্দুর গৃহে ইহার নৃত্যাংশ স্বভাবতঃই পরিত্যক্ত হইয়াছে। আদিবাসীর করম-উৎসব বর্ষা-উৎসব, ভাদু-উৎসবও বর্ষা-উৎসব ব্যতীত আর কিছুই নহে।
বর্ষা বা ভরা ভাদ্রে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বলিয়৷ ইহার নাম ভাদু-উৎসব, ইহার গান ভাদুগান।"১
আবার কাশীপুর-রাজকন্যা ভদ্রাবতীর নামানুসারে ভাদুর উৎপত্তি বলে নানা কাহিনি প্রচলিত হয়ে আসছে। লোকসংস্কৃতি-গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্যের ভাষায়— "আনুমানিক ১৮১৩ খৃষ্টাব্দে
মানভূম জিলার পঞ্চকোটের রাজধানী কাশীপুরে নীলমণিসিংহ দেবশর্ম্মা নামে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তাঁহার ভদ্রেশ্বরী নামে এক সুন্দরী কন্যা ছিল। ভদ্রেশ্বরী বয়ঃপ্রাপ্তা হইলেন, কিন্তু তাঁহার বিবাহের কোন সম্ভাবনা দেখা গেল না।রাজান্তঃপুরের মধ্যে অধিকাংশ অনূঢ়া রাজকন্যার জীবন যে ভাবে কাটিয়া যায়, তাঁহার জীবনও সেই ভাবেই কাটিতেছিল। এই ভাবেই একদিন ভদ্রেশ্বরী পরলোক গমন করিলেন। প্রাণাধিকা কন্যার অকাল পরলোক-গমনে রাজা নিদারুণ ব্যথিত হইলেন— তিনি তাঁহার রাজ্যমধ্যে প্রচার করিয়া দিলেন যে, রাজকন্যার স্মৃতিরক্ষার জন্য ভাদ্রমাসে পল্লীতে পল্লীতে তাঁহার নামে উৎসব পালন করিতে হইবে। প্রজাগণ সানন্দে আদেশ পালন করিল। তারপর মানভূম হইতে তাহা বাঁকুড়া, বৰ্দ্ধমান, বীরভূম প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তার লাভ করিল। আধুনিক কালে রচিত বহু ভাদুগানের ভিতর দিয়াই এই বিষয়টির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় । কিন্তু সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, বহু পূৰ্ব্ব হইতেই এই উৎসব এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইহার সঙ্গে কাশীপুররাজ ও তাঁহার কন্যার নাম আসিয়া যুক্ত হইয়াছে। কাশীপুর রাজপরিবারের এই বিবরণটি ঐতিহাসিক সত্য।"২
অপর এক কিংবদন্তি থেকে জানা যায় কাশীপুররাজ নীলমনি সিংহের কন্যা ভদ্রাবতী ছিলেন রূপে গুণে অসামান্যা এবং প্রজাদরদী। এখন ভদ্রাবতীর বিবাহ স্থির হলে বিবাহের দিন তার ভাবি স্বামীর অকাল প্রয়াণ ঘটে। এই ঘটনায় ভদ্রাবতী মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন এবং আত্মাহূতি দেন। রাজা নীলমনি সিং কনিষ্ঠা-কন্যা ভদ্রাবতীর সতীত্বের এই অমর-স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ভাদু-পূজা ও ভাদু-গানের প্রচলন করেন।
ভাদু ব্রতের উপকরণ ও পদ্ধতি :
ভাদু কাল্পনিক এবং লৌকিক দেবী, প্রথমদিকে তার নিজস্ব কোন মূর্তি ছিল না। একটি পোড়ামাটির পাত্রে ফুল ও প্রদীপ সাজিয়ে সারা ভাদ্রমাস সন্ধ্যাকালে এর পূজা করা হত। কিন্তু বর্তমানে ভাদুর মূর্তি তৈরি করে তার বন্দনা করা হয়। ভাজু পূজায় কোন মন্ত্রতন্ত্রের বালাই নেই। গানই হল ভাদুর মন্ত্র, এবং কুমারী ও সধবা মেয়েরাই তার প্রধান উপাসক। ভাদ্রের প্রথম দিন বেদী করে পাতা হয় ভাদুর মূর্তি। ভাদুর উপকরণ সামান্যই– ধূপ, প্রদীপ, নানারকম ফুল এবং সমবেত সংগীত শেষে নানা ধরনের মিষ্টান্ন, যেমন; পেঁড়া, জিলাপি, খাজা, লবঙ্গ, গজা, ভাজামিষ্টি, সন্দেশ, মিঠাই, কোথাও চপ, সিঙ্গাড়া ইত্যাদি। আর ভাদ্রসংক্রান্তির পরদিন হয় ভাদুকে জলে বিসর্জন।
ভাদুগানে দার্শনিকতা :
ভাদুগান যেহেতু লোকসাহিত্য, তাই স্বাভাবিকভাবেই এইসব গানে লোকদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত-বাংলা ঘন জঙ্গল অথবা লাল কাঁকুরে মাটির দেশ ভাদুগানের লীলাক্ষেত্র। এখানে কৃষিব্যবস্থা তত উন্নতি নয়। এখানে লোকসমাজে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই গায়ে-গতরে খেটে দু-বেলা দু-মুঠো অন্নসংস্থানের উপায় করে। মাটির কাছাকাছি অবস্থান করাতে এরা ভাদুকে মর্ত্যভূমিরই একজন– নিজেদের ঘরের কন্যা বা মাতা হিসাবেই গ্রহণ করেছে। জগতের সমস্ত ঠাকুরদেবতাকে এক দেবীর মধ্যে খুঁজে পাওয়ার বাসনা থেকেই উক্ত এলাকার নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত মা-বোনেরা ভাদুকে যেন নিজেদের গৃহ-হৃদয়-মন্দিরে স্থান দিয়েছে। তাদের বন্দনাগানে ভাদু তাই ধনদাত্রী, বিদ্যাদাত্রী– সমস্ত দেবীর সারাৎসার। এই লৌকিক দেবী যেন সমস্ত সংগতির মূল। একটি প্রচলিত ভাদুগানে সেই ধর্মীয় দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে–
"সাঁঝ দিলাম সন্ধ্যা দিলাম, স্বর্গে দিলাম বাতি গো।
সব ঠাকুরের সন্ধ্যা লাও মা, লক্ষ্মী সরস্বতী গো।।
সব সঙ্গতি পরাণ-গতি, সন্ধ্যা দাও ভাদুর কাছে।
শঙ্খ বাজাও ঘন্টা বাজাও, ঘরে ভাদু ধন আছে।।"
ভাদু একই আধারে মাতা এবং কন্যা। আর দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত-বাংলার লোকপ্রবাদেও আছে– "বিটি মাটি সমান।" কাশীপুরের রাজার বিটি (মেয়ে) ভদ্রাবতী কোন এক জাতীয়তা মন্ত্রে, না কি যাদুমন্ত্রে এই অঞ্চলে সকলের আদরের কন্যা 'ভাদু' হয়ে উঠল তা এক আশ্চর্য কিংবদন্তি। এ বিষয়ে নিবেদিতা দিন্দা লিখেছেন–
"প্রথমে পূজাটি ছিল রাজবাড়ীর উৎসব। পরে বিভিন্ন গ্রামে এই উৎসবটি ছড়িয়ে পড়ে। উচ্চ বর্ণ থেকে নিম্ন বর্ণের মধ্যেই পূজা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। বিশেষত বাউরি, বাগদি, রাজোয়াড় প্রভৃতি তপশিলি জাতিগুলি ভাদু পূজায় মেতে ওঠে। জীবনের একঘেঁয়েমি, অবসাদ, দুঃখ-বেদনা ভুলে যাওয়ার পথ খুঁজে পায়। কালক্রমে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে ভাদুর আরাধনা বিস্তার লাভ করে।"৩ এই ভাদুর সঙ্গে শাক্ত পদাবলির উমা বিষয়ক গানের সাদৃশ্য অতি সহজেই চোখে পড়ে। হিমালয় কন্যা উমা মাত্র তিনদিনের জন্য বৎসরান্তে মর্ত্যপৃথিবীতে আবির্ভূত হন। তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে মা মেনকার হৃদয়োচ্ছ্বাস ও আকুতি যেন উপচে পড়ে–
"উমা গো যদি দয়া কোরে হিমপুরে এলি,
আয় মা করি কোলে।
বর্ষাবধি হারায়ে তোরে, শোকের পাষাণ বক্ষে ধোরে,
আছি শূন্য ঘরে।
কেবল মরি নাই– মা বেঁচে আছি,
দুর্গা দুর্গা নাম কোরে।।"৪
ভাদ্রের শুরুতে বৎসরান্তে ভাদুর আগমনীতেও তার বন্দনা; ভাদুগানের অন্যতম বিষয় ও সুর–
"একটি বছর পরে
ওলো ভাদু আস্যেছু মোদের ঘরে।
ফুলের আসর ফুলের বাসর গো
ফুলের করি বিছানা।
গানে গানে প্রাণ মাতাব
মন মাতাব অন্তরে।
ফ্যালফ্যালি ব্লু শাড়ি যে গো
গায়ে করে আবরণ।
একটি বছর পরে
ওলো ভাদু আস্যেছু মোদের ঘরে।।"
কিন্তু আবাহনের উল্টোপিঠেই আছে বিসর্জন। আগমনীর আনন্দ ধুয়ে যায় বিষাদের অশ্রুজলে। শাক্ত পদাবলীর উমাসঙ্গীতে যেমন আগমনীর পর বিজয়া, তেমনি ভাদ্র-সংক্রান্তিতে ভাদুর বিদায় দৃশ্যে কেবলই প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা। উমাসঙ্গীত ও ভাদুসঙ্গীত উভয়কেই তাই রসজ্ঞ সমালোচকের ভাষায় বলা যায়– "Drama of welcome and farewell."। আগমন ও বিদায়ের মাঝখানে একটি নিশির বাধা। নিশি ফুরোলে মা মেনকার 'নয়নের মণি' উমা বিদায় নেবেন। তিনদিন ধরে স্বর্ণদীপের ন্যায় দেদীপ্যমান উমা ফিরে যাবেন কৈলাসে, মা মেনকা সে বেদনায় গেয়ে ওঠেন–
"কি হলো, নবমী নিশি হৈলো অবসান গো।
বিশাল ডুমরু ঘন ঘন বাজে, শুনি ধ্বনি বিদরে প্রাণ গো।।
কি কহিব মনোদুঃখ, গৌরী-পানে চেয়ে দেখ–
মায়ের মলিন হয়েছে অতি ও বিধু বয়ান।।"৫
বাংলার জঙ্গলমহল ও রুখা টাঁড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভাদু হল আদরের সন্তান, তথা 'ধন' বা 'মণি'। তাকে বিসর্জনের ভাবানুষঙ্গে বাঙালি রমণীমণে স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায় কন্যা বিদায়-বিচ্ছেদের ভাবনা–
"নিশি শেষ হল ধন
ভাদু মায়ের কর গো তোরা খুব যতন।
কাল সকালে যেতে হলে
মন করে কেমন কেমন।।
আলতা পরিয়ে চুল আঁচড়ে
বাঁধ বেণী করোগো যতন।
নিশি শেষ হল ধন।।
ভাদু মায়ের করো গো তোরা খুব যতন।
নিশি শেষ হল ধন।।"
বাংলার এইসব রুক্ষ-শুষ্ক অনুর্বর প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় নিত্যই অভাব। সেই অভাবের সংসারে সন্তানের অনেক চাহিদাই অভিভাবকেরা পূরণ করতে পারে না। কিন্তু সেই অভাবের স্থান পূরণ করতে তারা আশ্রয় নেয় ভালোবাসা আর আদরের। যত্ন করে সামান্য খাদ্যদ্রব্য দিয়েই তারা ভাদু-কন্যার হৃদয় জুড়িয়ে দিতে চায়–
"ও ভাদু মা, ও ভাদু মা, আমি তোমার মা হব।
আঁচল ভরে মুড়ি দিব বদন ভরে চুমু খাব।।"
ভাদুপূজা ও গানের পশ্চাতে মনস্তাত্ত্বিক দর্শনটিকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। সন্তান ও ফসলের আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষ যে নানা ধরনের ব্রত পালন করে থাকে, তার মূলে রয়েছে সদৃশমূলক যাদু-বিশ্বাস। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় প্রান্তজনের কাছে ভদু হল ষাঁড়া-ষষ্ঠী বা লক্ষ্মীর অনুরূপ দেবী। তাই সন্তান ও ফসলের আকাঙ্ক্ষা থেকে ভাদুগান ও পূজার প্রচলন দেখা যায়। একটি ভাদুগানে তার তাই বলা হয়েছে–
"কোলে যদি আসে ভাদু।
আসছে বছর আনব যাদু।।"
শুধু সন্তান নয়, ভাদু কৃপা করলে, জীবনে আসে সমৃদ্ধি– তাই ভাদুকে আপ্যায়ন ও তার বন্দনা ভাদুগানের প্রচলনের একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক। একটি ভাদুগানে প্রতিফলিত হয়েছে সেই মনস্তাত্ত্বিক দর্শন–
"ভাদুকে আনিতে যাব
চন্দন কাঠের চৌদলে।
যদি ভাদু দয়া কর
রাখব সোনার মন্দিরে।
ভাদু আসছে কত গম্ভীরে
সোনার মন্দিরে।।"
অনুরূপ কামনা থেকে অনুরূপ ফল দেবে– এই সাদৃশ্যমূলক যাদুবিশ্বাস থেকেই ভাদুর কাছে সমৃদ্ধি চাওয়া।
ভাদুগান রচয়িতাদের শিশু-মনস্তত্ত্ব সমালোচকদের মুগ্ধ না করে পারে না। ভাদুগানের ভজনকারীদের নিকট ভাদু তাদের গৃহস্থ সন্তান। তাকে লালন-পালনের মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা, আদর যত্ন, তার খাবার-দাবার পোশাক-আশাক, তার শিক্ষা, খেলাধুলা, প্রেম বিবাহ যাবতীয় বিষয়েই অভিভাভকের সস্নেহ প্রযত্ন ভাদুগানে সম্যক লক্ষিত হয়। ভাদু শুধু কন্যা নয়– রাজকন্যা। তাই তাকে সুন্দরভাবে সজ্জিত করার ক্ষেত্রেও গান রচয়িতাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এমনই একটি গানে পাই–
"ভাদু রাজার বিটি
আলবের্ট কাটে বেঁধেছে মাথার ঝুটি
পাশ চিরুনি প্রজাপতি
বাঁশ পাতায় জুঞ্জি খাড়ি
ভাদু রাজার বিটি।"
ভাদুগান রচয়িতারা প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ের। সেখানে রাস্তাঘাট কাঁচা। জলনিকাশি ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। রাস্তার তুলনায় ঘরগুলি উঁচুতে থাকায় বর্ষার জল কুল্হি তথা রাস্তাতেই বয়ে যায়। ভাদুগানে ঊঠে এসেছে সেই সামাজিক পরিবেশ–
"চল ভাদু চল লাইতে যাব
কুল্হিতে বাঁধ বাঁধাব।
কুল্হির জলে সিনান করে
একমাথা চুল শুকাব।।"
'একমাথা চুল' মানে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঋতুবিশেষের ব্যাধি; যেমন বর্ষাকালে চোখ ওঠা বা 'জয় বাংলা (কনজাংটি ভাইরাস)'র মতো ব্যাধির হাত থেকে বাঁচতে ভাদুকে নতুন জলে স্নান করতে নিষেধ করার কথা পাই একটি ভাদু গানে। এইগানেই আবার ব্যাধির নিরাকরণ রূপে পাই প্রাথমিক লোকচিকিৎসার কথা–
"ভাদু করি গো মানা,
নতুন জলে সাঁতার দিতে যেও না
ভাদু করি গো মানা।।
ঘরে ঘরে চোখ উঠেছে গো
চোখে বড় যন্তনা।
হাতে লইয়া হলদি কানি
তারপরে ডাক্তারখানা।।
ভাদু করি গো মানা,
নতুন জলে সাঁতার দিতে যেও না।
ভাদু করি গো মানা।।"
ভাদুগানে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার লোকায়ত চালচিত্র যে ভাবে ফুটে উঠেছে, তাতে বিভিন্ন সময়ের ভাদুগান রচয়িতাদের সমাজদর্শন-অভিজ্ঞতার সম্যক পরিচয় মেলে। ভাদুগানের এলাকা বরাবরই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে। তখনও দামোদর বাঁধ, কংসাবতী ড্যাম ইত্যাদি জলাধার গড়ে ওঠেনি, বর্ষা ছাড়া চাষবাস এখানে সেভাবে হত না। এলাকার মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য ঝরিয়া, রাণিগঞ্জ আসানশোল দুর্গাপুরের কয়লাখনি অথবা শিল্পাঞ্চলে কাজ করতে যেত সপরিবারে। জীবিকার খোঁজে অজয় দামোদর পেরিয়ে কোলফিল্ড এরিয়ায় কাজ করতে যাওয়ার কথা পাই দক্ষিণ বাঁকুড়ায় প্রচলিত একটি ভাদু গানে–
"উত্তরকুলি গেছিলে ভাদু,
ময়লা পাথর কাটাতে
এত কেনে দেরি হল মা?
অজয়ে বান পড়েছে।
অজয় ভেঙ্গে জয় জয় দিব।
মণ্ডা ভেঙে জল খাব।
এসো আমার প্রাণের ভাদু
কোলে লয়ে পার হব।।"
বালিকা-শিশু থেকে কুমারী এমনকি বিবাহিতা কন্যা, আবার তারই মাতৃমূর্তি– গীতিকাররা নানা বয়সের উপযোগী ভাদুগান রচনা করেছেন। ভাদু বড় হয়, তাকে স্কুলে ভর্তি করার ছবি পাই একটি গানে। নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতির বিজ্ঞাপন হয়ে পড়ে ভাদু–
"বলি ও বকুল ফুল।
আমার ভাদু যাবে গো একবার ইস্কুল
বলি ও বকুল ফুল।।
জামা জোড়া এঁটে দিব গো।(২)
কানেতে হইবে দুল।। (২)
পাড়ায় পাড়ায় আসবে মাস্টার।(২)
পরীক্ষাতে হয় না ভুল।
বলি ও বকুল ফুল।"
ভালোবাসা এবং দারিদ্র্য– দুইয়ের টানাপোড়ন থেকেই আদরের কন্যা ভাদু কখনো হয়ে ওঠে অভিমানী। তার অভিমান ভাঙাতে মিষ্টির থালা হাতে এগিয়ে আসে অভিভাবকেরা–
"আমার ভাদু মান করেছন গো, (২)
উ-পাড়ার বকুল তলে,
আন্ গো থালা, লে গো মিষ্টি
চল্ যাব মান ভাঙাতে (২)
মানের কপাট খুল ভাদু গো (২)
মান ভাঙাতে এসেছি (২)
আমরা মায়ের শিশু ছেলে
মান ভাঙাবার কী জানি?
জোড়া পানের খিলি
এতদিন তুই কার গালে ভরা ছিলি?"
ভাদু বড় হয়ে ওঠে। মানবিক ভাদুর জীবনে আসে প্রেম। কিন্তু প্রেমে কারো ভাগ্যে জুটে সফলতা, কারো ভাগ্যে যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা। কুমারী বয়সে দৈহিক আসঙ্গলিপ্সা যে দুঃখের কারণ হতে পারে, সে বিষয়ে ভাদুগীতিকাররা সচেতন করে,দিয়েছেন। দেহপ্রেমকে শসার সাথে তুলনা করে তাঁরা প্রতীকে- ইঙ্গিতে যৌনমনস্তত্ত্বে সুনিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। একটি গানে পাই–
"শসা তলের ভাদু তুমি শসা যেন খাইঅ না
শিশিরেতে উঠু-ডুবু ঘরকে কেনে আস্য না।।
ভাদু করেছিলাম মানা
ও ভাদুধন প্রেমের শসা খাইঅ না।।
প্রেমের শসা খেলে ভাদু ঘটবে কত লাঞ্ছনা।
ভাদু করেছিলাম মানা
ও ভাদু ধন প্রেমের শসা খাইঅ না।
ভাদু করেছিলাম মানা।।"
সম্বন্ধ করে অভিমান ভাঙিয়ে ভাদুর বিয়ে দিতে হয়। ট্রেনে-মোটরে অনেক দূর থেকে হয়তো বর আসবে। এতোদূরে শ্বশুরঘর, স্বাভাবিকভাবেই ভাদুমণির অভিমান হয়। এমনই এক অভিমান-ভাঙানো গান–
"রেলে ট্রেনে বর আসছ্যে
রাজার ট্যাস্কি মোটরে
গুরুগুরু শব্দে নামবে এসে
বর্ধমানের শহরে।
ভাদু করগো বিয়ে।
মান কেন কপাট দিয়ে
ভাদু করগো বিয়ে।।"
এরপর ভাদুর শ্বশুরবাড়ি যাবার উদ্যাপন-পালা। ঢাঁক বাজিয়ে নতুন শাড়িতে তাকে বিদায় জানাতে হবে–
"ভাদুর যাবার বেলা
কিনে দেব লৈতন ছাঁচের আকবালা।
ভাদুর ঢাকে দে ভাই খাড়ি।
আমার ভাদু যাচ্ছেরে শ্বশুর বাড়ি।
ভাদুর ঢাকে দে ভাই খাড়ি।।"
বিয়ে দেবার পরও ভাদুধনকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। যে-কালে কুলীন সমাজে বহুবিবাহ প্রথার চল ছিল, সেকালে তার আঁচ সমাজের সর্বস্তরেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ভাদুর জীবনেও তাই স্বাভাবিকভাবেই আসে সতীন-সমস্যা। সতীন-কাঁটা থেকে সাবধান করতে তাই গাওয়া হয়–
"উপর পাড়ায় যেও ভাদু
নামঅ পাড়ায় এস না।
নামঅ পাড়ায় সতীন আছে
পান দিলে পান খেও না।"
কালক্রমে সংসারের নতুন বৌমা থেকে মা হয়ে ওঠে ভাদু। গীত রচয়িতারা মাতৃত্বের (বিশেষত ব্যাটাছেলের মায়ের) সম্মান দাবী রেখে গান গায়–
"পুরুলার একটি বেগুন
বউকে রাঁধতে দিও না।
বউ হয়েছে বেটার মা
বউকে কিছু বল না।"
এইভাবে ভাদু দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত-বাংলায় হয়ে ওঠে ঘরেরই একজন। যার সুখে আনন্দিত আর দুঃখে ব্যথিত হন গীতিকারেরা। সারা ভাদ্রমাস জুড়ে যে মাটির ভাদুকে কন্যাজ্ঞানে বন্দনা করা হয়, পয়লা আশ্বিনের সকালে যখন তাকে বিদায় দেওয়া হয়, মনে করা হয়, সে যেন শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে– ফিরে আসবে একটি বছর পরে। ভাদুর বিদায়ের মধ্যেই যেন আছে আবাহনের ইঙ্গিত। সমবেতকণ্ঠে ভাদুর ব্রতীরা তাই গেয়ে ওঠেন–
"ভাদু যাই বলো না,
যাই বলিলে আমরা প্রাণে বাঁচবো না
ভাদু যাই বলো না
জলে হেলা জলে খেলা গো।
জলে তোমার কে আছে?
আপন মনে বুঝিয়ে দেখ,
জলে তোমার কে আছে?
আপন মনে বুঝিয়ে দেখ,
জলে শ্বশুর ঘর আছে।।"
==============================
তথ্যসূত্র :
১। ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য, 'বাংলার লোকসাহিত্য', পরিবর্ধিত ২য় সং, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলিকাতা, ১৯৫৭, পৃ. ১৮১
২। প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১-১৮২
৩। নিবেদিতা দিন্দা, 'তপশিলি জাতির চালচিত্রে ভাদু', কার্তিককুমার মণ্ডল (সম্পা) লোকসংস্কৃতির দর্পণে পুরুলিয়া, সংবেদন, মালদা, ২০১৮, পৃ-১০৪
৪। উদয়চাঁদ বৈরাগী, আগমনী (গান), অমরেন্দ্রনাথ রায় (সম্পা) 'শাক্ত পদাবলী' ১২শ সং, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা, ২০১০, পৃ. ২৭
৫। কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য, বিজয়া (গান), অমরেন্দ্রনাথ রায় (সম্পা) 'শাক্ত পদাবলী' ১২শ সং, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা, ২০১০, পৃ. ৪৪
(লেখাটি পূর্ব প্রকাশিত)
প্রাবন্ধিক উপানন্দ ধবল : গবেষক, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষক, পি আর এম এস মহাবিদ্যালয়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন